উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মেঘের মুলুক

মেঘের মুলুক

 ছিলাম মাঠে, এসেছি মেঘের মুলুকে দার্জিলিঙে। কলকাতার চেয়ে সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে। সাড়ে সাত হাজার ফুটে প্রায় দেড় মাইল হয়; সেটা যে ঠিক কতখানি উঁচু, মনের ভিতরে এর একটা পরিষ্কার আন্দাজ করা ভারি শক্ত।

 শকুনগুলো অনেক সময় প্রায় হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে পারে। আবার বর্ষার মেঘও মাঝে মাঝে হাজার ফুট নিচু অবধি নেমে আসে; হয়তো তার চেয়েও নীচে নামে, বা শকুন যত উঁচুতে উঠতে পারে, সাড়ে সাত হাজার ফুট তার চেয়েও পাঁচ-সাত গুণ উঁচু।

 আমরা ছেলেবেলায় বুড়োদের মুখে শুনতাম যে মেঘে্রা বাঁশের পাতা খেতে পাহাড়ে যায়, তখন কোচেরা (একরকম পাহাড়ী লোক, যাদের নামে কুচবিহার হয়েছে)। তাদের বল্লম দিয়ে মারে। সেই মেঘ তারা নাচের লোকদের কাছে বেচতে আনে, তাকেই আমরা বলি অভ্র!

 এ কথা যে ঠিক নয়, তা অবশ্যি তোমরা সকলেই জান। টিপিপানা মেঘে রোদ পড়লে তার চেহারা অনেকের কাছে অভ্রের মতো ঠেকতে পারে। মেঘ হাওয়ায় ভেসে ভেসে ক্রমাগতই গিযে পাহাড়ের গায়ে ৫কছে আর সেখানে বাঁশেরও অভাব নাই। এখন যেমন দার্জিলিং অবধি রেল হয়েছে, আগে তো আর তেমন ছিল না। সেকালেব লোকে দূর থেকেই এসব দেখে, অভ্রের গল্প তয়ের করেছিল।

 শোনা যায় একজন সাহেব পাহাড়ী মুটের ঝাকায় চড়ে প্রথমে দার্জিলিং এসেছিলেন। সে অবশ্যি অনেকদিনের কথা, এখন পাহাড়ে উঠবার কোনো রকমের পথই ছিল না। জানোয়ার চলবার পথ ছিল, সেই পথ ধরে পাহাড়ীরা গভীর বনের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে আসত আর লোকজনের উপর ভারি দৌরাত্ম্য করত। সেই পাহাড়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করবার জন্য আমাদের সরকার পাহাড়ের নীচে, বনেব ধারে পাহারা রাখতেন।

 পাহাড়ের নীচেকার এসব জায়গার নাম তরাই। তরাই বড় ভয়ানক স্থান, তখন আরো ভয়ানক ছিল। সেখানে গেলে দু-তিন মাসের ভিতরে জ্বর আর পিলেয় ভুগে হাড্ডি সার হয়ে যেতে হত। সরকারি পাহারাওয়ালারা এমনি করে ভুগত আর পাহাড়ীদের মুখে শুনত যে পাহাড়ের উপরকার জায়গা বড়ই খাসা। শেষে দু-একজন লোক সাহস করে উপরে গিয়ে দেখে এল সত্যিসত্যিই সে সকল জায়গা খুব ভালো।

 এমনি করে লোকে প্রথমে দার্জিলিঙের কথা জানতে পেরেছিল। দার্জিলিং যাবার পথটি যখন প্রথম তয়ের হয়, তখন তার প্রত্যেক মাইলে ষাট হাজার টাকা খরচ পড়ে। সেই পথের ধারে ধারেই এখন রেলের লাইন বসেছে। খেলনার মতন ছোট ছোট গাড়ি দেখলে হাসি পায়। ছোট একটি ইঞ্জিন, তার পিছনে এরকম আট-দশখানা গাড়ি জুড়ে ট্রেন হয়েছে তারই

