উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মশা
মশা
আমরা ছেলেবেলায় মশার বাসা খুঁজিতে যাইতাম। টেকি গাছে মশা বাসা করে এই আমাদের বিশ্বাস ছিল। লাল রঙের একপ্রকার বড় পিঁপড়ে যেমন গাছের পাতা দিয়া বাসা প্রস্তুত করে, ঢেঁকি গাছে সেই রূপ অতি ক্ষুদ্র বাসা পাওয়া যায়। এগুলি কিসের বাসা তাহা আমি আজিও জানিতে পারি নাই, কিন্তু আমার ছেলেবেলায় এই সংস্কার ছিল যে, এগুলি মশার বাসা বই আর কিছুই নহে। বাস্তবিক এই সকল বাসার প্রায় প্রত্যেকটিতে এক-একটি করিয়া মশা পাওয়া যায়।
যে-সকল মশা আমাদের রক্ত খাইতে আইসে তাহারা সকলেই স্ত্রী-মশা। পুরুষ-মশা নিরীহ লোক; সে ফুলের মধু খাইয়া জীবন ধারণ করে। উহাদের স্ত্রী পুরুষের মুখের গঠনেরও কতকটা তফাত আছে।
ডিম পাড়িবার সময় হইলে স্ত্রী-মশা উপযুক্ত একটি জলাশয় খুঁজিয়া লয়। নির্জন পুকুরগুলি এই কার্যের পক্ষে অতি উৎকৃষ্ট স্থান। কিন্তু তিন-চারদিন ধরিয়া ঝি যে জলের হাঁড়ি ঘরের কোনে রাখিয়া দিয়াছে, তাহার খোঁজ পাইলেও মশার মা নিতান্ত দুঃখিত হইবে না। একেবারে অনেকগুলি ডিম পাড়া হইবে। পেছনের দুইখানি পায়ের সাহায্যে ডিমগুলিকে একত্র করিয়া একটি ক্ষুদ্র নৌকার আকারে সাজানো হইবে;এই নৌকাটি জলে ঘড়িয়া দিলেই সে ভাসিতে থাকিবে। ডিমের সরু দিকটা উপরে থাকে, সুতরাং কিরূপে নৌকার আকার হয় তাহা সহজেই বুঝা যাইতেছে। উপযুক্ত সময় হইলেই ডিম ফুটিয়া মশার ছানা বাহির হয়। এই সময়ে এগুলিকে দেখিলে কেহই মনে করিতে পারে না যে, ইহারাই কালে মশা হইয়া মানুষ খাইতে আসিবে। তোমরা নিশ্চয়ই গরমের দিনে স্থির জলে মশার ছানাগুলিকে তিড়িং তিড়িং করিয়া নাচিতে দেখিয়াছ কিন্তু তাহাদিগকে চিনিতে পার নাই। ডিম হইতে বাহির হইয়া ইহারা জলে খেলা করিতে থাকে। ঝি অনেক সময় না দেখিয়া খাবার জলের সহিত গেলাস করিয়া যে কতগুলি পোকা আনিয়া দেয় তাহা এই মশার ছনা। ইহাদের নিশ্বাস ফেলিবার যন্ত্র ল্যাজের কাছে। নিশ্বাস ফেলিবার সময় ল্যাজের অগ্রভাগটি জলের উপরে ভাসাইয়া দিয়া ঝুলিতে থাকে। চোয়ালে একপ্রকার লোম আছে, সেই লোমগুলি কেমন করিয়া যেন জলের উপর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র আবর্ত প্রস্তুত করে। সেই আবর্তে ঘুরিয়া নানারকমের খাদ্যাখাদ্য আসিয়া মুখের ভিতর পড়ে। মশার ঘনা এই উপায়ে জীবন ধারণ করে।
তিনবার চর্ম পরিবর্তনের পর ইহার আর-এক প্রকারের আকার ধারণ করে, তাহাতে মশার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি মোটামুটি সকলই বর্তমান থাকে। কিছুকাল পরে পূর্ণাবয়ব মশা ইহার ভিতর হইতে বাহির হয়। খোলসটা জলের উপর ভাসিতে থাকে; মশা তাহারই উপর বসিয়া উড়িবার জন্য যথেষ্ট বল লাভের অপেক্ষা করে। অল্পক্ষণ রোদ বাতাস লাগিলেই
তাহার হাত-পা শক্ত হয়। তখন সে শুন্যে উড়িয়া অপরাপর সঙ্গীদের সহিত খেলা করে।
মশাগুলি বড় লোভী। গায়ে বসিবামাত্রই যদি তাহাকে তাড়াইয়া না দেও তবে সে আস্তে আস্তে শুঁড়টি চামড়ার ভিতর ঢুকাইয়া দিবে। রক্ত খাইতে খাইতে সে এতই আরাম পায় যে শেষে আর তাহার বাহ্যজ্ঞান থাকে না-আমরা এত খাইলে বোধহয় খবরের কাগজওয়ালারা এতদিন আমাদের নাম ছাপিয়া দিত। যখন গায়ে বসে, তখন দেখিবে যে, তাহার শরীরটি ছুঁচের অগ্রভাগের ন্যায় সরু। ক্ষুধায় তাহার এই দশা হইয়াছে; কিন্তু কিছুকাল তাহাকে খাইতে দাও, দেখিবে শীঘ্রই সে ফুলিয়া উঠিবে, তাহার পেটটি লাল হইয়া আসিবে। এই সময়ে তাহার দুই পাশে আঙুল দিয়া চাপিয়া সেই স্থানের চামড়া টান করিয়া ধরিলেই সে আটকিয়া পড়ে। শুঁড়টি ঢুকাইবার জন্য যে ফুটো করিতে হইয়াছিল টান করিয়া ধরিলে সেই ফুটো সরু হইয়া যায়। সুতরাং শুঁড় আর বাহির হইতে পারে না। রাত্রিকালে মশারির ভিতরে দুই-একটি মশা জোগাড়যন্ত্র করিয়া প্রায়ই ঢুকিয়া যায়। সকালবেলা আর তাহারা উদর লইয়া চলিতে পারে না। এইরূপ অবস্থায় অনেক মশাকে ধরিয়া টিপিয়া মারা গিয়াছে।
একটি গল্প বলিয়া শেষ করিতেছি। গল্পটি বোধহয় সত্য নহে, কিন্তু ইহাতে মজা আছে। কতকগুলি আইরিস সাহেব একবার এদেশে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা কখনো মশা দেখেন নাই, সুতরাং প্রথমে মশারি কিনেন নাই। রাত্রিতে শুইয়াই বুঝিতে পারিলেন যে এদেশের কাণ্ডকারখানা অন্যরকম। অনেক ধমকাইলেন, অনেকবার হত মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ভয় দেখাইলেন, দাঁত খিচাইলেন কিন্তু মশারা কোনোমতেই ভয় পাইল না। অবশেষে লেপদ্বারা সর্বশরীর ঢাকিয়া কিয়ৎকালের জন্য নিরাপদ হইলেন। কিছুকাল পরে একজন লেপের এক কোণ সরাইয়া দেখিলেন যে ঘরের ভিতর একটা জোনাকী পোকা আসিয়াছে। দেখিয়াই তিনি চ্যাঁচাইয়া উঠিলেন, “ওরে আর রক্ষা নাই। লেপ মুড়ি দিয়া কি করিবে? ঐ দেখ জানোয়ারগুলি একটা লণ্ঠন লইয়া আমাদিগকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছে!”