উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/রামজীবন

রামজীবন

 রামজীবন বলিলাম বটে, কিন্তু তার নাম রামজীবন ছিল, কি আর কিছু ছিল তাহা জানি না |

 সে অনেকদিনের কথা; এদেশে তখন ইংরাজের রাজত্ব ভাল করিয়া হয় নাই। বাঙ্গালা দেশের অধিকাংশ তখন হিন্দু রাজার অধীন ছিল। রামজীবন ঐ সময়ে পূর্ব বাঙ্গালার একটি ক্ষুদ্র বিভাগের শাসনকর্তা ছিলেন। রামজীবনের বংশ, এবং তাহার সেই সুন্দর বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এখনও বর্তমান।

 রামজীবন যারপরনাই ধার্মিক লোক ছিলেন; এবং প্রজাদিগকে অতিশয় স্নেহের সহিত পালন করিতেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং সাধু সজ্জনের প্রতি তাহার সদব্যবহারের সুখ্যাতি সমস্ত বাঙ্গালায় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। নবদ্বীপ হইতে বড় বড় পণ্ডিতগণ রামজীবনের সুখ্যাতি শুনাইয়া তাহার সভায় আসিতেন, এবং সেখানে আশাতিরিক্ত অভ্যর্থনা প্রাপ্ত হইয়া আনন্দে আশীর্বাদ করিতে করিতে দেশে ফিরিতেন।

 ইহার মধ্যে একবার বাঙ্গালার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হইল। পূর্ব বাঙ্গালার সেই সকল স্থান অতিশয় উর্বরা বলিয়া প্রসিদ্ধ। অন্য স্থানে যখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়, তখনও সেখানকার লোকেরা না খাইয়া মরে না। কিন্তু যে বারের কথা বলিতেছি, তখনকার মতন দুর্ভিক্ষ বুঝি আর কখনও হয় নাই। অতিশয় বৃদ্ধ লোকদের মুখে শুনিয়াছি—তাঁহারাও আবার তাঁহাদের ছেলেবেলার বৃদ্ধদের নিকট শুনিয়াছিলেন—যে সেই সময়ে ভদ্রলোকেরাও বনের কচু সিদ্ধ করিয়া খাইয়া জীবনধারণ করিয়াছিলেন। শেষটা কচু ফুরাইয়া গেলে নাকি কলাগাছের থোড়, মোচা, এমনকি, শিকড় পর্যন্ত খাইতে হইয়াছিল।

 এই দারুণ দুর্ভিক্ষে প্রজার ক্লেশ দেখিয়া রামজীবন নিতান্তই ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। যাহারা নিতান্ত গরীব, তাহদের খাজনা মাপ করিয়া দিলেন। যাহাঁদের তাহাতেও কুলাইল না, তাহাদিগকে নিজের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতে লাগিলেন। রাজসরকার হইতে যে বেতন পাইতেন, তাহ নিতান্তই অল্প ছিল না;কিন্তু দেশ সুদ্ধ লোককে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতে তাহাতে কুলায় না। বেতনের টাকা ফুরাইয়া গেলে, ঘরের সঞ্চিত টাকা বাহির করিয়া দিলেন। এইরূপ করিয়া যখন নিজের অবস্থাও অন্যের অবস্থার ন্যায় হইয়া দাঁড়াইল, তখন “যা করেন ভগবান” বলিয়া রাজকোষ প্রজার জন্য মুক্ত করিয়া দিলেন। এতটার পর বুঝি দুর্ভিক্ষের মনেও লজ্জা বোধ হইল! —তাহার কঠোরতা ক্রমেই কমিয়া আসিতে লাগিল। দেশের মধ্যে স্বচ্ছলতা আবার ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া রামজীবন সকল চেষ্টা সফল জ্ঞান করিলেন।

 যে স্থানের কথা বলিতেছি, সে স্থান তখন ফাগ এবং তঞ্জের বস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এবং বার্ষিক রাজকর টাকায় না লইয়া, এই দুই জিনিসের দ্বারা আদায় করাই নিয়ম ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় লৈাকে খাইতে পায় নাই সুতরাং তাহারা উদরের চিস্তাতেই দিন কাটাইয়াছে। সূক্ষ্ম বস্ত্র বুনিবার অথবা সুন্দর রঙ প্রস্তুত করিবার অবসর তাহদের হয় নাই। তাহা ছাড়া রামজীবন নিজে নিঃস্ব হইয়া পড়িয়াছেন, আর রাজকোষের অর্থ দ্বারা প্রজার প্রাণ রক্ষা

