উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/দুঃখিনী
তার নাম কি, তাতে আমার কাজ নাই। বেচারি বড়ই দুঃখিনী। বাড়ি নাই, ঘর নাই, কি খাবে তার ঠিক নাই। দয়া করে যদি খানকতক তরকারির খোসা দাও, তাই খেয়ে সে যারপরনাই খুশি হবে।
এর আগে সে আরেকজনদের বাড়ি থাকত; তাঁরা চলে গেলে নিতান্ত জড়সড় হয়ে আমাদের দরজায় দাঁড়াল। মাথা হেট করে শুধু লেজ নাড়ছে আর এক-একবার ভয়ে ভয়ে মুখের পানে তাকাচ্ছে; জানে না রাখবে কি তাড়িয়ে দেবে। শরীরটি রোগা, মুখখানি মলিন, কিন্তু চোখদুটি দিয়ে যেন বুদ্ধি ফুটে বেরুচ্ছে। ঘরের ভিতর বসে খাচ্ছি আর সেই উঠান থেকে সে ভুরু কুঁচকিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে, কান খাড়া কবে, তার খবর নিচ্ছে। আমার হাতপাত থেকে মুখে যাওয়া-আসা করছে, ওর মুখখানিও তার সঙ্গে সঙ্গে উঠছে নামছে।
ওর নাকি মা আছে, সে তার খবর নেয় না। বোন আছে, সে কামড়িয়ে তাকে খোঁড়া করে দিয়েছে। তাই তাকে দাঁড় করিয়ে ছবি আঁকা ভালো মনে হল না; খোঁড়া পা দেখিয়ে বেচারাকে লজ্জা দিয়ে কি ফল?
আমাদের এখানে এসে দুঃখিনীর তিনটি ছানা হল, দুটি খোকা, একটি খুকি। আমরা ভাবলাম, যা হোক, তবু এদের নিয়ে ওর একটু সুখে দিন যাবে। সে কি আর ওর ভাগ্যে আছে? আমাদের হঠাৎ একটু কাজ পড়ল আমরা চলে গেলাম। ভাবলাম, চাকর রইল, সে দুঃখিনী আর তার ছানাগুলোকে দেখবে। আমাদের ও বাড়িতে ঢের ভাত ফেলা যায়, দুঃখিনীর খাবার কষ্ট হবে না। কিন্তু ও বাড়িতে গিয়ে আর দুঃখিনীর খাওয়া হল না। ছানাগুলোকে খানিকের তরেও ফেলে যেতে মার প্রাণ চাইল না। কাজেই মাসখানেক প্রায় উপোস করেই তার দিন কাটাতে হল। আমরা এসে দেখি, বেচারার হাড়গুলো আর চামড়াখানি ছাড়া আর কিছুই নাই। চলতে গেলে টলতে থাকে, প্রাণটি কেবল কোনোমতে দেহে টিকে আছে ছানাগুলো আবার ততদিনে এমনি ডানপিটে হয়ে উঠেছে, দুধ খেতে গিয়ে মাকে কামড়িয়ে কামড়িয়ে ঘা করে দিয়েছে। সেই ঘায়ের যন্ত্রণায় এখন ওরা খেতে গেলেই সে খেঁকিয়ে ওঠে।
একদিন দেখি, দুঃখিনী শুয়ে আছে ছানাগুলো তার কাছে দুধ খেতে গিয়েছে। ভাবলাম, এবারে দুঃখিনী তাদের ঠেঙাবে। কিন্তু দুঃখিনী তা না করে, উঠে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। ছানাগুলো ভাবল, বাঃ, কি মজা! তারাও তার সঙ্গে সঙ্গে ধেই ধেই করে নাচতে
লাগল। দুঃখিনী নাচতে নাচতে একটু একটু করে খিড়কির দরজার দিকে যাচ্ছে, ছানাগুলোও নাচতে নাচতে তার সঙ্গে চলেছে।
