উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বিড়ালের জাত

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

বিড়ালের জাত

 আমাদের ঘরের বিড়ালগুলি দেখিতে ছোট বটে, কিন্তু পদে খুব বড়। শুনিয়াছি, বাঘ না কি বিড়ালের বোন-পো হয়।

 সিংহ তাহার কে হয়, তাহা সঠিক বলিতে পারি না। তবে পণ্ডিতেরা বলেন যে, সেও না কি বিড়ালেরই জাত-ভাই।

 সিংহ পশুর রাজা, একথা অনেকবার পুস্তকে পড়িয়াছি। কে তাহাকে রাজা করিল;কি দেখিয়া করিল,কোন বিশেষ গুণে, না কি খালি দাড়ি-গোঁফের জোরে—এ সকল কথার পরিষ্কার উত্তর এখন খুজিয়া পাওয়া কঠিন হইবে। তবে এইমাত্র বলিতে পারি, যে সকল দেশেই তাহকে পশুর রাজা বলে।

 দেখিতে খুব জমকালো তাহাতে সন্দেহ নাই। মুখ ভার করিয়া দাড়াইলে, নেহাৎ কেওকেটা বলিয়া উড়াইয়া দিতে ভরসা হয় না। কিন্তু গায়ের জোরে সে বাঘের চাইতে বড় কি না, তাহা সন্দেহের বিষয়। বাঘে সিংহে লড়াই দেখা গিয়াছে—দুবারই কিন্তু পোষা বাঘ আর পোষা সিংহে। একবার বিলাতে এইরূপ লড়াই হয়, তাহতে সিংহটা জিতে; আর একবার কলিকাতায় এইরূপ হয়; তাহাতে বাঘটা জিতে। সুতরাং জয়-পরাজয় কাহারও হয় নাই বলিতে হয়।

 শুনিয়াছি, সিংহের মেজাজটা না কি খুব রাজার মতন। কিন্তু ইহার অর্থ কি বুঝিব, জানি না। অনেকগুলি রাজার কথা শুনিলে তাহাদিগকে খুব ছোট লোক বলিয়াই মনে হয়। তাহ ছাড়া সিংহের বিরুদ্ধে আজকাল এ বিষয়ে ঢের কথা শুনিতে পাওয়া যায়;তাহার সকল কথা সত্য হইলে, লজ্জার বিষয় বলিতে হইবে। সাহসের কথা যদি বল, তবে সিংহ এ বিষয়েও খুব প্রশংসার পাত্র নহে। শিকারীর সামনে পড়িলে, অন্য দশটা জানোয়ারের ন্যায় সেও চম্পট দিতে কুষ্ঠিত হয় না। অনেক বড় বড় শিকারীর মুখে শুনা গিয়াছে যে সিংহের ব্যবহার মোটের উপরে অনেকটা কাপুরুষেরই মতন। বিদঘুটে ভেংচি দেখিয়া, আর বিকট চীৎকার শুনিয়া সিংহকে ভয় পাইতে দেখা গিয়াছে। তবে একথা শুনিয়াছি, যে একবার ক্ষেপিয়া দাঁড়াইলে, সিংহ কিছুতেই ভয় পায় না।

 পক্ষান্তরে বাঘেরও মহত্ত্বের কথা শুনা গিয়াছে। একবার একটা বাঘ শিকারীর তাড়া খাইয়া পলাইতেছিল, এমন সময় একটি ছোট ছেলে গাছের উপর হইতে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, যে ঐ বাঘ। ছেলেটি যে গাছের ডালে বসিয়াছিল, তাহ বেশী উচুতে ছিল না। বাঘ এক লাফে সেখানে উঠিয়া, একেবারে সেই ছেলের মাথাটা কামড়াইয়া ধরিল;কিন্তু এমনি আলগোছে ধরিল, যে দাঁত বসিল না। অর্থাৎ যেমন করিয়া তাহারা বাচ্ছ এক স্থান হইতে অন্য স্থানে লইয়া যায়, সেইরূপ করিয়া ধরিল। এইরূপে তাহাকে গাছ হইতে নামাইয়া রাখিয়া বাঘ চলিয়া গেল। ছেলেটি ভয়ে অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু তাহার একটুও লাগে নাই। জ্ঞান হইলে, সে খালি বলিয়াছিল, “উঃ! কি গন্ধ।” এই গল্পটা শুনিলে কি এরূপ মনে হয় না, যে অত ছোট ছেলেকে কঠিন আঘাত দিতে বাঘের ইচ্ছা হয় নাই।

