উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/শুকপাখি

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

শুকপাখি

 টিয়া, কাকাতুয়া, চন্দনা, নুরী, ফুলটুসী, ময়না, এরা সকলেই শুকপাখি। অতি প্রাচীনকাল থেকে লোকে এই পাখিকে পুষে আসছে, আর তার কত আদর করছে তার সীমাই নাই। সংস্কৃতে এই পাখির অনেক নাম আছে। খুব বুদ্ধিমান, তাই তার নাম ‘মেধাবী’; ঠোঁটটি বাঁকা তাই সে ‘বক্রচঞ্চ’ বা ‘বক্রতুণ্ড’; ঠোঁট লাল তাই ‘রক্ততুণ্ড’; দেখতে ভালো তাই ‘প্রিয়দর্শন’; সুন্দর কথা কয়, তাই ‘মঞ্জুপাঠক’; ‘কী’ এমনি শব্দ করে তাই ‘কীর’; কথা সঞ্চয় করে অর্থাৎ স্মরণ করে রাখে তাই ‘চিমি’।

 ঠোঁট লাল বলে শুকের নাম ‘রক্ততুণ্ড’। এ থেকে এই মনে হচ্ছে যে, যেগুলোকে আমরা টিয়া আর চন্দনা বলি, সেগুলোই আসলে আমাদের শুক, আর গুলোর অনেকেই বিদেশ থেকে আসে। এগুলো গরম দেশের পাখি, পৃথিবীর সকল গরম স্থানেই এদের দেখা যায়। এশিয়ায় আছে, আমেরিকায় আছে, আফ্রিকায় আছে, অস্ট্রেলিয়ায় আছে।

 অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমে যখন সাহেবরা গিয়েছিলেন তখন এই-সকল পাখির জ্বালায় তাদের চাষবাস করাই দায় হয়ে উঠেছিল। পঙ্গপালের মতো আকাশ অন্ধকার করে তারা শস্যের ক্ষেতে এসে পড়ত, আর শস্যের শীষ কেটে মুখে করে নিয়ে গাছে বসে মনের আনন্দে


খেত। এখন ক্ষেতের সংখ্যা বেশি হয়েছে, এ-সব পাখিও দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এখন আর এক-একটা ক্ষেতের উপরে তত বেশি টিয়া দেখা যায় না। আগে যখন ক্ষেতের সংখ্যা অল্প ছিল, তখন এক-এক ক্ষেতে ত্রিশ চল্লিশ হাজার করে টিয়া এসে পড়ত।

 টিয়ার ঠোঁট দেখেছ, কি চমৎকার! টিয়া তার ঠোঁট দিয়ে যেমন সহজে আর পরিষ্কার করে শস্যের খোসা ছাড়িয়ে শাঁসটুকু খায় আর কোনো পাখি তেমন পারে না। জিবখানি ঠিক যেন মানুষের জিবের মতো। অনেকে বলেন যে এইজন্যেই টিয়া এমন পরিষ্কার কথা বলতে পারে।

 আমার একটি টিয়া ছিল, সে এমন সুন্দর কথা কইত যে, তেমন সুন্দর কথা আর আমি কোনো পাখিকে বলতে দেখি নি। কেউ তার সামনে আছাড় খেলে সে “হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ” করে হাসত। কুকুর দেখলে তাকে ‘আ তু!’ বলে ডাকত। যে-সব লম্বা কথা সে আওড়াত, তার মধ্যে দুটি হচ্ছে এই—

কৃষ্ণ কথা! কৃষ্ণ কথা!
কৃষ্ণ কথা কওরে প্রাণ,
কৃষ্ণ ভজিলে পরিত্রাণ।
“চক্রধর কৃষ্ণ জগত করতা
ত্বরিতে তরাও কৃষ্ণ তুমি সে ভরসা।”

 এই পাখিটি আমাকে বড্ড ভালোবাসত। আমি তার দাঁড়ের কাছে মুখ নিলেই সে খুব মিষ্টি সরু সুরে “উ—!” বলে, তার ঠোঁটটি এনে আমার নাকে ঠেকিয়ে রাখত।

 এ হচ্ছে টিয়ার চুমো খাওয়া। অনেক টিয়াই এমনি করে থাকে। একবার এই কথা নিয়ে ভারি মজা হয়েছিল।

 এক সাহেবের টিয়া চুরি যায়, আর তাই নিয়ে কাছারিতে মোকদ্দমা হয়। টিয়াটি পুলিসের লোকে কাছারিতে এনে হাজির করেছে, এখন সেটি যে সেই সাহেবের, সে কথা প্রমাণ করতে হবে। সাহেব খাঁচার কাছে মুখ নিয়ে গেলেন, অমনি পাখিটি তাড়াতাড়ি এসে আদরের সহিত তাঁকে চুমো খেল। তাতে একটা ছেকরা বলল যে, যে খাঁচার কাছে মুখ নেবে তাকেই পাখি চুমো খাবে। এ কথা প্রমাণ করে দেবার জন্য সে খাঁচার কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে একটা চুমো খাতো।” অমনি মাথা ফুলিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে তার ঠোঁট এমনি কামড়ে ধরল যে ঠোঁটসুদ্ধ ছিঁড়ে নেবার গতিক! সে ছোকরা যতই ভ্যাঁ ভ্যা করে চ্যাঁচায়, টিয়া ততই আরো বেশি করে ঠোঁট বসিয়ে দেয়! অনেক কষ্টে শেষে তাকে ছাড়ানো হয়েছিল।

 তারপর গোলমাল থেমে গেলে সেই সাহেব টিয়াটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কুকুর কি বলে?” টিয়া বলল, “ভৌ, ভৌ, ভৌ!” বিড়াল কি বলে? “মিউ মিউ মিউ!”

