উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/প্রবাসী পাখি

প্রবাসী পাখি

 কতগুলো বক হাঁটু-জলে নেমে ভারি গম্ভীরভাবে মাছ ধরবার ফন্দি আঁটাছে, একসময় একটি রাজহাঁস উড়ে এসে সেইখানে নামল। বকগুলো তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘বাঃ চোখ লাল, মুখ লাল, পা লাল, তুমি কে হে?’

 হাঁস বলল, ‘আমি হাঁস।’

 বকেরা বলল, ‘তুমি কোত্থেকে আসছ?’

 হাঁস বলল, ‘মানস সরোবর থেকে।’

 ‘সেখানে কি আছে?’

 ‘সোনার পদ্মবন আছে, অমৃতের মতো জল আছে, আর মণি-মাণিকের বেদীওয়ালা গাছ আছে।’

 ‘শামুক সেখানে আছে কি?’

 ‘না।’

 এ কথায় বকগুলো হো হো করে হেসে বলল, ‘তবে সে ছাই জায়গা। শামুক নেই, খাব কি?’ তারা ঠিক কথাই বলে ছিল, যেখানে খাবার মিলে না, অন্তত আমি তো সেখানে গিয়ে থাকতে রাজি নই, তা সেখানে সোনার পদ্মফুলই থাক, আর মাণিকের বেদীই থাক।

 মানস সরোবরে ঢের লোক গিয়াছে। সেখানে সোনার পদ্মফুলও নাই, মাণিকের বেদী বাঁধানো গাছও নাই, হাঁসের এ-সব নিতান্তই বাজে কথা। তবে, তার কথার মধ্যে এইটুকু সত্য হতে পারে যে সে মানস সরোবর থেকে এসে ছিল।

 আমি পোষা হাঁসের কথা বলছি না, কিন্তু বুনো হাঁসগুলো যখন শীতকালে আমাদের দেশে আসে, তখন বাস্তবিকই তারা হিমালয় পার হয়ে আসে। মানস সরোবর থেকেও আসতে পারে, তার চেয়েও উত্তর থেকে, এমন-কি, সাইবিরিয়া থেকেও আসতে পারে।

 এ কথা অবিশ্বাস করার কোনে কারণ নেই, এ-সকল পরীক্ষিত বিষয়। অনেক পাখির এরকম অভ্যাস আছে। তাদের কারও বেশি শীত সয় না, কারও গরম সয় না, কারও কোনোটাই সয় না। হাঁসগুলো শীতকালে এসে আমাদের দেশে দেখা দেয়, বৈশাখ মাসে চলে যায়। শীতকালে বাংলা দেশের কোনো কোনো জায়গায় এদের কলরবে লোকের ঘুমানো অসম্ভব হয়। তারপর গরম পড়তেই তারা এ দেশ ছেড়ে পালাবার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। কেন পাগল হয় তা আমি ঠিক বলতে পারি না। গরমের ভয়ে হতে পারে, আরো কারণ থাকতে পারে। যে কারণেই হোক, নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে তারা তখন চলে যাবেই।

সে সময়ে সন্তানের মায়াও তাদের আটকে রাখতে পারবে না। তারপর আবার শীতকাল এলেই তারা এদেশে ফিরে আসবে।

 শুধু যে এ দেশে আসবে তা নয়, ঠিক যে জায়গাটিতে আগে শীত কাটিয়ে গিয়েছিল হয়তো সেই জায়গাটিতেই ফিরে আসবে। কলকাতার চিড়িয়াখানায় একবার হাঁসের গায়ে চিহ্ন দিয়ে এ বিষয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল। সেখানকার একটা ডোবায় কতগুলো বুনো হাঁস থাকত, গ্রীষ্মকালে তারা চলে গেল, আবার শীতকালে এসে সেই ডোবায় উপস্থিত হল।

  আমি আগেই বলেছি, অনেক পাখিরই এরকম অভ্যাস আছে। এজন্য তারা কত কষ্টই স্বীকার করে। এদেশ থেকে হিমালয় পার হয়ে সাইবিরিয়া চলে যাওয়া কিরূপ কঠিন কাজ, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। অনেক পাখি বড়-বড় সাগর পার হয়ে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়। এদের মধ্যে গগন-বেড়ের মতো বড়-বড় পাখিও আছে, তাদের এক-একটার ওজন প্রায় আধমণ। আবার খঞ্জনের মতো ছোট-ছোট পাখিও আছে, যার ওজন এক ছটাকের বেশি হবে না।

 আমি ভাবি এই ছোট-ছোট পাখিগুলো কি করে এত বড় সাগর পার হয়ে যায়। না জানি সে কিসের টান, যাতে তাদের এত কষ্ট সইবার শক্তি এনে দেয়। অন্ধকার রাত্রে সেই অকুল পাথারে কে তাদের পথ দেখায়?

 আর, কত পাখি! লাখ লাখ, কোটি কোটি। এর কত যে যেতে যেতে পথে মারা যায়, তার সীমা সংখ্যা নাই। শুধু পথের কষ্টে যে তারা মরে তা নয়, চলা ফেরার সুবিধার জন্য সমুদ্রে ধারে জায়গায় জায়গায় বাতি-ঘর থাকে, সেখানকার বাতিগুলো ভয়ানক উজ্জ্বল। আগুন দেখে পোকা উড়ে আসে, ঠিক তেমনি এই পাখিগুলো বাতিঘরের বাতি দেখে সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তাদের অনেকে সোজাসুজি সেই ঘরের দেয়ালে পড়ে ঢুঁ খায়, অমনি আর তাদের উড়তে হয় না। বড়-বড় গগন-লেড়গুলোকে এমনি করে একেবারে থেঁৎলা হয়ে যেতে দেখা গিয়েছে।

 যারা বাতি-ঘরটাকে এড়িয়ে এ-বিপদ থেকে রক্ষা পায়, তারা ক্রমাগত সেই বাতি-ঘরের চারধারে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। ঘুরে ঘরে এসে শেষে আর উড়বার শক্তি থাকে না, তখন সেই বাতি-ঘরের আশেপাশে বিশ্রামের জায়গা না থাকলে অমনি করে ঘুরতে ঘুরতেই কত বেচারার প্রাণ বেরিয়ে যায়। এক-একটা বাতিঘরের কাছে এমনি করে এক রাত্রের ভিতরে চার-পাঁচশো পাখি মরতে দেখা গিয়েছে। হল্যাণ্ড দেশের উপকূলে একটা প্রকাণ্ড বাতি-ঘর আছে তার ধারে নাকি একদিন একহাজার পাখি এমনিভাবে মারা গিয়েছিল।

 এজন্য কোনো কোনো জায়গায় বাতি-ঘরের গায়ে পাখিদের জন্য ‘দাঁড়’ বসিয়ে দেওয়া হয়। ঘুরে ঘুরে নিতান্ত ক্লান্ত হলে পাখিরা তাতে বসে বিশ্রাম করে, তারপর আবার ঘুরতে থাকে। এমনি করে তাদের সারারাত কেটে যায়, প্রভাতের আলোক ফুটে উঠলে তবে তাদের চোখের ধাঁধা ভাঙ্গে। দাঁড় বসাবার কাজটি খুব হিসেব করে করা চাই। দাঁড় আলোর বেশি কাছে হলে পাখিরা তাতে বসতে চায় না, বেশি দূরে হলে তাকে তারা দেখতে পায় না।