উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/আবার পুরীতে

আবার পুরীতে

 এবারে আবার পুরী গিয়াছিলাম। দু বৎসর আগে আর একবার যাই। এই দু বৎসরের মধ্যে স্থানটির সমুদ্রের ধারের চেহারা অনেকটা বদলাইয়া গিয়াছে। যেসকল জায়গায় আগে বালি ভিন্ন কিছুই ছিল না, এখন সেখানে অনেকগুলি নূতন বাড়ি হইয়াছে। ইহারই একটি ছোট বাড়িতে আমরা ছিলাম। প্রথমবারের বাড়িটির চেয়ে এ বাটীটি সমুদ্রের অনেক কাছে।

 এ বাড়িতে আসিয়াই কতকগুলি কাঁকড়া আর কুকুরের সহিত পরিচয় হইল। কাঁকড়াগুলি আমাদের উঠানেই থাকিত; বাড়ি হইবার পূর্বে এ সকল জমি তাহাদেরই ছিল। কুকুরগুলি বোধহয় বাড়ি হইবার আগে এখানে আসিয়াছিল। বেচারারা নিতান্তই গরিব। চেহারা দেখিয়া মনে হইল, যেন পেট ভরিয়া আহার তাহাদের অল্পই জোটে; কিন্তু এরূপ কষ্ট এবং অযত্নের মধ্যে থাকিয়াও তাহাদের স্বভাবের মিষ্টতা হারায় নাই। প্রথমে ইহাদ্রে একটিই ঐ বাড়িতে ছিল, সুতরাং প্রথম পরিচয় তাহার সঙ্গেই হয়। জীর্ণ শীর্ণ অস্থি-চর্মসার শরীরটিতে যেমন একদিকে তাহার দারিদ্র্যের লক্ষণ দেখা গেল, তেমনি লম্বা লম্বা হাত-পা, লম্বা লেজ এবং স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে তাহার ভদ্রতার আভাসও ছিল। সেই লম্বা লেজটি নাড়িয়া সে আমাদিগকে অভ্যর্থনা করিল। আমরা অল্প কয়টি লোক, আমাদের পাতের ভাতে ভালো করিয়া তাহার পেট ভরিত কিনা সন্দেহ, কিন্তু তাহার জন্যই সে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হইয়া সমস্ত রাত্রি আমাদের বাড়িতে পাহারা দিত।

 ক্রমে আর দুটি কুকুর আসিয়া জুটিল। ইহাদের একটা একটু বুনোগোছে ছিল, ভদ্রতার ধার বড় একটা ধারিত না। শিশুকালে কে তাহার লেজ কাটিয়া দিয়াছিল, এখন তাহার তিন আঙ্গুল মাত্র অবশিষ্ট আছে। আমরা ঘনিষ্ঠতা করিতে গেলে সে ঐ তিন আঙ্গুল লেজটুকুই গুটাইয়া অবিশ্বাস প্রকাশ করিত। অন্যান্য কুকুরগুলির তুলনায় ইহার মনটাও একটু কুটিল ছিল বলিয়া বোধহয়; কিন্তু আমাদের সঙ্গে সে কোনোরূপ মন্দ ব্যবহার করে নাই।

 তারপর আবার একটা মস্ত কুকুর আসিল। যতদিন কেবল আমরাই ছিলাম ততদিন তাহাকে দূরে দূরে দেখিতে পাইতাম বটে, কিন্তু সে আমাদের কাছে বড় একটা ঘেঁষিত না। কিন্তু যখন আমাদের বাড়িতে ছোট-ছোট ছেলেরা আসিল, তখন দেখি যে কুকুরটা আসিয়া তাহাদের সঙ্গে বন্ধুতা করিয়া বসিয়াছে। ছেলেদের সঙ্গে সে এমনি উৎসাহ করিয়া খেলিত যে, একদিন লাফ দিয়া তাহাদের মাথার উপর দিয়াই চলিয়া গেল।