 যাহা হউক বিড়াল জাতীয়দের মধ্যে বাঘ আর সিংহ এই দুজনেই শ্রেষ্ঠ। এ দুজনের যিনিই রাজা হউক, তাহাতে ফলের বড় ইতর বিশেষ দেখি না।

 আজকাল আমাদের দেশে সিংহ বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। প্রাচীন কবিদিগের বর্ণনা দেখিলে বোধহয়, যেন আগে ভারতবর্ষের অনেক স্থানেই সিংহ ছিল। কিন্তু এক গুজরাট ভিন্ন অন্যান্য স্থান হইতে সিংহ অনেকদিন হইতেই লোপ পাইয়াছে। গুজরাটেও যে অব বেশী দিন সিংহ পাওয়া যাইবে, তাহা বোধহয় না। সিংহের আদত জায়গা এখন আফ্রিকা। সেখানকার বার্বেরী দেশীয় সিংহই সকলের প্রধান। তাহার চেহারা যেমন দেখিতে জমকালো, গায় বলও তেমনি প্রচণ্ড। আমেরিকায় সিংহ বলিয়া একটা জন্তু আছে। সে বাস্তবিক সিংহ নহে। রংটা অনেকটা সিংহের মতন বটে, কিন্তু আকৃতি সিংহের চাইতে অনেক ছোট, আর তাহার কেশর নাই। এই জন্তুর আসল নাম “পুমা”। পুমা খুব সাহসী, আর বড় প্রতিহিংসা-প্রিয়।

 আমেরিকার সিংহ যেমন সিংহ নহে, তেমনি আমেরিকার বাঘও ঠিক বাঘ নহে। এই জন্তুর নাম “জ্যাগুযার"। ইহার পরাক্রম খুব বেশী, তাই সেখানকার লোকেরা অনেক সময় ইহাকে টাইগার বলে। যাহার গায় লম্বা লম্বা ডোর সেই বাঘই টাইগার। জ্যাগুয়ারের গায় চক্র থাকে।

 এতক্ষণ বাঘের কথা বলিয়া দু-একটা বাঘের গল্প না বলিয়া শেষ করা ভাল দেখায় না।

 দুই বন্ধুর বড়ই মাছ ধরিবার সখ। কোথায় একটা খালের ধারে মাছ ধরিবার ভারি সুবিধা; তাই দুজনায় পরামর্শ করিল, যে পরদিন ভোরে সেখানে মাছ ধরিতে যাইবে। ভোরবেলা একজন খালের ধারে গিয়া দেখিল, যে সেখানে আর একজন ইতিপূর্বেই আসিয়াছে। এই ব্যক্তি অবশ্য তাহার বন্ধুই হইবে, এইরূপ মনে করিয়া সে তাহার কানের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কটা ধরলে?” তখনও ভাল করিয়া ফরসা হয় নাই, আর লোকটির দৃষ্টিশক্তিও বোধহয় একটু ক্ষীণ ছিল। সুতরাং সে বুঝিতে পারে নাই, যে ওটা তাহার বন্ধু নয়, বাঘ আসিয়া আছে। বাঘও মাছ খাইতে নিতান্তই ব্যস্ত ছিল, সুতরাং পিছন হইতে কে আসিতেছে, তাহার খবর রাখে নাই। আর তাহার ওরূপ কানের কাছে গিয়া বোধহয় ইতিপূর্বে কেহ কোন কথা বলে নাই। সুতরাং সে ভারি চমকাইয়া গেল, আর থতমত খাইয়া যাওয়াতে, সেই লোকটিকে দু-একটা আঁচড় দিয়াই ছুটয়া পলাইল। তদবধি ঐ ব্যক্তিকে দেখিতে পাইলেই পাড়ার ছেলেরা পিছন হইতে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিত, ‘কটা ধরলে?'

