উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/নানা প্রসঙ্গ: ১

নানা প্রসঙ্গ: ১

 একটি ছোট দীপের নীচে একটি বড় দীপ ধর। ছোট দীপটি নিবিয়া যাইতে চাহিবে কেন, জান? দীপ জ্বালাতে অঙ্গারাম্ল নামক একপ্রকার বায়ু জন্মে। সেই বায়ু প্রদীপের শিখায় মুখ হইতে বেগে ঊর্দ্ধে উঠিয়া যায়। বাতাসে অম্লজান নামক বায়ু আছে, তাহা আছে বলিয়াই আগুন জ্বলিতে পারে। বড় দীপটি ছোট দীপের নীচে ধরিলে, তাহা হইতে অঙ্গারাম্ল বায়ু উঠিয়া ছোট দীপটিকে ঘিরিয়া ফেলে, আর বাতাসের অম্লজান আসিয়া তাহাকে জ্বালাইতে পারে না। কাজেই সে নিবিয়া যায়।

 ছোট দীপটি নিবিয়া যাওয়ামাত্রই তাহার জ্বলন্ত পলিতাটি আনিয়া বড় দীপের নীচে (খুব কাছে কিন্তু একটু ব্যবধান রাখিয়া) ধর; যেন ছোট দীপের পলিতা হইতে যে ধূম এখনোও বাহির হইতেছে তাহা বড় দীপটায় লাগিতে পারে। এখন দেখিবে বড় দীপ হইতে একটু আগুন নামিয়া আসিয়া ছোট দীপটিকে পুনরায় জ্বালাইয়া দিবে। ইহাতে এই বুঝা যায় যে পলিতা হইতে যে ধোঁয়া গিয়া বড় দীপটার গায়ে লাগিয়াছিল, তাহাতে এমন কিছু জিনিস ছিল যাহা জ্বলে। এই জিনিসটা পলিতার ভিতর হইতেই বাহির হইতেছিল; অত্যন্ত গরম লাগিলেই জিনিসটা বাহির হয়। এই জিনিসটা শূন্যে উঠিয়া যাইবার সময় জ্বলে, আর তাহাকে আমরা দীপের শিখা বলি। গরমে এই জিনিসটা বাহির হইয়া গেলে অনেক সময় আর কতগুলি জিনিস পড়িয়া থাকে, তাহাকে আমরা অঙ্গার, ভস্ম ইত্যাদি নাম দিই।

 কাঠের কয়লা জ্বালাইলে তাহা হইতে শিখা বাহির হয় না, পাথর কয়লা জ্বালাইলে তাহা হইতে শিখা বাহির হয়। যে জিনিসটা জ্বলিয়া শিখা হয়, কাঠ জ্বলিবার সময়ই সেই জিনিসটা ফুরাইয়া গিয়াছে—তারপর কয়লা পাইয়াছ। কাজেই কাঠের কয়লায় সেই জিনিসটা নাই, আর তাহা জ্বলিবার সময় শিখাও দেখা যায় না। পাথর কয়লায় কিন্তু সেই জিনিসটা আছে, সুতরাং পাথর কয়লা জ্বলিবার সময় শিখা দেখা যায়। পাথর কয়লার এই পদার্থটা কৌশলক্রমে বাহির করিয়া তাহা দ্বারা কলিকাতার রাস্তায় রাত্রিকালে আলো দেওয়া হয়। তাহাকে তোমরা গ্যাসের আলো বল। পাথর কয়লা হইতে গ্যাস বাহির করিয়া ফেলিলে যাহা থাকে, তাহার নাম কোক্‌ কয়লা। কোক্‌ কয়লা হইতে পাথর কয়লার ন্যায় শিখা বাহির হয় না। তাহার কারণ এই যে, যে জিনিসটা জ্বলিয়া শিখা হয়, তাহার অধিকাংশ অগ্রেই বাহির করিয়া লওয়া হইয়াছে।

 দুই পয়সা দিয়া সাহেবদের তামাক খাইবার একটা চীনা মাটির পাইপ ক্রয় কর। তাহার বাটিটির ভিতরে একখণ্ড পাথর কয়লা পুরিয়া বাটির মুখ অতি উত্তমরূপে শিব গড়িবার মাটি দিয়া বন্ধ করিয়া দেও। এখন সেই কয়লা-পূর্ণ পাইপের মাথাটি আগুনে ফেলিয়া দেও, নলটি যেন আগুন হইতে বাহির হইয়া থাকে। কিছুকাল পরে ঐ নলের মুখে আগুন দিলে সুন্দর গ্যাসের আলো জ্বলিবে।

 এইগুলি তোমরা সকলেই পরীক্ষা করিয়া দেখিবে। কেবল আমরা বলিতেছি বলিয়া ভালোমানুষের মতো মানিয়া লইবার কোনো প্রয়োজন নাই। ছোট দীপ আর বড় দীপের পরীক্ষাটি করিবার সময় দেখিবে যেন ছোট দীপটা বড় দীপ অপেক্ষা অনেক ছোট হয়, আর দীপগুলি যেন না কাঁপে।

 অনেকদিন হইল একজন প্রসিদ্ধ ইংরাজ লেখক আয়র্ল্যাণ্ড দেশ দেখিতে গিয়াছিলেন। সেখানে একটি ছেলে তাঁহাকে পথ দেখাইয়া নানাস্থানে লইয়া গিয়াছিল। বাড়ি আসিয়া সাহেব ঐ ছেলেটিকে কিছু পুরস্কার দিতে ইচ্ছা করিলেন। সাহেব মদ খাইতে ভালোবাসিতেন সুতরাং পকেট হইতে একটি বোতল বাহির করিয়া তাহাকে কিছু মদ খাইতে দিলেন, ছেলেটি মদ খাইতে চাহিল না। সাহেব তাহাকে পরীক্ষা করিবার জন্য বলিলেন তোমাকে আট আনা দিব, তুমি খাও। সে খাইতে অস্বীকার করিল। তারপর সাহেব এক বোতল বাহির করিয়া তাহাকে কিছু মদ খাইতে দিলেন, ছেলেটি মদ খাইতে রাজি হইল না। সে অতি গরিব ছেলে, তাহার গায়ের জামা ছেঁড়া ছিল, কিন্তু সে এত প্রলোভনেও বিচলিত না হইয়া পকেট হইতে একটি মেডেল বাহির করিল, সেটি মদ্যপান নিবারণী সভার মেডেল। সেই মেডেলটি সাহেবকে দেখাইয়া বলিল, ‘আমি মদ খাইব না প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। আপনার যত টাকা আছে তাহা সমস্ত দিলেও আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিব না।’ এই ছেলেটির বাপ অত্যন্ত মদ খাইতেন, শেষে মদ্যপাননিবারণী সভার যত্নে তিনি মদ খাওয়া ছাড়িয়া ভালো লোক হইয়াছিলেন। মরিবার সময় এই মেডেলটি তিনি ছেলেকে দিয়া গিয়াছিলেন। বালকের কথা শুনিয়া সাহেব মদের বোতল নিকটবর্তী একটা পুকুরে ফেলিয়া দিলেন, এবং ‘নিজে আর কখনও মদ খাইব না’ এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, যাহাতে অন্যেরাও মদ না খায় সেই চেষ্টায় জীবন উৎসর্গ করিলেন।