উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/পুরী

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

পুরী

 আজকাল রেল হইয়া পুরী যাইবার বেশ সুবিধা হইয়াছে, তাই এখন অনেকেই শখ করিয়া সেখানে গিয়া থাকেন। যাইবার পথটি বেশ। অনেকগুলি সুন্দর-সুন্দর নদী পার হইতে হয়। আর বালেশ্বর ছাড়াইলে পথের দুধারে অনেক পাহাড়ও দেখা যায়। নদীগুলির এক-একটা খুব চওড়া, তাহার উপরে বড়-বড় পোল আছে। পার হইবার সময় দু-একটা কুমিরও যে না দেখা যায়, এমন নহে। পাহাড়গুলিও নিতান্ত ছোট নহে, আর দেখিতেও বেশ। মাঝে মাঝে দূর হইতে এক-একটা মস্ত পাহাড় দেখা যায়, তাহার মাথা মেঘে ঢাকা। আবার পথের পাশ্বেই এক-একটা লাল রঙের পাহাড়ে ছোট-ছোট ঝোপের শোভাও চমৎকার লাগে।

 হাবড়া হইতে বালেশ্বর পর্যন্ত পথের দুধারেই প্রকাণ্ড মাঠ, কাছে লোকের বসতি বড় বেশি দেখা যায় না। কাকর মাটি তাহাতে খুব বেশি, গাছপালাও জন্মায় না। সুতরাং এই পথটুকু ভালো না লাগিবারই কথা। সুখের বিষয় এই যে, রাত্রির মধ্যেই ট্রেন এইসকল স্থান পার হইয়া যায়। বালেশ্বর গিয়া ভোর হয়।

 তবে এই মাঠের ভিতরেও যে দেখিবার একেবারে কিছুই নাই, তাহা নহে। হাঁটিয়া শ্রীক্ষেত্র যাইবার সেই পুরানো পথ এই মাঠের উপর দিয়াই গিয়াছে। রেল হইতে বার বার সেই পথ দেখিতে পাওয়া যায়। দেখিবার যে উহাতে এমন বিশেষ কিছু আছে, তাহা নহে। আমাদের দেশী বিশ্রীগোছের পাকারাস্তা যেমন হইয়া থাকে, এও সেইরূপ। তোমরা দেখিলে উহাকে কিছুমাত্র ভালো বলিবে না। তথাপি আমি উহাকে বার বার দেখিয়াও ক্লান্ত হই নাই। আমার যে বড়ই সুন্দর লাগিয়াছিল, তাহা নহে;কিন্তু ঐ পথটাকে দেখিয়া আমার ছেলেবেলার অনেক কথা মনে হইতেছিল। ঐ পথ দিয়া কত লোক শ্রীক্ষেত্র গিয়াছেন। ছেলেবেলা তাহদের অনেকের মুখে এই পথের বর্ণনা শুনিয়াছি। মাথা-ফাটানো রৌদ্রের মধ্যে তপ্ত কাকরের উপর দিয়া পথ চলা। পা ফুলিয়া যায়, পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তথাপি উৎসাহের ত্রুটি নাই। পুরুষদের চাইতে স্ত্রীলোকদেরই উৎসাহ বেশি। একটি বৃদ্ধা গ্রামের কয়েকটি ভদ্রলোকের সঙ্গে জগন্নাথ দর্শনে গিয়াছিলেন। তিনি মহাপ্রসাদ, জগন্নাথের ছবি, সমুদ্রের ফেনা, হোগলার ঠোঙ্গা, হোগলার পাখা প্রভৃতি অনেক আশ্চর্য জিনিস লইয়া দেশে ফিরিলে পর, বহুদিন পর্যন্ত আমরা তাহাকে মুহুর্তের জন্য বিশ্রাম করিতে দিই নাই। জগন্নাথের চেহারা কেন ওরূপ হইল? সুভদ্রা ঠাকুরুণ ভাইদের মাঝখানে অমন জড়সড় হইয়া আছেন কেন? কালাপাহাড় কিরকম ভয়ানক লোক ছিল? ইত্যাদি কথা শুনিতে শুনিতে আমাদের মুখের হা আর চোখ ক্রমে গোলাকার হইয়া উঠিত। আর শেষকালে সেই বৃদ্ধ যখন — ঠাকুর ফুলা পায় খোড়াইতে খোড়াইতে কিরূপ করিয়া আক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহার অভিনয় করিয়া দেখাইতেন, তখন ব্যাপার যাহা হইত সে আর কি বলিব!

 সেই — ঠাকুর এই পথে শ্রীক্ষেত্র গিয়াছিলেন। এই পথে খোড়াইতে খোড়াইতে তিনি আক্ষেপ করিয়াছিলেন। তাঁহার নামটি পর্যন্ত এতদিনে ভুলিয়া গিয়াছি, কিন্তু তথাপি কিরূপ করিয়া তিনি এই পথে গিয়াছিলেন তাহা যেন স্পষ্ট মনে হইতেছিল।

 আর মনে হইতেছিল সেই বুড়ো ওড়িয়া পাগুটির কথা, শিশুকালে যাহার সহাস্য মুখখানি

দেখিলে আমরা কতই আনন্দিত হইতাম। পাণ্ডার নিজের সম্বন্ধে এমন বিশেষ সংবাদ আমরা কিছুই জানিতাম না, যাহাতে তাহাকে দেখিলে আমাদের ভারি সুখ হইবার কথা। কিন্তু তাহার একটি আশ্চর্য লম্বা থলে অথবা তাহার ভিতরকার প্রসাদের খাতিরেই শিশুকাল হইতে এপর্যন্ত তাহার কথা মনে করিয়া রাখিয়াছি। সেই প্রসাদের থলেসুদ্ধ সেই বুড়ো পাণ্ডা নিশ্চয় এই পথে গিয়াছিলেন। তখন তিনি আক্ষেপ করিয়া ছিলেন কি না তাহা আর এখন জানিবার উপায় নাই। কিন্তু ক্লেশ তাহার খুবই হইয়াছিল, এ কথা বলিতে পারি।

 এই পথ ভিন্ন আরো দেখিবার জিনিস আছে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে দুপুরবেলায় ঐ-সকল স্থানে মরীচিকা দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ সময়ে একবার কটক গিয়াছিলাম, তখন আমি দেখিয়াছি, তাহার পূর্বে কেবল পুস্তকেই উহার কথা পড়িয়াছিলাম, চক্ষে দেখা হয় নাই। মরুভূমিতে মরীচিকা দেখিতে পাওয়া যায় এ কথাই জানিতাম। ও জিনিস যে মরুভূমি ছাড়িয়া আমাদের এত কাছে আসিয়া বসিয়া আছে, তাহা কি আর আমি জানি। কাজেই তখন আমি তাহার মর্ম বুঝিতে না পারিয়া উহাকে জলই মনে করিয়াছিলাম। কিন্তু কটক হইতে ফিরিবার সময় আমার এ ভ্রম দূর হইল। তখন একজন সাহেব আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাকে বলিলেন, “দেখেছ কেমন মরীচিকা?” আমি অবাক হইয়া বলিলাম, “উহা জল নম “তিনি বলিলেন, “না, উহা মরীচিকা। সমুদ্রের কাছে গেলে আরো স্পষ্ট দেখা যায়।” তখন অনেক মনোযোগ করিয়া দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, উহা জল নয়।

 রাত্রিতে হাবড়া স্টেশন হইতে রওয়ানা হইয়া সকালে বালেশ্বরে গিয়া যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন বেশ বুঝা যায়, যে একটা নুতন স্থানে আসা গিয়াছে। স্টেশনের নামে আর বাঙ্গালা অক্ষর নাই, তাহার স্থানে ওড়িয়া ভাষা হইয়াছে। আমরা যেমন করিয়া বাঙ্গালা আর দেবনাগর অক্ষরে মাত্রা দিই, ওড়িয়া অক্ষরের মাত্রা তেমন করিয়া দেওয়া হয় না। সোজা কসিটির বদলে তাহাতে পুঁটুলী পাকাইয়া আনিতে হয়;আসল অক্ষরটি তাহাতে তলায় পড়িয়া থাকে। অনেক অক্ষরেরই আসল অংশটুকু সংস্কৃত অথবা বাঙ্গালা অক্ষরের ন্যায়।

 এইরূপ ওড়িয়া অক্ষর দেখিয়া, আর ওড়িয়া ভাষা শুনিয়া বেশ আমোদেই পথ ছাড়ায়। ইচ্ছা হইলে ইহার সঙ্গে ওড়িয়া জলখাবারের বিষয়টাও যোগ করিতে হানি নাই। তবে, তাহাতে আমোদ কতখানি হইবে, আর ক্ষুধাই বা কতটুকু কমিবে, তাহা যে খাইবে তাহার মেজাজ এবং দাঁতের উপর নির্ভর করে। অন্তত আমি একবার বালেশ্বর স্টেশনের জলখাবারের যে নমুনা দেখিয়াছিলাম, তাহ বাস্তবিকই যদি ঐ অঞ্চলের গুণপনার নমুনা হয়, তবে এ কথা বলিতে পারি, তাহদের জিনিস খুব মজবুত। খাইবার সময় তাহা যেমন মজবুত, পেটের ভিতর গিয়াও যে তাহার চাইতে কম টেকসই হইবে তাহা মনে হয় না। সুতরাং এক ঠোঙ্গা কিনিলে ক্ষতি কি! আর কিছু লাভ না হউক, পুরী পর্যন্ত অবশিষ্ট মাইল শতেক এই এক ঠোঙ্গা মিঠাইয়ের চর্চাতেই উত্তমরূপে কাটানো যাইবে।


 পথে ভুবনেশ্বর স্টেশনের কাছে একটু সতর্ক হওয়া আবশ্যক, কারণ ট্রেন হইতে তথাকার মন্দিরগুলির দৃশ্য দেখিতে খুব সুন্দর। আর খুরদা স্টেশনে নামিয়া যে গাড়ি বদলাইতে হয়, সে কথাটাও না ভুলাই ভালো,কারণ তাহাতে পুরী পৌছাইবার ব্যাঘাত হইতে পারে। তবে,

আমার দাদা যেরূপ সতর্ক হইয়াছিলেন, এতটা না হইলেও চলিবে। তিনি নাকি বড়ই হুঁসিয়ার লোক, তাই কটক হইতে পুরী আসিবার পথে তিনি ভুবনেশ্বরেই তাড়াতাড়ি নামিয়া গাড়ি বদলাইতে ছুটলেন। গাড়ি যে পাইলেন না তাহা বোধ হয় আর আমার না বলিলেও চলিবে, ততক্ষণে তিনি যে ট্রেনে আসিয়াছিলেন, তাহাও ছাড়িয়া গেল! কিন্তু —’ দাদা সহজে দমিবার লোক নহেন। তিনি বলিলেন, “ভালোই হইল ভুবনেশ্বর দেখিয়া যাই!”

 পুরী পৌছাইবার চারি-পাঁচ মাইল থাকিতেই জগন্নাথের মন্দির দেখিতে পাওয়া যায়। যেন একটা প্রকাণ্ড ভুট্টা। ভুট্টার দানা যেরূপ করিয়া সাজানো থাকে, মন্দিরের আকৃতিও কতকটা ভুট্টারই মতন। মন্দিরের এই দৃশ্যটি দেখিতে বেশ সুন্দর, কিন্তু কাছে গিয়া আমার তাহা এত সুন্দর বোধ হয় নাই বিশাল সবুজ মাঠের মাঝখানে বিস্তৃত জলাশয়, তাহার পাশে সেই প্রকাণ্ড মন্দির, গাছপালা তাহার কোমরের নীচে পড়িয়া আছে। দেখিলে বাস্তবিকই তাহাকে একটা যেমন তেমন জিনিস বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু মনের এই আনন্দটুকু অল্পক্ষণই থাকে যতই কাছে যাওয়া যায়, ততই ছোট-ছোট জিনিসে মন্দিরকে আড়াল করিয়া ফেলে। সে সবুজ মাঠ আর বিশাল জলাশয়ের নির্মল জল দেখা যায় না। সমুদ্রের বালি, আর হাডিডসার গাছপালা তাহার স্থান অধিকার করে। ইহার উপর আবার যেই স্টেশনে নামিলাম আমনি,

‘—দক্ষিণে, বামে, পিছনে সম্মুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।’

 আমি তীর্থ করিতে পুরী যাই নাই, বেয়ারাম সারাইবার জনা গিয়াছিলাম। কিন্তু বার বার সবিনয়ে বলাতেও পাণ্ডা মহাশয়েরা আমার কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না। আমি যত বেশি করিয়া বলি, তাহারাও ততই আরো যত্বপূর্বক আমাকে আহ্বান করেন। শেষটা গাড়িতে উঠিয়া কতকটা নিশ্চিন্ত হইলাম বটে, কিন্তু বাসায় আসিয়া দেখি, সেখানে একজন আসিয়া আছেন!

 যাহা হউক, শেষটা ইহাকেও বুঝিতে হইল যে এ ব্যক্তিকে ছাড়িয়া দেওয়াই ভালো। আমিও রক্ষা পাইয়া নিজের অবস্থা এবং বাসস্থান বিষয়ে মনোযোগী হইলাম।

 এইখানে একটা কথা বলিয়া রাখি। আমি বেয়ারাম লইয়া সেখানে গিয়াছিলাম। নিয়ম পালন করিতেই আমার সমস্ত সময় কাটিয়া যাইত চারিদিকে বেড়াইয়া দেখিবার অবসর আমার হয় নাই। বেড়াইবার অবসর যখন হইত, তখন সমুদ্রের ধারে চলিয়া যাইতাম। মন্দিরের ওদিকে দু-একদিন মাত্র গিয়াছিলাম। আমার ভিতরে যাইবার উপায় ছিল না বাহির হইতে যাহা দেখা যায়, তাহাই দেখিয়াছি। সুতরাং মন্দিরের সম্বন্ধে আমার বেশি কথা বলিবার নাই।

 মন্দিরটা খুব বড়। আর প্রাচীর সিংহদ্বার প্রভৃতি লইয়া দেখিতেও বেশ জমকাল। কিন্তু কাছে গিয়া কারুকার্য তেমন ভালো বোধ হয় না। সামনের রাস্তাটি খুবই চওড়া,আমি আর কোথাও এমন প্রশস্ত পথ দেখি নাই। এই পথে জগন্নাথের রথ চলে। পথের এক প্রান্তে রথখানি রহিয়াছে। সেখানকার বড় পর্ব রথযাত্রা। রথযাত্রার সময় দুই তিন লক্ষ লোক পুরীতে জড়ো হয়। এই কয়দিন ইহারা জগন্নাথের প্রসাদ খাইয়াই দিন কাটায়। প্রসাদ বাজারে বিক্রয় হয়, কিনিয়া খাইলেই হইল। যাহা খাইতে পারে খাইবে অবশিষ্ট আর একবার খাইবার

জন্য রাখিয়া দিবে। জগন্নাথের প্রসাদ ফেলিয়া দিবার জো নাই। বাসি হইয়া পচিয়া গেলেও তাহা খাইতে হইবে। জগন্নাথের প্রসাদ খাইতে জাতির বিচার নাই। চণ্ডাল যদি ব্রাহ্মণকে প্রসাদ আনিয়া দেয়, তাহাও তাহাকে খাইতে হয়।

 পুরীতে গোদের প্রাদুর্ভাবটা কিছু বেশি। সেখানকার লোকের নাকি এই বিশ্বাস যে, জগন্নাথের প্রসাদ মাড়াইলে গোদ হয়।

 পুরীতে গিয়া প্রথমেই একটা ব্যাপার একটু আশ্চর্য বোধ হয়। সমুদ্রের ধারের স্থানগুলিতে গাছপালা বাড়িতে পায় না। বড়গাছগুলি আমগাছের মতন। নিমগাছ কুলগাছের মতন। অনেকগুলি গাছই আবার একপেশে। একদিকে কারো ডালপালা বেশ বাড়িয়াছে, কিন্তু আর এক দিকে বেশি ডাল নাই আবার যাহা আছে তাহাতেও পাতা খুব কম। সমুদ্রের ধারের বালি হাওয়ায় উড়াইয়া আনিয়া এই সকল গাছের ঐরূপ দুর্দশ করে। হাওয়ার দিন সমুদ্রের ধারে এই কথাটি বেশ বুঝিতে পারা যায়। খুব শুকনো দিনে বেশি হাওয়া হইলে, তাহার চোটে বালির কণাসকল ছুটিয়া আসিয়া গায়ে পড়ে। আর এত জোরে পড়ে যে, খালি চামড়ায় পড়িলে অনেক সময় তাহাতে পিপড়ের মতন বেদনা বোধ হয়। এই হাওয়ায় তাড়ানো বালির দৌরাত্ম্যে গাছের কচি পাতাগুলি প্রায় মারা যায়।