 একদল শিকারী শুয়র মারিবার জন্য একটা বন ঘেরাও করিয়াছে অন্য লোকেরা খানিক দূরে থাকিয়া তামাসা দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এক দুধওয়ালা দুধ বেচিয়া কেঁড়ে হাতে বাড়ী ফিরিতেছিল; সেও একটা উই ঢিপির উপরে উঠিয়া বসিয়াছে। বনের ভিতরে শুয়র ছিল কি না জানি না, কিন্তু একটা ছোট বাঘ সেখানে ছিল;সে বেচারা বেগতিক দেখিয়া পলাইবার চেষ্টা দেখিতে লাগিল। বনের ভিতর হইতে বাহির হইয়া সে চুপি চুপি ঐ উইটিপির নীচ দিয়া চলিয়াছে, এমন সময় দুধওয়ালা তাহাকে দেখিতে পাইল। এত বড় শিকার সামনে দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিলে কে চুপ করিয়া থাকিতে পারে? বিশেষতঃ যদি একটা দুধের কেঁড়ে হাতে থাকে। সুতরাং দুধওয়ালা দুহাতে কেঁড়ে উঠাইয়া তাহার দ্বারা বাঘের মাথায় যথাশক্তি এক ঘা লাগাইল। সে জানিত না, যে দুধের কেঁড়ের চাইতেও বাঘের মাথাটা শক্ত হয়। কেঁড়েটি তো গুড়া হইয়া গেলই, বাঘ বড় হইলে সে যাত্রা প্রাণটিও যাইত। যাহা হউক একে বাঘ ছোট ছিল, তাহাতে আবার প্রাণের ভয়ে ব্যস্ত থাকায়, তাহার যুদ্ধ করিবার অবসর অল্পই ছিল। তথাপি সে দুধওয়ালা মহাশয়কে কয়েক চড় দিতে ছাড়ে নাই। তখন তাহারা তাহাকে হাসপাতালে লইয়া চলিল। সেখানে গিয়া তাহার জ্ঞান হইলে পর, সে এই বলিয়া আপসোস্ করিতে লাগিল যে, হায় রে, আমার চার আনার কেঁড়েটা ছিল।

 এক কুয়ার ধারে একটা গরু ঘাস খাইতেছে, ঝোপের ভিতরে থাকিয়া বাঘের চেষ্টা, যে তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িবে। ঠিক লাফ দিবার সময় গরুটা হঠাৎ টের পাইয়া সরিয়া পড়িল, আর বাঘ মহাশয় বেমালুম কুয়ার ভিতরে ঢুকিয়া গেলেন। বাঘের মতন জন্তু চুপচাপ একটা কুয়ার ভিতরে পড়িয়া থাকিতে রাজি হইবে, এরূপ কিছুতেই আশা করা যায়;সুতরাং তখন ভারি একটা সোরগোল শুনিয়া দুনিয়ার লোক আসিয় সেখানে জড় হইল, আর এরূপ অবস্থায় শাস্ত্রে যেমন লেখে, তদনুযায়ী লগী, বাঁশ ইত্যাদি সদ্ব্যবহার করিল।

 শীতকালের সন্ধ্যাবেলায় এক ব্যক্তি ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আগুন পোহাইতে ছিলেন, এমন সময় একটা বাঘ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাঘটা যখন উঠানের মাঝখানে আসিয়াছে, তখন সেই ব্যক্তি তাহাকে দেখিয়া মনে করিলেন, যে ওটা বুঝি বাছুর! সুতরাং তিনি ঐরূপ সন্ধ্যার সময়েও বাছুর বাহিরে রাখার দরুন চাকরকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন। বাঘ কিন্তু ততক্ষণে একেবারে পৈঠার উপরে আসিয়া উঠিয়াছে এখন তাহাকে বাঘ বলিয়া চিনিতে পারিয়াছে কিন্তু পলাইবার আর সময় নাই। তখন তিনি আর কি করেন—তাড়াতাড়ি হড়িশুদ্ধ আগুন বাঘের মুখে ঢালিয়া ঘরে ঢুকিয়া দরজা আঁটিলেন। বাঘের জীবনে আর কখনও এরূপ অভ্যর্থনা নাই, সুতরাং সে আর সেখানে বিলম্ব না করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল।