উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/নানাপ্রসঙ্গ: ৫

নানাপ্রসঙ্গঃ ৫
 একদিন বড় ঝড় হইতেছিল। দশ-বারোজন লোক একটা ঘরে আশ্রয় লইল। মেঘে আকাশ অন্ধকার হইয়াছে। এমন সময় একখানা কালো মেঘ ঘরের উপরে আসিয়া থামিল। মেঘখানা ভয়ানক কালো, দেখিলেই ভয় হয়। ইহা দেখিয়া একজন বলিল, ‘মেঘটা অবশ্যই কিছু চায়, হয়তো আমাদের মধ্যে একজন মহাপাপী আছে, তাহার মাথায় বাজ ফেলিয়া মেঘটা তাহাকে মারিতে আসিয়াছে।” আর একজন বলিল, ‘একজন দোষীকে মারিতে গিয়া তাহার সঙ্গে এতগুলি নির্দোষীকে বধ করিবে, বোধহয় এইজন্যই বাজ পড়িতে দেরি হইতেছে। কিন্তু দেরি আর কতক্ষণ হইবে, দোষী ব্যক্তি যদি শীঘ্র পৃথক হইয়া না যায় তবে আর সকলেও তাহার সঙ্গে মারা যাইবে।” আর-একজন বলিল, ইহা কখনই হইতে পারেনা, চল আমরা প্রত্যেকেই এক-একবার করিয়া বাহিরে যাই। যে দোষী সে বাহিরে গেলেই তার ঘাড়ে বাজ পড়িবে। এই পরামর্শ বেশ সঙ্গত বোধ হইল তারপর এক-একজন করিয়া বাহিরে যাইয়া ফিরিয়া আসিতে লাগিল। এইরূপে একজন ছাড়া আর সকলেই বাহিরে গিয়া আসিল, কিন্তু তাহদের কাহারো মাথায় বাজ পড়িল না। শেষ, ব্যক্তির পালা যখন আসিল তখন সে আর কোনমতেই বাহিরে যাইতে চাহে না। অন্যান্যেরা মনে করিল, ‘এই ব্যক্তিই দোষী, ইহাকে ঘর ছাড়িয়া যাইতে হইবে, নতুবা ইহার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও মারা পড়িব।’

এই ভাবিয়া সকলে ঠেলিয়া তাহাকে ঘরের বাহির করিয়া দিল, আর আমনি ঘরের উপর বাজ পড়িয়া তাহারা মরিয়া গেল। যাহাকে বাহির করিয়া দিয়াছিল সে বাঁচিল।

 একটি ছোটছেলের বাপ-মা মরিয়া যাওয়াতে সে বড়ই দুঃখে পড়িল। সে মনে করিল যে এরূপ দুঃখ সহ্য করার চাইতে মরিয়া যাওয়াই ভালো। এই ভাবিয়া সে একটা গর্ত খুঁড়িতে আরম্ভ করিল। এমন সময়ে এক পুত্রহীন সওদাগর সেই পথ দিয়া যাইতেছিল, সে সেই ছেলেটিকে ঐরাপ গর্ত খুঁড়িবার কারণ জিজ্ঞাসা করিল। বালক উত্তর করিল, আমার মা নাই, বাপ নাই, আমার আর বাঁচিয়া ফল কি? আমি এই গর্তে পড়িয়া মরিব।” সওদাগরের বড় দয়া হইল, সে বলিল, “তোমার মরিয়া কাজ নাই, তুমি আমার সঙ্গে এস, আমরাই তোমার বাপ-মা হইব।’ বালক সওদাগরের সঙ্গে তাহার বাড়িতে গেল, সেখানে সে খুব যত্ন পাইতে লাগিল। কিছুদিন পরে সওদাগরের এক ছেলে হইল। সওদাগর ও তাহার স্ত্রী এখন সেই দুঃখী ছেলেটিকে অত্যন্ত হিংসা করিতে লাগিল। তাহদের হিংসা এতদূর বাড়িয়া উঠিল যে তাহারা সেই ছেলেটিকে মারিয়া ফেলিবার জন্য একটা গভীর কুপ খুঁড়িয়া রাখিল— মনে করিল, ‘একবার তো কূপে পড়িয়াই মরিতে গিয়াছিল, এবারে কূপ প্রস্তুত রহিয়াছে দেখিলে অবশ্যই তাহাতে ঝাঁপিয়া মরিবে। কিন্তু সেই দুঃখী সন্তান ইহার কোনো খবর পাইবার পূর্বেই সওদাগরের নিজের ছেলে সেই কূপ দেখিতে গেল এবং হঠাৎ তাহাতে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিল।

 গল্পগুলি সত্য না হউক ইহাদের ভিতর বেশ উপদেশ আছে। পরের মন্দ ভাবিও না। দেখ এই সকল লোক পরের অনিষ্ট করিতে গিয়া কি শক্তিই পাইল।