উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/স্যাণ্ডো
স্যাণ্ডো
একটা ষণ্ডা ছেলে একটা রোগা ছেলেকে মারিয়াছিল। রোগা ছেলেটা উল্টাইয়া মারিতে সাহস পাইল না। সে বলিল যে, “আমার গায়ে খুব জোর থাকলে তোকে দেখাইতাম।”
বাস্তবিক গায়ে খুব জোর থাকাটা নেহাত মন্দ নয়। পাঠক পাঠিকারা কি মনে করেন জানি না; কিন্তু আমি যদিও খুব বেশী রোগা নই, তবু আমার মনে হয়, যে গায়ে আরো অনেকখানি জোর থাকিলে ভাল হইত।
নিজের গায়ে জোর থাকিলে ত ভাল লাগিবারই কথা। অন্যের গায়ে জোর থাকিলে, তাহার কথা বলিয়াই কত সুখ পাওয়া যায়। সেই জন্যই হনুমান, ভীম, ইঁহারা সকলের এত প্রিয় হইয়াছেন। আর সেই জন্যই আজ স্যাণ্ডে সাহেবের সম্বন্ধে কিছু বলা হইতেছে।
স্যাণ্ডো জাতিতে জর্মন। পৃথিবীতে এখন ইনিই সকলের চাইতে বলিষ্ঠ লোক। ছেলেবেলা ইনি রোগ ছিলেন। এমন কি, ইহার মা-বাপ মনে করিয়ছিলেন, যে ইনি খুব বেশিদিন বাঁচিবেন না। এই স্যাণ্ডো খালি নিজের চেষ্টায় এখন পৃথিবীর মধ্যে সকলের চাইতে বলবান। আর, তিনি বলেন যে, চেষ্টা করিলেই সকলেই তাঁহার মত হইতে পারেন।
আঠার বৎসর পর্যন্ত স্যাণ্ডো খুবই রোগী ছিলেন। ইহার পর এনাটমি শাস্ত্র পড়িয়া, তিনি এক নূতন ব্যায়াম প্রণালী অনুসারে ব্যায়াম করাতে, তিন বৎসরের মধ্যে তাঁহার শরীরের বল ভয়ানক বাড়িয়া গেল।
এই সময়ে স্যাম্সন্ আর তাহার ছাত্র সাইক্লপ, এই দুজনে পালোয়ান, লণ্ডন নগরে
তামাসা দেখাইতেছিল। তাহদের গায়ের জোর দেখিয়া সকলে আশ্চর্য হইয়া যাইত। স্যামসন্ বিজ্ঞাপন দিয়াছিল, “সাইক্লপের তামাসা গুলি যে করিতে পরিবে, সে ১৫০০ টাকা পাইবে। আর আমাকে যে হারাইতে পরিবে, সে ১৫০০০ টাকা পাইবে।”
এই সংবাদ শুনিয়া স্যাণ্ডো লণ্ডনে আসিযা উপস্থিত হইলেন। স্যাম্সন্ রোজ তামাসা শেষে চেঁচিয়া বলে, “সাইক্লপের তামাসাগুলি যে করিবে, তাহাকে দেড়হাজার, আর আমাকে যে হারাইবে, তাহাকে পনের হাজার টাকা দিব।” কিন্তু এ পর্যন্ত কেহ তাহার কথায় উত্তর দেয় নাই। সেদিনও সে ঐ কথাগুলি বলিয়া নিয়ম রক্ষা করিল। স্যাম্সন্ মনে করে নাই যে কেহ উত্তর দিতে দাঁড়াইবে। এমন সময় স্যাণ্ডোর পক্ষ হইতে একজন উঠিয়া বলিলেন, “তোমার টাকা কোথায় দেখাও। আমার একজন পালোয়ান আছে।” স্যামসন ১৫০০ টাকার একখানা নোট উপস্থিত করিল।
স্যাণ্ডো আস্তে আস্তে স্টেজে (অর্থাৎ যেখানে তামাসা দেখান হয়, সেইখানে) গেলেন। সাধারণ ভদ্রলোকের পোষাক পরিয়া তিনি গিয়াছিলেন, সে পোষাকে তাঁহাকে তেমন ষণ্ডা দেখাইতেছিল না; তাই প্রথমেই অনেকে তাঁহাকে বিদ্রুপ করিতে লাগিল। স্বয়ং স্যাম্সন্ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। যাহা হউক স্যাণ্ডো যখন কোট খুলিলেন, তখন আর এত হাসির অবসর রহিল না।
