উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/হাতি

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।



হাতি

 আমাদের দুটো করে হাত আছে, বানরের আছে চারটি। কিন্তু আমাদের কেউ হাতি বলে না, হাতি বলে, যার একটাও হাত নেই, তাকে। আমার অনেকগুলো দাঁত পড়ে গেছে, তবু যা আছে, হাতির ততগুলি নাই। কিন্তু আমি দন্তী হতে পারলাম না, দন্তী হল হাতি।

 হাতি যা দিয়ে হাতের কাজ করে, সে হচ্ছে তার নাক। সেটি যে কি আশ্চর্য জিনিস, তা তোমরা সকলেই জান। তাকে যদি হাত বলতে রাজি হও, তবে এ কথাও মানতে হবে যে, এমন আশ্চর্য হাত আর জগতে নাই। আর হাতির দাঁতের কথা ভেবে দেখ, সে জিনিসটিও কম আশ্চর্য নয়। এই আশ্চর্যের খাতিরেই বোধহয় ঐদুটি নাম দেওয়া হয়ে থাকবে।

 এখন আমরা হাতির ঘাড়ে চেপে বেড়াই, কিন্তু আমাদের উচিত তাকে মান্য করে চলা, কেননা, এককালে সেই পৃথিবীর রাজা ছিল। তখন মানুষের জন্ম হয়নি, আর কুমিরের বাদশাই চলে গেছে। সেই সময়ে ছোট-বড় শত শত রকমের হাতি মনের আনন্দে এই পৃথিবীময় চরে বেড়াত। এখন আমরা মোটে দুরকমের হাতি দেখতে পাই, আমাদের দেশের হাতি, আর আফ্রিকার হাতি। কিন্তু সেকালে নানারকমের হাতি ছিল। কোনটার চার দাঁত, কোনোটার দুই দাঁত কোনোটার দাঁত উপরের চোয়ালে, কোনোটার দাঁত নিচের চোয়ালে; কোনোটার শুঁড় লম্বা, কোনোটার শুড় ছোট; কোনোটার রোঁয়া নেই, কোনোটা রোঁয়ায় ভরা; কোনোটার বাড়ি গরমের দেশে।

 আমাদের দেশে একরকম পুরনো হাতির হাড় পাওয়া গিয়াছে, তার একেকটা দাঁত প্রায় চৌদ্দ ফুট লম্বা ছিল। কলিকাতার জাদুঘরে গেলে এই হাতির হাড় দেখতে পাওয়া যায়। সে যে কতকালের পুরনো হাড়, সে কথা আর এখন ঠিক করে বলবার উপায় নাই। সে হাড় এখন পাথর হয়ে গেছে। পণ্ডিতেরা এ-সব হাড় পরীক্ষা করে দেখেছেন, সেগুলো ঠিক আজকালকার হাতির হাড়ের মতো নয়; সুতরাং এই হাতিগুলো ছিল একটু ভিন্ন রকমের। তাই ওদের একটা নুতন নাম দেওয়া হয়েছে—‘স্টেগোডন্‌ গণেশ’!

 আরেকটা হাতির নাম হয়েছে ডাইনোর্থীরিয়ম্। ইউরোপে এর অনেক হাড় পাওয়া গেছে;আমাদের দেশেও নাকি কিছু কিছু পাওয়া গেছে শুনেছি। এর দাঁত দুটি ছিল নীচের চোয়ালে;একটু বেঁটে গোছের আর নীচের দিকে বাঁকানো। আর একটার ছিল চারটে দাঁত; দুটো উপরে, দুটো নীচে। পণ্ডিতেরা একে বলেন ‘ম্যাস্টোডন’।

 সাইবিরিয়ার বরফের ভিতরে আরেক রকম হাতি পাওয়া গিয়াছে তার নাম হয়েছে ‘ম্যামথ্‌’। এর কিনা বরফের উপরে চলাফেরা করতে হত, কাজেই তার গায় মুনিদের দাড়ির মত লম্বা লম্বা রোঁয়া ছিল। মাঝে মাঝে এ সকল হাতির আস্ত শরীর পাওয়া যায়, তাতে এখনো মাংস চামড়া আর লোম রয়েছে:বরফের মধ্যে থাকায় কিছু পচতে পায় নি। পুরানো হাতির মধ্যে এগুলোই হচ্ছে সকলের চেয়ে নুতন। মানুষের জন্মের পরেও এরা বেঁচে ছিল। আমার বোধহয় ম্যাস্টোডনও ছিল। সাবেক মানুষের হাতের আঁকা এদের ছবি পাওয়া


