উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/দূরবীন

দূরবীন

 হ্যান্স লিপার্সী নামক একজন ওলন্দাজ চশমাওয়ালা প্রথমে দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করে। সেই সময়ে গ্যালিলিও নামক ইটালী দেশীয় বিখ্যাত জ্যোতির্বেত্তা বাঁচিয়া ছিলেন। তিনি ঐ দূরবীক্ষণের কথা শুনিয়া নিজে ঐরূপ একটি দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করিলেন।

 তখনকার দূরবীক্ষণগুলি অবশ্য নিতান্তই ক্ষুদ্র ছিল। কিন্তু ঐ দূরবীক্ষণ দিয়াই গ্যালিলিও আকাশের সম্বন্ধে এমন সকল কথা জানিতে পারিয়া ছিলেন, যে লোকে তাহা শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিল। এমন কি, অনেকে তাহা বিশ্বাস করিতে না পারিয়া গ্যালিলিওকে নানারূপে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিতেও ছাড়ে নাই।

 গ্যালিলিও তাঁহার দূরবীক্ষণ দিয়া দেখিলেন যে চন্দ্রের বড়বড় পর্বত আছেবৃহস্পতি গ্রহের চারিটি চন্দ্র আছে শুক্র গ্রহ্বে হ্রাস বৃদ্ধি হয়; অর্থাৎ আমাদের চন্দ্র যেমন পূর্ণিমার রাত্রিতে ঠিক গোল থাকে, তারপর দিন দিন একটু একটু কমিয়া শেষে অমাবস্যায় একেবারেই মিলাইয়া যায়, তারপর আবার একটু একটু বাড়িয়া আবার পূর্ণিমা ফিরিয়া আসিলে ঠিক গোল চাদটি হয়, শুক্র গ্রহেরও সেইরূপ হইতে দেখা যায়।

 গ্যালিলিও তাহার দুরবীন দিয়া দেখিয়া যখন বলিলেন যে, সূর্যের গায়ে কালো কালো দাগ আছে, তখন সকলে হাসিয়া উঠিল। অনেকে বলিল যে, ও কালো দাগ তোমার চোখেই আছে।

 যাহা হউক, এখন আমরা জানি, যে গ্যালিলিও ঠিক কথাই বলিয়াছিলেন। গ্যালিলিওর সময় হইতে এ পর্যন্ত ক্রমেই ভালো ভালো, বড় বড় দুরবীন প্রস্তুত হইয়াছে। সেই সকল দুরবীন দ্বারা আজকালকার লোক যাহা দেখিতেছে, গ্যালিলিও তাহা দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। কালে আরো বড় বড় দূরবীন প্রস্তুত হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহাদের সাহায্যে যাহা জানা যাইবে, না জানি তাহা কত আশ্চর্য।

 দূরবীনের কথা বলিতে গেলে পণ্ডিত হর্শেল সম্বন্ধে কিছু না বলিয়া থাকা যায় না। ইনি প্রথমে সিপাহী ছিলেন; তৎপর সৈন্যদল হইতে পলায়ন করিয়া শাস্তির ভয়ে নিজের জন্মস্থান জার্মানি দেশ হইতে ইংলণ্ডে আসিয়া গান বাজনার ওস্তাদের ব্যবসা আরম্ভ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই এই ব্যবসায়ে তাহার বেশ পশার হইয়া ছিল, কিন্তু শীঘ্রই তাহাকে এই ব্যবসায়ও ছাড়িতে হইল। হার্শেল দূরবীন দিয়া আকাশ দেখতে বড়ই ভালোবাসিতেন;কিন্তু তাহার ভালো দূরবীন ছিল না। একটু ভালো দূরবীনের জন্য তখনকার একজন বড় কারিকরকে লেখাতে সে ব্যক্তি ভয়ানক দাম-চাহিয়া বসিল। হর্শেল গরিব মানুষ, এত টাকা তিনি দিতে পারিলেন না;অথচ একটা ভালো দূরবীন তাহার চাই। সুতরাং তিনি স্থির করলেন যে একটা দূরবীন নিজে তয়ের করিয়া লইবেন।