সাইক্লপ প্রথমে ২৮ সের ওজনের দুইটা জিনিস দুহাতে লইয়া সেগুলিকে মাথার উপরে তুলিল। ইহার মধ্যে তাহার হাত আগাগোড়াই ঠিক সোজা রহিল। স্যাণ্ডো অবিকল সেইরূপ করিলেন।
তারপর সাইক্লপ ৩ মন ওজনের একটা বারবেল (লম্বা লোহার ডাণ্ডা, তাহার দুই মাথায় দুইটা গোলা) দুহাতে মাটি হই৩ে মাথার উপরে তুলিল। স্যাণ্ডো যখন তাহাও করিলেন, তখন সকলে হাততালি দিতে লাগিল। তাহা দেখিয়া স্যাণ্ডো এক হাতেই সেই বারবেলটাকে মাটি হইতে উপরে তুলিয়া দেখাইলেন।
এরপর সাইক্লপ একহাতে দুই মণ পনের সের ওজনের একটা ডম্বেল্ উঠাইয়া, সেই হাতটাকে সোজা করিয়া বাড়াইয়া রাখিল; এবং আর এক হাতে একমণ ওজনের একটা ডম্বেল্ মাথার উপরে তুলিল। স্যাণ্ডোও সেইরূপ করিলেন।
সাইক্লপ এই সকল তামাসাই দেখাইত সুতরাং সকলেই মনে করিল, যে স্যাণ্ডোর জিৎ হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে স্যামসন গোলমাল করিতে লাগিল। সেখানকার গণ্যমান্য লোকদের একজন মধ্যস্থ হইয়া মীমাংসা করিয়া দিলেন যে, সাইক্লপ্ আর দুইটা তামাসা দেখাইবে, তাহা যদি স্যাণ্ডো করিতে পারেন, তবেই স্যাণ্ডোর জিৎ হইবে। স্যাণ্ডো বলিলেন যে, ‘দুইটা কেন, কুড়িটা বলুন, তাহাতেও রাজি আছি।” সাইক্লপ্ চিৎ হইয়া শুইয়া তিন মণ ওজনের একটা জিনিস তুলিল, সে জিনিসটার উপর আবার দুজন লোক উঠিয়া দাঁড়াইল। তারপর লোক দুজন নামিয়া গেল, আর সাইক্লপ্ সেই ভারি জিনিসটাকে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। স্যাণ্ডোও ঠিক ঐরূপ করিলেন।
সকলের শেষে প্রায় সওয়া ছয়মন একটা পাথরের সঙ্গে আরো একমণ ষোল সের বাঁধিয়া দেওয়া হইল। সাইক্লপ্ দুটা চেয়ারের উপরে দাঁড়াইয়া এক আঙ্গুলে এইগুলিকে মাটি হইতে প্রায় চার ইঞ্চি উঠাইল। ইহাও যখন স্যাণ্ডো করিয়া দেখাইলেন, তখন সাইক্লপের হার মানা ভিন্ন আর উপায় রহিল না। সুতরাং এক হাজার পাঁচশত টাকার পুরস্কারটা তাঁহাকে দিতে হইল। পুরস্কার পাইয়া স্যাণ্ডো বলিলেন, “আমি শুধু ১৫০০ টাকার জন্য আসি নাই। ১৫০০০ টাকার পুরস্কারটাও লইয়া যাইতে ইচ্ছা করি।” কিন্তু স্যাম্সন্ সেদিন আর কিছু করিতে রাজি হইল না। বলিল, “আগামী শনিবারে এস।”
শনিবারে লোকের ভিড় এত বেশী হইল, যে সামনের দরজা দিয়া কিছুতেই স্যাণ্ডো ঢুকিতে পাইলেন না। পিছনের দরজায় গিয়া দেখিলেন, সেটাও বন্ধ। দরজার পিছনে লোক আছে, অথচ সে কিছুতেই দরজা খুলিয়া দেয় না। শেষটা আর উপায় না দেখিয়া দরজার পিছনে এমনি এক ঘা লাগাইলেন, যে দরজার কব্জা খুলিয়া গেল। ভিতরের লোকটা ইহাতে খুব চোট পাইল। তাহাকে একশত পঞ্চাশ টাকা বক্সিস্ দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া স্যাণ্ডো ঘরে ঢুকিলেন।