 সমুদ্রের হাওয়া সমুদ্র ছাড়িয়া বেশি দূরে যায় না। সুতরাং সমুদ্রের কাছের গাছপালারই এইরূপ দুরবস্থা। সমুদ্র হইতে দূরে বড় বড় গাছের অভাব নাই। তাহা ছাড়া এক এক রকমের গাছ সে দেশের মাটিতে স্বভাবত খুব বাড়ে বলিয়া বোধ হইল। প্রথমে পুরীর বাসায় ঢুকিয়াই দুটি পেপে গাছ দেখিলাম; তেমন বড় পেপেগাছ আমি আর কখনো দেখি নাই। সে দেশে পেপের নাম অমৃত ভাণ্ড। এমন জমকাল নামের গরিমায়ই বা সেখানকার পেপেগাছ ফুলিয়া এত বড় হয়! আর তাহার ডালপালাই বা কত বাড়ির পাশেই কয়েকটা বট গাছ ছিল। সে গাছগুলি যেমন উচু পেপেগাছগুলি বরং তাহার চাইতে একটু বেশি উচু। তবে, পরিসরে অবশ্য ঢের কম।

 একপ্রকার মনসাগাছও সেখানে খুব জন্মায় সেগাছের পাতা দেখিতে সাপের চক্রের মতন। একটা পাতার টিকির ভিতর দিয়া আর একটা বাহির হয়। ফুল-ফলও পাতার আগাতেই হয়। কুমড়ো ফুলের মতন বড়-বড় হলদে। সেই ফুলগুলি দেখিতে খুব সুন্দর।

 সে দেশের ঘরবাড়ি আমি বিশেষ প্রশংসা করিতে পারিলাম না। তিনটি চলনসই শয়ন ঘর, ভাড়ার, রান্না ঘর, একটি অতিশয় ক্ষুদ্র স্নানের খোপ, আর সেইরূপ আর একটি জায়গা তাহাতে কাঠ রাখা চলে। তিনটি বারান্দা, পাচিল ঘেরা আঙ্গিনা, ভিতরে একটি কুয়া। এইরূপ একটি বাড়ির জন্য আমাকে মাসে সত্তর টাকা করিয়া দিতে হইয়াছিল। দূরে ঐ বাড়ির চেহারা দেখিয়া ছেলেরা বলিয়াছিল, “য়্যা! বিচ্ছির বাড়িটি যদি আমাদের হয়”শেষটা সেই “বিচ্ছিরি” বাড়িতেই গাড়ি থামিল। গাড়ি হইতে নামিয়া দেখি, একটি কুকুর সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে। একটি সে-দেশী চাকরও ছিল;কিন্তু তাহার কথা তেমন উল্লেখযোগ্য নহে। কুকুরটা তাহার চাইতে ঢের ভালো লোক কুকুর হইলেও সে আমাদিগকে আদর-যত্ন করিতে ক্রটি করে নাই।

 কুকুর আর সেই চাকর ভিন্ন সে বাড়িতে আরো অনেকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হইল। কিন্তু তাহারা মানুষ নয়, ছোট ছোট ব্যাঙ। একটা দুটো নয়, অনেকগুলি। ভাবে বোধ হইল,

যেন তাহারাই সচরাচর ঐখানে থাকে। এমন নিশ্চিন্তভাবে পরের ঘরে থাকিতে আর কোনো জন্তু পারে না। কাজের মধ্যে তো দেখিলাম, খালি থপথপ করিয়া দেওয়ালের ধারে বেড়ানো, আর কোণে পৌছাইলে সেই কোণ বাহিয়া দেওয়ালে উঠিবার চেষ্টা। কাজটি অতিশয় কঠিন। দুই পা ছড়াইয়া দুদিককার দেয়ালে প্রাণপণে ঠেস না দিলে এ কাজ হইবার জো নাই। আর ছড়ানোও যেমন তেমন হইলে হইবে না। ব্যাঙ ভিন্ন অন্য কোনো জন্তুর সেরূপভাবে পা ছড়াইবার ক্ষমতা আছে কি না, বিশেষ সন্দেহের বিষয়। আর তাহা দেখিলে কি হাসিই পায়, তাহা কি বলিব! কিন্তু ব্যাঙ খুব ধীর প্রকৃতির জানোয়ার, যারপরনাই গম্ভীরভাবেই সে এ কাজ করিতে থাকে।

 এই ব্যাঙ তাড়ানোই কিছুদিন ছেলেদের কাজ হইল। সহজে কি তাহারা যায়। ধমকাইলে যে তাহারা কানে শোনে, তাহার কোনো প্রমাণই পাওয়া গেল না। লাঠি দিয়া খোচাইতে গেলে খালি একটু ব্যস্ত হয়, কিন্তু ঘরের বাহিরে যে যাইতে হইবে, এ কথা তাহদের মাথায়ই আসে না। শেষটা একটি ছেলে এক ফন্দি বাহির করিল। কাগজের ঠোঙ্গা সামনে ধরিয়া পিছনে তাড়া করিলে অতি সহজেই ব্যাঙ তাহাতে লাফাইয়া উঠে। তাহার পর তাহাকে বাহিরে ফেলিয়া দিলেই হইল।

 এইরূপ করিয়া ব্যাঙের উপদ্রব কমিল বটে, কিন্তু উই দেখা দিল। ঐ উইয়ের লোভেই এত ব্যাঙ আসিয়াছিল। উইয়েরা আমাদের জিনিসপত্র কাটিয়া আমাদিগকে অস্থির করিয়া তুলিল। বই আর জুতার উপরেই তাহদের বেশি আক্রমণ, বিশেষত জুতা যতই মজবুত হয়, ততই যেন উহ্য তাহার মিষ্ট লাগে। লোহা, পিতল ভিন্ন আর কিছুই তাহার দাঁতের কাছে টেকে না, খালি কেরসিন তেল এক জিনিস আছে, যাহার কাছে উই জব্দ থাকে।

 পুরীর ঘরের কথা বলিতে ব্যাঙ আর উইয়ের কথা উঠিয়াছিল তাহার পর দেশের মানুষের কথা আসা স্বাভাবিক। সেদেশের লোক আমরা এখানে বসিয়াই ঢের দেখিতে পাই। তাহারা কেমন কথা কয়, কেমন পান খায়, কেমন রাধে, কেমন সুরে পালকি বয় এসকল কাহারো অজানা নাই। একটা কথা অবশ্য মনে রাখা উচিত। আমাদের এখানে যাহারা পালকি বহিতে, চাপরাসী গিরি আর মুটের সর্দারি করিতে ও রাধিতে আসে, তাহদের দেখিয়া সে-দেশের ভদ্রলোকের সম্বন্ধে বিশেষ জানা যায় না। দুঃখের বিষয়, সেখানে গিয়াও আমি সেদেশের ভদ্রলোকদের সহিত মিশিবার সুযোগ পাই নাই। সেখানে গিয়াও সেইওড়িয়া ব্রাহ্মণ আর ওড়িয়া চাকর লইয়াইব্যস্ত হইয়াছি, আর সেই ওড়িয়া পালকিওয়ালার চ্যাচানিতেইকান ঝালাপালা হইয়াছে। একটা বড়রাস্তার পাশেই আমার বাসা ছিল, আর সেই রাস্তার সংলগ্ন একটি ঘরে দিনের বেলায় আমি বসিতাম। সুতরাং ওড়িয়া পালকি বেহারার সংগীত শুনিতে আমার ক্রটি হয় মাই। এখানকার ওড়িয়ার তেমন গান গাহিতে জানেইনা। সেখানে কোনো স্থান দিয়া একটা পালকি গেলে সিকি মাইল পর্যন্ত তাহদের আক্ষেপ শুনিতে পাওয়া যায়। মনে হয়, যেন তাহারা বড়ই বিপদে পড়িয়াছে, আর সেইবিপদটা যেন তাহদের পান্ধীর ভিতরে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, যে সওয়ারটি ভারী হইলে নাকি ঐরাপ করিয়া তাহারা গালি দেয়। ইহা যদি সত্য হয়, তবে বলিতে হইবে যে পালকিতে উঠিবামাত্র সকলেই হঠাৎ ভয়ানক ভারী হইয়া যায়। আসল কথা কিন্তু তাহার কিছুইনহে। উহাদের ঐ

চীৎকারের ভিতরে একটা শৃঙ্খলা আছে। সামনের একজন যেন চ্যাঁচাইয়া বলিল, ‘ওরে বাবা রে!” পিছনের একজন যেন উত্তর দিল, “কি হল রে!’ সামনের লোক বলিল, ‘ওগো মাগো।’ পিছনের লোক বলিল, “কোথায় যাব গো! মাগো বাবা গো’ বলে না আর কিছু যে বলে, তাহাও আমি জানি না, কথাগুলি নাকি বড়ই উদ্ধশ্বাসে বলে তাহাতেই এরূপ মনে হয়। উহাতে বেশ একটা ছদ আছে, তাহাতে মনে হয়, যে একসঙ্গে পা ফেলিবার সুবিধার জন্য ঐরূপ করে, কারণ এক সঙ্গে পা ফেলিয়া চলাতে সওয়ারির আরাম আছে। অনেক সময় এরূপ বুঝা যায়, যে সামনের ব্যক্তি সর্দার, সে ঐ উপায়ে চলার সম্বন্ধে উপদেশ দেয়। আসল কথাটা যে কি, তাহা উহারাই বলিতে পারে।

 এই তো গেল পালকী বেহারার কথা। তাহার পর চাকর বামুনের কথা। কিন্তু তাহা বলিবার আগে একটু সতর্ক করিয়া দেওয়া দরকার। তীর্থস্থানে সাধারণত বিস্তর অপদার্থ অলস লোক আসিয়া জড়ো হয়। বিশেষত পুরীর মতন যদি তীর্থস্থান হয়, যেখানে রান্নাবান্নার ঝঞ্ঝাট নাই, অতি অল্প পয়সার প্রসাদ কিনিয়া খাইলেই চলে। চাকর বামুনের সংবাদ লইতে গেলেই এই হতভাগারা আসিয়া উপস্থিত হয়, কাজেই ভালো লোক সেখানকার কে তাহা জানিবার উপায় থাকে না। হয় নিতান্ত বেকুব, না হয়, বেজায় পাজি, এইরূপ লোকই প্রায আমার ভাগ্যে জুটিয়াছিল।

 চাকর আসিল, তাহার দুই পায়ে দুই গোদ, সেই গোদ ভরাট করিতে যেন শরীরের অন্যান্য স্থানের মাংস খরচ হইয়া গিয়াছে। সে ব্যক্তি আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “কি কাজ করিতে হইবে?’

 ‘এই জল তুলবি ঘর ঝাট দিবি, বাসন মাজবি, এইসব কাজ করবি।’

 ‘সওদা করিব না?’

  না। তাহার লোক আমাদের আছে।’

 ‘সওদা করিব না, ত কঁড় করিব? বলিয়া বেচারা একেবারেই নিরুৎসাহ হইয়া গেল। বলা বাহুল্য, সে ব্যক্তি আর আমাদের কাজে আসে নাই। অন্য বিষয়ে বুদ্ধি যেমনই থাক, সওদা’ অর্থাৎ বাজার করার মর্ম, সে বেশ বুঝিয়াছে। বুদ্ধির নমুনাও কিঞ্চিৎ দিতেছি।

 সেখানকার একজন পদস্থ বাঙ্গালি ভদ্রলোকের এক ওড়িয়া চাকর ছিল। সে লোক ভালো, সুতরাং তাহার বুদ্ধিটা একটু মোটা। মনে কর, যেন তাহার নাম গদাধর।

 একদিন বাবুর একটি অতিশয় পরিচিত বন্ধু দূর দেশ হইতে আসিলেন। বাবু তখন আপিসে গিয়াছে, সুতরাং গদা বলিল, বাবু নাই! বন্ধুটি একটু নিরাশ হইয়া বলিলেন, পরিবার তো আছেন? গদা বলিল, না, না, পরিবার নাই!’ বন্ধু আর কি করেন, তিনি ক্ষুন্ন মনে ফিরিয়া গেলেন। বাড়ির কী সবই শুনিয়াছেন, কিন্তু চ্যাচাইয়া তো আর কিছু বলিতে পারেন না। তিনি গদার ব্যবহারে যারপরনাই আশ্চর্য হইলেন, আর সে ভিতরে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিরে গদা, তুই যে বলিলি পরিবার নাই?গদা নিতান্ত সরলভাবে বলিল, ‘আমি তো ভালোই করেছি, বাবু পরিবা’ নিতে এসেছিল, আমি নাই বলে বাঁচিয়ে দিয়েছি।” সে দেশে পরিবা’ বলিতে তরকারি বুঝায়। গদা মনে করিয়াছে বাবু তরকারি চায়। সে মনিবের হিতৈষী লোক, তাহার ইচ্ছা নহে যে তাহার তরকারি লোকসান হয়, সুতরাং সে আগন্তুক বাবুকে, পরিবা নাই বলিয়া বিদায় করিয়াছে!

যেমন চাকর তেমনি পাচক। তবে এ কথা বলার দরকার যে, আমি যে কয়েকটিকে পাইয়াছিলাম, তাহদের কেহই বোকা নহে। সুতরাং—আর থাক সে-সব কথা বলিয়া আর এখন লাভ কি? জিনিস তো আর ফিরিয়া পাইব না। উহাদের গায়ে যে হনুমানের মতন জোর ছিল না,ইহাই আমার সৌভাগ্য। নতুবা একদিন ভোরে উঠিয়া হয়তো দেখিতাম, যে আমরা ময়দানে বাস করিতেছি, বাড়িঘর কোথায় গিয়াছে, তাহার ঠিকানা নাই।

 পূর্বেই বলিয়াছি, আমি সেখানকার সাধারণ লোকের সহিত মিশিতে পাই নাই, সুতরাং তাহার সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু বলিতে পারলাম না। দুইটা বিষয় আমি লক্ষ্য করিয়াছি। তাহারা গায়ে হলুদ মাখিতে খুব ভালোবাসে। আর তাহদের কেমন একটা বেখাপ্পা কৌতুহল আছে। পথ চলিতে চলিতে তোমাকে ডাকিয়া তোমার আবশ্যক অনাবশ্যক দশটা খবর লইয়া যাইবে। কবে এসেছ? কত দিয়ে ঘর ভাড়া করিলে? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এত বার দিতে হইয়াছে, যে আমি চটিয়া যে গল্পের সেই রামা চাকরের মতন একটা কিছু করিয়া বসি নাই ইহা আমার বিশেষ প্রশংসার বিষয় বলিতে হইবে। রামা বাজারে মাছ কিনিয়াছে, সকলেই তাহার দাম জিজ্ঞাসা করে, তাহাতে রামার রাগ হইল। তখন রামা মাছ মাটিতে রাখিয়া রাস্তায় পড়িয়া চীৎকার করিতে লাগিল, আর হাত পা ছুঁড়িতে লাগিল। বাজারের সমস্ত লোক কাজকর্ম ফেলিয়া রামার কাছে আসিয়া উপস্থিত। সকলেই বলে, “কি হইয়াছে? কি হইয়াছে? রামা যখন বুঝিল, যে আর বেশি অবশিষ্ট নাই, প্রায় সকলেই আসিয়াছে, তখন সে আস্তে আস্তে উঠিয়া গা ঝাড়িল, আর মাছটি উচু করিয়া ধরিয়া বলিল, ওগো, আর কিছু নয়, আমার এই মাছটা সাড়ে সাত আনা হয়েছে, তোমরা সবাই শুনে রাখ! সাড়ে সাত আনা!! সাড়ে সাত আনা!!!