 দূরবীক্ষণের নল অথবা তাহার স্কুপগুলি সহজেই প্রস্তুত করা যায়। কিন্তু উহার মধ্যে আসল জিনিস যে ঐ কয়েক খণ্ড কাচ, তাহাই প্রস্তুত করিতে ভয়ানক বুদ্ধি আর পরিশ্রমের দরকার। বড় কাচখানি গড়িতে এত পরিষ্কার হাতের দরকার হয় যে, উহার কোন জায়গায় এক ইঞ্চির কুড়ি হাজার ভাগের একভাগ মাত্র ভুল হইলেও তাহাতে কাজ আটকায়। ঐ বড় কাচখানিই দুরবীক্ষণের প্রাণ। দূরবীক্ষণের দামের অনেকটা এই কাচের জন্যই দিতে হয়। কোনো কোনো দূরবীক্ষণে এই কাচখানির পরিবর্তে একখানি আরশি থাকে। হার্শেলের সময়ে খুব বড় কাচওয়ালা দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করিবার উপায় জানা ছিল না, আর কাচওয়ালা দুরবীক্ষণের অপেক্ষা আরশিওয়ালা দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করিতে পরিশ্রম কম; সুতরাং তিনিও এইরূপ আরশিওয়ালা দূরবীক্ষণই প্রস্তুত করিবেন স্থির করিলেন।

 হর্শেল সমস্ত দিন তাহার ওস্তাদী ব্যবসায় করিতেন, সন্ধ্যার পরে দূরবীক্ষণের জন্য আরশি পালিশ করিতে বসি্তেন। এরূপ করিয়া খুব ভালো দূরবীন প্রস্তুত করা কিরূপ কঠিন কাজ তা বুঝিতেই পার। কিন্তু হর্শেল যে কেবলমাত্র ভালো দূরবীন প্রস্তুত করিয়াই সন্তুষ্ট ইয়াছিলেন, তাহা নহে—তিনি এত ভালো দূরবীন প্রস্তুত করিয়াছিলেন যে তেমন ভালো দূরবীন সে সময়ে আর কেহই প্রস্তুত করিতে পারিত না। কি ভয়ানক খাটুনিই তাহার খাটিতে হইয়াছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলিয়া যাইত, স্নান নাই, আহার নাই, —হর্শেল ক্রমাগত বসিয়া আরশিই পালিশ করিতেন। তাঁহার ভগিনী ক্যারোলীন সর্বদা তাহার কাছে থাকিয়া ক্ষুধার সময় মুখে খাবার তুলিয়া দিতেন, আর অতিরিক্ত পরিশ্রমের ক্লেশ কমাইবার জন্য তাহাকে আরব্য-উপন্যাস পড়িয়া শুনাইতেন।

 এইরূপ পরিশ্রম করিয়া হর্শেল দূরবীক্ষণ তয়ের করিয়াছিলেন। একটি নয়, দুটি নয়, অনেকগুলি। রাজারা অবধি তাহার তৈয়ারি দূরবীক্ষণ পাইলে যারপরনাই খুশি হইতেন। তখনকার দূরবীক্ষণগুলির মধ্যে হর্শেলের তৈয়ারি কয়েকটা দূরবীক্ষণই সকলের চাইতে বড় ছিল।

 হর্শেল ক্রমে ওস্তাদী ব্যবসায় ছাড়িয়া দিয়া দূরবীক্ষণ নির্মাণ এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চা লইয়াই দিন কাটাইতে লাগিলেন। কালে তিনি একজন প্রধান জ্যোতির্বেত্ত হইয়াছিলেন। যাহা হউক, তাহার সকলের অপেক্ষা বড় কাজ দূরবীক্ষণ-নির্মান নহে—তাহ ইউরেনস গ্রহের আবিষ্কার। বাস্তবিক জ্যোতির্বেত্তা বলিয়াই হর্শেলের অধিক খ্যাতি। তবে, আমরা নাকি এখন দূরবীক্ষণের কথা লইয়াই একটু ব্যস্ত আছি, সুতরাং অন্য বিষয়ের কথা এখন না পাড়াই ভালো।

 হর্শেল অনেক দূরবীন প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তাহার বড়খানির আরশিটি চার ফুট চওড়া ছিল। ইহার পরে লর্ড রস এর চাইতেও বড় একটা দূরবীন প্রস্তুত করেন, তাহার আরশিখানি ছয় ফুট চওড়া। এত বড় কাচওয়ালা দূরবীন এপর্যন্ত কেহ প্রস্তুত করিতে পারে নাই। সকলের অপেক্ষা বড় কাচওয়ালা দূরবীক্ষণের কাচ পঞ্চাশ ইঞ্চি চওড়া,গত প্যারী প্রদর্শনীতে এই দূরবীক্ষণটি দেখানো হইয়াছিল।

