উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/জার্মানের কুকুর

জার্মানের কুকুর

 আজকালকার ভীষণ গোলাগুলির সামনে খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা বড়ই কঠিন কাজ। আজকালকার সৈন্যেরা প্রায়ই গর্তের ভিতর থেকে যুদ্ধ করে। একদল ফরাসী সৈন্য তাদের গর্তে বসে আছে, জার্মানরা দল বেঁধে তাদের মারতে আসছে। আর-একদল ফরাসী সৈন্য একটা বনের ভিতরে থেকে ‘লাখমারী’ বন্দুক দিয়ে সেই জার্মানগুলোকে তাড়াচ্ছে।

 'লাখমারী’ বন্দুক দিয়ে ভয়ানক তাড়াতাড়ি গুলি ছোঁড়া যায়। এসব বন্দুকের ইংরাজী নাম হচ্ছে “Mitrailleuse”। এর কোনো বাংলা নাম নাই; কিন্তু লাখমারী বললে বোধহয় তোমরা সকলেই বুঝতে পারবে।

 যা বলছিলাম। জার্মানরা লাখমারীর গুলিতে জ্বালাতন হয়ে ভাবল যে ওগুলোকে ঐ বন থেকে দূর করতে না পারলে চলছে না। তাই দুপুর রাতে ভয়ানক অন্ধকারের মধ্যে তাদের দু দল সৈন্য সঙ্গিন বাগিয়ে সেই বনের দিকে রওনা হল। তারা খুবই চুপি চুপি যাচ্ছিল, কিন্তু ফরাসীরা তবু তাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে তাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। জার্মানরা ভেবেছিল যে, কাছে এসেই ফরাসীদের উপরে ভয়ংকর আলো ফেলবে। তা হলেই তাদের মারতে খুব সুবিধা হবে। কিন্তু সেই ভয়ংকর আলো যখন দপ্‌ করে জ্বলে উঠল, তখন তা পড়ল জার্মানদের মুখের উপরে, আর ফরাসীরা মনের সাধ মিটিয়ে গুলি করে তিন মিনিটের মধ্যে সেগুলোকে মেরে শেষ করে দিল। সকালে দেখা গেল যে দুশো আশি জন জার্মান সেখানে মরে পড়ে আছে।

 সেই জার্মানদের একজনের একটি কুকুর ছিল। সে তার প্রভুকে এতই ভালবাসতো যে এমন ভীষণ সময়েও তার কাছছাড়া হয় নি। জার্মানটি কপালে গুলি খেয়ে চিৎ হয়ে মরে পড়ে আছে, কুকুরটি গুলিতে খোঁড়া হয়েও, অতিকষ্টে তিনপায়ে দাঁড়িয়ে প্রভুর কপালের সেই গুলির দাগটা চাটছে, আর করুণ স্বরে তার মনের দুঃখ জানাচ্ছে।

 একটি ফরাসী কাপ্তানের তাকে দেখে বড়ই মায়া হল, কিন্তু তিনি অনেক মিষ্ট কথা বলেও তাকে ভুলাতে পারলেন না। তাঁর সেই-সব মিষ্ট কথার উত্তরে সে ভালো করে একবার তাঁর দিকে তাকালও না, বরং অতি গম্ভীর স্বরে তাকে শাসিয়ে দিল। শেষে তিনি তাঁর লোকদের বললেন, জার্মানটিকে গোর দাও।” প্রভুকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাবে, এ কথা কুকুরটির প্রাণে কিছুতেই সহ্য হল না। যতক্ষণ তার সাধ্য ছিল, ততক্ষণ কারও ক্ষমতা হল না যে তার প্রভুর কাছে যায়। তারপর যখন দূর থেকে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে, মুখে মুখোস পরিয়ে দেওয়া হল, তখন আর বেচারা কি করবে? সে বাধ্য হয়ে তখন নিতান্ত দুঃখের সহিত সকলের সঙ্গে তার প্রভুর সমাধি কার্য দেখতে চলল।

 গোর দেওয়া শেষ হয়ে গেলে সেই জার্মানটির টুপি আর তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই রইল না। ফরাসী কাপ্তান সেই তলোয়ার আর টুপি শুকিয়ে কুকুরটিকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন কুকুরটিও তার প্রভুর এই শেষ চিহ্নদুটিকে চিনতে পেরে তাদের মায়ায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাঁর সঙ্গে চলল। মুখোস তখনো তার মুখে রয়েছে, সেটা খুলতে সাহস হচ্ছে না।

 কাপ্তান এই ভাবে কুকুরটিকে তাঁর শোবার জায়গায় নিয়ে একটা বিছানা,—অর্থাৎ কতগুলো খড় একটা কাঠের বাক্সে রেখে দেওয়া হয়েছে, তাই তাঁদের বিছানা, তারই উপরে শুইয়ে দিলেন। সেই জার্মানটির টুপি আর তলোয়ারখানিও তার পাশে রেখে দেওয়া হল, যদি তাতে তার মন একটু ঠাণ্ডা থাকে।

 এ-সব দেখেশুনে কুকুরের মনও যেন একটু গলল। কাপ্তান তাকে আদর করতে গেলে এখন আর সে গর্‌গর্‌ করে না। শেষে একবার একটু লেজ-ও নাড়ল। তখন কাপ্তান বুঝলেন যে আর তার মনে রাগ নাই। রাগ থাকলে কুকুর কখনো লেজ নাড়েনা, সেটি হচ্ছে তাদের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা। সেই কৃতজ্ঞতার আরো প্রমাণ এই পাওয়া গেল যে, সে এখন মুখ তুলে তাঁর মুখের পানে মেহের সহিত তাকায়। আমনি তার মুখোস খুলে দিয়ে তাকে একটু জল খেতে দেওয়া হোল। তারপর ডাক্তার এসে তার ভাঙ্গা পায়ে ওষুধ লাগিয়ে কাঠ দিয়ে বেঁধে দিলেন। সে সেই বাঁধনশুদ্ধই লাফিয়ে উঠে তার নতুন বাসস্থানটির এদিক সেদিক ঘুরে দেখে নিল। তারপর যখন তার জন্য বাটি ভরা সুরুয়া আর খাবার এসে

উপস্থিত হল, তখন তো আর তার আনন্দের সীমাই রইল না। সেই সুরুয়া খাওয়া হলে কাপ্তান যেই বললেন, “এখন শোও গিয়ে”, অমনি নিতান্ত লক্ষ্মীটির মতো সে তার সেই খড়ের বিছানায় উঠে শুয়ে রইল।

 এতদিনে সেই কাপ্তানটির সঙ্গে তার খুবই বন্ধুত্ব হয়েছে। এখন আর তাঁকে ছেড়ে সে এক মুহূর্তও থাকতে রাজি হয় না, খানার সময়ই হোক, আর যুদ্ধের সময়ই হোক, ছায়ার মতো তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আছেই।