 এক দোকানীর একটা টিয়া দুটি কাজ জান্‌ত। সে শিস দিতে পারত, আর বলতে পারত “ভাগ, বেটা!" একদিন পাখিটা খাঁচায় বসে শিস্‌ দিচ্ছিল, তাই শুনে একটা কুকুর ভাবল বুঝি তার মুনিব তাকে ডাকছে। এই ভেবে বেচারা যেই ছুটে খাঁচার কাছে এসেছে, অমনি পাখিটা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “ভাগ্‌ বেটা!" তা শুনে কুকুর থতমত খেয়ে তখনি লেজ গুটিয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।

 আর একটা টিয়া স্পেন দেশে একটা বাড়িতে থাকত সেইখানে সে কয়েকটা স্পেন দেশী কথা শিখেছিল। তারপর একজন ইংরাজ কাপ্তেনের কাছে তাকে বেচে ফেলা হয়। কাপ্তেনের সঙ্গে ইংলণ্ডে এসে দিনকতক পাখিটি বড়ই বিষন্ন হয়ে থাকত, কিন্তু সেটা ক্রমে শুধরে এল। শেষে সে ইংরাজী শিখে স্পেন দেশী কথা সব ভুলেও গেল। এমনিভাবে অনেক বছর যায়। ততদিন বুড়ো থুরথুরে হয়ে বেচারার এমনি অবস্থা হল যে সে কিছু খেতে পারে না, এমন-কি, ভালো করে দাঁড়ে উঠে বসতেও পারে না। এমন সময় একদিন স্পেন দেশ থেকে একটি ভদ্রলোক সেই বাড়িতে এলেন। তার মুখে স্পেন দেশী কথা শুনেই পাখিটির হঠাৎ সেই ছেলেবেলার সব কথা মনে পড়েছে। অমনি সে আনন্দে অধীর হয়ে পাখা মেলে চীৎকার করে উঠ্‌ল আর সেই ছেলেবেলায় যে-সব স্পেন দেশী কথা শিখেছিল অনেক বছর ধরে যার একটি বর্ণও বলে নাই, সেই কথাগুলি আওড়াতে আওড়াতে মরে গেল।

 ব্রেজিল দেশে একটা টিয়া নাকি এমনি বুঝে শুনে কথা উত্তর দিতে পারত যে তা শুনে সে দেশের শাসনকর্তা সেটাকে দেখবার জন্য আনালেন। পাখিটা এসেই সেখানে অনেক সাহেব দেখে বলল, “কত সাহেব।” শাসনকর্তাকে দেখিয়ে সকলে জিজ্ঞাসা করল “ইনি কে?” টিয়া বলল, “সেনাপতি হবে!” সে কোথা থেকে এসেছে, কার পাখি সব সে শাসনকর্তাকে বলল। শেষে শাসনকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কি করিস?” সে বলল, “হ্যাঁ মুরগির ছানা দেখি।” শাসনকর্তা হেসে বললেন, “তুই মুরগির ছানা দেখিস্?” সে বলল, “হ্যাঁ খুব পারি।” এই বলে ঠিক মুরগি যেমন করে তার ছানাদের ডাকে, তেমনি শব্দ করতে লাগল।

 আর একটা টিয়ার মাথা গরম জলে ঝল্‌সে নেড়া হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সে টাকপড়া লোক দেখলেই বলত, “মাথা ঝলসে গেছে!”

 টিয়াপাখি অনেকদিন বাঁচে। একশো বছরের টিয়াপাখিও নাকি দেখা গিয়াছে। কিন্তু সাধারণত এদের আয়ু কুড়ি-তিরিশ বছর হয়ে থাকে। বেশি বুড়ো হলে এদের ঠোঁট এত বেশি বেঁকে যায় যে আর তা দিয়ে খাবার তুলতে পারে না।

 টিয়াপাখিরা এমন কথা কইতে পারে, গানও গাইতে পারে শুনেছি, কিন্তু তাদের স্বাভাবিক ডাক বড়ই কর্কশ। এই ডাকটি শুনেই এই পাখির ‘কীর’ নাম রাখা হয়েছিল। এরা আবার অনেকগুলি মিলে দল বেঁধে থাকে, আর সকালে বিকালে সবাই জুটে প্রাণ ভরে চ্যাঁচায়। তখন ব্যাপারখানা কেমন হয় মনে করে দেখ।

 এদের মধ্যে আমাদের দেশী টিয়া আর আফ্রিকার ছেয়ে রঙের টিয়া খুব কথা কইতে পারে। আমেরিকার বড়-বড় টিয়াগুলির নাম ম্যাকাও (MacaW)। এদের গায়ে পালক থাকে না, আর এরা তেমন কথাও কইতে পারে না। কিন্তু এদের গায়ের রঙ ভারি জমকাল।

 টিয়াপাখিরা পরস্পরকে খুব ভালোবাসে। একটির কোনোরকম বিপদ হলে আর গুলো কিছুতেই তাকে ফেলে যেতে চায় না। এমন ঘটনাও হয়েছে যে শিকারীর বন্দুকের গুলিতে সঙ্গীদের দলে দলে মরতে দেখেও তারা তাদের ছেড়ে পালায়নি, বরং প্রাণের ভয় ছেড়ে দিয়ে তাদের নিয়ে দুঃখ করেছে, আর তাই দেখে লজ্জা পেয়ে শিকারীদের বন্দুক ছোঁড়া বন্ধ করতে হয়েছে।