উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/গ্লাটন

গ্লাটন্‌

 গ্লাটন্‌ নামক জানোয়ারের বাড়ি আমাদের দেশে নয়। উত্তরের শীতপ্রধান দেশ-সকলে ইহারা বাস করে; কামস্কট্‌কা উপদ্বীপে ইহারা খুব বেশী পরিমাণে থাকে। ঐ-সকল শীতপ্রধান দেশে ভোঁদড় জাতীয় অনেক প্রকারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জন্তু বাস করে; তাহারা নিশাচর বৃত্তি করিয়া জীবন ধারণ করে। তাহাদের জ্বালায় সেখানকার লোকেরা সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকে। গৃহপালিত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র আহারীয় পশুপক্ষীর প্রতি ইহাদের বড়ই অনুরাগ। এই কারণে ঐসকল দেশের অধিবাসীদিগের সহিত ইহাদের শত্রুতা চিরকাল চলিয়া আসিতেছে। তাহার উপর আবার এই-সকল পশুর চর্ম অতিশয় মূল্যবান। সুতরাং ইহাদিগকে বধ করিবার জন্য নানা প্রকার উপায় অবলম্বিত হয়। এরূপ লোক আছে যে, নানাপ্রকার কৌশল করিয়া ঐসকল জন্তু ধরাই তাহাদের ব্যবসায়। আমরা যে জন্তুর কথা কহিতেছি, সেও এই জাতীয়; কিন্তু তাহার স্বাভাবিক ধূর্ততা এত বেশি যে, তাহাকে কেহই ধরিতে পারে না।

 গ্লাটনের সম্বন্ধে পূর্বকালে লোকের অনেক আশ্চর্য সংস্কার ছিল। তখনকার একটা পুস্তকে লেখা আছে যে ঐ গ্লাটন যদি কোনো বড় জন্তুর মৃত শরীর দেখিতে পায় তবে অমনি উহাকে খাইতে আরম্ভ করে। খাইতে খাইতে যখন পেটটা ঢাকের মতন ফুলিয়া উঠে, আর তাহাতে জিনিস ধরে না, তখন গ্লাটন্‌ খুব নিকট অবস্থিত দুটি গাছের মধ্য দিয়া শরীরটাকে নিয়া যাইতে চেষ্টা করে। এইরূপ করাতে ভয়ানক চাপ পড়িয়া তাহার পেটের ভিতরের সব জিনিস বাহির হইয়া যায়। এইরূপে পেট খালি হইলে গ্লাটন্‌ আবার আসিয়া খাইতে আরম্ভ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত আহার্য পদার্থ একেবারে ফুরাইয়া না যায়, ততক্ষণ এই উপায়ে ক্রমাগত ভক্ষণ এবং উদগীরণ চলিতে থাকে।

 অনেক বলিয়াছেন যে, গ্লাটন্‌ কোনো গাছে উঠিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, নীচে কোনো বড় জন্তু আসিলে অমনি তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়ে। এইরূপে হঠাৎ পড়াতে তেমন প্রকাণ্ড জানোয়ারটাও ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া যায় আর আত্মরক্ষা করিতে পারে না। গ্লাটন এই অবস্থায় তাহাকে সহজেই মারিয়া ফেলিতে পারে। যাহা হউক আধুনিক অনেক পণ্ডিতের এই মত যে, গ্লাটন গাছে উঠিতে তত পটু নহে;সুতরাং এই-সকল গল্পকে গল্পের ভাবেই গ্রহণ করিতে হইবে।

 গ্লাটন্‌ জানোয়ারটি আড়াই ফুটও লম্বা হইবে না, কিন্তু তাহার বুদ্ধি বড় বেশি। শিকারীরা অন্যান্য জন্তু ধরিবার জন্য যে ফাঁদ পাতে, গ্লাটন অনায়াসে তাহার ভিতরের খাবারটুকু খাইয়া যায়। ফাঁদে কোনো ছোট জানোয়ার পড়িলে তাহাও উদরস্থ করে। গ্লাটন্‌কে এপর্যন্ত খুব কম লোকেই ফাঁদ পাতিয়া ধরিতে পারিয়াছে। নিম্নে একজন শিকারীর লিখিত একটি গল্প অনুবাদ করিয়া দেওয়া গেল।

