উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/ভোঁদড়
ভোঁদড়
অনেক স্থানেই ভোঁদড় দেখিতে পাওয়া যায়। তোমাদের অনেকেই কলিকাতার পশুশালায় গিয়াছ সেখানে একটা গোল চৌবাচ্ছায় যে কয়েকটা ভোঁদড় রাখা হইয়াছে তাহাদের কাছে দশ-পাঁচ মিনিট দাঁড়াইয়াছ কি? আমি যতদিন সেগুলিকে দেখিতে গিয়াছি, একদিনও তাহাদের কোনোটাকে স্থির হইয়া বসিতে দেখি নাই। একবার ডুব দেওয়া আর কিছুদূর গিয়া মুখ ভাসাইয়া পুনরায় ডুব দেওয়া, কাজের মধ্যে ত এই ইহা লইয়াই বেচারারা এত ব্যস্ত যে, দেখিলে বোধহয় ঐ জলটুকুর প্রত্যেক পরমাণুর সহিত তাহাদের পরিচয় থাকার উপরই ব্রহ্মাণ্ড নির্ভর করিতেছে। তোমরা ইহা দেখিয়া হয়তো মনে করিয়াছ যে, ঐরূপ করিযা তাহারা জলের ভিতর মাছ খোঁজে। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। মাছ খুঁজিতে হইলেও ঐরূপ করা সম্ভব বটে, কিন্তু অধিকাংশ সময় কেবল আমোদ করিবার জন্যই ইহারা ঐরূপ করিয়া থাকে।
ভোঁদড়গুলি অত্যন্ত আমোদপ্রিয়। স্বাধীন অবস্থায় তাহাদের বাসস্থানের নিকটবর্তী জলার ধারে পরিবারস্থ সকলে মিলিয়া যখন খেলা কবে, তখন তাহাদিগকে দেখিলে বোধহয় যেন পৃথিবীতে তাহাদের চাইতে সুখী জীব আর নাই। আমি বন্য ভোঁদড়ের খেলা কখনো স্বচক্ষে দেখি নাই, কিন্তু যাহারা দেখিয়াছেন তাঁহারা বলেন যে, তাহার চাইতে আমোদজনক দৃশ্য বড় অধিক নাই। দিনের বেলায় কিন্তু ইহারা তত মন খুলিয়া আমোদ করিতে পারে না, সূর্য অস্ত গেলেই তাহাদের আনন্দের সময় হয়। তাহাদের খেলার একটা বেশ নিয়ম আছে। প্রথমে সংগীত তারপর ব্যায়াম। কোনো কোনো সময় ব্যায়াম এবং সঙ্গীত এক কালেই চলিতে থাকে। তাহারা কোন্ রাগিনী কোন্ তাল অবলম্বন করিয়া কি গান গায়, তাহা আমি বলিতে সক্ষম নহি তবে ব্যাপারটা কিরূপ হয় তাহার কিঞ্চিৎ আভাস দিতেছি। অনেক ছেলের গান গাইবার একটা বাতিক আছে। তাহাদের গানে পৃথিবীর সকল প্রকারের রাগিনী এবং সকল প্রকারের তালই সময়ে ব্যবহার হয়। মনে কর এইরূপ কুড়িজন ছেলে তিন রাত্রি বাহিরে বসিয়া চ্যাঁচাইল, আর হিম লাগিয়া তাহাদের গলা বসিয়া গেল—এখন কথা কহিতে গেলে কেবল একটা সাঁই সাঁই শব্দ মাত্র শুনিতে পাওয়া যায়। এখন যদি এই কুড়িজন ছেলে রাত্রিতে নদীর ধারে কোনো নির্জন বনে গিয়া গান গায়, আর ম্যাও ম্যাও করে, আর শেয়ালের ডাক ডাকে, আর কাশে, আর নাকে কাটি দিয়া ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ করিয়া হাঁচে, তবে ভোঁদড়-পরিবারের গানের নকল করিতে পারে। ইহাদের ব্যায়াম টুটাবাজি। তোমাদের ব্যায়াম-শিক্ষক হয়তো তোমাদিগকে দুই-তিনজনে মিলিয়া মাটির উপর উল্টাবাজি করিতে হইলে কিরূপ করিতে হয় তাহা বলিয়া দিয়াছে। না দিয়া থাকিলেও আমাদের দেশী বাজিকরদিগকে ঐরূপ করিতে অবশ্যই দেখিয়াছ। ভোঁদড়েরা কুড়ি-পঁচিশটি মিলিয়া একটা পিণ্ডের আকার ধারণপূর্বক ঐ বাজি করে। তবে তোমাদের উদাবাজিতে আর তাহাদের উল্টাবাজিতে একটু তফাত আছে। তোমরা সমান জমির উপর উল্টাবাজি কর, তাহারা ডাঙ্গার হইতে উল্টাবাজি করিয়া গড়াইয়া জলে পড়ে।