আমি বড় বড় মূলোরমত দাঁতগুলোর কথাই বলছি। এছাড়া অবশ্য হাতির কসে আরও দাঁত আছে।

গিয়াছে।

 হাতি ভারি হুঁশিয়ার জন্তু। সে জানে যে তার দেহখানি অনেক মণ ভারি, নরম জমিতে তার পা বসে যেতে পারে। তাই পথের অবস্থা ভালো মতো পরীক্ষা না করে সে কখনো চলে না। কোনো জায়গায় হুছট খেলে, সে কথা চিরকাল মনে করে রাখে। লোকে বলে, ‘হাতিরও পিছলে পা’। তার মানে এই যে নিতান্ত সতর্ক লোকেরও মাঝে মাঝে ভুলচুক হয়। হাতির পা পিছলাতে তোমরা দেখেছ? আমি দেখেছি! ভালো মতেই দেখেছি, কেননা আমরা কয়েকজন তখন তার পিঠের উপরে ছিলাম। আর, পিঠের উপরে ছিলাম বলেই, আর কতকটা অন্ধকার রাত ছিল বলেও, আসল ব্যাপারখানা যে কি হয়েছিল তা বুঝতে পারি নি। তবে, এইটুকু বলতে পারি যে হাতিটা বসে পড়েছিল, গড়ায়নি, তাই আজ এই গল্পটি তোমাদের শোনাবার অবসর পাচ্ছি। এটা যে নিতান্তই একটা হাসির ব্যাপার হয়েছিল, সে কথা তোমাদের মানতেই হবে, যদিও ঠিক সেই সময়টাতে আমাদের আদপেই সে কথা খেয়াল হয় নি।

 আর হাসির ব্যাপার হয়, যখন কপিকল দিয়ে হাতিকে জাহাজে তোলে। শূন্যে লটকে থাকতে আমার তেমন ভালো লাগে না, এ কথা আমি সরলভাবে বলছি। হাতি নাকি তখন বড্ড বেজায় রকমের চ্যাঁচায়, তা ছাড়া আরো অনেক কাজ করে তার কথা লেখার দস্তুর নাই।

 আর হাসির কাণ্ড হয়, হাতি যখন হাঁচে। এক-একটা মানুষের হাঁচি শুনে চল্লিশ হাত দূরে থেকে চমকে উঠতে হয়, হাতির হাঁচির তো কথাই নাই। হাঁচবার আগে সে কেমন একটু ব্যস্ত আর জড়সড় হয়, তারপর একবাব চ্যাঁচায়, তারপর হাঁচে। তখন যে তার অর্থ বোঝে সেও ভারি আশ্চর্য হয়, আর যে বোঝে না, তার তো প্রাণ-ই উড়ে যায়।

 হাতি ভারি বুদ্ধিমান; মাহুতের কত কথাই তার বুঝে চলতে হয়। ‘বৈঠ্‌’ বললে বসে, ‘ধৎ’ বললে থামে, ‘মাইল’ বললে দাঁড়ায়; (আর খুব হুঁশিয়ার হয়), ‘দেলে’ বললে ধরে, ‘ভরি’ বললে ছাড়ে; ‘পিচ্ছো’ বললে হটে; ‘জুগ্‌’ বললে মাথা নোয়ায়; ‘থৈরে’ বললে শোয়; ‘হৈ’ বললে সরে; ‘বোল্‌’ বললে চ্যাঁচায়, ‘ডোগ্‌’ বললে ডিঙ্গায়; ‘মার’ বললে মারে।

 আশ্চর্যের কথা এই যে, অত বড় জানোয়ার এতটুকু মানুষের ধোকায় পড়ে কেন এত নাকাল হতে যায়? ওকে যে ফাঁকি দিয়ে ধরে, তার কথা শুনলে হাসিও পায়, দয়াও হয়। দুঃখের বিষয়, আজ আর সে কথার জায়গা নাই।