 এই কুকুরগুলিকে ছাড়িয়া আসিতে কষ্ট বোধ হইয়াছিল। আসিবার পূর্বে তাহাদের যথেষ্ট ভাত আর মাছ রান্না করিয়া তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ খাওয়াইলাম। খাইবার সময় তিনটি কুকুর আসিয়া উপস্থিত হইল, বড় কুকুরটাকে খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। এত খাবার বোধ হয় আর কোনোদিন তাহারা পায় নাই। লেজকাটা কুকুরটা অনেক ভাত দেখিয়া এতই ব্যস্ত হইয়া উঠিল যে সে পারিলে সব ভাত একাই খায়। সে তাহার নিজের ভাগ পায়ে ঢাকিয়া অন্য দুটা কুকুরের ভাগ খাইতে লাগিল। কাজেই শেষটা তাহার ভাগ খাইবার বেলা আর তাহার পেটে স্থান রহিল না।

 পরদিন বড় কুকুরটা আসিয়া উপস্থিত। সে কোথায় যেন গিয়াছিল, সে অবধি তাহার কিছুই খাওয়া হয় নাই। যাহা হউক, তাহার জন্য খাবার যথেষ্ট রাখা হইয়াছিল।

 সেবারে পুরীর ব্যাঙ আর উইয়ের কথা বলিয়াছিলাম। এ বাড়িটিতে এই দুই জন্তু দেখিতে পাইনাই। টিকটিকি আর গিরগিটি অনেকগুলি ছিল। আমাদের বারান্দায় একটা তালপাতার বেড়া ছিল। রাত্রিতে বাহিরের বাতাস আর শীতের তাড়ায় যত গিরগিটি আসিয়া এই বেড়ায় আশ্রয় লইত। তাহাদের ঘুমাইবার ভঙ্গির কথা মনে হইলে এখনো আমার হাসি পায়। শরীরটাকে যত উৎকৃষ্ট রকমের বাঁকাইতে পারে ততই বোধহয় উহাদের ঘুমাইবার সুবিধা। কেহ যদি দড়ির আগায় ঝুলিতে ঝুলিতে পা ঘাড়ে তুলিয়া মাথা নীচের দিকে দিয়া ডিগবাজি খাইবার মাঝখানে ঘুমাইয়া পড়ে, তবে হয়তো সে গিরগিটির নিদ্রার মর্ম খানিকটা বুঝিতে পারে।

 পুরীর বিড়ালগুলি এবারে আমাদিগকে বড়ই জ্বালাতন করিয়াছে। আমরাও যে তাহাদের সহিত বন্ধুতা করিতে পারি নাই, এ কথা বলাই বাহুল্য। আমার লাঠিটার কথা কহিবার শক্তি থাকিলে এ বিষয়ে তোমরা অনেক আশ্চর্য সংবাদ শুনিতে পাইতে। দুঃখের বিষয়, করিয়াও উহাদের সংশোধন হয় নাই। এরূপ নির্লজ্জ জন্তু আর বেশি আছে কি না সন্দেহ। যত মার খায়, ততই আরো বেশি করিয়া দৌরাত্ম্য করে। মারের চোটে কোমরও যদি ভাঙ্গি য়া যায়, তবুও সামনের দুপায় হিচড়াইয়াই ছুট দিবে। খানিক দূর যাইতে না যাইতেই দেখিবে তাহার কোমর সোজা হইয়া গিয়াছে। আর খানিক গেলে হয়তো বেদনার কথা একেবারেই ভুলিয়া যাইবে। কাজেই আর বেশি দূর যাইবার পূর্বেই সে ফিরিয়া আসিয়া রান্নাঘরের কোণে উকিঝুকি মারিবে। সেখানে যদি কেহ থাকে, তবে হয়তো তাহাকে বলিবে মিঞাও! কি মিঞা? বড় যে মারিয়াছিলে? আর যদি কেহ না থাকে, তবে তো বুঝিতেই পার। বল দেখি, এমন অবস্থায় নিতান্ত সাধু মহাপুরুষ ভিন্ন সাধারণ লোকের রাগ হয় কিনা?

