উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/ধূমকেতু

ধূমকেতু

 যাত্রায় যেমন সং, আকাশে তেমনি ধূমকেতু। আকাশের গ্রহ নক্ষত্রগুলির সকলেরই এক একটা নিয়মিত কাজ আছে; কিন্তু ধূমকেতুগুলিকে দেখিলে হঠাৎ মনে হইতে পারে, যে


ইহাদের কোন বাঁধা কাজ নাই। কোথায় যায় কোথায় থাকে তাহার ঠিক নাই, খালি মাঝে মাঝে এক একবার লেজ পরিয়া আসিয়া, দিন কয়েক তামাসা দেখাইয়া যায়।

 আমি দেখিয়াছি, যাত্রায় সং আসিলে, কোন কোন ছোট ছেলে ভ্যাঁ করিয়া কাঁদিয়া ফেলে। ধূমকেতু দেখিলে কেহ কাঁদে কি না জানি না। কিন্তু সেকালে অনেক লোকেরই বিশ্বাস ছিল, যে ধূমকেতু উঠিলে বড়ই ভয়ের কারণ হয়। হয় ভয়ানক মারিভয় হইবে, না হয় দুর্ভিক্ষ হইবে; আর কিছু না হইলেও অন্ততঃ একটা রাজা টাজা কেহ মরিবে।

 ক্রমে ইহাদের সম্বন্ধে লোকে যতই বেশী জানিয়াছে, ইহাদের সম্বন্ধে ভয়ও ততই কমিয়াছে। কিন্তু তাহা খুব অল্পদিনে হয় নাই।

 ধুমকেতু কি জিনিস, তাহা এখনও একেবারে স্থির হয় নাই। ইহাতে জিনিস যে খুব সামান্য—আর যাহা আছে, তাহাও যে ধোঁয়ার মতন, তাহা অনেকদিন আগেই বুঝা গিয়াছিল। একটু শক্ত ভারি জিনিসের অমন খামখেয়ালী চালচলন হয় না।

 খামখেয়ালী নয়? আচ্ছা অত বড় একটা লেজের তার কি দরকার বল দেখি! কোন কোনটির আবার একটি লেজে মন উঠে না। দুটি তিনটি— একটার আবার ছটি লেজ দেখা গিয়াছিল। আর একটা প্রথমে ভাল মানুষের মতন আসিয়াছিল; তারপর দুদিনের ভিতরে কোথা হইতে ছয় কোটি মাইল লম্বা এক লেজ বাহির করিল। কেহ কেহ আবার একলাটি আসেন, তারপর দুটিতিনটি হইয়া যান।

 এ সকল দেখিলে এই কথাই বলিতে হয়, যে শক্ত জিনিসের ওরূপ করা সম্ভব না। ধোঁয়া হইলে সবই সম্ভব হয়। ধোঁয়া যে, তাহা আর একটা বিষয় হইতে বেশ বুঝিবে। এক একটা ধূমকেতু এত মোটা, তাহার লেজটা লক্ষ মাইল পুরু, তথাপি তাহার ভিতর দিয়া পিছনের তারাগুলিকে পরিষ্কার দেখা যায়।

 এমন যন্ত্র আছে, যে তাহার ভিতর দিয়া কোন জ্বলন্ত জিনিসের আলোক পরীক্ষা করিলে, সেই জ্বলন্ত জিনিসটা কি তাহা বলিয়া দেওয়া যায়। এই যন্ত্রের নাম বর্ণবীক্ষণ (Spectroscope)। এই যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, যে ধূমকেতুতে অঙ্গার লোহা, সীসে ইত্যাদির জ্বলন্ত বাষ্প আছে। এই বাষ্প এত পাতলা অবস্থায় আছে, যে মোটের উপরে তাহাদের পরিমাণ অতি সামান্য। এমন কি, কোন উপায়ে যদি একটা ধূমকেতুকে ধরিয়া ঘন করা যাইত, তাহা হইলে হয়ত তোমরা তাহাকে পকেটে পুরিতে পারিতে। খুব বড় ধূমকেতুর ওজনও কয়েক সেরের বেশী হইবে না।