 “একবার একটা বৃদ্ধ গ্লাটন্‌ আমার মার্টেন (ভোঁদড় জাতীয় আর-এক প্রকার ক্ষুদ্র জন্তু) ধরিবার ফাঁদগুলির খোঁজ পাইল। আমি পনেরো দিন পর একদিন ফাঁদগুলি দেখিতে যাইতাম, সে তার চাইতে ঘন ঘন আসিতে লাগিল। ইহাতে আমি বড়ই চটিয়া গিয়া মনে করিলাম যে, যেরূপেই হউক উহার চৌর্যবৃত্তি বন্ধ করিতেই হইবে। এই ভাবিয়া আমি ভিন্ন ভিন্ন ছয় স্থানে ছয়টা মজবুত ফাঁদ প্রস্তুত করিলাম এবং তিনটা লোহার ফাঁদও সংগ্রহ করিলাম। তিন সপ্তাহকাল চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। সে এই-সকল ফাঁদের কাছেও গেল না। কিন্তু আমার মার্টেন ধরিবার ফাঁদগুলিকে পূর্বাপেক্ষা অধিক উৎসাহের সহিত ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ফেলিতে আরম্ভ করিল। যে-সকল মার্টেন ফাঁদে পড়িত, সেগুলিকে এবং ফাঁদে যেসকল আহার দেওয়া হইত তাহাও খাইয়া ফেলিতে লাগিল। তখনকার দিনে বিষ খাওয়াইয়া মারার নিয়ম ছিল না, সুতরাং এরপর আমি বন্দুক পাতিয়া তাহাকে মারিতে চেষ্টা করিলাম। বন্দুকটিকে এরূপভাবে রাখা হইল যে গ্লাটন সেই পথে যাইবার সময় তাহা দেখিবেই। এরপর প্রথম যেদিন সেই স্থান দেখিতে গেলাম সেদিন দেখিলাম যে, গ্লাটন্‌ সেখানে আসিয়াছিল কিন্তু আহারটাকে ছোঁয় নাই, কেবল শুঁকিয়াই চলিয়া গিয়াছে। ইহার পরের বারে আসিয়া প্রথমেই যে দড়ি দ্বারা বন্দুকের কলের সহিত আহারের সংযোগ ছিল সেই দড়িটিকে কাটিয়াছে (কাটিয়াছে আবার বন্দুকের মুখের একটু পেছনে, যেন কাটিবার সময়ে হঠাৎ বন্দুক ছুটিয়া গেলেও গুলি গায়ে না লাগে) তারপর নিশ্চিন্ত মনে আহারটি লইয়া গিয়া পুকুরের ধারে বসিয়া খাইয়াছে। সেইখানে গিয়া আমি দড়িগাছ পাইলাম। ইচ্ছপূর্বক এত বুদ্ধি খরচ করিয়াছে ইহা আমি কোনমতেই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না; কারণ ঐরূপ

করিতে হইলে ঠিক মানুষের বুদ্ধির সমান বুদ্ধির আবশ্যক করে। সুতরাং আমি আবার কল পাতিয়া রাখিলাম। দড়িটি যেখানে ছিঁড়িয়াছিল সেইখানে বাঁধিয়া দিলাম। কিন্তু ক্রমাগত তিনবার অবিকল একইরকম ফল পাইলাম। আরো আশ্চর্যের বিষয় এই যে দড়িটি যে জায়গায় বাঁধিয়া দেওয়া গিয়াছে প্রত্যেকবার তাহার একটু পেছনে কাটিয়াছে, কি জানি যদি ইহার মধ্যেও আমি তাহার বিনাশের জন্য কোনরূপ সন্ধান করিয়া রাখিয়া থাকি। এইসকল দেখিয়া আমি এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, এইরূপ বুদ্ধিমান জন্তুর বাঁচিয়া থাকাই উচিত।”