 তোমরা অনেকেই দূরবীন দেখিয়াছ। একটা নল, তাহার দুমাথায় কাচ পরানো—দূরবীনের চেহারা মোটামুটি এইরূপ। একদিকের কাচ বেশ বড় ইহা দ্বারা দূরবীনের নলের ভিতরে দেখিবার জিনিসের ছবি তৈয়ার হয়। অন্য দিকের কাচ ছোট, ইহাতে সেই ছবিখানিকে খুব বড় করিয়া দেখায়। বড় দেখাইলেই আমাদের বোধ হয় যেন জিনিসটাকে কাছে দেখিতেছি।

 বড় কাচখানির ইংরাজি নাম (অবজেক্ট গ্লাস) object glass অর্থাৎ জিনিসের কাচ। যে জিনিসটাকে দেখিতে যাইতেছ, এই কাচখানিকে তাহার পানে ফিরাইয়া ধরিতে হয়, এইজন্যই উহার নাম জিনিসের কাচ। আর ছোট কাচের পিছনে চোখ রাখিয়া তাকাইয়া দেখিতে হয়, এইজন্য উহার নাম (আই পীস) eye piece অর্থাৎ চোখের কাচ। এক কথা, আমার কথা শুনিয়া হয়তো বোধ হইতে পারে যে object glassটি বুঝি একখানি কাচ, কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। একখানি কাচ দিয়া object glass তৈয়ার করিলে তাহাতে জিনিসের চারি ধারে রামধনুর মতন রঙ দেখা যায়। সুতবাং এই দোষ দূর করিবার জন্য দুরকমের দুখানি কাচ দিয়া object glass প্রস্তুত করা হয়। অবশ্য যেমন তেমন দুখানি কাচ লইলেই তাহা দ্বারা অবজেক্ট গ্লাস প্রস্তুত করা যায় না,ইহার একটা হিসাব আছে। কিন্তু সেই হিসাবটা নাকি একটু কঠিন, সুতরাং এখানে তাহার চর্চা হইতে পারে না।

 আইপীসও সচরাচর একখানি কাচের হয় না। একখানি কাচের আইপীস্ দিয়া একেবারেই কাজ চলে না এমন নহে অবজেক্ট গ্লাস ভালো হইলে, একখানি কাচের আইপীস্ দিয়াও বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু যাহা দেখা যায় তাহা সবই উলটা। ঐরাপ আই পীসের

ভিতর দিয়া আমাকে দেখিলে দেখিবে আমার পা উপর দিকে মাথা নীচের দিকে।

 আকাশ দেখিবার সময় ঐরাপ আই পীস ব্যবহারে কোনো দোষ হয় না;কিন্তু পৃথিবীর গাছপালা, মানুষ, গোরু, বাড়িঘর ইত্যাদিগকে উলটা দেখিতে একেবারেই ভালো লাগে না। সুতরাং পৃথিবীর জিনিসপত্র দেখিতে হইলে যাহাতে সোজা দেখা যায়, তাহার বন্দোবস্ত করিতে হয়। এইজন্য আরো অন্তত দুখানি কাচের প্রয়োজন। ইহা ছাড়াও ভালো করিয়া দেখিতে হইলে শুধু একখানি কাচের আই পীসে সকল সময় কাজ চলে না। সুতরাং আকাশ দেখিবার জন্য সচরাচর দুখানি কাচের আই পীস ব্যবহার হয়। অবশ্য তাহাতেও জিনিস উলটাই দেখা যায়; কিন্তু হইলেও, দেখায় বেশ পরিষ্কার।

 খানিক আগে যে আরশিওয়ালা আর কাচওয়ালা দূরবীনের কথা বলিতেছিলাম, এখন তাহার অর্থ বেশ বুঝিতে পারবে। আমরা সচরাচর যে-সকল দূরবীন দেখিতে পাই, তাহা কাচওয়ালা দূরবীন;কেন না,ইহাদের অবজেক্ট গ্লাস কাচের। অবজেক্ট গ্লাসের কাজ, দূরবীনের ভিতরে জিনিসের ছবি তৈয়ার করা। এই কাজ আরশি দ্বারাও হইতে পারে। সুতরাং এমন দূরবীনও হয়, যাহাতে অবজেক্ট গ্লাসের বদলে একখানি আরশি আছে। তাহাকেই বলে আরশিওয়ালা দূরবীন।

