উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মূল বর্ণ

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

মূল বর্ণ

 রামধনু বিষয়ক একটি প্রস্তাব গত বর্ষের সখায় লেখা হইয়াছিল তাহাতে এক জায়গায় লেখা ছিল যে, লাল সবুজ আর ভায়োলেট এই তিনটি মূল বর্ণ আব অন্য কযেকটি বর্ণ ইহাদের হইতে উৎপন্ন। লাল, নীল এবং পীত এই তিনটি মূল বর্ণ, এইরূপ বিশ্বাসই সাধারণে প্রচলিত; সুতরাং আমাদের চিঠিও পাইয়াছি। চিঠিখানি পডিয়া আমরা অতিশয সন্তুষ্ট হইয়াছি এবং আহ্বাদের সহিত এ বিষয়ে আমবা যাহা জানি, পত্রলেখকের সন্দেহ দুব করিবার জন্য তাহা লিখিতেছি।

 প্রথমে অবাস্তর কথা দু-একটি বলা আবশ্যক হইয়াছে। এ বিষযটি ভালো কবিয়া বুঝিতে হইলে সখার এই প্রবন্ধে কুলাইবে না। কিন্তু কিছু একটু বুঝাইতে চেষ্টা করার পূর্বেও আলোক সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। আলোক আছে বলিয়াই আমরা জিনিসের বঙ দেখিতে পাই। রঙটা বাস্তবিক জিনিসের নয়, রঙটা আলোকের। জিনিসটা কিছু আমাদের চক্ষে আসিয়া পড়ে না; আমরা যে সকল জিনিস দেখি, সেগুলি যদি আমাদের চক্ষে আসিয়া পড়ার দরকার হইত, তবে এতদিনে অন্ধ হইয়া যাইত ম! জিনিস হইতে আলো আসিয়া আমাদের চক্ষে পড়ে। সেই আলোকের যে রঙ জিনিসটারও সেই রঙ দেখা যায়। জিনিস হইতে আলোক দুই প্রকারে আসিয়া আমাদের চক্ষে পডিতে পারে। এক জিনিসটার ভিতর দিয়া আসিতে পারে, আর তাহার গায়ে পড়িয়া উলটিয়া আসিয়া আমাদের চক্ষে পড়িতে পারে। আর এক কথা, ভিতর দিয়াই আসুক, উলটিয়াই আসুক, জিনিসে যত প্রকারের আলো পড়ে, সাধারণত তাহার সকলগুলি আমাদের চক্ষে আসিতে পারে না। আলো পড়িবামাত্র জিনিসটা তাহার কিছুটা খাইয়া ফেলে, বাকি আমাদের কাছে আসিতে দেয়। কোনো জিনিস লাল আলো ছাড়া আর সকল রঙের আলো খাইয়া ফেলে, তাহাকে লাল দেখা যায়; যে জিনিস সবুজ ছাড়া আর সব আলো খায়, তাহাকে সবুজ দেখা যায়। সে জিনিস সকল প্রকারের আলোই খায়, তাহাকে কালো দেখা যায়। যে জিনিস কোনো প্রকারের আলোই খাইতে জানে না, সে সাদা। জিনিসে যত আলো পড়ে, তাহার সব যদি সে খাইয়া ফেলে, তবে তাহাকে কালো দেখাইবে। সবুজ জিনিসে সবুজ ছাড়া আর যেরূপ আলোই পড়ুক না, সে তাহা খাইয়া ফেলিবে এবং কালো দেখাইবে।[১] আমরা সাধারণত যে আলোতে দেখি তাহা সাদা। সাদা আলো সকল প্রকারের আলোর সমষ্টি; সুতরাং তাহাতে সকল প্রকারের জিনিসই স্বাভাবিক বর্ণের দেখা যায়। সাদা জিনিস কোনোরূপ আলোকই খায় না, সুতরাং তাহাতে যখন যে রঙের আলো পড়ে, তখন সেই রঙ দেখায়। ইত্যাদি।

 লাল রঙের কাচ লাল কেন? না তাহার ভিতর দিয়া সে কেবল লাল রঙের আলো আসিতে দেয়, আর সব খাইয়া ফেলে। সবুজ কাচের ভিতর দিয়া কেবল সবুজ আলো আসিতে পারে, সেইজন্য সে সবুজ ইত্যাদি। এখন মনে কর একখানা লাল রঙের কাচের উপর একখানা সবুজ রঙের কাচ রাখিয়া দুখানারই ভিতর দিয়া চাহিয়া দেখিলে কি দেখিবে? লালে সবুজে মিশিয়া যে রঙ হয়? না; সবুজ কাচখানা আলোর সব রঙ খাইয়া কেবল সবুজ আলো আসিতে দিয়াছিল, লালখানায় তাহাও খাইয়া ফেলিল। সুতরাং কোনো রঙই দেখিবে না। দেখিবে কেবল কালো।

 কাচের উপর আলো পড়িলে তাহার কতকটা উপর হইতেই উলটিয়া আইসে; কিন্তু সে অতি অল্প। অবশিষ্ট আলো ভিতরে যায়। কাচে রঙ থাকিলে আবার এই যে ভিতরে আসিল ইহাদের কতকগুলিকে সে খাইয়া ফেলে। এখন যাহারা থাকিল তাহাদের কিছু অপর পৃষ্ঠে লাগিয়া ফিরিয়া আইসে, অবশিষ্ট ওপিঠে বাহির হইয়া যায়;এই দুইরকম আলোর দরুনই কাচের রঙ দেখা যাইবে। যত প্রকার জিনিসের রঙ দেখা যায়, (তাহাদের যদি নিজের আলো না থাকে) সকল প্রকার জিনিসের ভিতরেই আলো গিয়া ফিরিয়া বাহিরে আসিয়াছে ইহা নিশ্চয়; কারণ বাহির হইতে যে আলোক ফিরিয়া আইসে তাহার রঙের পরিবর্তন হইতে পারে না। পরিবর্তন হওয়ার অর্থ এই যে, যতগুলি ছিল, তাহার কিছু খাইয়া ফেলিয়াছে। যাহার নিজের আলো নাই তাহা দ্বারা আর কোনোরূপ পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নহে। অনেকে মনে করেন যে, যে জিনিস স্বচ্ছ নহে, তাহার ভিতরে আলো যাইতে পারে না, তবে তাহার রঙ হয় কি করিয়া? ইহার উত্তরে এই বলা যাইতে পারে যে, এমন জিনিস নাই, যাহা অল্প পরিমাণেও স্বচ্ছ নয়। খুব পাতলা হইলে ধাতুর পাতের ভিতর দিয়াও আলো আসিতে পারে।

 এখন কাজের কথা হউক। আমাদের সাধারণ বিশ্বাস, নীল পীত মূল বর্ণ, তার যোগে সবুজ হইয়াছে। এখন জানিলাম, লাল সবুজ মূল বর্ণ, তার যোগে পীতের উৎপত্তি এবং সবুজ ভায়োলেট মূল বর্ণ, তার যোগে নীলের উৎপত্তি। আমাদের প্রমাণ নীল রঙের আর পীত রঙের জিনিসের চুর্ণ মিশাইয়া দেখা। কিন্তু পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে যে ঐরূপভাবে মিশ্রিত চুর্ণ হইতে যে আলো আইসে তাহার অধিকাংশই দুই প্রকারের চুর্ণের ভিতর দিয়াই আসিয়া থাকে। সুতরাং ঐরূপ আলোর যে রঙ মিশ্রিত চুর্ণেরও প্রায় সেই রঙ হইবে। নীল পীত যদি মূল বর্ণ হইত, তবে নীল চুর্ণ আলোর সমস্ত অংশ খাইয়া কেবল নীল অংশ রাখিত, সেই অংশ আবার পীত চুর্ণের ভিতর দিয়া যাইবার সময় ভক্ষিত হইয়া যাইত। সুতরাং লাল এবং সবুজ কাচের ভিতর দিয়া আসিয়া আলোর যে দশা হইয়াছিল এখানেও তাহাই হইত। দুই চূর্ণ মিশিয়া প্রায় কালো রঙ হইত। কিন্তু নীল পীত উভয়ের মধ্যেই সবুজ

উপেন্দ্র—১১৭

থাকায় সবুজ আলোটা উভয় প্রকার চূর্ণের ভিতর দিয়াই চলিয়া আসিতে পারে, কেহই তাহাকে খাইয়া ফেলেনা। সুতরাং মিশ্রের রঙ সবুজ দেখায়। সেইরূপ লাল চুর্ণ আর সবুজ চূর্ণ মিশাইয়া আমরা একটা ধুঁয়ার মতন রঙ পাই। তাহাতেই মনে করি, বুঝি লাল আলো আর সবুজ আলো মিশিয়াও ঐ রঙই হইবে। কিন্তু লাল আলো আর সবুজ আলো মিশিয়া যে রঙ হয় সে কিরূপ, জান? সে সাদা মতন। অতএব দুই-তিন রঙের চুর্ণ মিশাইয়া সেই রঙের আলো মিশাইয়া ফেলিয়াছি, মনে করিলে চলিবে না।

আমরা এতক্ষণ যাহা বলিলাম তাহাতে আমাদের বক্তব্য বিষয়টাকে খুব পরিষ্কার করিতে পারিয়াছি এরূপ ভরসা করি না। একটি কথা মনে রাখিতে চেষ্টা করিবে: দুই-তিন প্রকারের চূর্ণ মিশাইলে একের বর্ণের সহিত অন্যের বর্ণের যোগ করা হইল না; উভয়ের সাধারণ অংশটুকু রাখিয়া অবশিষ্ট অংশটুকুকে ধ্বংস করা হইল মাত্র। কারণ, প্রথম যার ভিতর দিয়া আলো আসিল, তার যে রঙ তাহা ছাড়া অন্য সকল প্রকারের আলো সে খাইয়া ফেলিল। অবশিষ্ট আলোটুকু যখন দ্বিতীয় চুর্ণের ভিতর দিয়া গেল সেও তাহাই করিল ইত্যাদি। একটি দৃষ্টান্ত দিই—সিন্দুর লাল, আণ্ট্রামেরিণ পরিষ্কার নীল। সিন্দুরে আল্ট্রামেরিণে মিশাইলে আমাদের হিসাবে বেগুনে রঙ হওয়া উচিত। কিন্তু কাজে দেখি প্রায় কালো রঙ হয়। লাল মূল বর্ণ, নীলে সবুজ এবং ভায়োলেট আছে এই দুয়ের মধ্যে সাধারণ কিছুই নাই, সুতরাং মিশ্রিত জিনিস কালো দেখাইবারই কথা। এখানেও দেখা যাইতেছে যে, আমরা যেরূপ বিশ্বাস করি, তার মতন কাজ হইল না। আমরা লাল রঙের জিনিস এবং নীল রঙের জিনিস অন্য জায়গায় মিশাইয়া বেগুনে পাইয়াছিলাম, তাহার কারণ এই ছিল যে, আমরা তখন যে নীল ব্যবহার করিয়াছিলাম তাহা বিশুদ্ধ নীল ছিল না, তাহাতে লালের অংশ কিছু ছিল। সুতরাং সেই লালের আভা দেখিয়া আমরা ভ্রমে পড়িয়াছিলাম। পণ্ডিতেরা এইরূপ অনেক শেষে স্থির করিয়াছেন যে, আমরা সচরাচর যাহা ভাবি তাহা নয়। বাস্তবিক লাল এবং ভায়োলেটই মূল রঙ।

 (Deschanel's Natural Philosophy নামক গ্রন্থের বর্ণ বিষয়ক পরিচ্ছেদে ইহার সবিস্তর বর্ণনা আছে)

  1. সবারে নুন মিশাইয়া তাহাতে পলতে ভিজাইয়া আলো জ্বলিলে সে আলো বিশুদ্ধ পীতবর্ণের হয়। সেই পীতবর্ণের আলোতে পীত ছাড়া অন্য রঙের জিনিস কালো দেখাইবে। পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইলে প্রথমত, ঘর সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে করিয়া লইতে হইবে।