উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মাছরাঙ্গার স্কুল

মাছরাঙ্গার স্কুল

 আমার তাঁবুর কাছে একটি ছোট নদী ছিল। ঐ নদীতে অনেক ছোট ছোট মাছ থাকিত। একদিন সকালে আমি নদীর ধারে গাছের নীচে বসিয়া আছি, এমন সময়ে একটি মাছরাঙ্গা উড়িয়া আসিয়া নদীর অন্য পারের মাটির ভিতর কোথায় ঢুকিয়া গেল। সেখানে মাটির নীচে একটা গাছের শিকড়ের আড়ালে লুকান, তাহার বাসা। আমি অনেক দিন মাছ ধরিয়াছি, চারিদিকে অনেক মাছরাঙ্গাও দেখিয়াছি, কিন্তু এতদিন তাহার বাসাটি দেখিতে পাই নাই। আমি যখনি যাইতাম, মাছরাঙ্গাগুলি খুব গোলমাল করিয়া নদীর উপরে উড়িয়া বেড়াইত, বোধহয়, তাহার আমাকে বুঝাইতে চাহিত, যে তাহাদের বাসা উপরের দিকে কোথাও হইবে।

 ইহার পর হইতে মাছ ধরিবার সময়ে আমি ঐ বাসাটাকে খুব লক্ষ্য করিয়া দেখিতাম এবং এইরকমে মাছরাঙ্গাদের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য নুতন বিষয় জানিয়াছিলাম। এক মাছরাঙ্গা কখনো অপরের জলে মাছ ধরিতে যায় না, আর অপরকেও নিজের জলে আসতে দেয় না। পরিষ্কারই হউক, আর ময়লাই হউক, নদীর কোনখানে বেশি মাছ আর কোনখানে কম মাছ, তাহা তাহারা সকল সময়েই বুঝিতে পারে, আর ঢেউ-এর অনেক নীচ দিয়া মাছ দৌড়িয়া গেলেও তাহারা ধরিতে পারে।

 এতদিনে আমার চেনা মাছরাঙ্গার ছানাগুলি একটু বড় হইয়াছে। একদিন সকালে একটা ঝোপের আড়ালে বসিয়া মাছরাঙ্গার গর্ত দেখিতেছি, এমন সময়ে ছানাদের মা তাহার ভিতর হইতে উঁকি মারিয়া চারিদিকে তাকাইতে লাগিল। নদীর ধারে একটা জলো সাপ শুইয়াছিল, মাছরাঙ্গী এক লাফে তাহার উপর গিয়া পড়িল, সে তো ভয়ে দৌড়। কিছুদূরে অল্প জলে কতকগুলি হাঁসের ছানা কোলাহলপূর্বক খেলা করিতেছে, তাহার ভালোমানুষ কাহকেও কিছু বলে না, তবুও মাছরাঙ্গী ছুটিয়া গিয়া বকিয়া ধমকিয়া তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিল। পথের মাঝখানে এক বেচারী ব্যাঙ বোদ পোহাইতেছে, তাহারও ঘাড়ে পড়িয়া মাছরাঙ্গী তাহাকে না তাড়াইয়া ছড়িল না। তখন সে আবার চারিদিক দেখিয়া, আর যদি কেহ লুকাইয়া থাকে, তাহকে ভয় দেখাইবার জন্য খুব জোরে একবার শব্দ করিয়া দৌড়িয়া গর্তে ঢুকিল।

 খানিক পরে দেখি, একটা ছোট মাছরাঙ্গা গর্তের ভিতর হইতে মাথা বাহির করিয়াছে। বাহিরের জগতের সহিত তাহার এই প্রথম পরিচয়। তাহার চারিদিক দেখা শেষ হইতে না হইতেই কে যেন পিছন হইতে তাহাকে এক ঠেলা দিল। সেও অমনি আর কিছু না বলিয়া উড়িয়া নদীর অন্যপারে একটা মরা গাছের ডালে গিয়া বসিল। তাহার পর আর একটি তাহার পর আরো একটি ঠিক ঐরকম করিয়া বাহির হইল, যেন প্রত্যেককে কি করিতে হইবে, কোথায় যাইতে হইবে, তাহা আগে হইতেই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ক্রমে ক্রমে সবগুলি ছানা সার দিয়া বসিল, তাহাদের নীচে পরিষ্কার জল, উপরে নীল আকাশ, আর চারিদিকে গাছপালা।

 এই তাহাদের হাতেখড়ি এবং ইহার জন্য পুরস্কারের অভাব ছিল না। তাহাদের বাবা ভোর হইতে ছোট মাছ ধরিয়া এক জায়গায় জড়ো করিয়াছে। সেই মাছ এখন তাহাদিগকে খাইতে দিয়া সে তাহার নিজের ভাষায় তাহাদিগকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল যে, এতদিন তাহারা যে অন্ধকার গর্তে ছিল, এই পৃথিবী সেরকম নয়। এখানে ভালো-ভালো খাবার জিনিস অনেক পাওয়া যায় সুখও খুব আছে।