 এই-সকল কাচ এবং আরশি প্রস্তুত করা যে বড়ই কঠিন কাজ, এ কথা বলিয়াছি। যে কোনোরকমের একটা আরশি বা কাচ হইলেই তো হইল না, ইহার একটা বিশেষ গড়ন আছে। আরশিখানির গড়ন সরার ন্যায়—মাঝখানটায় গর্ত। কাচ দুখানি গোল—তাহাদের একখানার মাঝখানটা পুরু ধার পাতলা, আর একখানার পাশ পুরু মাঝখানটা পাতলা। আর কোন জায়গায় কতখানি পুরু, বা কতখানি পাতলা, বা কতখানি গর্ত, এ-সকলের হিসাবও যেমন তেমন হিসাব নহে।

 সুতরাং কাজ কঠিন হইবারই কথা। আরশির বেলা পরিশ্রম অনেক কম কারণ তাহার একপিঠ গড়িতে পারিলেই হইল। কিন্তু কাচ দুখানিতে চারিটি পিঠ সুতরাং তাহাতে চারিগুণ পরিশ্রম। এত পরিশ্রমের অর্থ ঢের খরচ এ কথা সহজেই বুঝিতে পার। একটা বড় দূরবীনের কথা যদি বলি, তাহা হইলে কথাটা আরো পরিষ্কার বুঝিতে পারবে।

 একটা খুব বড় দূরবীক্ষণের ছবি দেওয়া গেল।[] আমেরিকার কালিফর্ণিয়া দেশে হ্যামিল্টন পর্বতের উপরে একটি মানমন্দির (অর্থাৎ নক্ষত্র দেখিবার আফিস) আছে। এই মানমন্দিরের নাম লিক মানমন্দির। এই মানমন্দিরে একটি বড় দূরবীক্ষণ আছে।

 দূরবীনটির নলটি প্রায় ৫৭ ফুট লম্বা। বড় কাচখানি (অবজেক্ট গ্লাস) তিনফুট চওড়া। যে স্তম্ভের উপরে দূরবীনটি আছে, তাহ ৩৮ ফুট উঁচু।

 আটত্রিশ ফুট উচুতে দূরবীন থাকিলে দেখিবার সময় খুব মুস্কিল হয় না? আকাশের মাঝখানের অর্থাৎ আমাদের মাথার উপরের কোনো জিনিস দেখিতে হইলে বেশি মুস্কিল না হইতে পারে, কারণ তখন দূরবীনের গোড়ার দিকটা আমাদের চোখের খুব কাছে থাকে কিন্তু দেখিবার জিনিসটি যদি আকাশের এক পাশে থাকে, তবে তো তাহার দিকে দূরবীন ফিরাইতে গেলেইতাহার গোড়ার দিকটা ভয়ানক উঁচুতে উঠিয়া যাইবে, তখন কি মইদিয়া উঠিয়া দেখিতে হইবে নাকি? মই দিয়া উঠিয়া যে না দেখা যায় এমন নহে। কিন্তু এরূপ করিয়া বেশি উঁচুতে উঠিয়া দেখা সুবিধাজনক নহে। ঘরের মেঝের নীচে এমন কল আছে যে, দরকার হইলে সমস্ত মেঝেটাকে ইচ্ছামতো উঁচু-নিচু করা যায়। দূরবীনের গোড়া যখন খুব উঁচুতে উঠিয়া যায়, তখন তাহার সঙ্গে তাহার সঙ্গে মেঝেটাকেও উঁচু করিলে আর গোল থাকে না।

