উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/শেয়ালের গল্প
শেয়ালের গল্প
মানুষের মধ্যে নাপিত যেমন, পাখির মধ্যে কাক যেমন, দেবতাদের মধ্যে নারদ মুনিঠাকুর যেমন ছিলেন, লোকে বলে জানোয়ারদের মধ্যে শেয়াল তেমন। শেয়াল পণ্ডিত সেকালে তাহার কত প্রতাপই ছিল। কুমিরের সাত ছেলে; শুনিয়াছি সবগুলিকে নাকি শেয়ালের নিকট পড়াইতে দেওয়া হইয়াছিল। শেয়ালপণ্ডিতও স্ত্রীর সঙ্গে যুক্তি করিয়া সাতদিনে সাতটার সদ্গতি করিয়াছিল। তারপর কি হইল সকলেই জানে। কিন্তু পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে এখন আর শেয়ালের সেদিন নাই। ইস্কুলে যত মাস্টারি খালি হয়, একটা শেয়ালকেও তাহাতে দরখাস্ত পাঠাইতে শুনি না। কত শক্ত মোকদ্দমা উপস্থিত হয়, এখন আর তাহার মীমাংসার জন্য শেয়ালের কাছে যাওয়া হয় না। তবুও শেয়ালের যাহা আছে তাহাতে নাম রক্ষার কাজ চলে।
শুনিয়াছি শেয়াল কুকুরের জাতি। হইতেও পারে; নহিলে তাহাদের মধ্যে এত শত্রুতা কেন? তা ছাড়া অনেক সময় কুকুর ঠিক শেয়ালের মতন ডাকিতে পারে; শেয়ালও মাঝে মাঝে কুকুরের ভাষায় আলাপ করিয়া থাকে। শেয়ালের ডাক সম্বন্ধে অনেকে কথা কহিয়া থাকেন। অনেকে ঐ ডাকের অর্থ বেশ বুঝিতে পাবেন। আমি বহু অনুসন্ধানে তিনপ্রকারের ব্যাখ্যা সংগ্রহ করিয়াছি:—
১. প্রথম শেয়ালের পায়ে কাঁটা ফুটিল। সে কাঁদিল—“উ!আ!” দূর হইতে অন্য শেয়াল জিজ্ঞাসা করিল “ক্যা হুয়া?” গোলমাল শুনিয়া অন্যেরা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল “ক্যাক্যাক্যাক্যা হুয়া?” তারপর সকলে মিলিয়া কতক্ষণ “আহা” “আহা” করিল; শেষে আহত শেয়ালকে এই বলিয়া সান্ত্বনা করিল যে, “হুয়া তো হুয়া!”
২. প্রথম শেয়াল বলিল, “আরে ওয়া? হা হ-হা!” দ্বিতীয় শেয়াল জিজ্ঞাসা করিল, “ক্যা। হয়া?” উত্তর হইল, “মৈ রাজা হুয়া,” শুনিয়া সকলে মিলিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিল, “আচ্ছ হুয়া!” “আচ্ছা হুয়া!”
৩. শেয়াল অন্য জন্মে তামাকখোর ছিল। অধুনা সে-সুখ হইতে বঞ্চিত হইয়া ভয়ানক কষ্ট পাইতেছে। তাই প্রহরে প্রহরে সেই হুঁকো যন্ত্রের কথা তাহার মনে হয়;আর বেচারা ঘন ঘন “হুক্কা” “হুক্কা” শব্দ উচ্চারণপূর্বক মনের অভাব জানায়।
প্রতি প্রহরেই শেয়াল ডাকে তাহাতেই তাহাকে যামঘোষ উপাধি প্রদান করা হইয়াছে। শেয়ালের ডাক শুনিয়া এক রাজার মনে বড়ই কষ্ট হইল; তিনি মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন,
“মন্ত্রী, ওরা কি চায়?” মন্ত্রী বলিলেন, “বড় খিদে পেয়েছে কিছু খাবার চায়” অমনি হুকুম হইল দশ হাজার টাকার সন্দেশ কিনিয়া ওদের বাড়ি পাঠাইয়া দাও। ধূর্ত মন্ত্রী দশ হাজার টাকা লাভ হইল, এক প্রহর পরে আবার শেয়াল ডাকিল। “এবারে কি চায়?” “বড় শীত, গরম কাপড় চায়।” হুকুম হইল লক্ষ টাকার বনাত কিনিয়া দাও। এক প্রহর পরে আবার শেয়াল ডাকিল। “এখন কি চায়?” “বড় মশা, মশারি চায়।” আরো লক্ষ টাকা মঞ্জুর। আবার এক প্রহর পরে শেয়াল ডাকিল “এবারে কি চায়?” “এবারে কিছু চায় না, মহারাজকে আশীর্বাদ করে।” অমনি রাজা মহাসন্তুষ্ট হইয়া কোটি টাকা মূল্যের শাল মন্ত্রীকে দিয়া ফেলিলেন।
শেয়ালের একটা দুর্বলতা আছে। এক শেয়াল ডাকিলে আর গুলি চুপ করিয়া থাকিতে পারে না। আমার কোনো বন্ধুর বাড়িতে একটা শেয়াল খাবার খুঁজিতে আসিয়াছিল। স্বাভাবিক ধূর্ততার সাহায্যে কেহ দেখিতে পাইবার পূর্বেই সে একটা ঘরের ভিতর যাইয়া মাচার নীচে আশ্রয় গ্রহণ করিল। সেখানে কতক্ষণ ছিল বলা যায় না, কিনতু সে সেখানে থাকিতে থাকিতেই জঙ্গলে একটা শেয়াল ডাকিল। অমনি আর কথা নাই, বেচারা দেশকাল সব ভুলিয়া গিয়া সেই ঘরের ভিতর হইতেই “ক্যা হুয়া” “ক্যা হুয়া” প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল। প্রশ্নের উত্তর আর জঙ্গল হইতে শুনিতে হইল না। বাড়ির লোকেরা আসিয়াই সে বিষয়ে তাহার জ্ঞান পরিষ্কার করিয়া দিল।
শেয়ালের ধূর্ততা সম্বন্ধে সকলেই কিছু কিছু জানেন। আমাদের একজন চাকর একবার একটা শেয়ালকে লক্ষ্য করিয়া ইঁট ছুঁড়িয়াছিল। দৈবাৎ ইঁটটা শেয়ালের কপালে লাগিল। লাগিবামাত্রই শেয়াল ‘হিক্’ শব্দ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। শেয়াল মরিয়াছে শুনিয়া সকলেরই আনন্দ। তাহাকে টানিয়া উঠানে আনিয়া সকলে বৃত্তাকার তাহার চারিদিক দাঁড়াইলেন। অনেক মন্তব্য প্রকাশের পর একজন বলিলেন, “আমার সন্দেহ হয়, এটা মরে নি।” এবিষয়ে কিঞ্চিৎ তর্ক-বিতর্ক হইল, তারপর একজন বলিলেন, “এত কথায় কাজ কি, একটা লাঠি এনে দু ঘা মেরে সন্দেহ দূর করে দাও না?” এই বলিয়া তিনি লাঠি আনিতে চলিলেন। তিনি চলিয়া যাওয়াতে যে একটুকু ফাঁক হইয়াছিল, শেয়ালটাও সময় বুঝিয়া সেইখান দিয়া চম্পট করিল।
এক পাদরি সাহেব পাড়াগাঁয়ে থাকিতেন। সেখানে শেয়ালের বড় অত্যাচার; তাঁহার সবগুলি মুরগি খাইয়া ফেলিত। সাহেব উপায়ান্তর না দেখিয়া খুব শক্ত একটা কাঠের ঘর করিলেন, তাহার ভিতরে মুরগি রাখিয়া দরজা বন্ধ করিয়া রাখা হইত। একদিন সাহেবের চাকরানী মুরগি ঘরে যাইয়া দেখে, যে একটা শেয়াল ঘরের ভিতরে আসিয়া প্রায় সবগুলি মুরগি মারিয়া ফেলিয়াছে। কেবল কয়েকটি মাত্র প্রাণভয়ে উপরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। সেগুলিকেও উদরসাৎ করিবার জন্য চেষ্টায় আছে। চাকরানীকে দেখিয়াই ধূর্ত শেয়াল মৃতপ্রায় হইয়া রহিল। সাহেব আসিয়া শেয়ালকে মৃতপ্রায় দেখিলেন এবং তাহার একটু আহ্বাদের বিষয় এই হইল যে, খাইতে খাইতে পেট ফাঁপিয়া শেয়ালটাও মরিয়া গিয়াছে। এখন তাহার প্রেতাত্মার উদ্দেশে ইচ্ছামতো গালিবর্ষণ করিয়া তাহাকে অনেক দূরে মাঠে ফেলিয়া দিয়া আসা হইল। যিনি ফেলিয়া দিতে গিয়াছিলেন তিনি একবার পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখেন যে শেয়ালটা দৌড়িয়া পলাইতেছে!