আমি যখন খুব ছেলেমানুষ ছিলাম, তখন আমাদের বাড়িতে একটি ভদ্রলোক থাকিতেন। তাঁহার বাড়ির কাছে অনেক ভোঁদড় আছে। তাঁহার কাছে শুনিয়াছি যে ভোঁদড়ের প্রতিহিংসা লইবার বৃত্তিটা বড় প্রবল। কাহারো উপর কোনো কারণে চটিলে তাহাকে সহজে ছাড়িয়া দিতে চাহে না। ঐ ভদ্রলোকটির মুখে শুনিয়াছি যে, তিনি প্রায়ই রাত্রিতে ছোট নৌকায় উঠিয়া মাছ ধরিতে যাইতেন। একদিন নৌকায় সম্মুখে একটা ভোঁদড় দেখিতে পাইয়া তাহাকে এক খণ্ড বাঁশ দিয়া গুঁতা মারিলেন। গুঁতা খাইয়া ভোঁদড়টা ক্যাঁচম্যাচ্ করিয়া উঠিল; আর অমনি নৌকার চারিধাবে কতকগুলি ভোঁদড় মাথা জাগাইল। তিনি বলিয়াছে যে, “সৌভাগ্যের বিষয় সেখানে অনেকগুলি ভোঁদড় ছিল না, সুতরাং তাহারা নৌকা আক্রমণ করিতে সাহস পায় নাই, নতুবা সেদিন তাঁহার প্রাণ লইয়া ঘরে আসাই দায় হইত।”
ভোঁদড়েরা মাছ ধরিয়া খায়; মাছ ধরিতে ইহারা এত পটু যে, কোনো কোনো দেশের জেলেরা ইহাদের সাহায্যে মাছ ধরিয়া বিস্তর পয়সা উপার্জন করে। ভোঁদড়দের সাহায্যে মাছ ধরারটা খুব সহজ ব্যাপার মনে করিও না। ভোঁদড় মাছ ভালো ধরিতে পারে সত্য; কিন্তু ধরিলে কি হইবে, পেটুক দুষ্ট ছেলের হাতে সন্দেশ দিলে যেরূপ হয়, অশিক্ষিত ভোঁদড়ের উপর মাছ ধরিবার ভাব দিলেও সেইরূপ হয়। ভোঁদড় মাছ পাইলেই খাইয়া ফেলে। খাইতে খাইতে পেট ভরিযা গেলেও মাছ ধরিতে ছাড়ে না। পেট ভরিলে মাছ খায় না, কিন্তু ধরিয়া তাহাকে দাঁতে টুকরা টুকরা করে। সুতরাং তখন ভোঁদড় মাছ না খাইলেও ওরূপ জন্তুকে মাছ ধরিতে দিয়া মৎস্যব্যবসায়ীর লাভ অতি অল্পই হয়।
ভোঁদড়কে দিয়া মাছ ধরাইবার ইচ্ছা থাকিলে খুব ছোট ছানা ধরিয়া আনিতে হয়। সেই ছানাকে মাছ খাইতে দিবে না; কেবল নিরামিষ খাওয়াইয়া তাহাকে পুশিবে। ভোঁদড় সহজেই কুকুরের মতন পোষ মানে। কোনো জিনিস ছুঁড়িয়া ফেলিলে কুকুরের ন্যায় ভোঁদড়ও তাহা আনিয়া দিতে শিখিতে পারে। প্রথমত, তাহাকে এরূপে নানাপ্রকারের জিনিস আনিয়া দিতে শিখাইতে হয়। এই বিষয়টা খুব ভালোরূপ শিক্ষা হইলে শুনো মাছ দিয়া পরীক্ষা করিতে হয়। মাছের ছালের ভিতর খড় পুরিয়া তাহা দ্বারা প্রথমত পরীক্ষা করিলে আরো ভালো হয়। শুকনো মাছ আনিয়া দিতে শিক্ষা হইলে, অর্থাৎ যদি দেখ যে ভোঁদড় সেই শুক্নো মাছটাকে খাইয়া ফেলিবার মতো কোনো ভাব প্রকাশ না করে তাহা হইলে তাহাকে মরা মাছ আনিতে দিবে। মরা মারে পাঠ ভালোরূপ শিক্ষা হইলে তাহাকে নির্ভয়ে জলে ছাড়িয়া দিতে পার।
ভোঁদড়ের লোম অতি কোমল। এইজন্য অনেক লোকে ভোঁদড় মারিয়া তাহার ছাল বিক্রয় করে। সেই ছলে বড়লোকের পা রাখিবার আসন তৈয়ারি হয়;আরো অনেক জিনিস তৈয়ারি হয়।
অনেক স্থানে দেখিয়াছি নদীর পাড় ঢালু হইলে ছেলেরা তাহাকে জল দিয়া পিছল করিয়া লয়, এবং তাহার উপর দিয়া জলে পিছলাইয়া পড়িয়া খেলা করে। কানাড়া দেশীয় ভোঁদড়গুলিও এই খেলা জানে। সেখানে ঢালু ও মসৃণ বরফের উপর উপুড় হইয়া ভোঁদড়গুলি খেলা করিয়া থাকে। অনেক সময় তাহারা এইরূপে চল্লিশ হাত পর্যন্ত পিছলাইয়া যায়।