 মাছের কথা শুনিয়া হয়তো অনেকেই ভাবিতেছেন, সেখানে মাছ পাওয়া যায়। মাছ খুব পাওয়া যায়, কিন্তু তাহার কথা আজ বলিলে চলিবে না। অনেক কথা। আর একদিন খালি মাছের কথা বলা যাইবে।

 তরকারি বেশি পাওয়া যায় না। কচু, কুমড়া আর কাচকলার নাম লইলেই প্রধান জিনিসগুলির কথা একপ্রকার শেষ হয়। আলু তো জগন্নাথ খানই না, সুতরাং তাহা সেখানে জন্মায়ও না। ফলের সময় সেখানে যাই নাই, কাজেই কি কি ফল পাওয়া যায়, আর তাহা খাইতে কেমন, তাহা বলিতে অক্ষম। কলা বেশ, আর আম, পেঁপে, আতা, নোনা, কুল ইত্যাদির গাছ দেখিয়াছি, সুতরাং তাহাও পাওয়া যায়। তবে খাইতে কেমন, তাহা জানি না।

 দুধের বড়ই কষ্ট। দুধের দোষে নয়, গোয়ালার গুণে। দুদিন সেখানকার দুধ খাইয়াই বুঝিতে পারলাম যে, সে কলিকাতার গোয়ালার চাইতে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ডাক্তার বলিলেন, গাই না কিনিলে তোমার অসুখ সারিবে না। পরদিন সকালে গাই কিনিতে লোক পাঠাইলাম, একটি ছোট ছেলে তাহার সঙ্গে গেল। বেলা একটার সময় ষোলো টাকায় কচি বাছুর সমেত এক কালো গাই কিনিয়া তাহারা ঘরে ফিরিল! উহাদের দেরি দেখিয়া আমরা মনে করিয়াছিলাম, না জানি ক্ষুধায় ছেলেটির কতই কষ্ট হইতেছে,কিন্তু ফিরিবার সময় দেখি, তাহার গালভরা হাসি। একটা গরু কিনিলাম, আর একটা সঙ্গে দিয়াছিল বলিয়া সে মহা সন্তুষ্ট। তাহার খুব আশা হইয়াছে যে আর দুমাস পরে ছোট গরুটার দুধও খাওয়া যাইবে। গরুর কথা বলিতে সেখানকার দুটা বাড়ের কথা মনে হইতেছে। দুইটাতে সাংঘাতিক

শত্রুতা, একটা আরেকটাকে ক্রমাগত খুঁজিয়া বেড়ায়, আর পরস্পরের উদ্দেশ্যে আক্রোশ প্রকাশ করে, দেখা হইলেই যুদ্ধ বাধিয়া যায়। ইহাদের জ্বালায় অনেক সময় পথ চলা কঠিন হইত। অথচ মানুষের সহিত ইহাদিগকে কখনো খারাপ ব্যবহার করিতে দেখি নাই। বরং একটা একদিন আমাদের ঘরে ঢুকিয়া যেরূপ অপ্রস্তুত হইয়া গেল, তাহাতে উহাদিগকে নিতান্ত ভালোমানুষ ভিন্ন আর কিছুই বলা যায় না। আমরা অবশ্য খুবই ভয় পাইয়াছিলাম, ততোধিক কোলাহল করিয়াছিলাম। অব একটা বাখারি আনিয়া তাহার চোখের সামনে নাডিতেও ক্রটি করি নাই। এই বাখারি দেখিয়াই ভয় পাইয়া থাকুক, না হয় আমাদের বাঙ্গলা কথার অর্থ বুঝিতে না পারিয়া তাহাকে উৎকট গালি মনে করিয়া থাকুক, যে কারণেই হউক, বেচারা যেন তাহার জীবনে আর কখনো এমন সঙ্কটে পডে নাই, এইরূপ তাহার ভাব হইল। আর দরজা খুলিয়া দিবামাত্র সে উদ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 পুরীর সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু যাহারা সমুদ্র দেখেন নাই তাহারা হয়তো জিজ্ঞাসা করিবেন, সমুদ্র কেমন দেখিলে? আমিও সমুদ্রো কথা বলিবার জন্যই এতক্ষণ ধরিয়া সুযোগ খুঁজিতেছিলাম।

 সমুদ্রটা কেমন? —এব উত্তরে আমি এমন কোনো কথাই খুঁজিয়া পাইতেছি না, যাহা বলিলে যে সমুদ্র দেখে নাই, সেও মনে মনে তাহার একটা চেহারা কল্পনা করিয়া লইতে পাবে। একটি শিশু পুকুর দেখিয়া বলিয়াছিল, কত বড় চৌবাচ্ছা!” সে যাহা আগে দেখিয়াছে, দেখা যায় না, তখন তাহাকে চৌবাচ্ছা মনে কবা শিশুর পক্ষেও সম্ভব না হইতে পারে। আর চৌবাচ্চাটাকে মনে মনে বাড়াইয়া তুলিয়া তাহার কুল-কিনারা দূর করিয়া দিতে পারলেও তাহা ঠিক সমুদ্রের মতন হইবে না।

 সমুদ্র বড় তাহার আর সন্দেহ কি? কিন্তু সমুদ্রের তীরে দাড়াইয়া তাহাকে যেটুকু বড় দেখা যায, তাহা তেমন কিছু আশ্চর্যের বিষয় নহে। পদ্মা প্রভৃতি বড়-বড় নদীর এক-এক স্থান সোজাসুজি দেখিতে প্রায় এইরূপই বোধহয়। হিমালয়ে উঠিবার সময় মাঠের দৃশ্য যে দেখিয়াছে, সে ঐরুপ সমুদ্রের চাইতে বড় জিনিসই দেখিয়াছে। যত উচুতে উঠা যায়, ততই বেশি দূর অবধি দেখিতে পাওয়া যায়। পুরীর কাছে সমুদ্র আসলে সাত হাজার মাইল লম্বা হইলে কি হইবে? তাহার কুলে দাড়াইয়া পনেরো-কুড়ি মাইলের অধিক দেখা যায় না। কিন্তু দাৰ্জিলিং-এর পথে এক এক জায়গায় নীচের দিকে তাকাইলে মাঠের উপর দিয়া ষাট-সত্তর মাইল পর্যন্ত দৃষ্টি চলে।

 সমুদ্রের সম্মান কেবল তাহার মস্ত শরীরটার জন্য নহে, তাহার আরো গুণ আছে। দেশের সাধারণ লোকেরাও সমুদ্রকে একটা দেবতা বলিয়াই মনে করে। এ কথার প্রমাণ সমুদ্রের ধারে গেলেই পাওয়া যায়।

 পুরী তীর্থস্থান, সেখানে অনেক দূর হইতে যাত্রীরা আসে। এ সকল যাত্রী যে সমুদ্র দেখিবার জন্য আসে, তাহা নহে, তাহাদের উদ্দেশ্য জগন্নাথ দেখা। ভক্তিমান যাত্রীরা অনেকে রেল হইতে জগন্নাথের মন্দির দেখিবামাত্রই হাত জোড় করে, আর মন্দিরে আসিয়া জগন্নাথকে প্রণাম করিয়া তবে সে হাত নাবায়। কিন্তু জগন্নাথের ওখান হইতে বিদায় হইয়াই যে সে যথেষ্ট মনে করিবে তাহা নহে, সমুদ্রকে একবার না দেখিয়া, তাহাকে পূজা না করিয়া, তাহাকে কিছুফল না খাওয়াইয়া আর তাহার ঢেউ না খাইয়া দেশে ফিরিলে তাহার সকলই অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়।

 নিতান্ত গরিব, আর নিতান্ত পাড়াগেয়ে লোক, পূজা করিবার পয়সা নাই, ঢেউ খাইবার ভরসা নাই, এমন লোকও সমুদ্রকে একবার সেলাম না করিয়া দেশে ফিরিবে না। আমি প্রায়ই দুপুরবেলা সমুদ্রের ধারে গিয়া বসিয়া থাকিতাম, তখন এইসকল লোককে দেখিতে আমার বড়ই ভালো লাগিত। উহাদের অনেকেই দূর দেশ হইতে আসিয়াছে হয়তো খোকাখুকি, অথবা ছোট ভাই বোন, না হয় আর কেহ। উহাদের জন্য দু-একটি সুন্দর উপহার প্রায় সকলেই কিনিয়াছে। রঙ্গিন বাঁশের ছাতা, সরু সরু বেত,বিচিত্র বর্ণের থলে এইরূপ দু-একটি জিনিস প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে। পুঁটুলির ভিতর হয়তো আরো কত জিনিস আছে। কেহ কেহ আবার দুটি করিয়া ছাতা কিনিয়াছে। বাঁশের ছাতা গুটাইবার জো নাই;কাজেই দুটিকেই মাথায় দিয়া চলিতে হইতেছে। তাহাতে চেহারাখনি খুলিয়াছে ভালো। মাঝে মাঝে আবার এক একজনের মাথায় এক একটা কড়া। তাহাতে ছাতার কাজও চলিতেছে, টুপির কাজও হইতেছে, আবার দরকার হইলে রান্নার কাজও চলিবে।

 ইহারা যে কতখানি কৌতুহল আর আগ্রহের সহিত সমুদ্র দেখিতে আসিয়াছে, তাহা ইহাদের মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। আর সমুদ্রকে দেখিয়া যে তাহারা কিরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছে তাহাও উহাদের সম্ভাষণেই প্রকাশ! হা রে! সমুদ্রের মহারাজ। ইহারা সাধারণত দূর হইতে সমুদ্রের প্রতি ভক্তি দেখাইয়াই চলিয়া যায়। কদাচিৎ দুই-একজন কাছে যাইতে সাহস করে। যাহারা কাছে যায়, তাহদের উদ্দেশ্য একটু সমুদ্রের জল তুলিয়া মাথায় দেওয়া। একাজটি অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। যেদিন সমুদ্রে ঢেউ বেশি থাকে, সেদিন এরূপ করিতে বেশ একটু সাহসের আবশ্যক। একস্থানে দাড়াইয়া সমুদ্রের জল হাতে পাওয়া অতি অল্প সময়ই সম্ভব হয়। ঢেউয়ের সঙ্গে জল এক একবার ছুটিয়া কাছে আসে, আবার অনেকদূর হটিয়া যায়। তাহাও যে শাস্তভাবে করে, তাহা নহে। তুমুল বিক্রম আর তর্জনগর্জনের সহিত ঢেউ আসিয়া ডাঙ্গায় ভাঙ্গিয়া পড়ে;তাহা দেখিলে মনে ভয় হওয়ারই কথা। ইহার সামনে সাহস করিয়া জল লইতে যে অল্প লোকেই যায়, তাহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। আর, ইহারাও যে একটু জল ছুঁইয়া মাথায় দিতে পারলে মুহূর্তকালও সেখানে বিলম্ব করে না, এ কথা বলাই বাহুল্য।

 মানুষের দেহে যেমন মুখখানিই সকলের আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমুদ্রের এই ঢেউগুলি সেইরূপ। সমুদ্রকে দেখিতে পাওয়ার অনেক আগেই ঢেউয়ের কোলাহল শুনিতে পাওয়া যায়। এ কোলাহলের আর নিবৃত্তি নাই। যেন দেশের সব রেলগাড়ি আর ঝড়েদের মধ্যে বচসা। এদিকে হয়তো হওয়ার লেশমাত্র দেখা যায় না, কিন্তু সমুদ্রে গিয়া দেখ, ঢেউয়ের নৃত্যের বিরাম নাই। লম্বা-লম্বা ঢেউ পনেরো-কুড়ি হাত চওড়া, চারি-পাঁচ হাত উঁচু, আর একশত গজ হইতে সিকি মাইল পর্যন্ত লম্বা। কোথা হইতে ক্রমাগত তীরের সঙ্গে এই খেলা ভিন্ন উহাদের আর কোনো কাজ নাই। ঢেউটা তীরের উপর আসিয়া পড়িল, আবার তীরের ধাক্কা খাইরা ফিরিয়া চলিল। ততক্ষণে পিছন হইতে আর এক ঢেউ আসিয়া উপস্থিত, কাজেই দুটিতে ঠোকাঠুকি হইয়া গেল। তখনকার দৃশ্য দেখিতে অতিশয় অদ্ভূত। বাজপড়ার

মতন একটা ভয়ানক শব্দ হয়;আর সেখানকার জলগুলি চুরমার হইয়া তুবড়িবাজির পাহাড়ের আকারের মতন লাফাইয়া উঠে।

 দূরে সমুদ্রের ভিতরের দিকে তাকাইলে এ সকলের কিছুই দেখিতে পাইবে না। সেখানকার ঢেউ অন্যরূপ। গভীর জল ছাড়িয়া যতই কম জলের দিকে আসা যায়, ততই এই সকল তীরমুখী লম্বা-লম্বা ঢেউ দেখিতে পাওয়া যায়। ঢেউগুলি অবশ্য সমুদ্রের ভিতরের দিক হইতেই আসে;কিন্তু গভীর জলে তাহারা তেমন উচু থাকে না, কাজেই তাহারা চোখে পড়ে না। তারপর যত কম জলের দিকে আসিতে থাকে, ততই ক্রমে উচু হইয়া শেষটা ভাঙ্গিয়া পড়ে। খুব লক্ষ্য করিয়া দেখিলে বোধহয় যেন ঢেউয়ের সামনের জলের বেগ কম, এমনকি, অনেক স্থলে ঠিক বিপরীত দিকেই তাহার গতি। এই উলটামুখো জলের সহিত ঠেলাঠেলির দরুনই তীরের কাছে এমন তুমুল কাণ্ড হয়। তীরে ঠেকিয়া সকল ঢেউকেই আবার ফিরিতে হয়। ইহা হইতেই ঐ উলটামুখো জলের উৎপত্তি। ঢেউগুলি তীরে ঠেকিয়া যখন ফিরিয়া চলে, তখন তাহাদিগকে অনেক দূর অবধি স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। পথে আর একটা ঢেউয়ের সঙ্গে বিবাদ হইলেও তাহারা লোপ হয় না,বিবাদ থামিয়া গেলে আবার তাহাকে অনেকখানি অগ্রসর হইতে দেখিতে পাওয়া যায়। তবে মোটের উপর দেখা যায়, যে তীরমুখী ঢেউয়ের জোর বেশি। এই কারণেই সমুদ্রে একটা কিছু জিনিস ফেলিয়া দিলে খানিক বাদে সেটা আবার তীরে আসিয়া উপস্থিত হয়। লোকে বলে সমুদ্র কাহারো কিছু গ্রহণ করে না; যাহা দেওয়া যায়, তাহা সে আবার ফিরাইয়া দেয়।’

 খানিক আগে যে যাত্রীদের সমুদ্রকে খাইতে দিবার কথা বলিয়াছি, তাহার জিনিসপত্রও এইরূপে সমুদ্র ফেরত দেয়। খাইতে দেওয়া আর কিছুই নহে, কোনোরূপ ফল সমুদ্রে ফেলিয়া দেওয়া, তাহা হইলেই সমুদ্রের আহার করা হইল। যিনি ফল দিলেন, তিনি এ জীবনে আর সে ফল খাইতে পারিবেন না। আবার যেমন তেমন ফল দিলে হইবে না— অন্তত তাহতে পুণ্যকর্ম—নিজের অতিশয় প্রিয় ফল হইলেই হইল। সমুদ্রের ধারে যে সকল ফলের নমুনা দেখিয়াছি, আর বাজারে সমুদ্রের আহারের জন্য যেরূপ ফল বিক্রি হইতে দেখিয়াছি, তাহাতে বোধহয়, যে ছোট ছোট ভিন্ন অন্যরূপ ফল সমুদ্র মহারাজের ভাগ্যে অল্পই জুটিয়া থাকে। নচেৎ মানিতে হয় যে ভালো বড় ফল পাইলে মহারাজ তাহ ফিরাইয়া দিতে বিশেষ কুষ্ঠিত হন। আমি যে-সকল নারিকেল তাহাকে ফিরাইয়া দিতে দেখিয়াছি, তাহার আকার সাধারণত কামরাঙ্গার চাইতে বড় হইবে না, পটলের মতনও ছিল।

 তারপর সমুদ্রের ঢেউ খাওয়ার কথা। সে অতি চমৎকার ব্যাপার;তাহার কথা একটু বেশি করিয়া না বলিলে অন্যায় হইবে। সমুদ্রে নামিয়া স্নান করিতে গেলেই উহার ঢেউয়ের অত্যাচার সহ্য করতে হয়। এই অত্যাচারটি এমন বিধিপূর্বক হইয়া থাকে যে, একবার উহার আস্বাদান পাইলে আর কখনো তাহা ভুলিতে পারা যায় না। ইহাই ‘ঢেউ খাওয়া ‘, ইহাতে আমোদ যথেষ্ট আছে, উপকারও আছে, আবার আশঙ্কাও আছে। ঢেউয়ের বাড়িতে অনেকে গুরুতর আঘাত পায়, এমনকি, অনেকের মৃত্যু হয়। অনেক সময় কোনো হতভাগ্য লোক ঢেউয়ের টানে পড়িয়া জন্মের মতো অদৃশ্য হয়।

 অবশ্য এরূপ দুর্ঘটনা অনেক সময় অসতর্কতা আর সাঁতার না জানার দরুনই ঘটিয়া থাকে। ঢেউয়ের সঙ্গে লড়িতে গেলে তাহার আঘাত তো লাগিবেই। তাহার সামনে বেকুবের

