উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/নানাপ্রসঙ্গ: ৪

নানাপ্রসঙ্গ: ৪

 তোমাকে কেহ যদি লাঠি দিয়া মারিতে আইসে, তবে তুমি কি কর? দৌড়াইয়া পালাও। আততায়ীর হাত এড়াইবার ইহাই সর্বোৎকৃষ্ট উপায় বলিয়া আমরা মনে করি। কিন্তু অনেক জানোয়ার ইহা অপেক্ষা অন্যরূপ উপায় অবলম্বন করে।

 অনেক জানোয়ার এইরূপ অবস্থায় পড়িলে মড়ার মতো হইয়া পড়িয়া থাকে। এইরূপে অনেক সময় বিপদ হইতে রক্ষা পায়।

 পীউইট্‌ পাখির বাসার কাছে মানুষ গেলে পীউইট্‌ ভাব দেখায় যেন সে ভালো করিয়া উড়িতে পারে না। এরূপ পাখিকে ধরা সহজ মনে করিয়া অনেকেই তাহার পিছনে যায়। এইরূপে পাখি তাহাকে ভুলাইয়া বাসা হইতে দুরে লইয়া যায়।

 কেন্দ্রাইকে বিরক্ত করিলে সে শরীর গুটাইয়া গোলাকার হইয়া থাকে। ইহা হইতেই কেন্দ্রাই সম্বন্ধে নিম্নলিখিত হেঁয়ালিটি উৎপন্ন হইয়াছে—

‘ছ’কুড়ি ছ’খানা পা,
রক্তবরণ গা,
টোকা দিলে টাকাটি হয়
তাকে তুই খা।’

 উটপক্ষীকে কুকরেরা তাড়া করিলে যখন সে মনে করে যে আর ইহাদের হাত এড়ানো গেল না তখন মাথাটি বালির নীচে গুঁজিয়া রাখে। অবশ্য ইহাতে বিপরীত ফলই ঘটিয়া থাকে, কিন্তু উটপক্ষী প্রথমে মনে করে যে বড়ই নিরাপদ হইয়াছে।

 একপ্রকারের পোকা আছে তাহারা নিজের বাড়িঘর সঙ্গে লইয়া বেড়ায়। কোনোরূপ ভয় পাইলেই ঘরের ভিতর লুকাইয়া থাকে।

 একপ্রকারের ফড়িং আছে, তাহারা পাখা দুটি একত্র করিলে দেখিতে ঠিক গাছের পাতার মতন হয়। তখন আর তাহাদিগকে সহজে চিনিতে পারা যায় না। এইরূপে তাহারা ফড়িংখাদক পাখিদের হাত হইতে রক্ষা পায়।

 গুগ্‌লিরা যখন নিতান্তই বেকায়দা দেখে, তখন তাহার মুখের কাছের দরজাটি বন্ধ করিয়া দেয়।

 শম্বুকজাতীয় অনেকপ্রকার জলজীব আছে, তাহার যখন দেখে যে শত্রুর হাত হইতে বাঁচিবার আর অন্য উপায় নাই, তখন একপ্রকার কালো জিনিস পেটের ভিতর হইতে বাহির করিয়া দেয়। ইহাতে জলটা অনেক দূর পর্যন্ত এত কালো হইয়া যায় যে, আর তাহার ভিতর দিয়া কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। এই অবসরে সে পলাইয়া কোনো নিরাপদ স্থানে যায়।

 কচ্ছপগুলির কাণ্ড-কারখানা সকলেই দেখিয়াছ, সুতরাং তাহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলার আবশ্যক দেখি না। একপ্রকারের কচ্ছপ আবার শুধু গলাটি আর হাত-পাগুলি ভিতরে লইয়া গিয়াই সন্তুষ্ট হয় না। তাহার শরীরের আবরণটা কবাটের মতো হইয়া সেই হাত-

পাগুলিকে ঢাকিয়া রাখে।

 শেয়ালগুলি যে কতবার মরিয়া থাকে তাহার আর কি বলিব। এ বিষয়ে শেয়ালের সঙ্গে আর কেহ পরিবে না।

 বুনোরোহিতের আঁইস বলিয়া একপ্রকার আইস অনেক জায়গায় বিক্রয় হয়, অনেকে তাহাতে আংটি প্রস্তুত করিয়া হাতে দেয়। বাস্তবিকই জঙ্গলে কোনোরূপ রোহিত মাছ থাকে, বা ঐগুলি যে মাছেরই আঁইস, তোমরা এরূপ মনে করিও না। ঐ-সকল আঁইস একপ্রকার চতুষ্পদ জানোয়ারের। আমাদের দেশে এইরূপ জানোয়ার অতি অল্পই আছে, সুতরাং আমরা উহাদিগকে সচরাচর দেখিতে পাই না, দক্ষিণ আমেরিকায় এই জাতীয় অনেক জন্তু বাস করে। এইসকল জন্তুকে আর্মাডিলো বলা হয়। আর্মাডিলো অনেকপ্রকারের হইয়া থাকে। দক্ষিণ আমেরিকায় অনেক বাঁদর থাকে, তাহদের জ্বালায় আর্মাডিলো বড় ব্যতিব্যস্ত হয়। বাঁদরগুলি তাহাদিগকে প্রথমে খোঁচায়। যদি তাহার গর্তে প্রবেশ করে তবে লেজ ধরিয়া টানিয়া বাহির করিয়া যারপরনাই বিড়ম্বনা করে। কেবলমাত্র এক জাতের আর্মাডিলোর নিকট বানরেরা কিঞ্চিৎ জব্দ থাকে। এই আর্মাডিলোর নাম বল আর্মাডিলো (Ball Armadillo)। বল আর্মাডিলো উপায়ান্তর না দেখিলে হাত-পা গুটাইয়া লেজ-মাথা গুঁজিয়া পাছা সামনে টানিয়া লইয়া বেশ একটি নিরেট গোলাকার জিনিস হইয়া থাকে।

 বাঁদরেরা আর তখন ধরিয়া টানিবার মতো কোনো জিনিস পায় না, সুতরাং অপ্রতিভ হইয়া ঘরে ফিরিয়া যাইতে হয়।