এইদিকে স্যাম্সন স্যাণ্ডোর দেরী দেখিয়া বলিতে লাগিল, “এই দেখ সে আসিল না। আমি জানিতাম, সে আসিবে না। আমি আর দশ মিনিট দেখিব।”
যাহা হউক এই দশ মিনিটের আধ মিনিট থাকিতে স্যাণ্ডো আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
তামাসা আরম্ভ হইল, স্যামসন যাহা যাহা দেখায়, স্যাণ্ডোও তাহা করিয়া দেখাইলেন। এই সকল তামাসা সাইক্লপের তামাসার চাইতে ঢের শক্ত।
প্রথম তামাসা—প্রকাণ্ড একটা লোহার ডাণ্ডা এক হাতে লইয়া আর এক হাতের উপর মারিয়া সেটাকে বাঁকান।
দ্বিতীয় তামাসা—জাহাজ বাঁধা লোহার দড়ি বুকে জড়াইয়া বুক ফুলাইয়া তাহা ছেঁড়া।
তৃতীয় তামাসা —শিকল হাতে জড়াইয়া তাহা ভাঙ্গা। স্যাণ্ডো এর সমস্তই করিলেন। তারপর বলিলেন, “এখন আমি যাহা করি, তাহা কর দেখি”? এই বলিয়া তিনি দুইটা ডম্বেল্ লইয়া কসরৎ করিলেন,তাহার একটা তিন মণ কুড়ি সের, আর একটা দুই মণ কুড়ি সের ভারি।
এবারে স্যামসন বলিয়া উঠিল, “ও ঢের দেখিয়াছি ওসব ফাকি।” মধ্যস্থেরা কিন্তু বলিলেন যে, “স্যাণ্ডোর জিৎ হইয়াছে এখন টাকা কোথায়?” স্যাম্সন্ বলিল, “টাকা কাল পাবে।” এই “কাল পাবে” বলিয়া গোলমাল করিয়া আর সে টাকা দিল না। শেষটা সেই নাট্যশালার কর্তৃপক্ষেরা সওয়া পাঁচ হাজার টাকা দিয়া স্যাণ্ডোকে সন্তুষ্ট করিলেন।
স্যাণ্ডো একবার প্যারিসে বেড়াইতে গেলেন। সেখানে ছেলেবেলার একটি বিশেষ প্রিয় বন্ধুর সহিত তাঁহার দেখা হইল। ১০ বছর বয়সের পর আর দু’জনের দেখা হয় নাই; কাজেই দুজনার খুব আনন্দ হইল। ছেলেবেলায় দু’জনে খুব বিলিয়ার্ড খেলিতেন; সেই কথা মনে হওয়াতে তাঁহারা একটা হোটেলে বিলিয়ার্ড খেলিতে গেলেন। সেখানে আর কতকগুলি ফরাসী লোক উপস্থিত ছিল। তাহারা স্যাণ্ডো আর তাঁহার বন্ধুর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করিতে লাগিল, আর তাঁহাদের খেলা শেষ না হইতেই তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে চাহিল। যাহা হউক হোটেলের লোকেরা বলিল যে, “উহাদের ওরূপ করিবার কোন অধিকার নাই, তোমরা যতক্ষণ ইচ্ছা খেলিতে পার।” সুতরাং স্যাণ্ডো আর তাঁহার বন্ধু একবার খেলা শেষ করিয়া আর একবার খেলিতে লাগিলেন। তাঁহারা জার্মান ভাষায় কথা বলিতেছেন; ফরাসীরা তাহা না বুঝিয়া মনে করিল যে বুঝি তাহাদিগকে বিদ্রূপ করা হইতেছে। সুতরাং তাহারা আরো চটিয়া গেল। খেলা শেষ হইলে দুই বন্ধু একটা টেবিলে বসিয়া কিছু জলযোগ করিতেছেন, এমন সময় সেই ফরাসীদের মধ্য হইতে খুব একটা লোক আসিয়া স্যাণ্ডোর সঙ্গে ঝগড়া বাধাইল।