মতন শরীর পাতিয়া দিলেও বিপদের আশঙ্কা আছে। ঢেউ আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাকে বাম পাশ এবং ঘাড় পাতিয়া লইতে হয়। লাফাইতে আপত্তি না থাকিলে ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে লাফাইয়া শরীরকে উহার সমান উঁচু রাখিতে পারিলেও ছোট ছোট ঢেউয়ের সময় কাজ চলিয়া যায়। বড় ঢেউ হইলে ডুব দিয়া উহার নিচে চলিয়া যাওয়াই যুক্তিসঙ্গত। ঢেউ অধিক উচু হইলে শেষে ফাটিয়া যায়। এই ফাটিবার সময় উহা হইতে বিশেষ বিপদের আশঙ্কা। এই সময়ে উহা হইতে দূরে থাকিয়া অথবা আগেই উহার নিচে চলিয়া গিয়া আত্মরক্ষা করিতে হয়। ফাটিবার পূর্বে ঢেউ হইতে কোনো ভয় নাই—অবশ্য যাহারা সাঁতার জানে তাহদের পক্ষে। যাহারা সাতার জানে না, তাহদের জলে না নামাই ভালো। সাতার না জানিয়া জলে নামার বিপদ এই যে, অল্প জলও অনেক সময় হঠাৎ অধিক জল হইয়া যায়। তখন সীতার ভিন্ন আত্মরক্ষার উপায় থাকে না। তাহা ছাড়া হাজার সতর্ক হইলেও নাড়াচাড়ার হাত এড়াইবার সাধ্য নাই। বড়-বড় ঢেউ এক একটা এমন আসে, যে তাহার সামনে আর কিছুতেই গাম্ভীর্য রক্ষা করা যায় না। সে আসিয়া তোমাকে লাটিমের মতন ঘুরাইয়া দিবে, ময়দার মতন ঠাসিয়া দিবে, তোমার অতিশয় গম্ভীর মুখখানি কখন হা করিয়া ফেলিবে, তাহা তুমি টেরও পাইবে না;ততক্ষণে সেরখানেক লোনাজল তোমার উদরস্থ হইয়া অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য তোমার মনের শান্তি নষ্ট করিয়া ফেলিবে।

 কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, যদি এমনি, তবে সে কাজ করিতে যাওয়া কেন?’ ইহার উত্তরে অনেক কথা বলা যায়।

 প্রথমত যে পুণ্য করিতে আসিয়াছে, সে লাঞ্ছনার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছে। তাহার পুণ্য চাই লাঞ্ছনা হইলে তাহাতে বরং পুণ্যের দাম বাড়িবে।

 স্বাস্থ্যের জন্য যে আসিয়াছে সে অবশ্য জল বাড়িতে লইয়া গিয়া তাহাতে স্নান করিতে পারে; কিন্তু তাহাতে উপকার কম। ঐ নাড়াচাড়ায় উপকার বেশি।

 আর ঐ লাঞ্ছনার জন্যই যে আসিয়াছে, তাহাকে ওরূপ প্রশ্ন করা তো স্পষ্টই অনাবশ্যক বোধ হইতেছে। ঐ লাঞ্ছনার ভিতরে ভারি একটা আমোদ আছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসরের বুড়োরা ঐ জলে পড়িয়া নাকাল হয়, আবার চ্যাচাইয়া হাসেও। ঢেউয়ের পর ঢেউ মাথার উপর দিয়া যাইতেছে শরীরটাকে ধোপার বাড়ি দিবার ফল অনেকক্ষণ যাবৎ হইয়া গেছে;তথাপি তাহারা উঠিতে চাহেনা। তাহার কারণ এই যে, এই নাড়াচাড়াতে তাহাদের শরীর মনে এমন একটা স্ফূর্তি আনিয়া দিতেছে যে অতি অল্প অবস্থায়ই তাহ লাভ করা যাইতে পারে।

 আমি জানি, অনেকে ইহার উলটা কথা বলেন। সমুদ্রে স্নান করিলে নাকি তাহদের গা চট্চট্‌ করে, আর চুলে নাকে মুখে কানে বালি ঢোকে, কাজেই সমুদ্রে স্নান সারিয়া আবার ঘরে আসিয়া তাহদের পরিষ্কার জলে গা ধুইতে হয়। হইতে পারে, কিন্তু আমি ওরূপ কোনো অসুবিধা ভোগ করি নাই, আর তাহদের কেন যে ওরূপ হয়, তাহারও একটি ভিন্ন অন্য কারণ খুঁজিয়া পাই নাই। সে কারণটি এই। অনেকে হয়তো সীতার জানেন না, অথবা জানিলেও হয়তো তাহারা খুব সতর্ক লোক, অধিক জলে নামিতে ইচ্ছা করেন না। ইহারা যেখানে কোমর জলের বেশি হয় না, এইরূপ জায়গায় দাঁড়াইয়া স্নান করেন। ঢেউ যখন আসে, তখন ওখানে ঐ পরিমাণ জল হয়;কিন্তু ঢেউ চলিয়া সে স্থান একেবারেই শুকাইয়া যায়। এরূপ করাতে আশঙ্কার কারণ খুবই কম; কারণ কোমর জলে যে ডুবিয়া মরিবে,

তাহার ডাঙ্গাতেই আর ভরসা কি? আমি অনেককে ঐরাপ করিতে দেখিয়াছি, আর তাহাদের দুর্দশাও দেখিয়াছি। ঢেউ আসিয়া অনেক দূর অবধি ডুবাইয়া ফেলিল, আবার হটিয়া গিয়া অনেকটা স্থান খালি করিয়া দিল। তখন ঐ খালি জায়গায় গিয়া একজন দাড়াইলেন। সে সময়ে তাহার চেহারা ঠিক পালোয়ানের মতন। ঢেউ আসিয়া উপস্থিত! তাহার ফলে মুহুর্তের মধ্যে সেই চেহারা আগে খুব ওস্তাদ বাজিকরের মতন, তারপরে উলটান কচ্ছপের মতন হইয়া গেল! ঢেউ ততক্ষণে চলিয়া গিয়াছে, আর স্নানের সখও একপ্রকার মিটিয়াছে এখন এই সুযোগে ডাঙ্গায় উঠিয়া আসিতে পারিলে হয়। কিন্তু উঠিবার চেষ্টায় কচ্ছপের অবস্থা হইতে প্রথমে ব্যাঙের, তারপর হাতির অবস্থায় আসিতে না আসিতেই পিছন হইতে আর এক ঢেউ আসিয়া তাহাকে আগের কুমিরের মতন করিয়া ফেলিল, শেষে কলাগাছের মতন করিয়া কুলের কাছে রাখিয়া গেল। সেখান হইতে নিতান্ত ঝড়ের কাকের মতন অবস্থায় ডাঙ্গায় উঠিয়া আসিলেন। বাড়ি আসিয়া ইহার কয় কলসি পরিষ্কার জলের দরকার হইয়াছিল, তাহা জানি না। যাহা হউক, তাহাতে নাকের মুখের আর কানের বালি অনেক পরিমাণ দূর হইলেও, আর চুলের বালি খানিকট কমিলেও পেটের ভিতরে যে বালি ঢুকিয়াছিল, তাহার যে কিছুই হয় নাই, এ কথা নিশ্চয়। বিচারে যত দোষ, সব অবশ্য ঐ সমুদ্র মানেরই সাব্যস্ত হইয়াছিল! ডাঙ্গার কাছের ঘোলাজল আর বালিতে যাহারা স্নান করে, তাহাদের কতকটা এইরূপ দশা হয়। ভিতরকার জল পরিষ্কার, সেখানে স্নান করিলে এ সকল অসুবিধা ভোগ করিতে হয় না। যাহা হউক, এ কথা স্বীকার করিতে হয়, যে ধারের বালিতে লুটুপাটু হওয়ার ভিতরেও অনেককে যথেষ্ট আমোদ পাইতে দেখিয়াছি। যাহার বর্ণনা উপরে দেওয়া হইয়াছে, তিনি ঐ দুর্দশার ভিতরেও প্রাণ খুলিয়া হাসিয়াছিলেন।

 আমি বলিতেছিলাম যে সমুদ্র স্নান করিতে গেলে প্রায় সকলকেই বিশেষ লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হয়;অথচ অনেকে সেই লাঞ্ছনার ভিতরেই ভারি একটা আমোদ অনুভব করেন। ইহা শুনিয়া অনেকের হয়তো সেই জর্মান সৈনিক পুরুষের কথা মনে পড়িবে। একজন সৈনিকের একশত বেতের হুকুম হইল। বেত খাইবার সময় কোথায় সে চ্যাচাইবে, না, তাহার হাসি আর থামেই না! সকলে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হইয়াছে কি? এত হাসিস কেন?” সৈনিক আরো হাসিতে হাসিতে উত্তর করিল, ‘আরে আমি নয়! যে বেত খাইবে, সে অন্য লোক!’

 ইহাতে প্রমাণ হয়, যে সুখ-দুঃখ অনেকটা মেজাজের উপরে নির্ভর করে। আমি এমন বলিতেছি না, যে বেত খাইলেও আমাদিগকে হাসিতে হইবে। কিন্তু এ কথা ঠিক, যে হড়িমুখো লোকের ভাগ্যে সুখ বেশি জোটে না। যাক, এখন আবার সমুদ্রের কথা বলি। সমুদ্রের জল আর হাওয়া উভয়ই স্বাস্থ্যকর। জলে লবণ প্রভৃতি জিনিস থাকে, আর ক্রমাগত নাড়াচাড়া পাইয়া তাহার সঙ্গে বায়ু অধিক পরিমাণে মিশিতে পায়। সেখানকার বায়ুও খুব পরিষ্কার, আর তাহাতে ওজোনের (Ozone) ভাগ বেশি। অক্সিজেন ঘন হইয়া ওজোন উৎপন্ন হয়; উহা খুব স্বাস্থ্যকর। তারপর সমুদ্রের ধারে রৌদ্রের গুণও একটু বিশেষরকম দেখা যায়। তাহা খুব উজ্জ্বল কিন্তু তত গরম নয়। ইহাতেও শরীরের উপকার আছে। এ সকলের ফল পাইতে হইলে সমুদ্রের জলে স্নান করা, আর সমুদ্রের হাওয়া খাওয়ার দরকার। সমুদ্রের ধারের বাড়িতে বাস করা, দুবেলা সমুদ্রের ধারে বেড়ানো, সমুদ্রের ধারের বালিতে বসিয়া থাকা, এ সকলের দ্বারা খুব উৎকট রোগও সারিতে দেখা যায়।

 বাড়ীটি কিন্তু যতদূর সম্ভব, সমুদ্রের কাছে হওয়া চাই। সমুদ্রের উপর দিয়া যে স্বাস্থ্যকর বায়ু বহিয়া আসে, তাহ সমুদ্রের কূল ছড়িয়া বেশি দূরে যায় না। সমুদ্রের কুল হইতে খানিক দূরে গিয়াই এই হাওয়া ক্রমে থামিয়া যায়, আর সেইখান হইতেই জ্বর জারির মুল্লুক আরম্ভ হয়। পুরীতে এ বিষয়ে খুব অসুবিধা। সমুদ্রের ধারে সেখানে বেশি বাড়ি নাই, যাহা আছে তাহার অতি অল্পই দেশী লোকেরা পায়। যাহা হউক, দু-একটা সুন্দর বাড়ি দেশী লোকদের জন্যও আছে। আর ডাকবাঙ্গালা তো আছেই, তাহার কুয়ার জলও অতি চমৎকার।

 সেখানে কুয়ার জলই খাইতে হয়। সমুদ্রের জল লোনা। সে জল খাইতে তো বিশ্রী লাগেই খাইলে গা বমিবমি করে, পেটের অসুখও হয়। যদি বেশি করিয়া ক্রমাগত খায়, তবে গলা ফুলিয়া যায়, আর আরো কত অসুখ হয়, তাহা আমি জানি না।

 আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সেখানকার ডাকবাঙ্গালার কুয়াটি সমুদ্রের খুব কাছে সমুদ্রের ধারের বালির উপরেই খোঁড়া হইয়াছে অথচ তাহার জল লোনা হওয়া দূরে থাকুক, তেমন পরিষ্কার মিষ্ট জল পুরীর আর কোনো কুয়াতে নাই!

 ডাকবাঙ্গালার জায়গাটি অতি সুন্দর। বাঙ্গালাটি সমুদ্রের বালির উপরেই, তাহার বারান্দায় বসিয়াই সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

 সমুদ্রের সৌন্দর্যের কথা আর একটু বেশি করিয়া না বলিলে হয়তো অনেকেরই রাগ হইবে, আর আমারও ভালো লাগিবে না। সমুদ্রের অনেক ব্যাপার অতি সুন্দর; দেখিলে আমোদও হয়, শিক্ষাও হয়, চোখের তৃপ্তি তো আছেই। সমুদ্রের সাধারণ দৃশ্য সূর্যোদয়, সূর্যাণ্ড, জীবজন্তু প্রভৃতি সকলের কথাই বলা আবশ্যক।

 যাহারা আর কখনো সমুদ্র দেখে নাই, তাহারা প্রথমে সমুদ্র দেখিয়া অনেক সময় নিরাশ হয়। তাহারা মনে করিয়াছিল, আরো ঢের বড় দেখিব। সমুদ্রটা ঘরের মেঝের মতন সমান নহে কচ্ছপের পিঠের মতন চিপিপানা। তাহার মাঝখানটা উঁচু হইয়া পিছনের অংশকে আড়াল করিয়া দেয়। তোমরা হয়তো বলিবে, ইহা তো অতি সহজ কথা, আমরা সকলেই জানি।’ তোমরা যে অনেক কথা জানো তাহাতে আমি কোনোরূপ সন্দেহ উপস্থিত করিতে যাইতেছি না। তোমাদের মতন থাকিতে আমরাই কি আর কম জানিতাম। গ্রামের ইজ্দি ডিস্পিক্শন অফ দি আর্থ, কমলালেবুর দক্ষিণে ২৭ মাইল চাপা জাহাজ সমুদ্রে যেতে ডুবে যায়; কোমর জলে খানিক ডোবে, মাঝারি জলে মাঝারি ডোবে, বেশি জলে মাস্তুল অবধি ডোবে” এসব আমাদের ছেলেবেলায়ও ছিল। তবে, এখন নাকি আমাদের অনেক বয়স হইয়া গিয়াছে তাই অত কথা আর চট্‌ করিয়া মনে পড়ে না। একদিন সমুদ্রের ধারে গিয়া দেখি যে জেলেরা ডোঙ্গায় চড়িয়া অনেক দূরে মাছ ধরিতেছে। এ ডোঙ্গা কিন্তু আমাদের দেশের ডোঙ্গার মতন নয় অর্থাৎ তাহা ডোঙ্গাই নয়। বাঁকা বাঁকা তিন-চার খানা আস্ত কাঠ জলে ভাসে। এই কখানাকে দড়ি দিয়া বধিলে হাতের অঞ্জলির মতন হয়, তাহার নাম কাটামারণ;তাহতেই চড়িয়া ওখানকার জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরিতে যায়। তাহার কথা পরে বলিব। এখন যাহা বলিতেছিলাম শুন। কাটামারণে চড়িয়া জেলেরা অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। ডাঙ্গার উপর হইতে দেখিলাম যে উহাদের অনেক পিছনেও সমুদ্র দেখা যায়। তারপর ডাঙ্গা হইতে নামিয়া জলের কাছে গেলাম; তখন দেখি যে সেই কাটামারণগুলির পিছনে আর সমুদ্রের ততখানি দেখা যায় না। তখন আমার সেই পুস্তকে পড়া বিদ্যার কথা

মনে হইল। যাহা মুখস্থ করিয়া রাখা গিয়াছিল, এতদিনে তাহা হাতে কলমে দেখা গেল। দেখিয়া আমার মনে হইল যে, জাহাজ আসিবার সময় কেমন হয় দেখিতে হইবে। ইহার কিছুদিন পরেই একটা জাহাজ আসিল;কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা সকালবেলায় পূর্বদিক হইতে আসাতে তাহাকে ভালো করিয়া দেখিবার সুবিধা পাই নাই। সমুদ্রের সেই অংশটা তখন সূর্যের আলোকে এমনি ঝক্ঝক্ করিতেছিল যে, সেদিকে ভালো করিয়া তাকানো গেল না। যাইবার সময় সেটা আমাকে ফাঁকি দিয়া রাত্রিতে চলিয়া গেল।

 পুরীর কাছে সমুদ্র একটুও গভীর নহে, তাই জাহাজ সেখানে কুলের কাছে ভিড়িতে পায় না, প্রায় আধ মাইল দূরে থাকে। জিনিসপত্র নৌকায় করিয়া তুলিয়া দিতে হয়, সে সকল নৌকায় দড়ির গাঁথুনি। লোনা জলে লোহা দুদিনেই মরিচা ধরিয়া ভাঙ্গিয়া যায়; সুতরাং নৌকার তক্তা জুড়িতে লোহা ব্যবহার হয় না। এইসকল নৌকায় করিয়া সমস্ত দিন ধরিয়া জাহাজে চাউল বোঝাই হইয়াছিল; আর কোনো জিনিস উঠিতে দেখি নাই। জাহাজ হইতে কোনো জিনিস সেখানে নামেও নাই।

