উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বিড়াল
বিড়াল
আগে ঠাকুরমার কাছে বিড়ালের সম্বন্ধে অনেক কথা শুনিয়াছিলাম;দুঃখের বিষয় তাহার সবগুলি এখন মনে হইতেছে না। আজ যদি সেই বৃদ্ধা বাঁচিয়া থাকিতেন, তবে তাঁহার কাছে আসিয়া বিড়াল সম্বন্ধে তোমাদের কত বৃহৎ কুসংস্কার দূর করিতে পারিতে। অতি শৈশবকালে, যখন প্রথম জানিতে পারিলাম যে আমার একজন ঠাকুরমা আছে, তখন হইতেই জানিয়াছিলাম যে তাঁহার একটি বিড়ালীও আছে। ঠাকুরমা বলিলেই আমার মনে হয়, এক বুড়ি দরজার ধারে কুশাসন বিছাইয়া নামাবলী মাথায় দিয়া জপ করিতেছে আর এক বিড়ালী তাঁহার অঞ্চলে গা ঢাকিয়া হাত-পা গুটাইয়া চক্ষু মুদিয়া ধ্যানে মগ্ন রহিয়াছে।
ঠাকুরমা বিড়ালীকে আদর করিতেন, কিন্তু হুলো বেড়াল দুচক্ষে দেখিতে পারিতেন না। বিড়ালীর ছানাগুলি যখন হইত তখনই হুলোগুলিকে ধরিয়া থলের ভিতরে পুরিয়া গ্রামান্তরে নির্বাসিত করা হইত।
কি করিয়া বাঘের মাসি বোন্পোয়ের সঙ্গে বিবাদ করিয়া, মানুষের বাড়িতে আসিয়া বিড়ালরূপ ছদ্মবেশ ধারণ করিল; তদবধি কি প্রকারে বাঘ তাহাকে শাস্তি দিবার জন্য ক্রমাগত খুঁজিয়া বেড়াইতেছে;এবং সেই ভয়ে বিড়াল কিপ্রকারে নিজ অস্তিত্বের চিহ্ন পর্যন্ত লোপ করিবার জন্য গর্ত খুঁড়িয়া মলত্যাগ করিয়া তাহা আবার যত্নপূর্বক মৃত্তিকা দ্বারা আচ্ছাদন করে; ইত্যাদি সকল কথাই ঠাকুরমা আমাদিগকে বলিয়া গিয়াছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ এই-সকল বিষয়ে মাথা ঘুরাইয়া অদ্যাপিও কোনো মীমাংসায় আসিতে পারেন নাই। তাঁহারা যদি আমার ঠাকুরমার নাতি হইতেন, তাহা হইলে শৈশবকালেই এ-সকল প্রশ্নের অতি সন্তোষজনক উত্তর পাইতেন।
বিড়াল মানুষের ঘরের জন্তু, মানুষ তাহার নিকটে অনেক উপকারও পাইয়া থাকে; কিন্তু তথাপি বেচারীকে কেন জানি না, কেহই দেখিতে পারে না। কুকুর ঐ বিষয়ে ভাগ্যবান। ঠাকুরমা বলিতেন-“কুকুরটির ইচ্ছা করে, বাড়ির কর্তার ছেলে হউক, তবেই তাহার খাবার সময় সে পেট ভরিয়া ভালো ভালো জিনিস খাইতে পাইবে। আর বেড়াল ইচ্ছা করেন গিন্নির চোখ কানা হউক, তবেই সে অলক্ষিতে মাছভাজা মুখে লইয়া চম্পট দিতে পারিবে।
এদেশে যেমন, অন্যান্য দেশেও তেমনি কতকটা দেখা যায়। ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশের অজ্ঞ লোকে বিড়ালকে ভূত-পেত্নীর চর বলিয়া মনে করিত। পূর্বে সেখানকার লোকের এবিষয়ে অনেক কুসংস্কার ছিল। জাদুকর শ্রীলোকদের প্রত্যেকে এক-একটি করিয়া বিড়াল থাকিত।