ভিতরে গুটিসুটি হয়ে বসে, হাঁ করে পথের শোভা দেখতে দেখতে দার্জিলিং যেতে হয়।

 দার্জিলিঙের পথে বনের শোভা বড় চমৎকার। একলা সে বনের ভিতর যেতে হলে প্রাণটি হাতে করে যেতে হয়, কিন্তু ট্রেনে যেতে কোনো ভয় নেই। একবার কিন্তু ট্রেনের সামনে একটা মস্ত বুনো হাতি পড়েছিল। সে হয়তো ট্রেনটাকে নতুনরকমের কোনো জানোয়ার মনে করে থাকবে, তাই বোধহয় লাইনের উপর দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল যে সেটার সঙ্গে লড়বে কি ভাগবে। এমন সময় ড্রাইভার পোঁ করে বাঁশি বাজিয়ে ট্রেনখানাকে খুব জোরে চালিয়ে দিল আর হাতিও তা দেখে মাগো! বলে লেজ গুটিয়ে দে প্রাণপনে ছুট!

 ট্রেনখানি সেই বনের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কেয়োর মতো এঁকেবেঁকে চলে। ত্রিশ ফুট পথ এগুলে তার এক ফুট উঁচুতে ওঠা হয়। পথের ধারে বিশাল বড়বড় সব গাছ, তাতে নানা রঙের ফুলও আছে কোনো কোনোটাকে প্রকাণ্ড লতার জালে জড়িয়ে রেখেছে, কোনো কোনোটার গায়ে লম্বা-লম্বা দড়ির মতো শ্যাওলা ঝুলছে। নীচের দিকে তাকাই-উঃ! কি ঘন বন। পাহাড়ের গা ঢেকে দিনকে রাত করে রেখেছে। যদি গাড়ি থেকে পড়ে যাই, তাহলে অমনি বনের ভিতর দিয়ে গড়িয়ে কোথায় চলে যাব। উপরের দিকে তাকাই বাবা! কি উঁচু সব গাছ! জাহাজের মাস্তুলের মতো সোজাসুজি সেই কোথায় উঠে গিয়াছে। ত্রিশ-চল্লিশ হাত অবধি তাদের অনেকের গা একেবারে খালি, শুধু মাথায় খানিকটা ডালপালা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় না যে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনোরকম পরিচয় আছে। কিন্তু একটু ভালো করে দেখলে মাঝে মাঝে এক একটা শিমুল, কদম বা আর কোনো জানা গাছ ধরা পড়ে, তাদেরও সেইরকম হাড়গিলেপানা চেহারা।

 গাছের আলো না হলে চলে না। সেই আলোর জন্য ব্যস্ত হয়ে তারা রেষারেষি করে কেবলই উঁচু হতে থাকে। কেননা, ঘন বনের ভিতরে পাশ দিয়ে আলো খুব কমই আসতে পারে, পাশাপাশি বাড়বার জায়গাও নাই। এসব বনে যে বাশ যথেষ্ট আছে, সে কথা আগেই শুনেছ। এসব বাঁশের একেকটা এমনি মোটা যে খুব রোগা একজন লোকের কোমরের সঙ্গে তার একটাকে মেপে বাঁশটাই মোটা দাঁড়িয়েছিল।

 এর এক একটা চোঙ্গায় এক কলসী জল অনায়াসে ধরে। পাহাড়ী ললাকেরা এই চোঙ্গা দিয়েই কলসীর কাজ চালায়। কলসীর চেয়ে এগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলতে ফিরতে অনেক সুবিধা, তাতে আবার এগুলো সহজে ভাঙ্গে না। বনের ভিতরে বড়-বড় অনেক কলাগাছও দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু সে কলা বানরেও খেতে পারে কিনা সন্দেহ, তাতে এতই বীচি।