 সমুদ্রের রঙ অতি সুন্দর। তাহা যে জমকালো তাহা নহে, কিন্তু যারপরনাই কোমল এবং সুন্দর। দেখিলে নীল রঙের কোনো দামী পাথরের কথা মনে হয়। বড়-বড় ঢেউগুলির পিঠে আসমানী রঙ, কোলে সবুজ রঙ, তাহাতে সাদা ফেনাগুলি যে কি সুন্দর দেখায় তাহা কি বলিব। লম্বা-লম্বা ঢেউগুলি যখন গড়াইয়া তীরের দিকে আসিতে থাকে, তখন তাহদের নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সেই ফেনাগুলি ফুলের মালার মতন দুলিতে থাকে।

 এইরূপ রঙ প্রায় দুপুরবেলায়ই বেশি দেখা যায়। সকালে বিকালে আকাশের রঙ অন্যরূপ থাকে, তখন সমুদ্রের রঙও অন্যরূপ হয়। সেসব রঙ দেখিতে আরো সুন্দর। কিন্তু আমি যদি এখানে তাহার বর্ণনা করিতে বসি, তবে অনর্থক পুথি বাড়িয়া যাইবে, অথচ যাহা চোখে দেখিবার ব্যাপার, মুখে বকিয়া তাহার কিছুই বুঝাইতে পারিব না।

 সকালে বিকালে সকলের চাইতে দেখিবার জিনিস সূর্যোদয় আর সূর্যস্ত। বৎসরের মধ্যে কয়েকমাস পুরীতে এই দুইটিই দেখিতে পাওয়া যায়। খুব ভোরে উঠিতে হয়। তখনো সূর্য উঠে নাই, পূর্বদিকে একটু ঝিকিমিকি দেখা দিয়াছে মাত্র। সে দিকটা ক্রমেই উজ্জ্বল হইতেছে, আর মনটাও তেমনি উৎসুক হইয়া উঠিতেছে—খালি কখন উঠিবে কখন উঠিবে এই ভাব। সে যেন আর উঠিতেই চায় না! শেষে একবার চট্‌ করিয়া একটুখানি আগুনের কণার মতো দেখা দিল। তখন তাহার চেহারা আমওয়ালা চাখিতে দিবার জন্য ছুরির আগায় করিয়া যে টুকরা বাহির করে সেইরূপ। ঢেউগুলি যেন তাহকে লইয়া লুফালুফি করিতে থাকে। ক্রমে কণার মতন, পুলির মতন, গম্বুজের মতন হইয়া শেষে হাড়ির মতন হইয়া যায়। উপরের দিকটা গোল, তারপর খানিকটা একটু সরু হইয়া তলার দিকটা আবার চওড়া। শেষটা একবার বা করিয়া জল হইতে আলগা হইয়া যায়।

 সূর্যোদয়ের ন্যায় সূর্যাভও দেখিতে খুব সুন্দর। তখনকার আকাশের রঙ প্রায়ই বেশি জমকাল হয়। চন্দ্রের উদয় অস্তও এইরূপ। তবে চাদের আলো কম, সুতরাং তাহার উদয় অস্ত তেমন উজ্জ্বল হয় না।

 কিন্তু পূর্ণিমার সময় চাঁদের আলোতে সমুদ্রের এমন একটা স্নিগ্ধ সৌন্দর্য হয় যে অনেকের নিকট তাহাই সর্বাপেক্ষা সুন্দর লাগে।

 এসব তো গেল আলোকের কথা। অন্ধকারের সময় সমুদ্র দেখিতে কেমন সুন্দর, এ কথা শুনিয়া কেহ হাসিবেন না। খুব অন্ধকার রাত্রিতে সমুদ্রের জলে একপ্রকার আলোক দেখা যায়। অবশ্য উহা হইতে প্রদীপের আলোর ন্যায় আলো বাহির হয় না; খালি জলে একরকম ঝিকিমিকি মাত্র দেখা যায়। ঢেউ ভাঙ্গিবার সময় মনে হয় অসংখ্য জোনাকী জলের উপর ছড়াইয়া পড়িতেছে। আমি দেখিতে পাই নাই, কিন্তু যাহারা দেখিয়াছেন তাহারা বলেন যে, তাহা ভারি সুন্দর। সমুদ্রের জলে নাকি একরকম জীবাণু আছে, তাহা নাড়া পাইলে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এই জীবাণু ঐরূপ আলোকের কারণ।

 জীবাণুর কথায় জীবজন্তুর কথা সহজেই মনে হইতে পারে; সুতরাং এখন তাহার কথা বলাই সঙ্গত মনে হইতেছে।

 সমুদ্রের জীব বলিলেই সকলের আগে আমার কাঁকড়ার কথা মনে হয়। তারপর শামুক ঝিনুকের কথা, তারপর মাছের কথা ও যাহারা মাছ ধরে তাহদের কথা।

 কাঁকড়া আর শামুক ঝিনুকের কথা আগে মনে হইবার কারণ এই যে, সমুদ্রের ধারে গেলেই ঐগুলিকে দেখিতে পাওয়া যায়। সমুদ্রের ধারে বেড়াইবার অর্ধেক আমোদ উহাদিগকে লইয়া। দুঃখের বিষয় অন্য অনেক স্থানে যেমন নানরকমের সুন্দর-সুন্দর শামুক ঝিনুক পাওয়া যায়, পুরীতে তেমন নাই। তথাপি যাহা আছে তাহার মতন সুন্দর শামুক ঝিনুক আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। সে সকল ঝিনুকের এমন সুন্দর রঙ আর এমন সুন্দর গড়ন যে দেখিলেই কুড়াইতে ইচ্ছা করে। আমরা অনেক ঝিনুক কুড়াইয়াছিলাম।

 কাঁকড়ার কথা আর কি বলিব! এমন সরেস জন্তু আর যে খুব বেশি আছে এ কথা আমি বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি। সমুদ্রের ধারের বালিতে প্রথমে তাহদের পায়ের দাগ দেখিতে পাই। একটা ছোট গোলার গায় লম্বা-লম্বা কাটা বিধাইয়া সেই কাটাসুদ্ধ গোলাটাকে গড়াইয়া দিলে যেমন দাগ পড়িতে পারে, সেইরূপ দাগ। একটা দুটা নয়, অসংখ্য। যেদিকে চাও খালি ঐরূপ দাগ। আমি তো অবাক হইয়া গেলাম। এরূপ অদ্ভুত চিহ্ন কিসের হইতে পারে, তাহা আমার মাথায়ই আসিল না। খানিক অগ্রসর হইয়া দেখিলাম যে, এইরূপ এক সার দাগ একটা গর্তের কাছে গিয়া উপস্থিত হইয়াছে, আর গর্তের মালিকও দরজায় বসিয়া আছে। কিন্তু আমাকে দেখিয়া সে বেচারা এত তাড়াতাডি গর্তের ভিতর ঢুকিয়া গেল যে, আমি ভালো করিয়া তাহার পরিচয়ই লইতে পারিলাম না।

 আমি প্রথমে মনে করিয়াছিলাম বুঝি মাকড়সা। আকারে একটা মাঝারি মাকড়সার চাইতে বেশি বড় হইবে না, আর রঙটাও কতকটা সেই রকমের। সে যে কাকড়া, তাহা আমার আদবেই মনে হয় নাই, কারণ কাকড়া এমন ছুটিতে পারে তাহা আমি জানিতাম না। যাহা হউক আমার ভ্রম দূর হইতে বেশি সময় লাগিল না। কারণ উছার আশেপাশে ঐরাপ আরো অনেক গর্ত ছিল, আর প্রায় অনেক গর্তের দরজায় এক একটি ছোট্ট কাকড়াও বসিয়াছিল। উহারা যে কিরূপ বিস্ময় এবং কৌতুহলের সহিত আমাকে দেখিতেছিল তাহা না দেখিলে বুঝিতে পরিবে না। কাকড়ার মুখশ্রীতে বিস্ময় কৌতুহল প্রভৃতি ভাব প্রকাশ পাওয়া সম্ভব নহে, এ কথা তোমরা বলিবার পূর্বেই আমি স্বীকার করিতেছি। তথাপি ঐ সময়ে উহাদের নিতান্তই কৌতুহল হইয়াছিল, এ কথা আমি নিশ্চয় বলিতে পারি। উহাদের অনেকেই আমাকে দেখিবার জন্য গর্ত ছাড়িয়া খানিক অগ্রসর হইয়া আসিয়াছিল, আর আমি

একটু নড়িলে চড়িলে উহারাও তাহার সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল।

 কাঁকড়ার চেহারা দেখিলে আমার ভারি হাসি পায়। প্রথমত উহার চক্ষু দুটি। এক একটি চোখ এক একটি বেঁটার আগায় বসান। ঐরাপ দুই চক্ষু দিয়া যখন সে তোমার দিকে তাকাইবে, তখন তোমার মনে হইবে যেন তোমাকে ভালো করিয়া দেখিবার জন্য সে দূরবীন লাগাইয়াছে। ভয়, বিস্ময় বা কৌতুহল হইলে চোখ কেমন বড় হইয়া উঠে দেখিয়াছ? হঠাৎ দেখিলে মনে হয়, যেন চোখ দুটি একটু বাহির হইয়া আসিয়াছে। বোধহয়, এইজন্যই কাকড়ার চেহারায় এতটা কৌতুহলের ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার পর উহার দুটি গোদা হাত, অর্থাৎ দাঁড়া। আমি যে কাঁকড়াগুলির কথা বলিতেছি, তাহাদের আবার একটি দাঁড়া আর একটির চাইতে ঢের বড়। কাহারো ডাইনেরটি বড় কাহারো বামেরটি বড়। বেশি ভারী কাজ হইলে বড় দাডাটা ব্যবহার করে। ছোটটি হালকা কাজের জন্য। কাকড়ার মুখ তাহার বুকের কাছে দাঁড়ায় করিয়া তাহাতে খাবার তুলিয়া দেয়। আমরা যেমন করিয়া হা ঁকরি, কাকড়া তাহা করে না; তাহার ঠোট আলমারীর দরজার মতন পাশাপাশি খোলে।

 বালির উপরে কত কাঁকড়ার গর্ত যে রহিয়াছে তাহার সংখ্যা নাই। কাছে গেলেই উহারা ভয় পাইয়া গর্তের ভিতরে চলিয়া যায়। কিন্তু যদি কোনোরূপ গোলমাল না করিয়া চুপচাপ বসিয়া থাক, তাহা হইলে খানিক পরেই উহারা আবার বাহিরে আসিবে। গর্তটিকে পরিষ্কার রাখা উহাদের এক প্রধান কাজ। সকলের গর্তের সামনেই খানিকটা নুতন মাটি দেখিতে পাইবে। হয়তো তোমার চোখের সামনেই আবার খানিকটা মাটি আনিয়া উহার উপরে ফেলিবে। দুহাতে সাপটিয়া ধরিয়া গর্তের ভিতর হইতে মাটি লইয়া আসে। দরজার বাহিরে আসিয়াই তাহা ছুঁড়িয়া দূরে ফেলিয়া দেয়। কাঁকড়ার পক্ষে অনেকখানি দূরেই ফেলে বলিতে হইবে। মাকড়সার মতন বড় কাকড়াটি মটরের মতন বড় একরাশ মাটি প্রায় ছয় ইঞ্চি দূরে ফেলিতে পারে। মনোযোগ দিয়া দেখিলে দেখা যায় যে, মাটি ছুড়িয়া ফেলিবার সময় বড় দাঁড়াটিকেই বেশি ব্যবহার করে।

 গর্তের সামনে কোনো একটি ছোট জিনিস ছুঁড়িয়া ফেলিলে কাঁকড়া তাড়াতাড়ি তাঁহার কাছে ছুটিয়া আসে। তারপর বেশ করিয়া সে জিনিসটাকে হাত বুলাইয়া দেখে; পছন্দ হইলে তাহাকে তুলিয়া মুখে দেয়। একদিন আমি লম্বা সূতায় রুটির টুকরা বাঁধিয়া দিয়াছিলাম। একতা কাঁকড়া আসিয়া সেটাকে পরীক্ষা করিলে, তারপর তাহাকে টানিয়া গর্তের ভিতরে লইয়া গেল। গর্তটা বেশ গভীর ছিল:প্রায় সওয়া ফুট সূতা ট্যারছাভাবে ভিতরে ঢুকিয়া গেল তারপর আমি সূতা ধরিয়া টানিলাম। সহজ টানে কি তাহা বাহির হয়! কাকড়াটা বোধহয় কিছুতেই রুটিটুকুকে ছাড়িয়া দিতে প্রস্তুত ছিল না;তাই সে যতক্ষণ পারিল প্রাণপনে তাহাকে আকড়িয়া ধরিয়া রাখিল। শেষে অগত্যা রুটির সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত। তখনো সে তাহা ছাড়ে নাই। ঐটুকু খাদ্যের মায়ায় সে এতটা ভুলিয়া গিয়াছিল যে, এদিকে আমি যে তাহাকে একেবারে আমার কাছে টানিয়া আনিয়াছি তাহা সে যেন বুঝিতেই পারে নাই। অবশেষে হঠাৎ একবার যখন রুটির সঙ্গে সঙ্গে সে শূন্যে ঝুলিতে লাগিল, তখন তাহার চৈতন্য হইল। এবারে রুটি ছাড়িয়া দিয়া যে গর্তের ভিতরে ঢুকিল শত প্রলোভনেও আর সে বাহিরে আসিল না।

 ইহারা কেমন ছোটে, তাহা আগেই বলিয়াছি। ভালো মানুষের মতন সোজাসুজি সামনের

দিকে যে চলে তাহা নহে, সে চলিবে পাশাপাশি—দেখিলেই তাড়া করিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তাড়া করিতে গেলে দেখা যায় যে তাহাকে ধরা কাজটি বড় সহজ নহে। তুমি খুব চট্পটে শয়তান গোছের লোক হইলে অবশ্য শেষে তাহকে ধরিতে পার, কিন্তু তাহার পূর্বে সে তোমাকে একশো ফাকি দিয়া হাজার ঘুরপাক খাওয়াইয়া তবে ছড়িবে।

 এই জাতীয় কাঁকড়া যেমন ছুটতে পারে, তেমনি আবার এমন কাঁকড়া ও আছে যে তাহারা ছুটিবে দূরে থাকুক, শুকনো মাটিতে চলিতেই পারে না। একদিন সমুদ্রের ধারে গিয়া দেখি যে ইহাদের একজন চিৎপাত হইয়া পড়িয়া আছেন। দেখিতে বেশ গাট্টা-গোটা জোয়ান কাঁটালের মতন কাঁটাওয়ালা খোলা পরিয়া সঙ্গিন সিপাই সাজা হইয়াছে। কিন্তু এদিকে দুরবস্থার একশেষ। কখন কে চিৎ করিয়া রাখিয়া গিয়াছে তদবধি সেইভাবেই রহিয়াছেন; সোজা হইবার শক্তিটুকু নাই। দেখিয়া আমার হাসিও পাইল, দয়াও হইল। চেহারাটি আবার অতিশয় উৎকট, গায় হাত দিতে ভরসা হয় না। সুতরাং আমি ছাতার আগা দিয়াই উলটাইয়া দিলাম। কিন্তু খালি উলটাইয়া দিলে কি হইবে, যদি হাঁটিবার ক্ষমতা না থাকে। নৌকার দাড়ের মতন কখানি পা; তাহাতে সাঁতার কাটিবার পক্ষে যতই সুবিধা হউক, ডাঙ্গায় চলার কাজ একেবারেই চলে না। দুই পা না যাইতে যাইতেই আবার ডিগবাজি খাইয়া যেই চিৎ সেই চিৎ। ইহার পরে ঐরূপ আরো অনেক কাকড়া জেলেদের জালে ধরা পড়িতে দেখিয়াছি, এ কাঁকড়া কেহ খায় না, সুতরাং জেলেরা এগুলিকে ফেলিয়া দেয়। যেটাকে যেখানে ফেলে, সেটা আর সেখান হইতে দূরে যাইতে পারে না। কারণ হাঁটতে গেলেই উলটাইয়া যায়, আর সেইভাবেই তাহাকে পড়িয়া থাকিতে হয়। জালে আর একরকম কাঁকড়া ধরা পড়ে, তাহার স্বভাব একটু আশ্চর্য রকমের। এই কাকড়ার খোলা নাই, অথচ খোলা না থাকিলে কাকড়ার বাচিয়া থাকাই ভার হয়। তাই সে বিস্তর বুদ্ধি খরচ করিয়া বেশ এক ফন্দি ঠাওরাইয়াছে। সমুদ্রে শঙ্খ শামুক ইত্যাদির খালি খোলার অভাব নাই। এই কাকড়া এইরূপ একটা খালি খোলার ভিতরে ঢুকিয়া থাকে। নরম শরীরটির সমস্ত খোলার ভিতরে; কেবল হাত পা গুলি বাহিরে থাকে, তাহাও ইচ্ছা করিলেই গুটাইয়া লইতে পারে। এইরূপে পরের খোলা পরিয়া ইহারা জীবন কাটাইয়া দেয়, চলাফেরা সমস্তই ঐ খোলাসমেত হইয়া থাকে। যেন সেটা তার নিজেরই খোলা। আমি এইরূপ যতগুলি কাঁকড়া দেখিয়াছি, তাহদের সকলেই লম্বা-লম্বা কাঁটাওয়ালা একরকম ছোট শঙ্খের ভিতরে ছিল। কাটা থাকায় অন্য কোনো জন্তু আসিয়া খপ করিয়া তাহাদিগকে গিলিয়া ফেলিবার ভয় ছিল না। এই কাকড়ার নাম সন্ন্যাসী কাঁকড়া (Hermit carb)।