স্যাণ্ডো প্রথমে খুব শান্তভাবে উত্তর দিতেছিলেন। এমন কি দুবার চড় খাইয়াও তিনি সহ্য করিয়াছিলেন এবং তাহার বন্ধু তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিতে চাহিলে, তিনি হাতে ধরিয়া তাহাকে বারণ করিয়াছিলেন। স্যাণ্ডো অবশ্য খুব স্নেহের সহিতই বন্ধুর হাত ধরিয়াছিলেন, কিন্তু সেই ধরাতেই বন্ধুর হাতখানি ভাঙ্গিয়া যাইবার যোগাড় হইয়াছিল। তিনি তখন বুঝিতে পারিলেন, যে স্যাণ্ডো আর এখন সে লোক নহেন।
সেই ফরাসী কিন্তু স্যাণ্ডোর শান্তভাব দেখিয়া ক্রমেই চটিতেছিল। শেষটা তাহাকে নাকে এমনি এক কীল মারিল যে, নাক দিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। তাহার ধাক্কায় টেবিলে প্লেট হইতে ঝোল পড়িয়া স্যাণ্ডোর সবে সেইদিন পরা নূতন সুটটি মাটি হইয়া গেল। এমন অবস্থায় কাহার না রাগ হয়? স্যাণ্ডোও ত মানুষ। সুতরাং তিনি আস্তে আস্তে উঠিয়া ফরাসীর ঘাড় আর এক হাতে তাহার দুই-পা ধরিয়া তাহাকে মাটি হইতে তুলিলেন। তারপর তাহার হাঁটু আর মাথায় ঠোকাঠুকি করিয়া তাহাকে টেবিলে আছড়াইয়া ফেলিলেন। সেই আছড়ে টেবিলের চাল ভাঙ্গিয়া ফরাসী ভায়া মেঝেতে পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া রহিল। দেড়দিন সে স্বাসপাতালে এই অবস্থায় ছিল। অবশ্য এই ঘটনায় স্যাণ্ডোকে পুলিশে যাইতে হইয়াছিল। প্রথমে একটা পুলিশ তাহাকে ধরিতে আসিলে, হোটেলের লোকেরা তাহাকে বলিল যে, “আরো জনকতক সঙ্গে করিয়া আইস, এ বড় ভয়ানক লোক।” যাহা হউক স্যাণ্ডো থানায় যাইতে কোন আপত্তি করিলেন না। স্যাণ্ডোর সঙ্গে তাহার বন্ধু এবং সেই ফরাসীর বন্ধুরাও গেল। এই ঘটনায় স্যাণ্ডোর কোন দোষ ছিল না আগাগোড়াই সেই ফরাসীর দোষ, একথা সেই বন্ধুরা থানার লোকদিগকে বলাতে, তাহারা সহজেই স্যাণ্ডোকে ছাড়িয়া দিল।
স্যাণ্ডোর রাগ থামিয়া গেলে পর, সেই লোকটাকে এত আঘাত দিয়াছেন বলিয়া, তাহার মনে খুব ক্লেশ হইতে লাগিল। তিনি তাহাকে হাসপাতালে দেখিতে গেলেন। কিন্তু সে তাহার সহিত দেখা করিতে চাহিল না।
প্যারিসের সেই ঘটনার কিছুদিন পরে স্যাণ্ডো লণ্ডনে আসিলেন। সেখানে এক রাত্রিতে তিনি তামাসা দেখাইতেছেন, এমন সময় একটি ভদ্রলোক তাহার সহিত দেখা করিবার প্রার্থনা জানাইলেন। ভদ্রলোকটিকে কোথায় দেখিয়াছেন বলিয়া স্যাণ্ডোর মনে হইল, কিন্তু ঠিক চিনিতে পারিলেন না। ভদ্রলোকটি অনেক সৌজন্য দেখাইয়া কিছু জলযোগের জন্য স্যাণ্ডোকে নিয়া এক হোটেলে গেলেন। তখন ভদ্রলোকটি বলিলেন, “মিস্টার স্যাণ্ডো, বোধহয় আমাকে চিনিতে পারেন নাই?” স্যাণ্ডো বলিলেন, “না মহাশয়।”