 এমনি বনের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে ঝাঁ করে ট্রেনখানা এক একটা ফাঁকা জায়গায় আসে;তখন দেখা যায় ইস, কত উঁচুতে উঠে এসেছি বাঙ্গালার মাঠ ঐ ধূধূ করছে। বড়- বড় নদীগুলি সাদা আঁচড়ের মতো সেই কোথায় চলে গিয়েছে।

 দেড় হাজার ফুট উঁচুতে উঠলে মেঘের সঙ্গে দেখা হয়। দেশে বসে আকাশের পানে তাকিয়ে আমরা যেসব ভারী ভারী মেঘ দেখতে পাই, তারা মোটামুটি এইরকম উঁচুতেই থাকে। ক্রমে হয়তো ট্রেন তার ভিতরে ঢুকে যায়। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে আমরা যাকে কুয়াশা বলি, এ ঠিক সেই জিনিস। দূরে থেকে তাকে দেখলেই সে মেঘ, আর ভিতরে ঢুকে দেখলেই সে কুয়াশা।

 ততক্ষণে বনের শোভা একটু কমে এসেছে, আর মেঘের আর মাঠের শোভা বাড়ছে।

মাঝে মাঝে একেকটা সুন্দর ঝরনাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আগে পাগলাঝোরা বলে একটা খুব বড় ঝরনা ছিল, তার পাগলামি একটু বেশি হলেই সে রেলের পথটা ভেঙ্গে ঠিক করে দিত। এখন পাহাড়ের গায়ে নানান দিকে পথ করে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কাজেই আর তার তেমন রাগ রঙ্গ নাই। তিন হাজার ফুটের উপরে উঠলে এই ঝোরাটাকে দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে যেসব মেঘের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এরপর থেকে তারা ক্রমেই নীচে পড়ে যেতে থাকে। তারপর ক্রমে মাঠের যে কী শোভা হতে থাকে, সে না দেখলে বুঝবার সাধ্য নাই। তখন আমাদের দেশের ভারী ভারী মেঘগুলোকে দেখে মনে হয় যেন তারা দল বেঁধে ঘাস খাবার জন্য মাঠে গিয়ে নেমেছে।

 এক মাইল উঁচুতে উঠলে প্রায় নববুই মাইল দূর অবধি মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এত দূর থেকে বিশেষ কিছুই বুঝতে পারা যায় না, কিন্তু মনের ভিতরে কি যে একটা আনন্দ হয় সে কি বলব!

 এতক্ষণে আর একটা খুব আনন্দের ব্যাপার ঘটে যায়। প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট অবধি ট্রেনখানা বড় বড় পাহাড়ের দক্ষিণদিক বেয়ে চলতে পাকে; সেসব পাহাড়ের উত্তরে যে কি আছে তা দেখা যায় না। তারপর যেই হঠাৎ একবার মোড় ফিরে, সেই পাহাড়গুলোকে ডান হাত ফেলে সে উত্তরমুখো হয়, অমনি দেখা যায়, হিমালয়ের সাদা সাদা বরফে ঢাকা চুড়োগুলো রোদে ঝিকমিক করছে।

 তারপরে শীতটিও ক্রমে জেঁকে উঠতে থাকে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে এবারে এক নতুন রাজ্যে আসা গেছে, তার নতুন রকমের হাওয়া, নতুনরকমের শোভা, সেখানে নতুন ধরনের মানুষ, নতুনতর মেঘের খেলা।

 দার্জিলিঙের পথে সবচেয়ে উঁচু ষ্টেশন হচ্ছে ঘুম। দার্জিলিং তারই এক ষ্টেশন পরে, আর খানিকটা নীচে। এই পথটুকু টেনখানি আপনি গড়িয়ে যায় ইঞ্জিনের আর তাকে টানতে হয় না। নেমে আসবার সময় দার্জিলিং থেকে ঘুম অবধি ট্রেনখানাকে ইঞ্জিনে টেনে পৌঁছে দেয়;তারপর ঘুম থেকে সুকনা অবধি ট্রেন অমনি চলে আসে। ইঞ্জিনখানা তাকে সামলে রাখবার জন্য সঙ্গে থাকে বটে, কিন্তু তাকে টানতে তো হয়ই না, ব্রেক কষে একটু পিছভাগে ঠেলে রাখতে হয়।

 ঘুম থেকে দার্জিলিং মোটে পাঁচ মাইল, এইটুকু যেতে আর বেশি সময় লাগে না। চলতে চলতে হঠাৎ একবার মোড় ফিরেই দার্জিলিং শহরটি দেখতে পাওয়া যায়। ময়রার দোকানে যেমন করে মিঠাইয়ের থালাগুলি সাজিয়ে রাখে, পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলি অনেকটা সেইভাবে সাজানো। দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। কিন্তু দার্জিলিঙের আসল শোভা ঘরবাড়িতে নয়, সে হচ্ছে মেঘের আর হিমালয়ের আর আলো আর ছায়ার শোভা।

 দেশে থেকে ঘরে বসে আমরা এই মেঘকেই দেখতে পাই:এই মেঘই সমুদ্রের কোলে জন্মলাভ করে, বাঙ্গালার মাঠের উপর দিয়ে এতখানি হাওয়া বেয়ে এসে দার্জিলিঙে উপস্থিত হয়েছে। দেশে বসে তো শিশুকাল থেকে একে দেখে দেখে বুড়ো হয়ে গেছি, তবে আবার এখানে এসে এর এত নতুন শোভা হল কোখেকে?

 শোভা হয়েছে এইজন্য যে আমাদের দেশে থাকতে দূর হতে উপরভাগে চেয়ে, তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম, আর এখন তার নিজের দেশে এসে, তার পেটের ভিতর ঢুকে তার নাড়ী-নক্ষত্র সব টের পাচ্ছি। আগে ছিলাম বিদেশী, এখন হয়েছি তা দেশের লোক। সে হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, আমাদের ঘরের ভিতরে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যায়। বেড়াতে বেরুলে আমার দাড়ি ভিজিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে রসিকতা করে। হাত ভিজাবে না, নাক মুখ কান কিছু ভিজাবে না, ধুতি ভিজাবে না, তা ভিজাবে না;ওর যত ঝোক আমার ঐ ঝাঁকড়া দাড়িগোঁফগুলোর উপরে আর পশমী কাপড় চোপড়ের উপরেও কতক। এসবের উপরে মুক্তার বিন্দু ছড়ানোই যেন তার কাজ।

 অনেকদিন ভোরের বেলায় উঠে দেখি, পাহাড়ের পিঠের উপরে মেঘের খোকারা ঘুমিয়ে আছে তাদের মাথার উপর দিয়ে হিমালয়ের ঝাপসা ছেয়ে রঙ্গের চূড়াগুলি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তখনো সূর্য উঠে নি, পুবের আকাশে লাজুক হাসির মতো একটু আলো দেখা দিয়েছে মাত্র। ক্রমে হিমালয়ের মুখ রাঙা হয়ে উঠতে লাগল, ব্যস্ত হয়ে রঙ ঢেলে তুলি নিয়ে বসলাম, মনে হল কতই কিছু আঁকব।

 দুষ্টু মেঘের খোকা! রোদের গন্ধ পেয়ে সে বেচারাও তাদের বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে। তারপর এক পা দু পা করে, না জানি কোন দেশের পানে তারা রওয়ানা হল। হিমালয় দিল ঢেকে, আমার আঁকবার আয়োজন সব দিল মাটি করে। দেখতে দেখতে তারা পাহাড় বন বাড়ি ঘর সব গ্রাস করে ফেলল। তখন আর আশপাশের বাড়ি ঘর গাছপালা কিছুই দেখবার জো নেই। আমাদের বাড়িখান যে মজবুত পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, পুষ্পক রথের মতো শুন্যে উড়ে পরীর মুলুকের পানে ছুটে চলছেনা, এ কথাটি বিশ্বাস করা ভার হয়ে উঠল। আবার তার দশ মিনিট পরেই দেখা গেল যে মেঘ উড়ে গিয়ে চারদিক রোদ ঝকমক করছে।

 সারাদিন ভরে এমনিতর খেলা। কখনো গেঁড়ির মতো হামা দিয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠে, কখনো ভেড়ার পালের মতো পাহাড়ের গায়ে বসে দল বেঁধে বিশ্রাম করে, কখনো বিশাল দৈত্যের মতন উঠে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি আড়াল করে ফেলে। ঐ যে ভারী ভারী মেঘগুলো জল ঢেলে আমাদের দেশ ভাসিয়ে দেয়, তাদের এক একটা যে কত উঁচু, তা এখানে এলে বেশ বুঝতে পারা যায়।

 ঐ দেখ সকল পাহাড়ের হাঁটুর নীচে, বাংলাদেশের মাটির কাছে, তার তলা থেকে বৃষ্টির ধারা নামছে, আর তার মাথা দশ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় ছাড়িয়ে আরো প্রায় দশ হাজার ফুট উপরে উঠে গিয়েছে।

 সারাদিন ভরে এমনিতর খেলা। তারপর সন্ধ্যাবেলায় শীত লেগে, আবার হয়তো তাদের ঘুমের কথা মনে হয়;অমনি তারা পাহাড়ের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, না হয় দুই পাহাড়ের মাঝখানের গর্তে নেমে, তাকে পরিপূর্ণ করে, বিশ্রাম করতে থাকে। দেখলে মনে হয়, না জানি কোন ধুনুরী মেঘের তুলো ধুনে রেখে দিয়েছে তা দিয়ে ঘুম পাড়ানী মাসির লেপ তয়ের হবে

 মনে করো না যে রোজই এমনিতর হয়। এর শোভা নিত্য নুতন। কখনো বা মেঘে আর রোদে মিলে পাহাড়ের গায়ে রঙ বেরঙের ঢেউ খেলিয়ে চোখ জুড়িয়ে দেয়, কখনো বা ঘড় ঘড় গর্জনে দিক বিদিক্‌ আঁধার করে, দিনের পর দিন খালি জলই ঢালতে থাকে। বর্ষাকালের আগাগোড়াই প্রায় এমনি ভাব। তখন প্রাণ ঝালাপালা হয়ে যায়, আর এদেশে থাকতে ইচ্ছা হয় না।

 বৎসরে মধ্যে শরৎকালটি এখানে সকলের চেয়ে সুন্দর, তখন আকাশ পরিষ্কার থাকে আর হিমালয়ের অতি চমৎকার শোভা হয়। কিন্তু তার কথা আরেক দিন বলব।

 যত উঁচুতে ওঠা যায়, ততই শীত। কলকাতার চেয়ে দার্জিলিঙে বেশি শীত, আবার দার্জিলিঙের চেয়ে হিমালয় পর্বতের উপবে বেশি শীত। সেখানে বারো মাসই বরফ পড়ে থাকে, তাই সেসব পাহাড় দেখতে সাদা।

 অবশ্য দার্জিলিঙও হিমালয়ের উপরে, কিন্তু তত উঁচুতে নয়। আগে কতকগুলো ছোটছোট পাহাড় পার হয়ে তবে হিমালয়ে পৌঁছাতে হয়। দার্জিলিঙ সেই ছোট পাহাড়ের উপরে। এগুলোকে বলে উপ-হিমালয়। দার্জিলিং থেকে উত্তরদিকে তাকালে হিমালয় যে কি সুন্দর দেখা যায়, কি বলব। এত উঁচু পাহাড় পৃথিবীতে আর কোথাও নাই:এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সারবাঁধা এতগুলো বিশাল পর্বতও আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। নীচের দিকে তাকাও, রঙ্গিত নদী দেখতে পাবে, সে প্রায় বাংলার মাঠের সমানই নিচু। উপরের দিকে তাকাও, দেখবে হিমালয় চূড়াগুলি যেন আকাশের গায়ে ঠেকে আছে তার সকলের চেয়ে উচুটি পাঁচ মাইলেরও বেশি উঁচু। রঙ্গিতের ধারে প্রায় আমাদের এখানের মতনই গরম, আর হিমালয়ের উপরে ভয়ংকর ঠাণ্ডা। সেখানে আজও কেউ যেতে পারে নি, যদিও অনেক চেষ্টা করছে। গাছপালা সেখানে জন্মায় না, খুব উপরে জীবজন্তু থাকবার জো নাই।