 জালের আর কাঁকড়ার কথা যখন উঠিয়াছে, তখন মাছের কথাও উঠিবে। মাছ সেখানে সমুয়েও ধরা হয়, আর নদী বিল পুকুর ইত্যাদিতেও ধরা হয়। তাহাকে বলে ‘মু-ধু-র’ মাছ। ('মধুর’ পড়িও না। 'মু-ধু-র’। উড়িষ্যার সব কথাই ‘কটক বড় মড়ক'-এর মতন করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়, হসন্তের ব্যবহার সে দেশে প্রায় নাই।) ইহা ছাড়া চিল্কা হ্রদ হইতেও মাছ আসে। নদী প্রভৃতিতে আমাদের দেশের সাধারণ মাছের মতন মাইথাকে, তাহার কথা আর বেশি করিয়া কি বলিব। চিল্কার মাছের চেহারাও অনেকটা এইরাপ সুতরাং সমুদ্রের মাছের কথাই আজ বলা যাউক।

 সমুদ্রের মাছের নাম শুনিয়াই হয়তো তোমরা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছ। মনটাকে হয়তো কত বড়-বড় জিনিসের জন্য প্রস্তুত করিয়া লইতেছে। সমুদ্রের বড়-বড় জন্তু অনেক আছে,

তাহাতে আর ভুল কি? দুটা একটা তিমি যে বঙ্গোপসাগরে না দেখা যায় এমন নহে; তাহার প্রমাণ তো জাদুঘরে গেলেই দেখা যায়। কিন্তু আমি এখানে পুঁথি খুলিয়া গল্প ফাঁদিতে বসি নাই, যাহা দেখিয়াছি, তাহাই বলিতে যাইতেছি, সুতরাং ‘সমুদ্রের সাপ’ (Sea Serpent) তিমি প্রভৃতির কথা বলার অবসর আমার হইবে না। আমি যে সমুদ্রের সাপ দেখিয়াছি, তাহা সাড়ে তিন হাতের অধিক লম্বা হইবে না। দেখিতে কতকটা ঢোঁরা সাপের মতো। গায়ে ডুমোডুমো দাগ আছে, লাজটা চ্যাটাল। এইরূপ একটা সাপ সমুদ্রের ধারে মরিয়া পড়িয়ছিল। সমুদ্রের সাপগুলির ল্যাজ প্রায়ই চ্যাটাল হয়, তাহাতে সাঁতরাইবার খুব সুবিধা। যা হউক আমি মাছের কথাই এখন বলিব। তবে মাছ শব্দটা এখানে একটু খোলাভাবেই ব্যবহার হইতেছে। এরূপ অনেক জানোয়ার যে তাহদের চৌদ্দ পুরুষের কেহ মাছের ধার ধারে নাই, অথচ তাহারা মাছ। যেমন জেলী মাছ, চিংড়ি মাছ, কট্‌ল মাছ ইত্যাদি। ইহাদের কেহ শামুক, কেহ পোকা, আর কেহ যে কি তাহা এক কথায় বলা ভারি মুশকিল। যাহা হউক লোকে উহাদিগকে মাছই বলে, সুতরাং আমিও তাহাই সুবিধাজনক মনে করিতেছি।

 সমুদ্রের মাছ হইলেই যে আমাদের দেশী মাছের চাইতে অনেক ভিন্ন হইবে এমন কোনো কথা নাই। তাহার প্রমাণ এই যে, ইলিশ মাছ সমুদ্রেরই মাছ, সেখান হইতে নদীর ভিতর দিয়া এখানে আইসে। চাঁদা মাছ, ফ্যাসা মাছ চ্যালা মাছ ইত্যাদি সমুদ্রে বিস্তর আছে। বাস্তবিক এইরূপ ঝকঝকে রুপোলি রঙের মাছই সেখানে বেশী দেখিলাম। এইসকল মাছ এক এক দিন জাল বোঝাই হইয়া উঠিতে দেখিয়াছি। রুই, কাতলা জাতীয় মাছ দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।

 যত মাছ দেখিয়াছি দুঃখের বিষয় তাহার সবকটার নাম শিখিয়া আসিতে পারি নাই। চ্যালার নাম ‘খণ্ড বানিয়া’, তাহার এক একটা প্রায় এক ফুট লম্বা হয়। খাইতে নেহাত মন্দ নহে, কিন্তু বাপ রে! তাহাতে কাঁটা, কি কাঁটা! ‘কো-কি-র’ খয়রা মাছের মতন। পিঠের রঙ কালচে। খাইতে বেশ। ‘চাঁদি’ হচ্ছে চাঁদা। ইহা সমুদ্রের এক উৎকৃষ্ট মাছ। চাঁদির অনেক প্রকার ভেদ আছে। ছোট, বড়, সাদা, পাশুটে সকলরকম চাদিই খাইতে ভালো, তবে বড়গুলিরই প্রশংসা বেশি। একরকম ছোট-ছেট চাঁদি আছে, সে যে দেখিতে কি সুন্দর তাহা কি বলিব! রঙটি যেন ঠিক মুক্তার মতন, আর দেখিতে এত কোমল এবং পরিষ্কার যে মনে হয়, যেন তাহাকে অমনি খাওয়া যাইবে। উহার ঝোল চমৎকার লাগিত। সমুদ্রের বেলে মাছের নাম ‘মেইলা’। ইহার গায়ের চেহারা বেলের মতো,ইহার পেটের ভিতরটি পরিষ্কার, কিন্তু মুখ চল আর দাড়ি গোফ একেবারেই নাই। ‘বেদ’ মাছ বলিয়া আর একটা মাছ আছে, দাড়ি গোঁফ আর চেহারার জাকজমকে সে বেলে মাছকে পরাস্ত করিয়াছে। উজ্জ্বল হলদে রঙের পরিপাটিতে কালো কালো দাগ; দেখিতে খুব জমকাল—আরো বড় হইলে (লম্বায় দশ ইঞ্চি আন্দাজ হইবে) ভয়ঙ্কর বলা যাইত। এ মাছ কেহ খায় না। জেলেরা উহাকে ধরিয়া ফেলিয়া দেয়। আর একটা অখাদ্য মাছের নাম ‘বে-ঙ’ মাছ। এ মাছ খুব ছোট ট্যাংরা মাছের মতন। মুখের চেহারা অনেকটা ব্যাঙের মতন। চোখ উঁচু-উঁচু, রঙ হলদে, অন্ধকার রাত্রিতে নাকি এ মাছ ঝক্‌ঝক্ করে, আর ইহা খাইলে নাকি অসুখ করে। তারপর শিরোমুণ্ডী মাছ। আমাদের চাকর বলিয়াছিল ‘রসমুণ্ডী’। তাহা শুনিয়া তোমরা হয়তো ভাবিতেছ মাছটা খাইতে বুঝি বড়ই সুস্বাদ। স্বাদের কথা বলিতে পারি না, কিন্তু তাহার গন্ধের কিঞ্চিৎ পরিচয় পাইয়াছি। সে কিরূপ পরিচয় তাহা এ কথা বলিলেই বুঝিতে পারবে যে ঐ মাছ কুটিয়া যে ঘটি লইয়া হাত ধুইয়াছিল, সে

ঘটি আর সেদিন কেহ ব্যবহার করিতে পারে নাই, মাছ খাওয়া তো দূরের কথা।

 সে দেশে হাঙ্গরের নাম ‘ম-গ-র’ (মকর)। এদেশে হাঙ্গরে মানুষ খায়, আর সেদেশে মানুষে হাঙ্গর খায়। হাঙ্গরও মানুষকে বাগে পাইলে তাহার ‘গোড় কাটি পক্কাই'তে (পা কাটিয়া নিতে) ছাড়ে না। ‘হাতুড়ে’ হাঙ্গরের মাথাটা ঠিক যেন একটা হাতুড়ির মতন, সেই হাতুড়ির দুই মুখে দুটি চোখ। সুখের বিষয় এই যে, বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে বড়-বড় মানুষখেকো হাঙ্গর কুলের কাছে আসে না। তবে দূরে গভীর জলে যে ভয়ানক রাক্ষস সব আছে, তাহার প্রমাণ প্রায়ই পাওয়া যায়। একদিন দুপুরবেলা আমি সমুদ্রের ধারে বসিয়া আছি, এমন সময় প্রায় মাইলখানেক দূরে একটা প্রকাণ্ড মাছ লাফাইয়া উঠিল। এতদূর হইতে মাছটাকে একটা মানুষের সমান বড় দেখা যাইতেছিল। সেটা লাফাইয়া জল ছাড়িয়া প্রায় দশ হাত উঁচুতে উঠিয়াছিল। ইহা দেখিয়া আমার মনে হইল, যে না জানি কতদূর বেগের সহিত সে ছুটিয়াছিল, যাহাতে এমন ভয়ানক লাফ দিতে পারিয়াছে। আর যাহার তাড়ায় এমন অসম্ভব বেগে ছুটয়াছিল, সেটা না জানি কিরূপ ভয়ানক জানোয়ার।

 আর একটা মাছ আছে তাহার নাম ‘শাকস্’ মাছ। ইহার চেহারা ভারি অদ্ভুত। শরীরটি রুইতনের টেক্কার মতন। তাহার দুই কান হাতির কানের মতন পাতলা। আর এক কোণে ছোট-ছোট দুটি চোখ, আর এক কোণে চাবুকের মতন লম্বা কাঁটাওয়ালা এক লেজ। ঐ লেজ উহার এক ভয়ানক অস্ত্র। উহা দ্বারা অনেকে চাবুক তয়ের করে। শাকস্ মাছের মাংস নাকি বেশ সুখাদ্য।

 ইংরাজিতে যাহাকে ‘সোল’ (Sole) বলে, সেই জাতীয় মাছও সেখানে পাওয়া যায়। এই মাছের চোখ একপেশে। মাছটি চাঁদা মাছের মতন পাতলা। ছেলেবেলায় উহার দুটি চোখ দুপাশেই থাকে আর রঙ সাদা থাকে। কিন্তু ইহার ক্রমাগত বালির উপরে এক পাশে কাৎ হইয়া পড়িয়া থাকার স্বভাব হওয়াতে শেষটা নীচের পাশের চোখটি ক্রমে উপরের পাশে চলিয়া আসে। তাহা ছাড়া উপরের পাশের রঙটি ক্রমে চারিপাশের বালির রঙের মতন হইয়া যায়, কিন্তু নীচের পাশের রঙ সাদাই থাকিয়া যায়।

 বোধহয় মাছের কথা ঢের বলা হইয়াছে। এখন যাহারা মাছ নয়, অথচ মাছ বলিয়া পরিচিত হইয়া গিয়াছে, তাহদের কথা কিছু বলা আবশ্যক।

 ইহাদের মধ্যে সকলের আগে ‘জেলী’ মাছের (Jelly fish) আর ‘তারা’ মাছের (Star fish) কথা বলিতে হয়। জন্তুর মধ্যে ইহারা সকলের চাইতে নিম্নশ্রেণীর। সাধারণ লোকে ইহাদিগকে দেখিয়া কখনই বলিবে না, যে ইহারা কোনোরূপ জন্তু। বরং ইহাদের চেহারা দেখিলে হঠাৎ গাছপালার কথাই মনে হইতে পারে। যাহা হউক, ইহারা জন্তু। ইহাদের আবার নানারকম শ্রেণীভেদ আছে, যদিও আমি একরকম তারা মাছ সেখানে দেখিতে পাই নাই। এই মাছের চেহারা পাঁচ কোণা তারার মতন। তাহার নাক মুখের কোনোরূপ পরিচয় পাওয়া যায় না। ইহাদের স্বভাব-চরিত্র অতিশয় আশ্চর্য। দুঃখের বিষয়, আমি তাহার কিছুই প্রত্যক্ষ করিতে পারি নাই, পুস্তকে পড়িয়াছি মাত্র। ইহারা ছোট-ছোট শামুক ঝিনুক খাইয়া জীবনধারণ করে। পুরীতে যে তারা মাছ দেখিয়াছিলাম, তাহার ভিতরে খুব ছোট-ছোট ঝিনুকের খোলা পাইয়াছি। কিন্তু এতদ্ভিন্ন উহাদের আচার ব্যবহারের আর কোনো পরিচয় পাই নাই। এগুলি দেখিতে একটুও সুন্দর নয়। একদিকের রঙ কালো আর একদিকের রঙ ফ্যাকাসে। মনে হয়,

যেন পুরানো জুতার পচা চামড়া আর হাড়ের কুচি দিয়া তাহাকে গড়িয়াছে। কিন্তু আমি পুস্তকে পড়িয়াছি যে অতিশয় সুন্দর তারা মাছ আছে। আর তাহাদের কোনো কোনোটার এই একটা আশ্চর্য স্বভাব আছে, যে তাহারা ভয় পাইলে আত্মহত্যা করে। সমুদ্রের ভিতরে অনেক নাড়াচাড়া সহ্য করে; কিন্তু জল হইতে তুলিলেই সে দেখিতে দেখিতে তাহার হাত পা ফেলিয়া দেয়। তারা মাছের মাঝখানটায় তাহার মুখ থাকে; চারিধারের পাপড়ি অথবা ডালপালার মতন জিনিসগুলি তাহার হাত পা। কোনো কোনোটা সাঁতরাইতে পারে, শিকার আঁকড়িয়া ধরিতেও পারে। কিন্তু কোনো কোনোটার হাত পা নাড়িবার বেশি ক্ষমতা আছে বলিয়া বোধহয় না। আবার চলাফেরা করিতেই পারে না, একটা বোঁটা দ্বারা কোনো জিনিসের গায়ে আটকানো থাকে, এরূপ তারা মাছও আছে।

