উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/জানোয়ার ডাক্তার
জানোয়ার ডাক্তার
একজন লোক শিকার করতে গিয়েছিল, বনের ভিতরেই তার রাত হয়ে গেল। তখন সে আর বাড়ি ফিরবার পথ না পেয়ে, একটা গাছে উঠে বসে রইল। খানিক বাদে সেখানে একটা প্রকাণ্ড সাপ এসে একটা হাতিকে ধরে গিলে ফেলল। হাতি খেয়ে তার পেট এমন ভারি হল যে আর সে ভালো করে চলতেই পারে না। তখন সে অনেক কষ্টে একটা গাছের কাছে গিয়ে তার একটুখানি ছাল খুঁটে খেল, আর অমনি দেখা গেল যে, হাতিটাতি সব হজম হয়ে তার পেট আবার কমে গিয়েছে।
পরদিন সকালে শিকারী গাছ থেকে নেমেই সেই গাছের খানিকটা ছাল চেঁছে নিল। তারপর বাড়ি ফিরে চাকরকে বলল। “একটা পাঁঠা কিনে আন!” রাত্রে সেই পাঁঠা রেঁধে, তার সবটাই সে একলা খেয়ে, তারপর সেই গাছের ছাল একটু খেয়ে শুয়ে রইল। পরদিন সকালে চাকর এসে দেখে যে শিকারীর হাড়, মাংস, নাড়িভুড়ি সব হজম হয়ে গেছে, খালি চামড়াখানি আর চুলগুলি পড়ে আছে।
এক গৃহস্থের ছেলেকে সাপে কামড়েছিল। গৃহস্থের একটি পোষা নেউল সেই সাপটকে মেরে ওষুধ আনতে চলে গেল। গৃহস্থ তখন বাড়ি ছিল না, সে বাড়ি ফিরে দেখল তার ছেলেটি মরে রয়েছে, নেউলটি কোথায় পালিয়ে গেছে। তা দেখে সে ভাবল যে নিশ্চয়ই নেউলেরই এই কাজ, নইলে সে পালাবে কেন? এমন সময় সেই নেউলটি ওষুধ নিয়ে ফিরে এল, কিন্তু গৃহস্থ সে কথা বুঝতে না পেরে লাঠি দিয়ে তাকে মেরে ফেলল। তারপর সে দেখল যে নেউলের মুখে একখানা কিসের শিকড়। ছেলের বিছানার কাছে যে একটা সাপ মরে আছে তাও তখন তার চোখে পড়ল। তখন সে মাথায় হাত দিয়ে ভাবল, ‘হায় হায়! কি করলাম? আমার ছেলেকে বোধহয় সাপেই কামড়িয়েছে, নেউল তাকে বাঁচাবার জন্য ঐ ওষুধ নিয়ে এসেছে!’ সত্যি সত্যিই, সেই শিকড়টুকু বেটে ছেলেটির মুখে দিতে মাত্র সে উঠে বসল।
এ-সব গল্প। রূপকথার ভিতরে অনেক জন্তুর ওষুধ জানার কথা শুনতে পাওয়া যায়। সাপ, শুকপাখি, কোলাব্যাঙ, এরা সকলেই সময় বিশেষে ডাক্তার হয়ে বসে। বেজী যে সাপের ওষুধ জানে, এ কথা আজও অনেকে বিশ্বাস করে।
কুকুরের পেট ভার হলে নাকি সে ঘাস চিবিয়ে খায়। আমি কুকুরকে ঘাস খেতে দেখেছি কিন্তু তখন তার পেট ভার হয়েছিল কিনা, আর ঘাস খেয়ে সে বেরাম সারল কিনা, এ কথা জিজ্ঞাসা করতে আমার মনে ছিল না।
যাহক, কুকুরের ডাক্তারির বিষয়ে এর চেয়ে ঢের বেশি ভালো প্রমাণ আছে। কাউণ্ট্ ম্যাটি অতি প্রসিদ্ধ লোক, তিনি অনেক ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। তাঁর একটা পুস্তকে আমি পড়েছি যে তিনি একটা কুকুরের কাছ থেকে একটা ভালে ওষুধের সন্ধান পান। কুকুরটার গায় ঘা ছিল; সে রোজ গিয়ে একটা গাছের পাতা চিবিয়ে খেত। তারপর সাহেব পরীক্ষা করে দেখলেন যে সেই গাছের পাতা ঘায়ের খুব ভালো ওষুধ।
