উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/সংকেত
আমার মনের ভাব উপরের কথায় হয়তো অনেকে স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছেন না। মুখে কথা না বলিয়া অন্য কোনো চিহ্নবিশেষ দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করার নাম সংকেত। অর্থাৎ আমি এ প্রস্তাবে যতবার সংকেত কথাটা ব্যবহার করিব ততবারই ঐরুপ বুঝিতে হইবে।
কোনো না কোনো আকারে সংকেত সকল স্থানেই প্রচলিত আছে। আমরা দিনের মধ্যে কতবার সংকেতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকি! বন্ধু আসিয়া একটা কিছু করিতে অনুরোধ করিলেন, তুমি মাথা নাড়িলে;আমি তোমার উপর চটিয়া গিয়া ভয় প্রদর্শন করিলাম, তুমি মুখে কিছু না বলিয়া অঙ্গুলি বিশেষ উন্নত করত আমাকে হনুমানের খাদ্য খাইতে বলিলে; ইত্যাদি, আর কত বলিব। এ সকলই সংকেত। এই প্রকারের সংকেত সকলেই কিছু কিছু ব্যবহার করিয়া থাকেন।
ইংলণ্ডে বোবা এবং কালারা এইরূপ সংকেতের সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করিয়া থাকে। হাতের এক এক প্রকার ভঙ্গি করিয়া তাহারা ইংরাজি বর্ণমালার এক একটা অক্ষর বুলায়। অক্ষর হইলে আর শব্দ রচনা শক্ত থাকে না। আমাদের দেশেও আছে।
‘অহি, কুম্ভ, চক্র, টংকার, তরল, পবন, জাতা।’
হস্ত থাকিতে কেন মুখে কথা বলি। অর্থাৎ সাপের ফণার মতো করিয়া হাত তুলিলেই একটি স্বরবর্ণ বুঝাইবে। এক হাতের মুষ্টির উপর আর এক হাতের মুষ্টি রাখিয়া কুম্ভের অনুকরণ (!) করিলেই ক-বর্গের একটি অক্ষর বুঝাইবে। হাত ঘুরাইয়া চক্র, বাতাসে টোকা দিয়া টংকার, হাতে বাতাসে ঢেউ তুলিতে চেষ্টা করিয়া তরল, পাখার কার্য হাতে করিয়া পবন, ও হাতে হাতে চাপিয়া জাতা করিলে, আর চ-বর্গ, ট-বর্গ, ত-বর্গ, প-বগ, য-বগ (য, র, ল, ব, শ, ষ, স, হ, ক্ষ ইত্যাদি) সকলই ক্রমান্বয়ে হইতে লাগিল।
স্বরবর্ণ বলিয়া পাঁচ আঙ্গুল দেখাইলে পঞ্চম স্বরবর্ণ (উ) বুঝাইল; প-বর্গ বলিয়া তিন আঙ্গুল দেখাইলে আর প-বর্গের তৃতীয় বর্ণ (ব) বুঝাইল।ইত্যাদি। একটা শব্দ শেষ হইয়াছে ইহা বুঝাইতে হইলে হাততালি দিতে হয়। সুতরাং প্রত্যেক শব্দের শেষে হাততালি পড়িবে।
প্রচলিত টেলিগ্রামের অধিকাংশই সাংকেতিক। জাহাজের লোকেরা নানা প্রকারের নিশান ব্যবহার করিয়া সাংকেতিক আলাপ করিয়া থাকে। কখনো বা একটিমাত্র নিশান হাতে লইয়া, তাহাকে নানা প্রকারে নাড়িয়া সংকেত করা হয়। কখনো মাথার টুপী হাতে করিয়া তদ্বারা সংকেত করা হয়। আরো কতপ্রকারে সংকেত করা হয় যে কি বলিব। কোনো সময় এত দূরের লোককে সংকেত হয় যে এ সকল কিছুই তত দূর হইতে দেখা যায় না। তখন খুব উচু জায়গায় ঘর করিয়া তাহার একটা দিক কেবল খড়খড়ি দ্বারা বন্ধ করা হয়। ঘরের ভিতরে আলো থাকে। খড়খড়ি খুলিলে সেই আলো অনেক দূর হইতে দেখা যায়। খড়খড়ি খুলিয়া কিছুকাল পর বন্ধ করিলে, একপ্রকার সংকেত বুঝায়; আর খুলিয়া অমনি বন্ধ করিলে অন্য প্রকারের সংকেত বুঝায়। এই দুই প্রকারের সংকেত দ্বারা সব অক্ষর বুঝানো যাইতে পারে। খড়খড়িওয়ালা ঘরের পরিবর্তে অনেক সময় খুব উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করা হয়। তখন তাহাকে একখানা তক্তা দ্বারা ঢাকিয়া ফেলিলেই কাজ চলে। সংকেত করিবারসময় তক্তাখানা সরাইতে হয়, তবেই আলোটা দেখা যায়। তক্তা সরাইয়া অল্পক্ষণ রাখিলে একপ্রকার সংকেত আর অধিকক্ষণ রাখিলে অন্যপ্রকার সংকেত বুঝায়।
সংকেতের কথা আমরা শেষ করিলাম। টেলিগ্রাফে যে সংকেত ব্যবহার করা হয় তন্মধ্যে মর্স সাহেবের সংকেত-প্রণালীই অধিক প্রচলিত। মর্সের টেলিগ্রাফের সংকেত এই প্রণালীতে করা হয়—মর্সের টেলিগ্রাফে টাক্ টিক্ করিয়া শব্দ হয়, তাহার হ্রস্বতা ও দীর্ঘতা অনুসারে দুই প্রকারের সংকেত হইতে পারে। শেষে যতপ্রকার সংকেতের কথা বলা হইল, সবগুলিই কেবল হ্রস্ব দীর্ঘ লইয়া হইয়াছে। শব্দ কি আলোক অধিকক্ষণ থাকিলে তাহা দীর্ঘ, তাহার চিহ্ন (—) এইরূপ। অল্পক্ষণ থাকিলে তাহা হ্রস্ব, চিহ্ন (-) এইরূপ।