তখন ভদ্রলোকটি বলিলেন, “চিনিলে হয়ত আমার সঙ্গে কথাই কহিতেন না।” ক্রমে জানা গেল, যে সেই ভদ্রলোক আর কেহ নহেন, সেই প্যারিসে স্যাণ্ডো যাহাকে ঠেঙ্গ ইয়াছিলেন, তিনিই। তিনি বলিলেন, “আমি আমার বন্ধুদের মধ্যে সকলের চাইতে ষণ্ডা। কিন্তু আমি কি জানিতাম, যে আপনি স্যাণ্ডো। তাহা হইলে কি আর আমি আপনার সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করি।” এইরূপ কথাবার্তার পর ভদ্রলোকটি সেইখানে স্যাণ্ডোর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করিলেন, এবং তাহার নিদর্শনস্বরূপ স্যাণ্ডোকে ১৫০০ টাকা মূল্যের একটি সোনার ঘড়ি উপহার দিলেন।
একবার স্যাণ্ডো আমেরিকা গিয়াছিলেন। সেখানে অনেক বড় বড় শহরে তামাশা দেখাইয়া লোককে আশ্চর্যাম্বিত করেন। কিন্তু সকলের চাইতে আশ্চর্য কাণ্ড হইয়াছিল, সানফ্রানসিস্কো নগরে, এক সিংহের সহিত তাঁহার যুদ্ধ।
একটা প্রকাণ্ড সার্কাসে সিংহ এবং ভালুকের যুদ্ধ হইবে বলিয়া বিজ্ঞাপন দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু দুইটা পশুকে এরূপ করিয়া ছেঁড়া ছিঁড়ি রক্তরক্তি করান আইনবিরুদ্ধ বলিয়া, পুলিসের লোক তাহা হইতে দিল না, অনেক লোক উৎসুক হইয়া টিকিট কিনিয়াছিল;তামাসা হইল না বলিয়া, তাহারা একটু নিরাশ হইল। তখন স্যাণ্ডো বলিলেন, “আমি ঐ সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করিব!” সিংহটা ছয় মণ ভারী। স্বভাবটি তার সিংহের পক্ষেও একটু একটু বেশী রকম হিংস্র। দিন সাতেক আগে তাহার রক্ষকটিকে জলযোগ করিয়াছে। স্যাণ্ডো বলিলেন, “এই সিংহের সহিত যুদ্ধ করিব!”
সিংহের সঙ্গে খালি বলেরই পরীক্ষা। সিংহ নখ দিয়া আঁচড়াইবে, দাত দিয়া কামড়াইবে। মানুষের ত আর তেমন নখ দাঁত নাই; সুতরাং একটা ছোরা বা অন্য কোনরকম অস্ত্র না হইলে কিরূপে আত্মরক্ষা হয়? কিন্তু অস্ত্র দিয়া পশুকে খোঁচাইলে নিষ্ঠুরতা হইবে; সুতরাং পুলিশ এ কথায় বাধা দিল। তখন অগত্যা ইহাই স্থির হইল যে, সিংহকে মুখোশ আর মোজা পরাইয়া দেওয়া হইবে। খালি গায়ের জোরের পরীক্ষা।
ইহাতেও স্যাণ্ডোর বন্ধুরা কহিতে লাগিলেন, “সিংহের এত জোর, যে এক চড় মারিয়া তোমার মাথা ছিড়িয়া ফেলিতে পারে।” যাহা হউক স্যাণ্ডো লড়িবেনই। দেশময় হুলস্থল পড়িয়া গেল।
যে তাবুতে তামাসা দেখান হয়, তাহাতে কুড়িহাজার লোক ধরে। এত লোকের সামনে তামাসা দেখাইতে হইলে, আগে একটু প্রস্তুত হইয়া লওয়াই দরকার। সুতরাং তামাসার আগে একদিন গোপনে সিংহের সহিত পরিচয় করিয়া লওয়ার ব্যবস্থা হইল।
অনেক লোক মিলিয়া, শিকল দিয়া বাধিয়া, সিংহ মহাশয়কে মোজা আর মুখোশ পরাইয়া দিল। সিংহ বিস্তর আপত্তি করিয়াছিল, সুতরাং তাহাকে এসকল পরাইতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগিল।