আর একবার কোনো ইংরাজি কাগজে আমি একটা প্রকাণ্ড মাকড়সা আর একটা কোলাব্যাঙের যুদ্ধের কথা পড়েছিলাম। মাকড়সাটা অতি ভয়ানক ছিল; সে-সব মাকড়সায় পাখি ধরে খায়। এক সাহেব একদিন দেখলেন যে, একটা কোলা ব্যাঙের সঙ্গে সেটার যুদ্ধ লেগেছে। মাকড়সাটার ভয়ানক বিষ, কিন্তু ব্যাঙ তার কামড়কে গ্রাহ্য করছে না। সে খালি যুদ্ধ করতে করতে এক-একবার গিয়ে একটা গাছের পাতা খেয়ে আসছে। এমনি করে সে মাকড়সার কয়েকটা পা ছিড়ে দিল। তখন সাহেবের হঠাৎ মন হল যে ঐ গাছের পাতা খেয়ে বোধহয় ব্যাঙটা বিষের জ্বালা দূর করে। এ কথার পরীক্ষা করবার জন্য সাহেব সেই গাছটা ছিড়ে ফেলে দেখতে লাগলেন এরপর ব্যাঙটা কি করে। ব্যাঙটা যুদ্ধ করতে করতে আবার ছুটে এসে যখন দেখল, সে গাছটা নাই, তখন বেচারা বিষের জ্বালায় অস্থির হয়ে অবশের মতো পড়ে রইল;আর তার যুদ্ধ করার শক্তি নাই।
এতে জানোয়ারদের ওষুধ জানার কথা প্রমাণ হয় কিনা, সে কথা ভেবে আমাদের দরকার নাই; কিন্তু অনেক জানোয়ার যে ওষুধের মর্ম বোঝে, এর পরিচয় তাদের কাজেই পাওয়া যায়। একবার একটা কুকুরের পা ভেঙ্গে যায়, এক ডাক্তার তাতে পটি বেঁধে ওষুধ লাগিয়ে সারিয়ে দেন। তারপর একদিন ডাক্তার দেখলেন যে সেই কুকুর আরেকটা কুকুরকে নিয়ে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে, সেটারও একটা পা ভাঙ্গা।
একটি ভদ্রলোক আমাকে একটা বানরের গল্প বলেছিলেন, সে একটা হাসপাতালের কাছে থাকত। হাসপাতালের রোজ ডাক্তার আসেন, রোগীরা গিয়ে তাঁকে হাত দেখায়, বানরটা তার সবই দেখে নিয়েছে। তারপর একদিন আর রোগীর সঙ্গে সেও গিয়ে ডাক্তারবাবুর সামনে তার হাতখানি বাড়িয়ে দিল। ডাক্তারবাবু দেখলেন, সত্যি সত্যি তার অসুখ হয়েছে!
আর-এক ডাক্তার সাহেবের পোষা বানরের গল্প পড়েছিলাম, সে রোজ দেখত সাহেব একটা টেবিলের উপরে মড়া রেখে অস্ত্র দিয়ে কাটেন তারপর আরেকদিন সাহেব সেই টেবিলের কাছে আসতেই বানরটা তাকে তার উপর চিৎ করে ফেলে চেপে ধরল। সে এমনি বেজায় ষণ্ডা বানর যে সাহেব কিছুতেই হাত ছাড়িয়ে টেবিল থেকে উঠতে পারলেন না। টেবিলের কাছেই সাহেবের অস্ত্রের ব্যাগ; বানরটা ক্রমাগতই হাত বাড়িয়ে সেইটে আনবার চেষ্টা করছে, কিন্তু অল্পের জন্য নাগাল পাচ্ছে না। বেগতিক দেখে সাহেব চ্যাঁচাতে লাগলেন, আর তা শুনে লোকজন ছুটে এসে তাঁকে বাঁচাল, নইলে সেদিন বানর দেখে নিত, তাঁর পেটের ভিতর কি আছে!
কুকুর যে তার ঘা চাটে সেও একরকম ডাক্তারি বলতে হবে। আমাদের কুকুর ছানাটার কানে ঘা হয়েছিল; তার মা রোজ বসে সেই ঘা চাটত। অবশ্য আমরাও ওষুধ দিতাম। তাতেই ঘা সারল, না, চাটাতে সারল, সে কথা বলতে পারি না।
বাঘের ঘা হলে নাকি সে নানান জিনিস দিয়ে তার ভিতর গুঁজতে থাকে, আর তাই নাকি তার ঘাও সারে না। এটা ডাক্তারির সামিল কিনা, সে কথা বলা একটু শক্ত। আর কাচপোকা যে হুল ফুটিয়ে আরশুলাকে অবশ করে, তাকেও ডাক্তারি না বলে বরং ডাকাতি বলাই ভালো।