 সাধু লোকের কথায় পরলোকগত পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয়ের জীবজন্তুর প্রতি অসাধারণ দয়ার কথা মনে পড়ে। পুরীতে নরেন্দ্র সরোবরের ধারে গোস্বামী মহাশয়ের সমাধির স্থানে একটি আশ্রম আছে। সেই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক মহাশয়ের নিকট এ বিষয়ে অনেক আশ্চর্য কথা শুনিয়াছি। ইতর প্রাণীরা অনেক সময় যথার্থ দয়ালু লোককে চিনিতে পারে, এবং অন্য লোক দেখিয়া তাহাদের মনে যেরূপ ভয় আর অবিশ্বাস হয়, ঐসকল দয়ালু লোকের সম্বন্ধে তাহা হয় না। গোস্বামী মহাশয়ের জীবনে ইহার অনেক দৃষ্টান্ত দেখা গিয়াছে। বিড়ালের জন্য দুধ রোজ বরাদ্দ করা, গরু ছাগলকে নিয়মিত আহার দেওয়া এ সকল তো তাঁহার ছিল। ইদুর আরশুলাগুলি পর্যন্ত নাকি ক্ষুধার সময় তাহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইত। উহারা আসিয়া তাহার গা খুঁটিতে আরম্ভ করিলেই উনি বলিতেন, ‘ওহে, ইহাদের আহার চাই, কিছু খাইতে দাও। খাবার দেওয়া হইলে পর উহারা সন্তুষ্ট হইয়া যথাস্থানে চলিয়া যাইত। যে সাপকে আমরা দেখিবামাত্র তাহার মাথা গুঁড়া করিয়া দিই, গোস্বামী মহাশয় সেই সাপকে পর্যন্ত যত্ন করিয়া রোজ দুধ-ভাত খাওয়াইছে। একটা সাপ ধ্যানের সময় আসিয়া তাহার শরীরে বাহিয়া উঠিত, কিন্তু কখনো কোনো অনিষ্ট করিত না।

 সকলের চাইতে বানরগুলি তাহাকে বেশি করিয়া ভালোবাসিত। আকারও তাহার নিকট কম করিত না। তাহার গায়ে হাত দিয়া তাহাকে ঠেলিয়া টিপিয়া নানা উপায়ে তাহার নিকট হইতে খাবার তো আদায় করিতই; খাবার জিনিস মনঃপুত না হইলে আবার আঁচড়াইয়া তাহাকে সাজাও দিত। তিনি ইহাতে রাগ করা দূরে থাকুক, বরং হাসিয়া বলিতেন, “ওহে, কি দিয়াছ, উহার পছন্দ হয় নাই; ভালো জিনিস দাও!

 বানরগুলি তাহার নিকট ছানা রাখিয়া নিশ্চিন্ত মনে অন্য কাজে মন দিত, কিছুমাত্র সন্দেহ করিত না। একদিন গোস্বামী মহাশয়ের পরিচিত একটা বানর তাহার বানরীকে লইয়া উপস্থিত হইল। বানরী কখনো সেখানে আসে নাই, কাজেই তাহার সংকোচ হওয়া স্বাভাকি। তাই সে দরজা অবধি আসিয়া আর কাছে আসিতে চাহিল না। বানরটা আগে নানান উপায়ে তাহাকে উৎসাহ দিল। তবুও যখন সে আসিল না, তখন বানর গোস্বামী মহাশয়ের কাছে আসিয়া তাহার হাতখানি টানিয়া নিজের হাতের ভিতরে লইয়া বানরীর দিকে চাহিয়া রহিল, যেন তাহাকে এই কথা জানাইল যে “দেখ, এ বড় ভালোমানুষ, কিছু করে না। ইহার পর বারী আর কাছে আসিতে কোনো আপত্তি করিল না।

 গোস্বামী মহাশয় এইসকল বানরকে বুড়ো দাদা, কালী, লেজকাটি ইত্যাদি নামে ডাকিতেন। ইহাদের অনেকে নাকি এখনো পুরীর লোকনাথের মন্দিরের কাছে বাস করে। এ কথা শুনিয়া একদিন লোকনাথের মন্দিরের ফটো তুলিতে গেলাম। মন্দিরের আঙ্গিনায় অনেক বানরও গতি ছিল। কিন্তু উহাদের ছবি তোলা আমাদের ঘটিল না। একজন পাণ্ডা আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের সঙ্গে কি চামড়া আছে?’আমরা বলিলাম, আমাদের ক্যামেরায় চামড়া আছে। তাহা শুনিয়া সে ব্যক্তি বলিল, ‘তবে শীঘ্র বাহিরে যাও, এখানে চামড়া আনিতে নাই। কাজেই আমরা বাহিরে চলিয়া আসিলাম।