এরূপ গল্প আছে যে, একবার এই শ্রেণীর কতকগুলি স্ত্রীলোক একটা বিড়ালের নামকরণ করিয়া রাত্রিযোগে তাহাকে লীথ্ নগরের সামনে রাখিয়া আসিল। এরপর সেই নগরে এমন এক ঝড় হইল যে, তেমন ঝড় সেখানকার কেহ কখনো দেখে নাই। সাধারণ লোকের এইপ্রকার কুসংস্কার থাকাতে অনেক সময় অনেক ভয়ানক ঘটনা হইত। কোনো স্থানে হয়তো ক্রমাগত কতগুলি দুর্ঘটনা হইল; অমনি সকলে সিদ্ধান্ত করিয়া বসিল যে, নিশ্চয়ই কেহ জাদু করিয়াছে। গ্রামের এক কোণে এক গরিব বুড়ি বাস করে, সংসারে তাহার কেহ নাই। হয়তো তাহার মনটা একটু হিংসুকে; হয়তো গ্রামের একজন একদিন তাহাকে আপনমনে বকিতে দেখিয়াছে;আর একজন হয়তো বুড়িকে একদিন লাঠি হাতে করিয়া কাক তাড়াইতে দেখিয়াছে। গ্রামের লোকের বুড়ির উপর ভারি সন্দেহ হইতে লাগিল। এরপর যদি বুড়ির একটা কালো বিড়াল থাকে, তবেই সর্বনাশ! বুড়ি নিশ্চয়ই ডাইনী। এমন সময় গ্রামের একজন চাষার মনে হইল যে, একদিন তাহার গোরু বুড়ির শসা গাছ খাইয়া ফেলিয়াছিল, সেইজন্য গোরুকে বুড়ি “তোর মুনিব উচ্ছন্ন যাউক” বলিয়া গালি দিয়াছিল, তারপর হইতে সেই চাষার ক্ষেতে ইন্দুর আসিয়াছে। আর রক্ষা নাই—বুড়ি ডাইনী; বুড়ির বিচার হইবে।
বিচারটা আবার কিরূপ জান? বুড়ির হাত-পা বাঁধিয়া তাহাকে পুকুরে ফেলিয়া দেওয়া হইবে;ইহাতে যদি সে ডুবিয়া মরে তবে সে নির্দোষ, আর যদি তাহা না হয়, তবে সে দোষী, তাহাকে পোড়াইয়া ফেলা হইবে।
যাহা-হউক, আমরা বিড়ালের কথা ভুলিয়া যাইতেছি। আমি বলিতেছিলাম, বিড়ালকে কেহই দেখিতে পারে না। কিন্তু তাই বলিয়া বিড়ালের কোনো সদ্গুণ নাই, এমন কথা বলা উচিত নয়। প্রথমে দেখ, বিড়ালের যদি কোনো গুণই না থাকিবে তবে এত লোকে বিড়াল পোষে কেন? চেহারার জন্য? ঠিক তাহা নহে। ইঁদুর মারে বলিয়া? তাহাই বা কেমন করিয়া বলি। অনেক বড়লোক এক-একটা বিড়ালকে যারপরনাই ভালোবাসিয়া গিয়াছে। ইংলণ্ডের বিখ্যাত পণ্ডিত ডাক্তার জন্সনের ‘হজ’ নামে একটা বিড়াল ছিল। হজ জন্সনের বাড়িতে থাকিয়া ক্রমে বৃদ্ধ হইল, তাহার শেষকাল আসিল। এই সময়ে জন্সন্ হজের যেপ্রকার শুশ্রুষা করিতেন, অনেক বাপ ছেলের জন্য তেমন করে না। জন্সন্ স্বয়ং বাজারে গিয়া হজের আহারের জন্য ঝিনুক কিনিয়া আনিতেন।
ইটালীর একজন খুব বিখ্যাত পাদরির তিনটা এঙ্গোরা বিড়াল ছিল। খানার সময় টেবিলের পাশে পাদরি-সাহেবের জন্য যেমন চেয়ার দেওয়া হইত, তেমন বিড়ালগুলির জন্যও চেয়ার থাকিত। হাজার বড়লোক পাদরি সাহেবের সঙ্গে খানা খাইতে আসুন-না কেন, তাঁহাকেও সেই বিড়ালগুলির সঙ্গে এক টেবিলে বসিয়া খানা খাইতে হইত।
বিলাতের আর-একজন বড়লোকের কথা শুনিয়াছি। তিনি অবিবাহিত ছিলেন, একটা বিড়ালী বৈ তাঁহার আর সঙ্গী ছিল না। এই বিড়ালীও সাহেবের সঙ্গে এক টেবিলে বসিয়া খানা খাইত। এমন কি, একটা খাবার জিনিস আসিলে তাহার এক টুকরা আগে বিড়ালীর পাতে দেওয়া হইত, তারপর সাহেব অবশিষ্টটুকু আহার করিতেন। এই সাহেবের একজন বন্ধু একবার তাঁহার বাড়িতে অতিথি হইলেন। খানার সময় সাহেব মাংসের টুক্রা কাটিয়া প্রথমে বন্ধুর পাতে দিলেন। এই সম্মানটুকু এতদিন বিড়ালীর ছিল। আজ তাহার অন্যথা হওয়াতে সে এতঊর অপমানিত বোধ করিল যে, একলাফে টেবিলের উপরে উঠিয়া