 যে স্তম্ভের উপরে দূরবীনটা আছে, তাহার ভিতরটা ফাঁপা। তাহাতে ঘড়ির মতন একটা প্রকাণ্ড কল আছে। দূরবীনটাকে একবার আকাশের কোনো জিনিসের পানে ফিরাইয়া ঐ কল চালাইয়া দিলে, আর সে জিনিস দূরবীনের ভিতর হইতে চলিয়া যাইতে পারে না। মনে কর, একটি তারা সন্ধ্যার সময় পূর্বদিকে দেখা দিয়াছে, আর তোমার ইচ্ছা হইল যে সমস্ত রাত্রি ধরিয়া ঐ তারাটিকে দেখিবে। এখন তুমি যদি একটিবার ঐ তারাটিকে দূরবীনের ভিতরে আনিয়া কল চালাইয়া দাও, তাহা হইলে তারাটি ক্রমাগতই দূরবীনের ভিতরে থাকিবে। তারাটি যেমন ক্রমে ক্রমে উপরে উঠিয়া মধ্যরাত্রে মাথার উপরে আসিবে, দূরবীনও তেমনি ক্রমে একটু একটু ঘুরিয়া মধ্যরাত্রে মাথার উপরের দিক লক্ষ্য করিবে। ভোরবেলা তারাটি যখন পশ্চিমে অস্ত যাইবে, দূরবীনও তখন ঠিক সেই দিকে মুখ ফিরাইবে।

 ছবির দিকে একটু মনোযোগ করিয়া দেখিলে দেখিতে পাইবে যে দুরবীনের গায় ছোটছোট কয়েকটি দূরবীন আঁটা রহিয়াছে। বড় দূরবীন দিয়া আকাশের জিনিসগুলিকে খুঁজিয়া বাতিল করা খুব কঠিন কাজ; এইজন্য ঐ ছোট দুরবীনগুলি উহার গায়ে পরানো রহিয়াছে। একটা জিনিসকে বড় দূরবীন দিয়া দেখিতে হইলে আগে ঐ ছোট দূরবীনের কোনো একটা দিয়া তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়। সেই জিনিসটি যখন ঐ ছোট দুরবীনের ঠিক মাঝখানে আইসে, এখন বড় দূরবীনের ভিতরেও তাহাকে দেখিতে পাওয়া যায়।

 দূরবীনের গোড়ার দিকে অনেকগুলি খুঁটিনাটি জিনিস দেখা যাইতেছে। অনেকগুলি ডাণ্ডা দেখা যায়, তাহাদের মাথায় এক-একটা চাকা পরানো। এই চাকাগুলিকে পাক দিয়া দূরবীনটাকে ইচ্ছামতো ঘুরানো ফিরানো ইত্যাদি নানান কাজ করা যায়।

 দূরবীনটা একটা ঘবের ভিতরে রহিয়াছে। ঐ ঘবের উপরটা গম্বুজের মতন। সেই গম্বুজের গোড়া হইতে আগা পর্যন্ত একদিকে ফাঁক আছে:ঐ ফাঁকের ভিতর দিয়া আকাশ দেখিতে হয়। দূরবীন যখন যেদিকে ফিরে, সমস্ত গম্বুজটাকে ঘুরাইয়া তাহার ফলকটিকে সেই দিকে আনিতে হয়। এই কাজ যাহাতে সহজে হইতে পারে, তজ্জন্য গম্বুজের নীচে চাকা পরানো আছে।

 এত কথার পর ইহা সহজেই বুঝিতে পারিবে যে, এরূপ একটা দূরবীনে ঢের টাকা ব্যয় হয়। লিক্ মানমন্দিরের দূরবীনটিতে সওয়া ছয়লক্ষ টাকা খরচ পড়িয়াছিল। এই টাকার চারিভাগের একভাগ অর্থাৎ একলক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার দুইশত পঞ্চাশ টাকা শুধু তিন ফুট চওড়া অবজেক্ট গ্লাসটির দাম।

 জেম্স্ লিক্ নামক এক সাহেবের টাকায় হইয়াছিল বলিয়াই লিক্ মানমন্দির নামটি হইয়াছে। লিক্ সাহেব অতিশয় দরিদ্রের সন্তান ছিলেন। লেখাপড়া অধিক শিখিতে পারেন নাই, কিন্তু ব্যবসায় করিয়া অনেক টাকা উপার্জন করেন। তাহার কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় এই সমস্ত টাকা তিনি একটি দূরবীক্ষণ এবং মানমন্দির নির্মাণের জন্য দিয়া গেলেন। তাহার উইলে লেখা ছিল যে এমন একটি দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করিতে হইবে যে তেমন দূরবীক্ষণ আর হয় নাই। কিন্তু ঐ দূরবীক্ষণ প্রস্তুত হওয়ার পরে ইহার চাইতেও বড় দুইটি দূরবীক্ষণ তৈয়ার হইয়াছে।


উপেন্দ্র—১২৩

  1. পত্রিকার পাতায় ছবিটি বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় দেওয়া সম্ভব হল না।