 ডাক্তার হেলী নামক এক জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি পুরাতন পুস্তকাদি পড়িয়া দেখিলেন যে ১৫৩১, ১৬০৭ এবং ১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দে এক একটা ধূমকেতু উঠিয়াছে। মোটামুটি প্রায় একই সময় অন্তর এক একটা ধূমকেতুর উদয় দেখিয়া, ডাক্তার হেলী মনে করিলেন, যে হয়ত একই ধূমকেতু ঐরূপ ৭৫।৭৬ বৎসর লাগে। এ কথা যদি সত্যি হয়, তবে ১৭৫৯ সালে ঐ ধূমকেতুর আবার ফিরিয়া আসিবার কথা। বাস্তবিক ১৭৫৯ সালে ঐরূপ এক ধূমকেতু আসিয়া উপস্থিত হইল। এরপর আর বুঝিতে বাকি রহিল না, যে ঐ ধূমকেতুটি এক নির্দিষ্ট পথে চলে, এবং একবার সেই পথ ঘুরিয়া আসিতে ৭৫।৭৬ বৎসর লাগে। ডাক্তার হেলী এই কথা প্রথম প্রমাণ করিলেন, সুতরাং এই ধূমকেতুর নাম “হেলীর ধূমকেতু” রাখা হইল।

 ইহার পর হইতে এ পর্যন্ত জ্যোতিষশাস্ত্রর অনেক উন্নতি হইয়াছে, আর খুব ভাল ভাল দূরবীক্ষণ প্রস্তুত হইয়াছে। এই সকলের সাহায্যে এখন হামেশাই ছোট বড় বিস্তর ধূমকেতু দেখিতে পাওয়া যায়। চক্ষে ইহার সবগুলি দেখিতে পাওয়া যায় না, তাই আমরা বুঝিতে পারি না, যে ধূমকেতু এমন সচরাচর দেখা সম্ভব। এখন আর পুরাতন পুঁথি খুঁজিয়া ধূমকেতু উঠিবার সময় স্থির করিতে হয় না। দিনকতক একটা ধূমকেতুকে দেখিলেই এখন জ্যোতির্বিদরা তাহার নাড়ী-নক্ষত্র সমস্ত বলিয়া দিতে পারেন। সে কোন্‌ পথে চলে, কয় দিনে ফিরিয়া আইসে, ঘণ্টায় ক’মাইল যায়—ইত্যাদি সকল কথাই এখন স্থির করা যায়।

 এমন ধূমকেতু আছে, যে তাহা সওয়া তিন বৎসর পর পর একবার ফিরিয়া আইসে। আবার এক লক্ষ বৎসর পরে একবার আইসে এমন ধূমকেতুও আছে। আবার ধূমকেতুর পথ বাহির করিতে গিয়া এমন ধূমকেতুও পাওয়া গিয়াছে, যে তাহারা আর কদাপি ফিরিয়া আসিবে না।

 ধূমকেতুগুলি এত বড় বলিয়া তাহাদিগকে দেখিলে সহজে বিশ্বাস হয় না, যে তাহারা এত হাল্কা। আগেকার লোকেরা অনেক সময় এই মনে করিয়া ভয় পাইত, যে এই ধূমকেতু গুলির যখন এত বুনো মেজাজ, তখন একটা পাগলা ধূমকেতু যদি ছুটিয়া আসিয়া পৃথিবীকে ঢুঁ মারে, তবে কি ভয়ানক কাণ্ডই হয়। কিন্তু এরূপ হাল্‌কা জিনিসের দ্বারা পৃথিবীর কোন অনিষ্ট হওয়ার বিশেষ আশঙ্কা দেখা যায় না। ১৮৬১ সালে একটা অতি প্রকাণ্ড ধূমকেতু উঠিয়াছিল। অনেকে বলেন, যে সেই সময়ে পৃথিবী সেই ধূমকেতুর লেজের ভিতর দিয়া চলিয়া আসিয়াছে, কিন্তু তাহাতে কাহারও বিশেষ কিছু হয় নাই। আর একবার একটা ধূমকেতু বৃহস্পতিকে ঘেঁসিয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাহাতে বৃহস্পতির কিছুই হয় নাই। বৃহস্পতির কিছু হয় নাই বটে; কিন্তু ধূমকেতু বেচারা কেমন থতমত খাইয়া পথ ভুলিয়া গেল। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, জগতের সকল জিনিসই সেইরূপ পরস্পরকে টানে। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি সকলেই পরস্পরকে টানে। ধূমকেতু বৃহস্পতির কাছ দিয়া যাইবার সময় বৃহস্পতিও তাহাকে ঐরূপ টানিয়াছিল। ধূমকেতুগুলি সূর্যের কাছে আসিয়া ভয়ানক গোঁ করিয়া ছুটে। এই গোঁ করিয়া ছুটয়াছিল বলিয়াই সে যাত্রা সেই ধূমকেতু বৃহস্পতির হাত এড়াইয়া গেল— কিন্তু সেই টানাটানিতে আর তাহার পথ ঠিক রহিল না। আগে এই ধূমকেতু ৫/ বৎসর অন্তর এক-একবার আসিত। কিন্তু ১৭৭৯ খ্রীষ্টাব্দে বৃহস্পতির কাছে তাড়া খাইয়া সেই যে সে পলাইয়াছে, এ পর্যন্ত আর ফিরে নাই।