 এত উঁচুতে বাতাস এমন হাল্কা যে নাক দিয়ে ভালো করে নিশ্বাস ফেলাই কঠিন। কুড়ি হাজার ফুট উঁচুতে গেলেই হাঁপ ধরে অস্থির করে দেয়;কাঞ্চনজঙ্ঘার উপরে গেলে কেমন হবে, তা তো কেউ বলতেই পারে না। কাঞ্চনজঙ্ঘা হচ্ছে দার্জিলিঙের ওখানকার সবচেয়ে উঁচু পর্বত, ২৮১৫৬ ফুট উঁচু, তারপর জানু, ২৫৩০৪ ফুট, তারপর কব্রু, প্রায় ২৪০০০ ফুট, তারপর পণ্ডিম, ২২০১৭ ফুট, তারপর নর্সিং, ১৮১৪৫ ফুট। এমনি করে পরপর কত যে দাঁড়িয়ে আছে, আমি তা বলে শেষ করতে পারব না। আর এই বুড়া বয়সে তাদের সব কটার নাম মুখস্থ করতে গেলে আমার প্রাণই বেরিয়ে যাবে।

 আমরা বলি কাঞ্চনজঙ্খা, কিন্তু আসলে নাকি সেটা বাংলা কথা নয়। আসল কথাটি হচ্ছে ‘খাচেন-ঝ-ঙ্গা। তার মানে বলছি, শুন। খাচেন’ কিনা বড্ড হিম; ঝ’ মানে পাঁচ;আর ‘ঙ্গ’ হচ্চে পর্বত।

 অর্থাৎ কিনা পাঁচটি পর্বত মিলে ঐ পর্বতটি হয়েছে আর সেখানে বড় হিম। এ কথা আমি একটি পুস্তকে পড়েছিলাম, সুতরাং সত্য হওয়া আশ্চর্য নয়।

 হিমালয়ের আরেকটা চূড়া আছে সে কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও উঁচু। তোমরা অনেকেই তার নাম শুনেছ। ইংরাজরা তাকে বলে এভারেস্ট, দেশী লোকেরা বলে গৌরীশঙ্কর, পাহাড়ীরা নাকি বলে ধেও-গঙ্গা। তার মানে যে কি, সে কথা আমি বলতে পারব না। আরেকটু হলেই এই পর্বতটি দার্জিলিং থেকে দেখা যেত। সিঞ্চল থেকে তার আগা দেখতে পাওয়া যায়।

 এতগুলো বড় বড় পর্বত এক জায়গায় থাকার একটু অসুবিধা আছে। এ বলে, আমাকে দেখ। ও বলে, আমাকে দেখ।’ কাজেই ওরা যে বাস্তবিকই কত বড়, সে কথা চট করে মাথায় আসে না। আমাদের বাংলার মাঠে এর একটাকে পাওয়া যেত, তবে তার আদর বেশ ভালো করেই হত। এদেশের পরেশনাথ পর্বতখানি ৪৫০০ ফুট মাত্র উঁচু, তাকে দেখেই কত লোকে অবাক হয়ে যায়।