সাহেবের নাক-মুখ আঁচড়াইয়া দিল। এই আঁচড়ের দাগ সাহেব এ জীবনে আর দূর করিতে পারিলেন না।
তোমাদের অনেকই বিখ্যাত হুইটিংটন্ সাহেবের কথা পড়িয়াছ। হুইটিংটন্ বাল্যকালেই পথের ভিখারি হইয়াছিলেন। হুইটিংটনের অনেক সদ্গুণ ছিল, এবং একটি অতি প্রিয় বিড়ালও ছিল। এরূপ গল্প আছে এই-সকল সদ্গুণের জোরে এবং বিড়ালের বিশেষ সাহায্যে হুইটিংটন্ শেষে বড়লোক হইয়াছিলেন। হুইটিংটন্ এবং তাঁহার বিড়ালের গল্প অতিশয় আমোদজনক; এবং যদিও ইহার সমুদয় অংশ সত্য নহে, তথাপি ইহার ভিতরে সুন্দর উপদেশ আছে।
এইসকল গল্প পড়িয়া তোমরা ইহাই বুঝিবে যে অনেক বড়লোক বিড়ালকে ভালোবাসিয়া গিয়াছেন। কিন্তু বিড়ালের যে বিশেষ কোনো সদ্গুণ আছে, এ-সকল হইতে তাহার কোনো প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না। কিন্তু এরূপ প্রমাণেরও কোনো অভাব নাই। নিম্নে এ সম্বন্ধে দুই-তিনটি গল্প বলিয়া শেষ করিতেছি।
কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা বিড়ালী ছিল। বিড়ালীকে সকলেই বিশেষ ভালবাসিত। একদিন রাত্রিতে বৈঠকখানার ঘরে ঘণ্টার শব্দ শুনিয়া সকলেরই ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। বাড়িতে চোর ঢুকিয়াছে মনে করিয়া সকলেই সশস্ত্র হইয়া বৈঠকখানার দিকে ছুটিলেন। দেখা গেল যে, বৈঠকখানার দরজা যেরূপভাবে বাহিরের দিক হইতে অর্গল দিয়া রাখা হইয়াছিল ঠিক তেমনি আছে, কিন্তু ভিতর হইতে ঘণ্টার শব্দ আসিতেছে। দরজা খুলিয়া দেখা গেল যে, বিড়ালী চাকরদের ডাকিবার ঘণ্টার কাছে দাঁড়াইয়া ক্রমাগত তাহা নাড়িতেছে। ঘণ্টাটি এমন স্থানে ছিল যে তাহাকে বাজাইতে হইলে একটু কষ্ট স্বীকার করিতে হয়। সন্ধ্যার সময় বিড়ালী ঐ ঘরে অজ্ঞাত সারে আটকা পড়িয়াছিল। বাহির হইবার উপায়ান্তর না দেখিয়া অগত্যা সে এই কষ্টটুকু স্বীকার করিয়াছে। অন্যান্য দিন ঐ ঘণ্টা বাজিলেই ঘরে লোক আসে, তাহা সে দেখিয়াছে। সুতরাং সে চেয়ারের উপর উঠিয়া, পিছনের দুই পায়ে দাড়াইয়া, এক হাতে ঘণ্টা বাজাইতে আরম্ভ করিল। ইহার ফল কি হইল, প্রথমেই শুনিয়াছ। বিড়ালী যে কেবল ঐদিন এরূপ করিয়াছিল, তাহা নহে। যখনই ঘরে সে আট্কা পড়িত, তখনই ঐ উপায় অবলম্বন করিয়া বাহিরে আসিত।
