উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বরাহ শিকার

বরাহ শিকার

 এক সাহেব গিয়েছিলেন বরাহ শিকার করতে। তার আগে তিনি কখনো বরাহ শিকার করেন নি। তাঁর ধারণা ছিল যে, একটা শুয়োর মারা এ আর এমনকি কঠিন। বনের মধ্যে ঢুকে তিনি এক শুয়োর দেখেই তাকে বল্লম নিয়ে তাড়া করলেন, ভাবলেন, শুয়োর মাটিতে, আমি ঘোড়ার উপরে, ও আমার কি করিবে?

 সকলে বারণ করল, তিনি তা না শুনে সোজা বরাহের উপর ঘোড়া হাঁকিয়ে দিলেন। তারপর চোখের পলকের মধ্যে যে কি হল তা কেউই ঠিক বুঝতে পারল না। শুয়োরটা হঠাৎ ‘ঘৎ’ করে ঘোড়ার ঠ্যাঙের ভিতর দিয়ে এমনি তেড়ে বেরুল যে ঘোড়াটা একেবারে ডিগ্‌বাজি খেয়ে উলটে গেল—আর শিকারী মশাই ঠিক্‌রে যেখানে পড়লেন আধঘণ্টা চোখ বুজে সেইখানেই শুয়ে রইলেন।

 বাস্তবিক শুয়োররে মতো বদ্‌মেজাজী জানোয়ার কমই আছে আর তার সাহসও বড় কম নয়। বাঘের পাশে দাঁড়িয়ে জল খেতে আর কোনো জানোয়ারই বোধহয় সাহস পায় না।

 একবার কতগুলো লোক শিকার করতে গিয়ে দেখে একটা বাঘ একটা নদীর ধারে জল খেতে এসেছে আর তার কয়েক হাত দূরে একটা বরাহ জল খাচ্ছে। বাঘটা ভয়ানক রেগে শুয়োরটার দিকে চেয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল।

 শুয়োর তাতে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে জল খাওয়া শেষ করে তারপর বাঘের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে ‘হুঁস’ করে তাকে এক ধমক দিল। তারপর ঘাড় বাগিয়ে পিঠের লোম খাড়া করে সে দাঁড়িয়ে রইল। এইরকম খানিকক্ষণ মুখোমুখি থেকে বাঘট একলাফ দিয়ে একেবারে শুয়োরের পিঠে পড়ল। দুই-তিন থাবা মেরে শুয়োরের ঘাড় থেকে খাবল খাবল মাংস তুলে ফেলল। বাঘের চড় বড় সহজ চড় নয়! শুয়োর যে তাতে একটু কাবু হয়েছিল সেটা কিছু আশ্চর্য নয়। কিন্তু এরই মধ্যে সেও বেশ দু চারটা গুঁতো মেরে বাঘের গায়ে দাঁত বসাতে ছড়েনি।

 শুয়োরটা বারবার বাঘের হাত এড়িয়ে আবার ঘুরে তেড়ে আসে। কিন্তু শুয়োরের অস্ত্র খালি দাঁতের গুঁতো—বাঘের যেমন দাঁত তেমনি নখ, তার উপর তার থাপ্পড়টিও আছে। সুতরাং খানিকক্ষণ পর্যন্ত মনে হলো যেন বাঘেরই জিত। সে শুয়োরের ঘাড়ে পিঠে গলার ঠ্যাঙে কামড়ে আঁচড়ে একেবারে রক্তারক্তি করতে লাগল। এর মধ্যে একবার শুয়োরটা একদৌড়ে খানিকটা দূর গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, মন হল যেন তার আর দম নাই। কিন্তু বাঘটা যেই আবার লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে পড়তে গেল, শুয়োরটা চট্‌ করে নিচু হয়ে কি রকম একটা গাঝাড়া দিল, তাতেই বাঘটা একেবারে ডিগবাজি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল।

 আর যায় কোথা! শুয়োর একলাফে তার উপর চড়ে দাঁত দিয়ে তিন চার গুঁতোয় তার পেট ফুঁড়ে দিয়ে তারপর হয়রান হয়ে মাটিতে পড়ে রইল। এদিকে বাঘেরও আর উঠবার সাধ্যি নেই—দুজনেই মাটির উপর পড়ে হাঁপাচ্ছে।

 তখন শিকারীরা গুলি মেরে তাদের শেষ করে দিল।

 বরাহ যখন ক্ষেপে বসে, তখন তার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না — আর সে যে কখন ক্ষেপে বসে তারও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। হয়তো শিকারীরা একটা শুয়োরকে তাড়া করেছে, শুয়োরটা দৌড়ে পালাচ্ছে, হঠাৎ কেমন করে একটা পাথরে পা লেগে শুয়োরটা পড়ে গেছে, অমনি আর কথাবার্তা নেই! সামনে গাছ জঙ্গল যা থাকে সে তাতেই তেড়ে গুঁতিয়ে সব ভেঙ্গে উপড়িয়ে সাবাড় করে দিল! ওদিকে শিকারীরা যে তাকে ধরে ফেলছে সে হুঁস তার নেই।

 একজন বড় শিকারী বলেছেন যে শুয়োর যখন তেড়ে আসে, তখন যদি তাকে এড়িয়ে চট্‌ করে তার পিছনের পা ধরে তোলা যায় তবে নাকি সে আর কিছু করতে পারে না। কথাটি সত্যি কিনা জানি না, কিন্তু আমায় যদি শুয়োরে তাড়া করে আমি তার ঠ্যাং ট্যাং ধরতে যাচ্ছি না, একেবারে একদৌড়ে একটা গাছের উপর চড়ে বসব!