 যাই হউক, আমরা একেবারে শুধু হাতে ফিরিয়া আসিতে রাজি ছিলাম না। মন্দিরের আঙ্গিনার বাহিরে বাগান, সেইখানেই যত বানর থাকে। সুতরাং আমরা পুকুরের ধারে কলা ছড়াইয়া বানরের দলকে নিমন্ত্রণ করিলাম। একজন চ্যাঁচাইয়া ডাকিতে লাগিল, আয়, আয়, আয়। অমনি কয়েকটি বানর আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরাও তাহাদের ছবি লইয়া বাড়ি ফিরিলাম। ইহাদের মধ্যে কাণী’ ‘লেজকাটি’ প্রভৃতির কেহ আছে কিনা জানি না।

 আগেই লোকনাথের মন্দিরের নিকট বানরের ছবি তোলার কথা বলেছি। দুঃখের বিষয়, সেবারের ছবিটির নীচে নরেন্দ্র সরোবরের নাম লেখা হইয়া গিয়াছে। আমার কিন্তু দোষ নাই, ও নাম উহাতে কি করিয়া লেখা হইল, তাহা আমি জানি না।

 যাই হক, কথাটা যদি উঠিল, তবে না হয়, নরেন্দ্র সরোবরের ছবিটাও দেওয়া যাউক। পুরীতে এই পুকুরটি অতিশয় প্রসিদ্ধ। আর ছবি দেখিলে বুঝিতে পারিবে, যে উহা যেমন তো পুকুর নহে। কলিকাতার লালদীঘি হইতে উহা অনেক বড়, আর তার চারিধার পাথর দিয়া বাধানো, জল বেশ পরিষ্কার, কিন্তু তাতে কুমির থাকায় নামিয়া স্নান করাটা তো নিরাপদ নহে। প্রত্যহ অনেক লোক ইহাতে স্নান করে বটে, কিন্তু ইহাদের দু-একটিকে মাঝে মাঝে কুমিরে ধরিয়াও থাকে।

 পুকুরের মাঝখানে যে একটি ছোট মন্দিরের মতন দেখা যায়, উহা জগন্নাথের গ্রীষ্মবাস। গ্রীষ্মের সময় কিছুদিন জগন্নাথকে এই স্থানে আনিয়া রাখা হয়। স্থানটি অতি সুন্দর, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছবিটি তেমন ভালো উঠে নাই। তখন সন্ধ্যা হইয়াছিল, তাই ভালো করিয়া ফটো তোলা গেল না।

 ফটো তুলিবার জন্য এবারে পুরীর অনেক জায়গায় ঘুরিয়াছি, তাহাদের কথা ক্রমে বলিব। আমরা সমুদ্রের কাছেই ছিলাম, সুতরাং সমুদ্রের নিকটবর্তী অনেকগুলি জায়গায় ছবি তোলা হইয়াছে। আমাদের বাড়ি হইতে খানিক পশ্চিমে গেলেই নরিয়াদিগের গ্রাম। তাহারা সারি সারি ঘর বাঁধিয়া বাস করে। পাশাপাশি দুখানি ঘরের মাঝখানে কিছুমাত্র ফাঁক রাখে না। দরজা জানালার ধার অতি অল্পই ধরিয়া থাকে। হাওয়া তো ঘরের ভিতরে খেলেই না। জিজ্ঞাসা করিলে একজন বলিল, “অতটুকু ঘরে আবার কত হওয়া খেলিবে? ঘরে, উঠানে, বাগানে, আঁস্তাকুড়ে ঘণ্ট পাকাইয়া তাহার ভিতরে উহারা বাস করে।