 আর এক কথা এই হচ্ছে যে এ সকল পর্বত যে দার্জিলিঙের খুবই কাছে, তা নয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা সেখান থেকে সোজাসুজি পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে। কিন্তু পাহাড়ের পথ দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে প্রায় দুশো মাইল হাঁটতে হয়। অথচ, সেখানকার হাওয়া যারপরনাই পরিষ্কার বলে তাকে এতই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় যে তাকে এত দূরের জিনিস বলে বোঝাই কঠিন হয়। কাজেই সে আসলে যত বড়, দেখলে মনে হয় যেন তার চেয়ে ঢের ছোট।

 যে হিমালয়ে না গিয়েছে সে বুঝতেই পারবে না সেখানকার হাওয়া কত পরিষ্কার। দশ মাইল দূরের জিনিসটিকে এত স্পষ্ট দেখা যায় যে মনে হয় যেন সে দু তিন মাইল মাত্র দূরে। কুড়ি মাইল, পঁচিশ মাইল দূরে পাহাড়ের উপরে বাড়ি আছে, পরিষ্কার দিনে তাতে রোদ পড়ে ঝক ঝক করতে থাকে। এত দূর থেকে নিতান্তই বিন্দুটির মতো ছোট দেখায়, নইলে তার দরজা জানলা গুণে দেওয়া যেত।

 এই পরিষ্কার বাতাসেই হিমালয়কে এমন ঝকঝকে করে রেখেছে। সেখানকার রোদের একটা জ্যোতি আছে, যা আমাদের এই ধুলোমাখা রোদে নাই। তার উপরে আবার ঝকঝকে বরফ। তার উপরে রোদের খেলা একবার যে দেখেছে সে আর জন্মে তা ভুলতে পারবে না। যদি পারে, সে বড় দুঃখী লোক।

 ভোরে আর সন্ধ্যায় যখন ঘন ঘন রোদের রঙ বদলাতে থাকে, তখন হিমালয়ের চেহারাও পলে পলে নূতন হতে থাকে। এই মিছরির কুঁদোর মতে, এই আগুনের মতে, এই সোনার মতো, এই মুক্তোর মতে, এই গরদের উপর চাঁদির কাজের মতো, এই খড়ির মতো যেন জাদুকরের ভেল্কি। এমনি করে দিনটি কেটে গিয়ে বিকালে আবার সোনার মতো, পাহাড়ের মাথায় সেই মানিকের মতো বরফ, সে যে কি সুন্দর, তার তুলনা কোথাও নাই। রাজরানীর বহুমূল্য পোশাক আর মুকুট তার কাছে লাজে মাথা হেঁট করে।

 এমনি করে রাত্রি এসে উপস্থিত হয়। তখন যদি আকাশে উজ্জ্বল চাদ থাকে, তবে তার শোভা হয় যেন আরো চমৎকার। অবশ্য তাতে তেমন তাক লাগিয়ে দেয় না, কাজেই সকলের কাছে তার তেমন আদর নাও হতে পারে। কিন্তু যে বোঝে, সে দেখেই বলে, আহা!

 লোকে বলেছে ওখানে দেবতাদের বাস। এমন সুন্দর জিনিস দেখে ও কথা বলবে, এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নাই। ও যে কতখানি সুন্দর, এসব কথায় তাই বোঝা যাচ্ছে।

 যা হোক, দূরে থেকে সুন্দর হলেও, ও সকল বড় ভয়ংকর স্থান। হিমালয় পার হয়ে তিববত যেতে হয়, কিন্তু পার হওয়ার মতো নিচু জায়গা ওতে বেশি নাই। যে কয়েকটি জায়গা আছে, তার কোনটাই প্রায় পনেরো যোলো হাজার ফুটের কম উঁচু হবে না। তাতেও আবার শীতকালে যাবার জো নাই, কারণ তখন সেসব জায়গা বরফে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মকালে চমরীর পিঠে চড়ে, ঝড়ের শীতের আর বরফের তাড়ায় নাকাল হয়ে, অনেক কষ্টে সে পথে চলতে হয়।