যে খাচায় লড়াই হইবে তাহা সত্তর ফুট লম্বা। লোকজন অতি অল্পই ছিল;কিন্তু যাহারা ছিল, তাহারা মনে করে নাই যে, স্যাণ্ডো এই খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়া আবার বাহির হইয়া আসিবেন। খালি হাতে খালি গায়ে স্যাণ্ডো খাচার ভিতরে প্রবেশ করিলেন। স্যাণ্ডোকে দেখিয়া সিংহ ভয়ানক রাগের সহিত লাফাইয়া তাঁহার ঘাড়ে পড়িতে গেল। কিন্তু স্যাণ্ডো হঠাৎ পাশ কাটাইয়া যাওয়াতে তাহ পারিল না। স্যাণ্ডো আর তাহাকে মাটিতে পড়িয়া আশ্চর্য হইবার অবসর দিলেন না। একহাতে গলা আর এক হাতে কোমর জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে কাধের সমান উচুতে তুলিলেন;তারপর আছড়াইয়া মেঝেতে ফেলিয়া দিলেন। এমন ব্যবহারে সিংহের রাগ হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক তাতে সেই সিংহটা আবার ভয়ানক রাগী। সে এমনি এক চড় উঠাইল, যে স্যাণ্ডো মাথা সরাইয়া না ফেলিলে, হয়ত তাহা গুড়াইয়া যাইত। কিন্তু স্যাণ্ডো তাড়াতাড়ি মাথা সরাইয়া লইয়া, তাহাকে আবার সাপটাইয়া ধরিলেন। সিংহের তখন প্রায় কলে ইঁদুর পড়ার গোছ হইল। সে কত চেষ্টা করিল, কিছুতেই স্যাণ্ডোর হাত ছাড়াইয়া যাইতে পারিল না। তারপর স্যাণ্ডো নিজেই তাহাকে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন।
এতক্ষণে সিংহটা এমন ভয়ানক রাগিয়াছে, যে সকলেই সাণ্ডোকে বাহিরে চলিয়া আসিতে বলিতে লাগিল। কিন্তু স্যাণ্ডোর ইচ্ছা, আর একবার শেষ পরীক্ষা হয়। তাই তিনি সিংহের দিকে পিছনে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন সে কি করে। সিংহও সেই মুহুর্তেই লাফাইয়া তাহার পিঠে চড়িয়া বসিল। তখন স্যাণ্ডো তাহার মাথার উপর দিয়া হাত বাড়াইয়া দুহাতে সিংহের গলা ধরিলেন;তারপর একটানে তাহাকে নিজের মাথার উপর দিয়া আনিয়া মেঝেতে আছড়াইয়া ফেলিলেন।
স্যাণ্ডো বাহিরে আসিলে দেখা গেল, যে মোজা পরা সত্ত্বেও সিংহ তাহাকে খুব আঁচড়াইয়াছে, তাহার সমস্ত শরীর বহিয়া রক্ত পড়িতেছে। স্যাণ্ডো তাহা গ্রাহ্যই করিলেন না। তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন, যে এখন আর ঐ সিংহের সঙ্গে প্রকাশ্যে লড়াই করাতে কোন মুশকিল হইবে না।
তামাসার দিন মোজা আর মুখোশ পরাইবার সময় সিংহটা এমনি রাগিয়া গেল, যে দুইটা শিকল ছিড়িয়া বাহির হইল। যাহারা তামাসা দেখিতে আসিয়াছিল, তাহারা এখন প্রাণ লইয়া পলাইবার পথ পায় না। চারিদিকে খালি চেচামেচি আর ছুটাছুটি, এমন সময় সিংহ দেখিতে পাইল, যে স্যাণ্ডো তাহার পানে তাকাইয়া আছেন। আমনি তাহার সেই রাগ আর তেজ কোথায মিলাইয়া গেল—তাহার আর নড়িবার শক্তি রহিল না। তখন সুযোগ বুঝিয়া তাহার খাচাটা