দুঃখিনী তড়াক করে দরজার চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে গেল, ছানাগুলো দেখল এবারে একটু মুশকিল। কিন্তু তারা ছাড়বার পাত্র নয়। দু একবার আছড়-পাছাড় খেয়ে তারাও শেষে চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে পাঁচিলের বাইরে গিয়ে উপস্থিত হল। তখন দুঃখিনী দুই লাফে পাচিলের ভিতরে এসে, আবার তার সেই জায়গাটিতে শুয়ে রইল। ছানাগুলো তখন বুঝল যে মা বডড ফাঁকি দিয়েছে।
ভারি চঞ্চল এই ছানাগুলো;আর দিনরাত ঝগড়াটা যে করে! যখন দেখবে তারা ঝগড়া করছে না, তখন নিশ্চয় বুঝতে হবে যে হয় তাদের ঘুম পেয়েছে, না হয় বডড শীত লেগেছে। ঝগড়া যেন তাদের খেলারই সামিল;অন্তত গোড়াতে খেলা নিয়েই আরম্ভ হয়। খেলা নানারকমের তার মধ্যে, একটা কিছু কামড়িয়ে ছিড়তে পেলে, সেই হচ্ছে সকলের চেয়ে সরেশ খেলা। এ খেলাটি ছেলে কুকুর, বুড়ো কুকুর সকলেই ভারি পছন্দ করে। আমাদের ও বাড়িতে ‘কেলো’ হচ্ছে ছেলেদের ভারি আদরের কুকুর।
তার বিছানা আছে, চামড়ার কলার আছে, সুন্দর শিকলি আছে। সেই শিকলিতে যখন সে বাঁধা থাকে, তখন বিষম চ্যাঁচায় আর যখন খোলা থাকে তখন ছেলেদের সঙ্গে খুব খেলা করে। একদিন ছেলেরা সব কোথায় গিয়েছে, কেলোর সাথী নাই। সে ভাবল, তাই তো, এখন কি করি! সে দেখল খাটের উপর কতকগুলো কাপড় রয়েছে কাজেই সে তাই নিয়ে খেলা করতে লাগল। ছেলেরা ফিরে এসে দেখল, কেলো তাদের শখের কাপড় সব ফালি ফালি করে রেখেছে। তখন কেলোকে ঠেঙ্গিয়ে তারা সে কাপড়ের দাম আদায় করে নিল।
আরেক রকম খেলা হচ্ছে একটা কিছু বেয়ে ওঠা। তুমি তাদের সামনে দাঁড়াইলেই, তারা লেজ নেড়ে লাফাতে লাফাতে এসে তোমার পা বেয়ে উঠতে চেষ্টা করবে, না পারলে অন্ততঃ চটিখানা কামড়িয়ে দেখবে। আর তোমার পায়ে যদি মোজা থাকে, তবে তো সোনায় সোহাগা।
তোমাকে যদি গাছে উঠতে দেখে, তবে তারা ভাববে, আমরাও পারি। সে বিদ্যা উঠতে। এখন তড়াক তড়াক করে উঠে যায়;কিন্তু যখন তা পারত না, তখন ঐ কাজটাই তারা প্রাণপণ করত। ওঠার চেয়ে তখন চিৎপাত হয়ে পড়াই হত বেশি। তখন গা ঝেড়ে উঠে কাউকে সামনে পেলে, তার উপর ভারি চটত।
ঐটুকু ছোট জানোয়ারের পক্ষে তাদের তেজ আছে খুবই বলতে হবে। দরকার হলে তোমাকেও তারা খেউ খেউ করে শাসাতে রাজি আছে। আগে কাক দেখলেই তাড়াত। এখন কাকেরা এখনো তাদের খুব খাতির করে আর কাছে গেলে সরে দাঁড়ায়। আগে এক বেটা মোরগ আমাদের বাড়ি এসে ভারি বড়াই করত। এখন তাকে দেখতে পেলে, ছানাগুলি এমনি তাড়া করে যে সে বেটা কক্ কক্ করে কোনখান দিয়ে পালাবে তার ঠিক পায় না।
হায়, দুঃখিনী! এখন আর তোমার সবকটি ছানা নাই। তার খুকিটি একদিন ফটকের বাইরে তামাশা দেখতে গেল, অমনি কোথাকার একটা কালো ভূতের মতো মিন্সে এসে তাকে ধরে নিয়ে ছুট দিল। তারপর থেকে আর দুঃখিনী তার বাকি ছানাদুটিকে বেশি বকে না।