একবার এক বৃদ্ধা উইল করিয়া তাহার সমস্ত বিষয় তাহার ভ্রাতুষ্পুত্রকে দিল। ইহার কিছুদিন পরেই বৃদ্ধার মৃত্যু হইল। ভ্রাতুস্পুত্র উকিল, বৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টির পরেই সে তাহার ঘরে আসিয়া তাহার উইল পড়িতে লাগিল। বৃদ্ধের একটি প্রিয় বিড়াল ছিল। এই বিড়াল, বৃদ্ধাকে এত ভালোবাসিত যে, একবারও তাহার কাছ-ছাড়া হইত না। এমন-কি, মৃত্যুর পরেও সেই মৃত শরীরে কাছে বসিয়া রহিল। বৃদ্ধার ভাইপো যখন বৃদ্ধার ঘরে বসিয়া উইল পড়িতেছিল, সেই সময়ে বিড়ালটি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিতের ন্যায় সেই ঘরের দরজার বাহিরে ছুটাছুটি করিতেছিল। কিছুকাল পরে যেই দরজা খোলা হইল, অমনি বিড়াল ছুটিয়া আসিয়া উকিল ভাইপোর গলা কামড়াইয়া ধরিল—অনেক কষ্টে তাহাকে ছড়ানো হইল। এই ঘটনার আঠারো বৎসর পরে ভাইপোর মৃত্যু হইল। মৃত্যুশয্যায় সে স্বীকার করিল যে, বৃদ্ধার টাকাগুলি শীঘ্র শীঘ্র পাবার জন্য সে তাহাকে খুন করিয়াছিল।
এক পরিবারে একটি অতি সুন্দর বিড়াল পালিত হইয়াছিল। সেই পরিবারের জ্যেষ্ঠ
সন্তানটিকে সে বড় ভালোবাসিত। সেই ছেলেটির সঙ্গে সে খেলা করিত এবং তাহার সকলপ্রকার অত্যাচার সে অতিশয় ভালোমানুষের ন্যায় সহ্য করিত। এইরূপে অনেকদিন চলিয়া গেল। অবশেষে ছেলেটির বসন্ত রোগ হইল। প্রথম কয়েকদিন বিড়ালটি কিছুতেই তাহার বিছানার পাশ ছাড়িয়া যাইতে চাহিল না। ব্যারাম যখন বাড়িয়া চলিল, তখন বিড়ালটিকে স্থানান্তরিত করিয়া এক ঘরে তালা দিয়া রাখিতে হইল। ছেলেটি মারা গেল। বিড়ালকে ছাড়িয়া দিবামাত্র সে উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া তাহার খেলার সঙ্গীকে দেখিতে আসিল—কিন্তু ইহার পূর্বেই তাহার মৃত শরীর সে ঘর হইতে স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। তাহার পর সে বাড়িময় ছোটাছুটি করিয়া অবশেষে সে ঘরে মৃতদেহ রাখা হইয়াছিল সেই ঘরে আসিল। এই স্থানে সে শোকে অধীর হইয়া শুইয়া রহিল। তাহাকে আবার তালা দিয়া রাখিবার দরকার হইল। ছেলেটিকে গোর দেওয়ার পরে বিড়ালটিকে দেখা গেল না। পনেরোদিন পরে নিতান্ত জীর্ণ শীর্ণ হইয়া সেই বালকটি যে ঘরে মারা গিয়াছিল, সেই ঘরে বিড়াল ফিরিয়া আসিল। এরূপ অবস্থায়ও তাহাকে কিছু খাওয়ান গেল না। তাহার সংগীকে না দেখিয়া সে করুণস্বরে চিৎকার করিতে করিতে বাহির হইয়া গেল। অবশেষে যখন ক্ষুধায় মৃতপ্রায় হইল, তখন খাইবার সময় কোনোপ্রকারে ঘরে আসিত, কিছু আহার করিয়াই আবার চলিয়া যাইত। অন্য সময় সে কোথায় থাকিত কেহই জানিত না। অবশেষে একদিন তাহার পশ্চাৎ যাইয়া দেখা গেল যে, সে সেই বালকটির গোরের পাশে পড়িয়া থাকে। এই পরিবারটি ঐ স্থানে পাঁচ বৎসর কাল ছিলেন। এই দীর্ঘকাল ব্যাপিয়া সেই বিড়ালটিকে সেই বালকের গোরের পাশে দিনরাত পড়িয়া থাকিতে দেখা গিয়াছিল। এই ঘটনার পর হইতে ঐ বিড়ালটির উপরে সকলেরই অতিশয় ভালোবাসা জন্মিয়া গিয়াছিল, এমন-কি তাহাকে একপ্রকার ভক্তির ভাবে দেখা হইত।