কাছে আনা হইল। তারপর স্যাণ্ডে এক ধাক্কা দিয়া তাহাকে চিং করিয়া খাচার ভিতরে ফেলিয়া দিলেন, আর তৎক্ষণাৎ খাঁচার দরজা আঁটিয়া দেওয়া হইল। দুঃখের বিষয়, এত কষ্ট করিয়া সিংহকে মোজা মুখোশ পরাইয়া খালি কষ্টই সার হইল। সে সিংহ এতক্ষণে স্যাণ্ডোকে বেশ চিনিয়া ফেলিয়াছে সে আর কিছুতেই যুদ্ধে প্রস্তুত নহে। ধাক্কা খোঁচা, গুতো, কিছুতেই আর রাগ হয় না—নিতান্ত ভাল মানুষের ন্যায় সে সকল প্রকার অপমান সহ্য করিতে লাগিল। শেষে উপায়ান্তর না দেখিয়া স্যাণ্ডো সিংহের লেজটাকে দিয়া দড়ি পাকাইতে আরম্ভ করিলেন। ইহাতে যদিও সিংহ খুব রাগিয়া লাফ দিয়া তাহাকে ধরিতে আসিল, কিন্তু একবার সাপটিয়া ধরিয়া আছাড় দিবার পরই সেই রাগটুকু চলিয়া গেল। তখন সিংহ হয়ত মনে মনে বলিতেছেন যে, “তুই মোর দাদা!” সে যুদ্ধ ত আর করিলই না;বরং স্যাণ্ডে যখন তাহাকে ধরিয়া কাধে তুলিয়া পইচারি করিতে লাগিলেন, তখনও সে ছোট খোকাটির মতন চুপ করিয়া রহিল, যেন ঐরাপ করিয়া চলাই তাহার অভ্যাস।
আজকাল স্যাণ্ডে যেসকল তামাসা দেখান তাহার কথা কিছু বলিয়া আমরা এই গল্প শেষ করিব।
এক জোড়া (৫২খানা) তাস লইয়া সেই আস্ত জোড়াকে ছিঁড়িয়া দুভাগ করা, যেমন তেমন বীরের কর্ম নয়—একবার চেষ্টা করিয়া দেখিলেই পার। স্যাণ্ডো তিন জোড়া তাস উপরি উপরি সাজাইয়া তাহা ছিঁড়িয়া দুভাগ তারপর সেই দুভাগকে আবার উপরি উপরি রাখিয়া ছিড়েন। অর্থাৎ ছয় জোড়া তাস একসঙ্গে ছিঁড়িলে যাহা হয়, তাহাই করেন।
দশ মণ ওজনের একটি পোল বুকে লইয়া স্যাণ্ডো চিৎ হইয়া শয়ন করেন। তারপর দুজন লোক সেই পোলের উপর দিয়ে একখানি এক ঘোড়ারগাড়ি হাঁকাইয়া যায়। এইসকল জিনিসের ওজন সর্বশুদ্ধ প্রায় চল্লিশ মণ!
স্যাণ্ডো বলেন যে, বলবান্ হওয়া সকলের পক্ষেই সম্ভব। তিনি ছেলেবেলা নিতান্তইরোগী ছিলেন; তারপর নিজের আবিষ্কৃত প্রণালী অনুসারে ব্যায়াম করিয়া অদ্বিতীয় বীর হইয়াছেন। এই প্রণালী অনুসারে নিয়মমত ব্যায়াম করিলে, সকলেই তাঁহার মতন হইতে পারে, এই কথা তিনি স্পষ্টাক্ষরে বলিয়াছেন। স্যাণ্ডো Strength And How to obtain it নামক একখানা পুস্তক লিখিয়াছেন। তাহাতে তাহার জীবন এবং ব্যায়াম প্রণালীর বিবরণ লেখা আছে আমার পরিচিত অনেকেই এই প্রণালীতে ব্যায়াম করিয়া বিশেষ উপকার পাইতেছেন। এই প্রণালীর বিশেষ গুণ এই যে, ইহা অন্য সকল প্রণালী অপেক্ষা সহজ। ইহাতে খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে কোন আঁটাতাটি নাই; ব্যয় অতি সামান্য; আর খুব শীঘ্র উপকার পাওয়া যায়।
প্রার্থনা করি, তোমরা স্যাণ্ডোর ন্যায় বলশালী হও, আর স্যাণ্ডোর চাইতে৭সেই বলের অধিকতর সদ্ব্যবহার কর।