করিয়াছেন;সুতরাং বার্ষিক রাজকরের জন্য প্রস্তুত হইবার তাহার কোন উপায়ই ছিল না। কর পাঠাইবার সময় আসিলে সে বৎসর রামজীবনের প্রেরিত কোন লোক রাজসরকারে হাজির হইল না।

 এখনকার কায়দা আর তখনকার কায়দায় অনেক বিষয়েই ঢের তফাৎ ছিল। আজকাল কোন রাজকর্মচারীদের কার্যে শৈথিলা দেখা গেলে, তাহার কৈফিয়ৎ তলব, তাহার জবাবদিহি, তাহার তদন্ত, তাহার বিচার ইত্যাদি কত কারখানাই না হয়; ততক্ষণে অপরাধী বেচারা অন্ততঃ একবার চারিদিক চাহিয়া দেখিয়া একটা হাঁপ ছাড়িবার অবসর পায়। কিন্তু তখনকার দস্তুর ছিল অন্যরকম। সেকালে পানটুকু হইতে চুনটুকু খসিলেই বাঁধিয়া লইয়া যাইত। এখন হয় আগে বিচার, তারপর সাজা, তারপর তোমার ভাগ্যে যাহা থাকে।

 রামজীবন এ সমস্তই জানিতেন, এবং কখন রাজসরকারের সিপাহী আসে তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সিপাহীরা আসিতে বেশী বিলম্ব করিল না, আর আসিয়াও বেশী কথাবার্তায় সময় নষ্ট করিল না। তাহারা বলিল, “জলদি খাজনা হাজির কর।” রামজীবন করযোড়ে সজলনেত্রে কহিলেন “বাবা, বিধাতা বাম ছিলেন, খাজনা সংগ্রহ করিতে পারি নাই; দুদিন মাপ কর।” কিন্তু মাপ করিবার হুকুম তাহারা লইয়া আসে নাই। তাহারা খাজানা নিবে, নয়ত বাঁধিয়া নিবে এই তাহাদের হুকুম। সুতরাং তাহারা রামজীবনকে বাঁধিয়া লইয়া চলিল। রামজীবনের অপরাধের কোনরূপ বিচার হইয়াছিল কিনা জানি না; কিন্তু রামজীবন তখন অন্য দশজন অপরাধীর ন্যায় জেল খাটিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে অন্যান্য কয়েদীদিগের ন্যায় কোদালী হাতে তাহাকে রাস্তা মেরামত করিতেও হইত।

 এইরূপে কিছুদিন যায়। পরে একদিন কয়েকটি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রাজধানীর রাস্তা দিয়া যাইবার সময় হঠাৎ রামজীবনকে দেখিতে পাইলেন, তিনি রাস্তায় মাটি ফেলিতেছেন, তাহার পায়ে বেড়ী। ইহারা অনেকবার রামজীবনের অভ্যর্থনা লাভ করিয়াছেন, সুতরাং সকলেই তাহাকে চিনেন। অথচ রামজীবনের মতন লোকের ঐরূপ অবস্থা হইতে পারে, ইহাও সহজে বিশ্বাস হয় না। তাহদের একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাপু, তোমার নাম কি? তোমার নিবাস কোথায়?” রামজীবন পণ্ডিত মহাশয়দিগকে প্রণাম করিয়া বিনীতভাবে নিজের নামধাম নিবেদন করিলেন। পণ্ডিতেরা শুনিয়া যারপরনাই বিস্ময়ের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এখানে কি করিয়া আসিলে?'’ এই প্রশ্নের উত্তরে রামজীবন সমস্ত ঘটনা খুলিয়া বলিলেন।

 রামজীবনের কথা শুনিয়া সেই সরল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কানে হাত দিয়া বললেন, “দুর্গা, দুর্গা। ধর্ম গেল!” আর এইকথা বলিতে বলিতে তাহারা দলবদ্ধ হইয়া একেবারে রাজসভায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহদের মুখে সকল কথা শুনিয়া রাজা তৎক্ষণাৎ রামজীবনকে ডাকাইয়া আনিলেন। এরপর কি হইল, সহজেই বুঝিতে পার। রামজীবন মুক্তি তো পাইলেনই তাহা ছাড়া, দুর্ভিক্ষে তাহার যত ক্ষতি হইয়াছিল, রাজসরকার হইতে তাহা পূরণ করিয়া দেওয়া হইল, প্রাপ্য খাজানা মাপ হইল, এবং প্রচুর পুরস্কার, প্রশংসা ও সম্মানের সহিত তাহকে বিদায় দেওয়া হইল।