 ছোট-ছোট মাছরাঙ্গাগুলির এখন মাছ ধরিতে শিক্ষা চাই। একটা নিরিবিলি জায়গায় তাহাদের স্কুল বসিল। এখানে খুব কম জল আর জলের নীচে কাদার উপরে মাছ স্পষ্ট দেখা যায়। জলের উপর একটা গাছের ডাল ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, বড় মাছরাঙ্গা দুইটা অনেকগুলি ছোট-ছোট মাছ মারিয়া ঐ ডালের নীচে জলে ছড়াইয়া রাখিল। তাহার পর ছানাগুলিকে আনিয়া ডালের উপর বসাইয়া, নিজেরা এক-একবার ডুব দিয়া দেখাইয়া দেয়, আর তাহাদিগকেও সঙ্গে সঙ্গে ডুব দিতে বলে। ছোট মাছরাঙ্গাদের ক্ষুধা পাইয়াছিল কাজেই মরা মাছগুলি ধরিতে তাহাদের উৎসাহের কোনরূপ ক্রটি হইল না। যাহারা একটু ভীতু, প্রথমে। জলে নামিতে ভরসা পায় নাই, লোভে পড়িয়া শেষে তাহাদেরও সাহস হইল।

 ইহার কিছুদিন পরে একদিন নদীর ধারে বেড়াইতে বেড়াইতে আমি একটা ছোট জলা জায়গা দেখিতে পাইলাম। ঐ জলের সঙ্গে নদীর কোনে যোগ নাই। জলের মধ্যে কতকগুলি মাছ যেন হঠাৎ কোনো অচেনা জায়গায় আসিয়া পড়িয়াছে, এইভাবে ছুটাছুটি করিতেছে। আমি ভাবিতে লাগিলাম, মাছগুলি কি করিয়া নদী ও ঐ জলের মাঝখানের জায়গাটুকু পার হইল। এমন সময়ে দেখি যে, একটি মাছরাঙ্গা মাছ মুখে করিয়া উড়িয়া আসিতে আসিতে আমাকে দেখিয়াই ঘুরিয়া অন্য দিকে চলিয়া গেল। তখন মনে করিলাম, বুঝি ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য আরো কোন অদ্ভুত উপায় বাহির হইয়াছে। এই ভাবিয়া ঝোপের আড়ালে লুকাইলাম। ঘণ্টাখানেক পরে মাছরাঙ্গাটি চুপিচুপি আসিয়া একবার সাবধানে সকল দিক দেখিয়া, আবার ডাকিতে ডাকিতে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে তাহার সমস্ত পরিবার লইয়া সেই জলার ধারে উপস্থিত। মাছ ধরা আরম্ভ হইল। ছানাগুলি তাহাদের মা-বাপকে ডুব দিতে দেখিয়া আর তাহাদের ধরা মাছের আস্বাদন পাইয়া নিজেরাও ডুব দিতে লাগিল। প্রথমবার কিছুই ধরিতে পারিল না। তাহাদিগকে উৎসাহ দিবার জন্য বড় মাছরাঙ্গারা কয়েকটা আহত মাছও অন্যান্য মাছের সঙ্গে জলে ফেলিয়া দিয়াছিল, তাহারা বেশি ছুটিতে পারে না, কাজেই তাহাদিগকে ধরা সহজ। ছোট মাছরাঙ্গারা প্রথমে সেইসব মাছ ধরিল। দু-একটা ধরিয়াই তাহারা যেন মাছ ধরিবার সন্ধান বুঝিয়া ফেলিল। তাহার পর ঠোট নীচের দিকে

ও লেজ উপরের দিকে করিয়া টুপ্‌ করিয়া জলে পড়ে, আর মাছ ধরে।

 নদীতে খুব স্রোত, সেখানে মাছ ধরা শক্ত, আর যেখানে কম জল, সেখানে মাছও কম। সেইজন্য মাছরাঙ্গা বুদ্ধি করিয়া এই জলটুকু বাহির করিয়াছে, আর নিজে মাছ আনিয়া তাহাতে ছাড়িয়াছে। প্রথম শিখিবার সময়ে মরা মাছ ছিল, কিন্তু এবারের মাছ জীয়ন্ত। তাহাদের নদীতে পলাইবার পথ নাই, চারিদিক বন্ধ। কাজেই বাচ্চাদের মাছ ধরিবার সুবিধা, কারণ যত ইচ্ছা সময় লইতে পারে।

 ইহার পর আবার যখন এই মাছরাঙ্গা পরিবারের সহিত আমার দেখা হইল, তখন তাহারা সকলেই খুব মাছ ধরিতে শিখিয়াছে। এখন আর আহত করা কিম্বা কয়েদ করা মাছের দরকার হয় না। তাহারা সকলেই খেলা করিয়া বেড়াইতেছে। একদিন তাহাদের এক চমৎকার খেলা দেখিলাম। আমি আগে আর কখনো মাছরাঙ্গার খেলা দেখি নাই।

 জলের উপর তিনটা ডালে তিনটি মাছরাঙ্গা বসিয়াছে। হঠাৎ ঠিক একসঙ্গে ঠোঁট নীচু করিয়া তিনজনেই ডুব দিল, আর তখনই উঠিয়া নিজের নিজের জায়গায় গিয়া বসিল। প্রত্যেকের মুখে এক-একটি মাছ। সেই মাছ গিলিবার জন্য তাহারা বেজায় ব্যস্ত হইয়া পড়িল, কাহারো বিষম খাইবার জোগাড়! এই খেলার উদ্দেশ্য, কে আগে ডুব দিয়া মাছ আনিয়া গিলিতে পারে। যে একবারে মাছ পায় না সে বেচারী মুখ ভার করিয়া নিজের ডালে গিয়া বসে। খেলা শেষ হইলে সকলে মিলিয়া নাচে, আর তাহাদের নিজের ভাষায় গান করে। ইহাদের জীবনের কাজই কেবল খাওয়া আর আনন্দ করা।