 জেলী মাছ সেখানে অনেকরকম আছে। আকারে আধুলি হইতে ঝুড়ির মতন পর্যন্ত জেলী মাছ দেখিয়াছি। ইহাদিগকে দেখিলে তালশাঁস অথবা থক্‌থকে সাগুর কথা মনে হয়। সকলগুলিরই সাধারণ আকৃতি ছাতা অথবা টুপির মতন, কোনো কোনোটা ওড়িয়া বেয়ারাদের পানের থলের মতন। আবার সকলেরই কোনোরকমের ঝালর আছে। রঙ সাদা অথবা লালচে, তাহাতে অনেক সময় সবুজ কারিকুরি থাকে। ইহারা জলে সাঁতরাইয়া বেড়ায়, আর ভয় পাইলে শরীর কোঁচকাইয়া হাত পা গুটাইয়া (ঐ ঝালর উহাদের হাত পা, মাঝখানে মুখ) সমুদ্রের তলায় পড়িয়া যায়। কোনো কোনোটা রাত্রিতে জ্বলে। অনেকগুলি আবার এমন আছে যে তাহা গায়ে লাগিলে ভয়ানক যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা কতকটা বিছুটির জ্বালার মতন, কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি, আর ইহাতে বুকের ভিতরে কেমন একটা কষ্ট বোধহয়। জালে পড়িয়া বিস্তর জেলী মাছ উঠে; জেলেরা জেলী মাছকে বলে ‘সৎরাং’। ইহাদের ইংরাজি নাম ‘জেলী ফিশ’ আর ‘সাগর বিছুটি’ (Sea nettle)। ইহাদের কোনোটা নির্দোষ আর কোনোটা বিষাক্ত, জেলেরা তাহা বেশ বুঝিতে পারে। সাধারণত তাহারা এগুলিকে দুহাতে ঘাঁটে, রাঁধিয়া নাকি খায়ও। কিন্তু একদিন একটা খুব উজ্জ্বল স্বচ্ছ আর সবুজ কারিকুরিওয়ালা জেলী মাছ দেখিয়া যেই তাহার কাছে গিয়াছি, অমনি একজন জেলে আমাকে নিষেধ করিয়া বলিল, ‘বাবু, বিন্ধিব।’ অবশ্য আমি আর তাহার কাছে যাই নাই। আর আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, যে উহার চেহারা আমি কখনো ভুলিব না। অতঃপর আবার তাহাকে দেখিতে পাইলে আমিও বলিতে পারিব—‘বিন্ধিব'। এরপর ‘কট্‌ল্‌’ মাছের (cuttle fish) কথা বলি, তবেই শেষ হয়। এ মাছ যে, মাছ নয়, তাহা তো বলিয়াই রাখিয়াছি। ইহারা শামুক জাতীয় জন্তু; কিন্তু শামুকের মতন ইহাদের খোলা নাই, যদিও একটা নরম গোছের হাড় আছে। এই হাড় সমুদ্রের ধারে অনেক দেখিতে পাওয়া যায়। সাদা-সাদা শশা বিচির মতন আকৃতি, কিন্তু শশা বিচির চাইতে ঢের বড়। এক ইঞ্চি হইতে আট ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হাড় সচরাচর দেখা যায়। অন্যান্য জন্তুর হাড়ের মতন ইহা তত মজবুত নহে। কতকটা খড়ির মতন সহজেই গুঁড়া হইয়া যায়। সাধারণ লোকে যত্নপূর্বক এই হাড় কুড়াইয়া আনে, বাজারে বিক্রয়ও করে। এই হাড়ে নাকি অনেক ভালোভালো ঔষধ প্রস্তুত হয়। ইহার চলিত নাম ‘সমুদ্রের ফেনা’। অনেকের বিশ্বাস, সমুদ্রের ফেনা জমিয়া এই জিনিস জন্মায়। আসলে অবশ্য তাহা নহে, ইহা কট্‌ল্‌ ফিশের হাড়। ইংরাজিতে এ জিনিসকে ‘কট‌্ল‌্ বোন‌্’ (cuttle bone) বলে।

 সেবারে আমি সবে কট্‌ল্ ফিশের কথা পড়িয়াছিলাম, আর বলিয়াছিলাম, উহাতে ঔষধ হয়। ঐ হাড়ের গুঁড়া পালিসের কাজে লাগে; অনেকে উহা দিয়া দাঁত মাজে।

 জাত বিশেষে কট্‌ল্ ফিশ এক একটা খুব বড় বড়ও হয়, কিন্তু আমি নিতান্ত ছোট-ছোটই দেখিয়াছি। উহাদের অবশ্য কোনোরকম দেশী নাম আছে; দুঃখের বিষয় আমি তাহা জানি না। একটি জেলের ছেলে চার পাঁচটা কট্‌ল্ ফিশ হাতে করিয়া সমুদ্রের ধারে দাঁড়াইয়াছিল, তাহা দেখিয়া আমি উহার সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ওগুলো কি?’ উদ্দেশ্য, নামটা শিখিয়া লই। ছেলেটি বড় ভীতু, কেমন জড়সড় হইয়া উত্তর দিল। তাহাতে নাম যদি বলিয়াও থাকে, আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই। আমি খালি এই কথাটা একটু বুঝিলাম, যে সে তাহা দিয়া ‘তরকারি পাকাইবে’। সবে আমার এইটুকু জ্ঞানলাভ হইয়াছে, আরো ঢের হইবে বলিয়া আশা করিতেছি, এমন সময় কোথা হইতে এক সাহেব আসিয়া আমার সব গোলমাল করিয়া দিল। সে বলে, ওটা নিতান্ত নিম্নশ্রেণীর মাছ। আমি বলিলাম ওটা মাছ নয়, শামুক জাতীয় জন্তু। সাহেব আমার সে কথায় আমলই দিল না। ততক্ষণে সেই ছোকরা কোথায় যে সরিয়া পড়িল, আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না।

 সেই কট্‌ল্ মাছগুলিকে দেখিয়া আমার ছোট-ছোট শুকনো কচুগাছের কথা মনে হইয়াছিল। শরীরগুলি যেন মুখী কচু (রঙ কিন্তু ঘোর খয়েরি) আর হাত পা গুলি যেন তাহার শুকনো ডালপালা। এক একটার এইরূপ আটটি কি দশটি করিয়া হাত (অথবা পা, যাই বল) থাকে। আমি যাহা দেখিয়াছি, তাহার কটা হাত ছিল, গুনিবার অবসর পাই নাই; কিন্তু উহার আকৃতি যেরূপ দেখিলাম তাহাতে বোধ হইল, যেন উহার দশ হাত। আর, দুটি হাত যেন অন্যগুলির চাইতে বেশি লম্বা বলিয়া বোধ হইয়াছিল; ইহাও দশ হাতওয়ালা কট্‌ল্‌ ফিশের একটা লক্ষণ। কট্‌ল্‌ ফিশের বড়-বড় উজ্জ্বল দুটো চোখ, আর টিয়া পাখির মতন ঠোঁটও আছে। ঠোঁটটি কিন্তু হাত পায়ের জঙ্গলের ভিতরে লুকানো থাকে বলিয়া দেখিতে পাওয়া যায় না।

 এ জন্তুগুলি যেন সমুদ্রের সঙ। অনেক দেশ ইহাদিগকে ‘শয়তান মাছ’ (devil fish) বলে। বাস্তবিক এমন বিকট বিদ্‌ঘুটে চেহারা আর কোনো জন্তুর আছে কিনা সন্দেহ। চালচলন আবার চেহারার চাইতেও অদ্ভুত। আট দশটা পা থাকিলে তাহার চলাফেরা সম্বন্ধে অন্তত আমাদের সাদাসিধা হিসাবে আর কোনো ভাবনার কথা থাকে না। কিন্তু ইহারা এতগুলি পা লইয়াও সন্তুষ্ট নহে; উহাদের আরো একরকম চলিবার কায়দা চাই। পাগুলি দিয়া পায়ের কাজ আর হাতের কাজ দুইই চলে; অর্থাৎ চলাফেরাও হয় আবার শিকারকে জড়াইয়া ধরাও যায়। সাধারণ চলাফেরার সময় এই পাগুলিই ব্যবহার হয়। কিন্তু পলায়নের সময় এমন পুরাতন পাড়াগেঁয়ে দস্তুর উহারা পছন্দ করে না; তখনকার জন্য একটা কোনোরূপ নূতন কায়দার নিতান্তই দরকার। সুতরাং চম্পট দিবার কাজটি দমকলে না হইলে উহাদের মন উঠে না। দমকলের বন্দোবস্ত বিধাতা উহাদের শরীরের মধ্যেই করিয়া দিয়াছেন; তাহা দ্বারা উহারা ইচ্ছা করিলেই পিচকারির মতন বেগে জল ফুঁকিয়া (অবশ্য মুখে ফুঁকিয়া নয়, সেই কলে ফুঁকিয়া) বাহির করিতে পারে। সে জলের এমনি ধাক্কা যে, সেই ধাক্কায় তীরের মতন বেগে পিছু হটিয়া উহারা তিলার্ধে অর্ধ ক্রোশ দূরে গিয়া উপস্থিত হয়।

 ইহাদের প্রত্যেকের আবার এক থলে করিয়া কালি থাকে। তেমন বেখাপ্পা গোছের

কোনো শক্র আসিলে ফস্ করিয়া তাহার সামনে একরাশ কালি বাহির করিয়া দেয়। কালিতে জল ঘোলা হইয়া গেলে শক্রর ধাঁধা লাগিয়া যায়। ততক্ষণে সে শয়তান দমকল ফুঁকিয়া কোথায় গিয়া গা ঢাকা দেয় তাহা টেরই পাওয়া যায় না। ইহার উপরে আবার ইহাদের চলাফেরার অভ্যাস রাত্রিতেই বেশি। সুতরাং ইহাদিগকে সঙ বা ভূত পেত্নী বলিলে এমন অন্যায় আর কি হয়।

 আমি পুরীতে যেমন ছোট ছোট কট্‌ল্‌ ফিশ দেখিয়াছি, তাহাতে আমার হাসিই পাইয়াছিল। কিন্তু এই জাতীয় জন্তু বড় হইলে নিতান্তই ভয়ানক হয়। একরকম আট পেয়ে কট্‌ল্ ফিশ (octopus) আছে, তাহার এক একটা হাত পা ছড়াইলে আট-দশ ফুট জায়গা জুড়িয়া বসে। এক একটা পা-ই তার দশ-বারো ফুট লম্বা, এমন অক্টোপাসও আছে। হাতির শুঁড়ের আকৃতি এক একটা পা, তাহার ভিতর দিক দিয়া ছোট ছোট বাটির মতন একপ্রকার জিনিস সার সার সাজানো থাকে। এইসকল বাটির মতন জিনিসের প্রত্যেকটি একটি জোঁকের মুখের মতন কাজ করে। অর্থাৎ যাহাতে লাগে, তাহাকেই উহারা এমন ভয়ানক চুষিয়া ধরে যে তাহার প্রাণ পর্যন্ত চুষিয়া বাহির করিবার গতিক হয়। যাহাকে একবার ধরে, তাহার কি আর রক্ষা আছে। আট হাতে জড়াইয়া ধরিয়া একটিবার ঐ ভয়ানক টিয়া পাখির ঠোঁটের মধ্যে লইয়া ফেলতে পারিলেই বেচারার জীবন শেষ হয়। এইরূপে অক্টোপাসের হাতে পড়িয়া মানুষের প্রাণ হারাইবার কথা শুনিতে পাওয়া যায়। ছোটখাটো নৌকা কট্‌ল্ ফিশের টানে উলটিয়া গিয়াছে, এরূপ ঘটনাও ঘটিয়া থাকে।

 ঐ চোষণীগুলির সাহায্যে উহারা এমন সব অসম্ভব কাজ করিতে পারে, যে লোকে তাহা দেখিয়া আশ্চর্য হয়। নিতান্ত ছোট ফাটলের ভিতর ঢুকিয়া থাকা, নিতান্ত অসম্ভব স্থানে বাহিয়া উঠা, এ সকল এবং অন্যান্য রকমেব মানুষ বাজিকরের অসাধ্য অনেক কাজ ইহারা নিতান্ত সহজভাবে প্রত্যহই করিয়া থাকে।

 ইহারা আঙ্গুরের মতন থোকা থোকা ডিম পাড়ে। শামুকেরাও ঐরূপ করে, তবে শামুকের ডিম অবশ্য খুব ছোট-ছোট। ডিমগুলিকে কোনো নিরাপদ জায়গায় আটকাইয়া রাখিয়া কট‌্ল্ মাছ অতি যত্নে পাহারা দেয়। ইহাদের শরীরের রঙ সকল সময় একরকম থাকে না, ক্রমাগত বদলায়। যে স্থানের যেমন রঙ, উহাদের শরীবের রঙও উহারা অনেকটা সেইরূপ করিতে পারে। আমি পূর্বেই বলিযাছি যে একটি ছেলের হাতে ছোট-ছেট কট্‌ল্ মাছ দেখিয়াছিলাম। আর সে বলিয়াছিল যে উহা রাঁধিয়া খাইবে। অনেকে এই জন্তুর মাংস খুব আদরের সহিত আহার করে, আর ইহাদিগকে শিকার করিবার জন্য বিস্তর ক্লেশ ও বিপদ সহ্য করে। এ সকল লোকের বাস আমাদের দেশে নহে; কিন্তু আমি একটা পুস্তকে এ কথা লেখা দেখিয়াছি যে ভারতবর্ষের বাজারে নাকি কট্‌ল্ ফিশের মাংস বিক্রয় হয়। এ কথা কতদূর সত্য, তাহা আমি বলিতে পারি না; তবে এ দেশের কেহ কেহ যে উহা খায়, তাহার প্রমাণ তো ঐ জেলের ছেলেটার কাছেই পাওয়া গেল।

 এই সকল জেলে মাদরাজি; ইহাদিগকে নোরিয়া বলে। চেহারায় কথাবার্তায়, চাল-চলনে, সকল বিষয়েই ইহারা উড়িয়াদের চাইতে অনেক বিভিন্ন। সেখানকার দেশীয় জেলেও আছে, কিন্তু তাহারা সমুদ্রের মাছ ধরে না, তেমন সাহস আর উদ্যোগ তাহাদের নাই।

 ভারতবর্ষের গরিব লোকেরা কি পর্যন্ত পরিশ্রম করিয়া আর ক্লেশ পাইয়া দুবেলা দুই মুঠা

ভাতের জোগাড় করে তাহা এই নোরিয়াদিগকে দেখিলে বেশ বুঝিতে পারা যায়। অবশ্য আমাদের দেশের জেলেরাও কম কষ্ট পায় না। শীত, গ্রীষ্ম, রোদ, বৃষ্টি, কুমিরের ভয় ইহাদের বেলাও খুব আছে। কিন্তু সমুদ্রে মাছ ধরার যে ক্লেশ দেখিয়াছি তাহার কাছে ঐ সকল কিছুই নহে।

 সচরাচর তিনরকম উপায়ে ইহারা মাছ ধরিয়া থাকে। এক উপায় ছেট ছেট জাল লইয়া সমুদ্রের কুলে কুলে ছোট-ছোট মাছ ধরা। হাত পনেরো লম্বা আর হাত দেড়েক চওড়া একখানি জাল, তাহার মাঝে মাঝে এড়োভাগে সরু সরু কাঠি পরানো। দুজন লোক জালের দুই মাথায় ধরিয়া জলের ধারে ধারে চলিতে থাকে। যেই একটা ঢেউ আসিয়া ডাঙ্গার উপরে খানিক দূর অবধি উঠিয়া যায়, অমনি তাহার ফিরিবার পথে জালখানিকে দুজনে বেড়ার মতন খাড়া করিয়া ধরিয়া তাহার পথ আগলায়। কাঠির সাহায্যে জালখানি বেশ দাঁড়াইয়া থাকে, সুতরাং জল সরিবার সময় তাহাকে জালের ভিতর দিয়া সরিতে হয়, আর মাছ আটকা পড়ে। বড় ঢেউ থাকিলে ঐ উপায়ে মাছ ধরা চলে না, আর ইহাতে ছোট-ছোট মাছই পড়ে, তাহাও বেশি নহে।

 দ্বিতীয় উপায়, কাটামারণে করিয়া সমুদ্রের ভিতরে গিয়া জাল দিয়া মাছ ধরা। ঐ জাল কিরকম তাহা দেখি নাই। কারণ যাইবার সময় উহা গুটানো থাকে, আর মাছ ধরিবার কাজটা সমুদ্রের ভিতরে এত দুরে হয় যে, ভালো করিয়া দেখাই যায় না। জেলেরা সকাল সকাল উঠিয়া মাছ ধরিতে বাহির হয়, আর দুপুরবেলায় ফিরিয়া আসে। যাইবার সময় ঢেউয়ের হাতে ইহাদিগকে বিস্তার লাঞ্ছনা পাইতে হয়। কতবার কাটামারণসুদ্ধ উলটাইয়া জলে পড়ে। আবার সেই ঢেউয়ের অত্যাচারের ভিতরেই কাটামারণ সোজা করিয়া পুনরায় উঠিয়া বসিতে হয়। কাটামারণের কাঠগুলি কর্কের মতন জলে ভাসে, আর খুব হালকা। কাটামারণ উলটিয়া গেলে তাহাকে সহজেই সোজা করা যায়। তবে টুপি পরিয়া মাথাটাকে বাঁচাইবার কতক চেষ্টা হইয়া থাকে বটে। ঐ ঢেউয়ের মুখে সোজা করাই অসম্ভব হইত, তাহার উপর আবার উহার আবার উহার জল সেঁচার দরকার। এই জন্যই ঐ স্থলে নৌকা ব্যবহার হইতে পারে না। আর নৌকায় করিয়া ঐ প্রণালীতে মাছ ধরাও সহজ হইত না।

 ছোট-ছোট এক একটি কাটামারণে দুজন লোক ধরে। দুজনে মিলিয়া মাছও ধরে, কাটামারণও সামলায়, আর তাহা করিতেই তাহাদের সময় চলিয়া যায়। শরীরের যত্ন করিবার অবসরও হয় না, সুতরাং তাহার কোনো চেষ্টাও হয় না। তবে টুপি পরিয়া মাথাটাকে বাঁচাইবার কতক চেষ্টা হইয়া থাকে বটে। ঐ সকল টুপি উহারা বাঁশের চটা দিয়া নিজেই বুনিয়া থাকে। দেখিতে ঠিক সেঁউতীর মতন।