 ইহারা একরকম হিন্দু। ইহাদের দেবদেবী আছে, পুরুত আছে, মন্দির আছে। মন্দির বলিতে একটা কিছু কাণ্ডকারখানা করিয়া বসিও না। সকলের চাইতে বড় মন্দিরটি ছাড়া আর কেননাটির ভিতরে মানুষ ঢুকিবার জায়গা নাই। অধিকাংশ মন্দিরই বাক্স প্যাটরার মতন ছোট ছোট চালাঘর মাত্র, উহার ভিতরে লাল, কালো, হলদে রঙের ছোট ছোট দেবতারা বড় বড় চোখ মেলিয়া যেন আশ্চর্য হইয়া বসিয়া থাকে। একটি দেবতার আবার ঘর পছন্দ হয় না, সে হাঁড়ির ভিতরে থাকিতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে পুরুত আসিয়া ইহাদের পূজা করিয়া যায়। নরিয়ারা ইহাদিগকে খুব মান্য করে, আর ইহাদের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা বলে। দুঃখের বিষয়, আমি দেবতাগুলির নাম ভুলিয়া গিয়াছি। একজন আছে, তাহাকে হাতি ঘোড়া দিয়া পূজা করিতে হয়। উহার মন্দিরের পাশে বিস্তর হাতি ঘোড়া পড়িয়া আছে। ছোট ছোট মাটির জিনিস। এক সময়ে ঠিক এইরকম হাতি ঘোড়া আমাদের কুমারেরা গড়িত। ছেলেবেলায় আমরা তাহা দিয়া খেলা করিয়াছি। কিন্তু আজকালকার খোকাদের হয়তো তাহা পছন্দই হইবে না। নরিয়াদের দেবতা ঐ হাতি ঘোড়া পাইয়াই যারপরনাই খুশি হয়। জানোয়ারগুলির অধিকাংশেরই হাত পা ভাঙ্গা। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ভাঙ্গা অতি ঘোড়া কেন দিয়াছ?’ নরিয়া বলিল, “আমরা কেন ভাঙ্গা দিব? ঠাকুর উহাতে চড়িয়া চড়িয়া হাত পা ভাঙ্গিয়াছে।তখন শুনিলাম, যে বোজ নাকি রাত দুপুরের সময় ঐ দেবতা বেড়াতে বাহির হয়। এ সকল হাতি ঘোড়া তখন আর ওরূপ ছোট ছোট থাকেনা, উহারা সত্য সত্যই বড় বড় হাতি মোড়া হইয়া যায়, আর ঠাকুর তাহাদের পিঠে চড়িয়া ব্রহ্মাণ্ড ঘুরিয়া আইসে।

 এ কথা শুনিয়া একজন বলিল, আমি তো এইখানেই থাকিকই আমি তো একদিনও তোমাদের ঠাকুরকে ঘোড়া চড়িয়া বেড়াইতে দেখি নাই। নরিয়া বলিল, ‘দেখিলে কি না তুমি আবার বলিতে আসিতে।অর্থাৎ উইদের বিশ্বাস, যে সে সময়ে কেহঠাকুরের সামনে পড়িলে তৎক্ষণাৎ তাহার মৃত্যু হয়।

 নরিয়া্রা বড়ই গরিব আর পরিশ্রমী। উহাদের কেহ সহজে ভিক্ষা করিতে চাবেনা। সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেলে নরিয়া ছেলেরা আসিয়া পয়সার জন্য বিরক্ত করে বটে, কিন্তু আমি কখনো তাহাদিগকে এমন কথা বলিতে শুনি নাই, যে ভিক্ষা দাও। কেহ হয়তো কতকগুলি কড়ি আনিয়া বেচিতে চাহিবে, না হয় বলিবে, ‘পানিমে যায়গা?’অর্থাৎ তুমি যদি একটা পয়সা দাও, তবে সে সমুদ্রের জলে নামিয়া তোমাকে কিছু তামাশা দেখাইতে প্রস্তুত আছে। তুমি রাজি হইলে উহারা নানারকম সাঁতার কাটিয়া দেখাইবে। রাজি না হইলে বার বার ঐ কথা বলিয়া তোমার কান ঝালাপালা করিয়া দিবে। তাহাতেও কাজ না হইলে ভেংচি কাটিয়া ডিগবাজি খাইয়া তোমাকে খ্যাপাইয়া তুলিবে। একদিন ইহারা একটা সং লইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়া বেজায় সোর সরাবৎ আরম্ভ করিয়া দিল। গোলমালের জ্বালায় অস্থির হইয়া আমি বাহিরে আসিয়া দেখি, একটার গায়ে ঘাস জড়াইয়া সেটাকে এক অদ্ভুত জন্তু সাজাইয়াছে, আর সবগুলি মিলিয়া তাহাকে লইয়া কোলাহল করিতেছে ইচ্ছ, কিছু বকসিস আদায় করে। আমি তখন একটা দরকারি কাজে ব্যস্ত ছিলাম, কাজেই বকসিস দেওয়া দুরে থাকুক, আমি তাহাদিগকে তাড়াইতে পারিলে বাঁচি। সুতরাং আমি করিলাম কি, ঘরের ভিতর হইতে মোটা লাঠিগাছ লইয়া, দাঁত মুখ খিচাইয়া, চোখ ঘুরাইতে ঘুরাইতে দুই লাফে একেবারে তাহাদের সামনে আসিয়া উপস্থিত। তাহারা তখন আমাকে ঝড়, না ভূমিকম্প, না ইঞ্জিন, না পাগলা হাতি, কি মনে করিয়াছিল তাহা উহারাই জানে, কিন্তু একবার আমাকে দেখিয়া আর কেহ দুবার দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিল না। সংটাই সকলের আগে ছুটিয়া পলাইল।