 আমি বলিতেছিলাম, যে ধূমকেতু সূর্যের কাছে আসিলে খুব ছুটে। বাস্তবিক ইহার চরিত্র অতি অদ্ভুত। সূর্যের নিকটে আসিলেই ইহার মাথায় গোল লাগিয়া যায়। তখন ইহাকে দেখিলে মনে হয়, যেন কুকুরের সামনে বিড়াল পড়িয়াছে। দূরে থাকিতে ধীরে ধীরে চলিয়াছিল—এত ধীরে ধীরে, যে ইচ্ছা করিলে আমরাও তেমনি ছুটিতে পারি। তখন তাহার তেমন ভয়ানক লেজও ছিল না; দূরবীন দিয়া তাহাকে একটা ঝাপ্‌সা তুলার ডেলার মতন দেখা যাইত। ক্রমে যতই সূর্যের কাছে আসিতে লাগিল ততই উজ্জ্বল আর গরম হইতে লাগিল। এত উজ্জ্বল, যে অনেক সময় দুপুরবেলায় সূর্যের কাছেও তাহাকে দেখা যায়। ক্রমে লেজটি দেখা দিল, আর সেই লেজটিকে অতি সাবধানে সূর্যের দিক হইতে ফিরাইয়া রাখিতে লাগিল। বেগ প্রায় লক্ষগুণ বাড়িয়া গেল। আবার সূর্যের নিকট হইতে চলিয়া যাইবার সময় ক্রমেই শান্তভাব ধারণ করিল।

 একবার একটা ধূমকেতু হঠাৎ দুইভাগ হইয়া যায়। সেই দুইভাগ স্বতন্ত্র দুইটা ধূমকেতুর মতন একই পথে চলিতে থাকে। এই ধূমকেতুর নাম “বিয়েলার ধূমকেতু” অর্থাৎ বিয়েলা নামক একজন পণ্ডিত ইহার আবিষ্কার করিয়াছিলেন। বিয়েলার ধূমকেতু ৬/ বৎসর পরপর ফিরিয়া আসিত। ১৮৪৫ সালে এই ধূমকেতু দুভাগ হইয়া গেল;আবার ১৮৫২ সালে সেই দুইভাগ একসঙ্গে ফিরিয়া আসিল। ইহার পর আর এ পর্যন্ত তাহাদিগকে দেখা যায় নাই। কিন্তু এই ধূমকেতু আকাশে যে পথে চলিত, পৃথিবী সেই পথের কাছ দিয়া যাইবাব সময় ক্রমাগত তিনবার খুব উল্কাবৃষ্টি হইয়াছে। পণ্ডিতেরা বলেন, যে বিয়েলার ধূমকেতু হইতেই এই উষ্কাগুলির উৎপত্তি। ১৮৮২ সালে খুব বড় একটা ধূমকেতু উঠিয়াছিল। ইহার পর আর এত বড় ধূমকেতু দেখা যায় নাই এই ধূমকেতুর লেজ দশকোটি মাইল লম্বা ছিল। এই ধূমকেতুর ছবিতে দেখ, তারাগুলি তাহার ভিতর দিয়া কেমন স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। ইহার মাথার চারিদিকে এবং সামনে খানিকদূর পর্যন্ত খুব পাতলা একখানি আবরণের মত দেখা যায়। লেজটি কেমন একটু বাঁকা দেখ। মাথাটাই খুব উজ্জ্বল, আর সেই দিকে সূর্য আছে। অনেক সময় মাথার ভিতরে আবার একটি বীচির মতন দেখা যায়। মোটামুটি ধূমকেতুর চেহারা এইরূপ হয়; তবে কোন দুইটি ধূমকেতুর চেহারাই অবিকল একরূপ হয় না।