 এসকল উপায়ে মাছ ধরিতে ছোট-ছোট জালই ব্যবহার হয়। নভেম্বর মাস হইতে উহারা বড় বড় জাল দিয়া মাছ ধরিতে আরম্ভ করে। আর সেই সময় হইতেই মাছ ধরা দেখিবার আমোদ আরম্ভ হয়। তখন আর কাটামারণে কাজ চলে না, নৌকার দরকার হয়। নৌকায় করিয়া অনেক দূর অবধি জাল ফেলিয়া আসে; তারপর ডাঙ্গায় আসিয়া তাহাকে টানিয়া তোলে। এক একটা জালের পিছনে কুড়ি-পঁচিশ জন করিয়া লোক খাটিতে হয়। স্ত্রী-পুরুষ, ছেলেবুড়ো সকলে মিলিয়া ইহাতে যোগ দেয়।

 আসল যে জাল, সেটা একটা প্রকাণ্ড থলে;তাহার ভিতরে কুড়ি-বাইশজন মানুষ পুরিয়া রাখা যায়। এই থলের বিনুনী খুব ঘন আর মজবুত; একটা ডানকোনা মাছও তাহার ফাঁক দিয়া গলিতে পারে না। থলের মুখের দুই পাশ হইতে খুব লম্বা লম্বা দুখানা জাল বাহির হইয়াছে তাহার একধার জলের উপরে ভাসে, আর একধার জলের নীচে ডুবিয়া ঝুলিতে থাকে। এই যে দুপাশের দুখানা জাল, তাহার বুনট থলের মতো এত ঘন নহে;আর থলের মুখ হইতে যতই দূরে যাওয়া যায়, ততই উহার ফোকর বড় হইয়া শেষটা এত বড় হয় যে তাহার ভিতর দিয়া তুমি আমিও ইচ্ছা করিলে গলিতে পারি। এত বড় ফোকরের ভিতর দিয়া মাছ কেন গলিয়া পলায় না, আমি অনেক সময় এ কথা ভাবিয়াছি।

 জালখানিকে রীতিমত সমুদ্রে ফেলা হইলে, প্রায় সিকি মাইল জায়গা ঘেরা হয়। সিকি মাইল দূরে সমুদ্রের ভিতরে থলেটা থাকে। হার মুখের এক পাশ জলের উপরে, এক পাশ জলের নীচে থাকে; যেন সে মাছগুলিকে গিলিবার জন্য হা ঁকরিয়া আছে। এই হা ঁকরা মুখের দুপাশ হইতে দুখানি জালের বেড়া ডাঙ্গা অবধি গিয়াছে মাঝখানে মাছ রহিয়াছে। তাহাদের সমূহই বিপদ, কিন্তু তখনো তাহারা তাহা বুঝিতে পারিতেছে না। যদি পারিত তবে তাহাদের অধিকাংশই অনায়াসে ঐ সকল বড়বড় ফোকরের ভিতর দিয়া গলিয়া বাঁচিতে পারিত। কিন্তু তাহারা তো তখনো সেই সিকি মাইল দূরের সর্বনেশে থলের সংবাদ পায় নাই। তাহারা প্রথমে খালি সেই বড় বড় ফোকরের মধ্য দিয়া পলায়ন করিবার সুযোগ তাহাদের চলিয়া যায়।

 এদিকে জেলেরা ডাঙ্গায় থাকিয়া দুই বেড়ার দুই মাথা একত্র করিয়া জালে টান ফেলিয়াছে। তাহাদের দুজন জলে নামিয়া ক্রমাগত জাল ঠিক রাখিতেছে, যাহাতে ঢেউয়ের তাড়ায় জাল জড়াইয়া গিয়া মাছ পলাইবার সুবিধা না হয়। ইহাদের গোলমালে মাছগুলি একদিকে যেমন জাল হইতে দূরে থাকিতেছে আরেক দিকে তেমনি ডাঙ্গার দিক হইতে থলের দিকে গিয়া জড় হইতেছে। সেদিকে জালের ফোকর ক্রমেই ছোট-ছেট, সুতরাং সে পথে পলাইবার আর ভরসা নাই। তখন ইচ্ছা থাকুক আর না থাকুক, ঐ থলের ভিতরেই তাহাদিগকে ঢুকিতে হয়। ভূতে পশ্যন্তি বর্বরাঃ!’অর্থাৎ যাহারা বোকা, বিপদ হইয়া গেলে পরে তাহাদের চৈতন্য হয়, সারা বছর নিদ্রায় কাটাইয়া পরীক্ষার সময় অনেক ছাত্র-বাবুদের যে দশা হয় সেইরূপ।

 এত পরিশ্রম করিয়া জালে কি উঠে, তাহা জানিতে সকলেরই ইচ্ছা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে ফল বড়ই অনিশ্চিত! এক একদিন থলে এমনি বোঝাই হইয়া উঠে যে সকলে মিলিয়া তাহাকে টানিয়া ডাঙ্গায় আনাই কঠিন হয়। আবার একদিন দেখিলাম যে একটা জালে একক্ষেপে মোটে সাড়ে পাঁচ আনার মাছ উঠিল। যে জেলের জালে ঐরূপ হইয়াছিল সে আমাকে বলিল বাবু, কাল খুব মাছ পাইয়াছিলাম, তিনশো টাকার মাছ বেচিয়াছি।

 জালে জেলী ফিশটা খুবই উঠে। জাল ডাঙ্গায় উঠিবার পূর্বেই এ কথা বলা যায় যে আর কিছু উঠুক না উঠুক, ঝুড়িখানেক জেলী ফিশ উঠিবে। আর একটা বিষয় এই দেখা যায় যে এক একটা জালে এক এক জাতীয় মাছই খুব বেশি পড়ে। খণ্ডবালিয়া উঠিল তো দেখিবে খালি খণ্ডবালিয়াতেই জাল বোেঝাই। কোনোদিন হয়তো দেখিবে থলের প্রায় প্রত্যেক ফোকরেই একটা কাঁকল মাছের ঠোট বাহির হইয়াছে। ইহাতে বুঝা যায় যে এই সকল মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়ায়, আর জালে পড়িলে ঝাকসুদ্ধই পড়ে। খুব বড় মাছ আমি জালে পড়িতে দেখি নাই।

উপেন্দ্র —১২৬

 সমুদ্রের ধারে বালির উপদ্রব একটু বেশি এ কথা পূর্বেই বলিয়াছি। হাওয়ায় বালি উড়াইয়া সেখানকার টালিবধানো রাস্তাটিকে ক্রমাগতই ডুবাইয়া দেয়; তাই মাঝে মাঝে লোক লাগাইয়া তাহাকে আবার খুঁড়িয়া বাহির করিতে হয়। সেখানকার ছোট গির্জাটির আঙ্গি নায়ও এইরূপ বালির অত্যাচারের চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়।

 পুরীর রেলের স্টেশনের কাছে সমুদ্রের ধারে চক্রতীর্থ নামক একটি স্থান আছে। দুইএকটি মন্দির ভিন্ন সেখানে আর কিছু নাই। যে নিমকাঠ দিয়া জগন্নাথের মূর্তি গড়া হইয়াছে, সেই নিমকাঠ সমুদ্রের জলে ভাসিতে ভাসিতে ঐ চক্রতীর্থে আসিয়া লাগিয়াছিল, তাই উহা তীর্থস্থান হইয়াছে। ওখানকার একটি মন্দিরের দেবতা নুমান। তীর্থযাত্রীরা সেই হনুমানের মন্দির প্রদক্ষিণ করে, আর তাহার পূজা দেয়। লোকের বিশ্বাস এই যে হনুমান ওখানে থাকাতে দেশ সমুদ্রের অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইতেছে নচেৎ মহা মুশকিলই হইত।

 চক্রতীর্থের কাছেই একটা বালির টিপির উপরে আর একটি ছোট মন্দির আছে। চৈতন্যদেব পুরীতে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। তাঁহার দেহ যে স্থানে আসিয়া তীরে লাগিয়াছিল, ঐ ছোট মন্দিরটি সেইখানে তয়ের করা হইয়াছে। সেখানে গেলে চৈতন্যদেবের খড়ম প্রভৃতি কতকগুলি জিনিস দেখিতে পাওয়া যায়। সমুদ্রের ধারের আর দুইটি বিষয়ের কথা বলিলেই পুরীর পালা শেষ করিতে পারি। পুরীতে মাঝে মাঝে জাহাজ আসে এ কথা বলিয়াছি। সুতরাং পুরী যে একটি জাহাজের স্টেশন এ কথা আর বিশেষ করিয়া না বলিলেও চলে। এখান হইতে বিলাত প্রভৃতি স্থানে যে সকল জাহাজ যায়, তাহারা পুরীর কাছ দিয়া যায় না; তাহাদের পথ পুরী হইতে প্রায় ষাট মাইল দূরে সমুদ্রের ভিতর দিয়া। কিন্তু এমন অনেক জাহাজ আছে যাহার রেঙ্গুন প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করে। পুরী এইসকল জাহাজের স্টেশন।

 এই সকল স্টেশনে দুইটি বিষয়ের বন্দোবস্ত রাখিতে হয়। ১) একটা নিশান, ২) রাত্রিকালের জন্য একটা আলো। সাধারণ নিশান এবং আলোর সঙ্গে এই নিশান আর আলোর একটু প্রভেদ আছে, তাই ইহাদের কথা এখানে উল্লেখ করিয়াছি।

 নিশানের দ্বারা জাহাজের লোকদিগকে নানারূপ সংবাদ দেওয়া যায়। ছোট-ছোট অনেক রকমের নিশান আছে, তাহাদের প্রত্যেকটির আকার এবং রঙ ভিন্ন রকমের আর প্রত্যেকটির এক একটা বিশেষ অর্থ আছে। এই সকল নিশান আর তাহার অর্থের দস্তুর মতন অভিধান থাকে, তাহার সাহায্যে নিশানের ভাষায় কথাবার্তা চালানো যায়।

 বাস্তবিক এরূপ একটা উপায় না থাকিলে জলযুদ্ধের সময় ভারি মুশকিল হইত। যিনি সেনাপতি, তিনি হয়তো যুদ্ধের সময় ইচ্ছা করিলেন যে নিজের জাহাজগুলিকে কোনো একটা বিশেষ হুকুম দিবেন। এখন সে হুকুম দেওয়া যায় কি করিয়া? স্থলে হইলে হয়তো দূত পাঠাইয়া সংবাদ দেওয়া সম্ভব হইতে পারিত, (স্থলযুদ্ধের জন্যও নানারূপ সংকেতের ব্যবস্থা আছে) কিন্তু নৌযুদ্ধে এরূপ সংবাদ কে লইয়া যাইবে? আর কেহ লইয়া যাইতে পারিলেও হয়তো সংবাদ পৌছইবার পূর্বেই যুদ্ধ শেষ হইয়া যাইবে। এইজন্য নৌযুদ্ধে ঐরূপ নিশানের দরকার। এই সকল জাহাজের লোকেরাই তৎক্ষণাৎ তাহা দেখিতে পায়, আর হুকুম মতো কাজ করে।

 ট্রাফালগারের যুদ্ধের সময় সেনাপতি নেলসন এইরূপে তাহার দলের জাহাজগুলিকে নিম্নলিখিত সংবাদ দিয়াছিলেন ইংলণ্ড আশা করেন যে, প্রত্যেক লোক তাহার কর্তব্য করিবে। গত রুশ-জাপান যুদ্ধে যেদিন সেনাপতি টোগো রুশিয়ার জাহাজ সকল চুর্ণ করেন, সেদিন তিনিও এই উপায়ে সৈন্যদিগকে বলিয়াছিলেন যে, আজিকার যুদ্ধের উপর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।’

 ইহাতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে ঐরূপ নিশান দিয়া দস্তুর মতন কথাবার্তা চালান যাইতে পারে। জাহাজের সঙ্গে ষ্টেশনের লোকদেরও এই উপায়ে কথাবার্তা চলে। ইহা ছাড়া ঝড় বৃষ্টির অবস্থা জানাইবার জন্য আবার বিশেষ রকমের সংকেত আছে। এ সকল সংকেত বিফল করিয়া দিতে পারে, তাই এজন্য কোনোরূপ কঠিন জিনিস ব্যবহার হয়। জিনিসটি গোল হইলে এক অর্থ, চৌকা হইলে এক অর্থ তিন কোনা হইলে এক অর্থ। আবার ইহাদের একটির সঙ্গে আর একটি মিলাইলে তাহারাই কতরূপ অর্থ হইতে পারে। এইরূপে অতি অল্প কয়েকটি জিনিস দিয়া অনেকরকম কথা বুঝানো যায়। যেমন ভয় নাই।’ ঝড়! বড় বিপদ! সাবধান ইত্যাদি। এই সকল সংকেত দেখিয়া জাহাজের লোকরা পূর্বেই সতর্ক হয়।

 সমুদ্রে যাইবার সময় পথে ঝড় বৃষ্টির অবস্থা কিরূপ হইবে তাহা জাহাজের লোকের চাইতে ডাঙ্গার লোকের বুঝা অপেক্ষাকৃত সহজ। কারণ জাহাজের লোকেরা চারিদিকে কয়েক মাইলের বেশি দেখিতে পায় না। পরিষ্কার দিনে হয়তো জাহাজ ছাড়িল, কিন্তু আর চারি ঘণ্টা পরেই এমন একটা স্থানে গিয়া তাহাদের উপস্থিত হইতে হইবে যেখানে ভয়ানক ঝড় চলিতেছে। জাহাজের লোকের সে স্থানের খবর সংগ্রহ করিবার উপায় নাই। কিন্তু ডাঙ্গার লোকেরা এক স্থানে ঝড়ের সংবাদ পাইলে তৎক্ষণাৎ সকল দেশে তার করিয়া সংবাদ দিতে পারে। এইরূপ কার্যের জন্য রীতিমতো সরকারি অফিস প্রায় সকল স্থানেই আছে। উহাদের কাজ কেবল ঝড় বৃষ্টি আর বায়ু ও আকাশের অবস্থার খবর লওয়া, এবং সর্বত্র সেই খবর দেওয়া। এইরূপে এক জায়গায় ঝড়ের নমুনা হইলে দেখিতে দেখিতে তাহার খবর জাহাজের ষ্টেশনে ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হয়, আর অমনি সেখানকার লোকেরা তাহা নিশানা লটকাইয়া দেয়। জাহাজের লোকেরা ক্রমাগত ঐ সকল নিশানের প্রতি লক্ষ্য বাখিয়া চলে।

 আলোর দ্বারা অবশ্য এতরকম খবর দেওয়ার ব্যবস্থা নাই তথাপি আলোকটি দেখিলে অন্তত এ কথা বুঝিতে পারা যায়, যে অমুক ষ্টেশনের কাছে আসিয়াছি। এই সকল আলোর লণ্ঠন বিশেষ রকমের। তাহার সামনের কাচখানার গড়ন এমনি, যে তাহাতে ভিতরকার আলোটাকে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতে না দিয়া সোজা সামনের দিকে পাঠাইয়া দেয়। তাহার ফলে অনেক দূর হইতে এই আলো দেখিতে পাওয়া যায়। আতসী কাচের গড়ন যেরূপ, এই লণ্ঠনের কাচের গড়ন কতকটা সেইরূপ, কিন্তু তাহার চাইতে অনেক জটিল।

 পুরীর লণ্ঠনটি অতি সামান্যরকম। কিন্তু এই জাতীয় লণ্ঠন এক একটা খুব বড়-বড় হয়, আর তাহার আলো সাধারণ আলোর চাইতে অনেক বেশি। অনেক স্থলে আবার এরূপ বন্দোবস্ত থাকে যে আলোটি ক্রমাগত না জ্বলিয়া একবার নিভিবে (অথবা লণ্ঠনটি ঘুরিবে, যাহাতে একবার তাহার সামনের দিক, একবার পিছনের দিক দেখা যায়, আর দুর হইতে মনে হয় যেন আলো জ্বলিতেছে আর নিভিতেছে)। এই উপায়ে বিশেষ বিশেষ স্থানের আলো দেখিয়া জাহাজের লোকেরা বুঝিতে পারে যে, উহা অমুক স্থানের আলো। পৃথক স্থানের আলো জ্বলা নিভার এক একটি বিশেষ হিসাব আছে। কোনোটার সহজ হিসাব; যেমন ‘এত সময়ে এতবার। কোনোটার হিসাব একটু জটিল; যেমন; ‘এতক্ষণ পর পর ক্রমাগত এতবার জ্বলিয়া তারপর এতক্ষণ। এইরূপ অসংখ্য হিসাব হইতে পারে।

 এইসকল আলোর কোনটা কি হিসাবে জ্বলে, জাহাজে জাহাজে তাহার একটা তালিকা থাকে। সেই তালিকা দেখিয়া কোন স্থানের কোন আলো তাহা চিনিয়া লইতে হয়।