 বাস্তবিক সমুদ্রের ধারের অসুবিধার মধ্যে এই নরিয়া ছেলেগুলিকে ধরিলেও অন্যায় হয় না। ইহাদের লক্ষঝম্প দেখিয়া মাঝে মাঝে আমোদ বোধহয় বটে, কিন্তু স্ত্রীলোক অথবা নিরীহ লোক দেখিলে ইহারা অনেক সময় বড়ই অভদ্রতা করিয়া থাকে। আবার ইহাদের কোনো কোনোটার চুরির অভ্যাসও আছে।

 এবারেও যে সমুদ্রে স্নান করিয়া খুব আনন্দ পাইয়াছি তাহা বলাই বাহুল্য। এখনো আমার হাঁটুতে তাহার দাগ আছে। তিন মাসের মধ্যে একটি দিন মাত্র আমার স্নান বাদ গিয়াছিল সেদিন সমুদ্রে সাইক্লোন-হইতেছিল। তখন সমুদ্রের চেহারা দেখিয়া আর নামিতে ভরসা হয় নাই। তারপরেই পূর্ণিমার জোয়ার ছিল;তখনো সমুদ্র খুবই চঞ্চল, কিন্তু স্নান বন্ধ হয় নাই। তবে সেদিনকার সেই পাগলা ঢেউয়ের হাতে যে শক্ত দুইটা আছাড় খাইয়াছিলাম, তাহার কথা অস্বীকার করিতে পারি না। প্রথমে একটা ঢেউ আসিয়া আমাকে নাকি মুখ থুবড়িয়া দিয়া ফেলিয়াছিল। তাহাতে আমি একটু পিছন বাগে জোর করিয়া সাবধান হইলাম, যেন আর ধুবড়িয়া ফেলিতে না পারে। কিন্তু তাহার পরের ঢেউটা যখন আমাকে বালির উপরে চিৎ করিয়া ফেলিয়া কুড়ি হাত লম্বা বিষম এক ধাক্কা দিল, তখন বুঝিলাম যে এর চেয়ে মুখ থুবড়িয়া পড়া ঢের ভালো ছিল।

 সূর্য গ্রহণের দিন স্নানের ঘটা খুব বেশি হয়; এবারে সূর্যগ্রহণের সময় পুরীতে ছিলাম। গ্রহণ আরম্ভ হইবার পূর্বেই বিস্তর লোক আসিয়া সমুদ্রের ধারে জড় হইল। অমাবস্যার জোয়ারে সমুদ্রের তেজ খুবই বেশি হয়, কাজেই সেদিনকার গান খুব কষ্টকর হইয়া থাকে। কিন্তু গানের সময় উপস্থিত হইলে প্রায় কেহই কষ্ট অথবা বিপদের দিকে তাকাইল না। যাহারা নিজে স্নান করিতে পারে না, তাহাদিগকে অপর বলিত লোকেরা সাহায্য করিতে লাগিল। এক এক জায়গায় দেখিলাম, দশ-পনেরোজন হাত ধরাধরি করিয়া স্নান করিতে নামিয়াছে। আমার বোধহয়, সেদিন বেশি ভিড়ের সময় প্রায় কুড়ি হাজার লোক সমুদ্রের বারে উপস্থিত ছিল। সর্বসুদ্ধ যে ইহার অনেক বেশি লোকে স্নান করিয়াছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

 গ্রহণের সময় আমরা কালো কাচের ভিতর দিয়া সূর্য দেখিতেছিলাম। একটি কানা উড়িয়া স্ত্রীলোক সেই কাচের ভিতর দিয়া সূর্য দেখিয়া ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। সে মনে ভাবে নাই যে, সূর্যটাকে ওরূপ আধখানা দেখিতে পাইবে। খানিক ভাবিয়া সে বলিল, আমি কিনা একচোখে দেখি, তাই আধখানা বৈ দেখতে পাইনি।