উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/সাপের খাওয়া

সাপের খাওয়া

 আমার একবার তিনটা বড়ি একসঙ্গে জল দিয়া গিলিয়া খাইতে হইয়াছিল, তখন আমার মনে হইয়াছিল যে এমন কঠিন কাজও করিতে হয়? সে কথা যদি কোনো একটা সাপে শুনিত, তবে সে আর কিছুতেই হাসি থামাইয়া রাখিতে পারিত না।

 সাপেরা মস্ত মস্ত জিনিস গিলিয়া খায়। খাবার জিনিসটা তাহার নিজের চেয়ে ঢের মোটা হইলেও সে সহজে তাহাকে ছাড়ে না, অন্তত একবার গিলিতে চেষ্টা করে। ছবিতে দেখ, সাপটা তাহার চেয়ে কতখানি মোটা একটা ব্যাঙকে গিলিতে যাইতেছে। ব্যাঙটাও কি বোকা। কোথায় লাফাইয়া পালাইবে, তাহার বদলে সে নিশ্চিন্তে বসিয়া আছে। সাপটা আস্তে আস্তে কাছে আসিয়া খপ্‌ করিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলে পর বেচারার টানাটানি দেখ। কিন্তু এখন আর টানাটানি করিয়া ফল কি? সাপে যখন একবার ধরিয়াছে, তখন আর ছড়িবে না; তাহার সাক্ষী শেষ তিনখানা ছবি।

 চতুর্থ ছবিখানিকে একটু ভালো করিয়া দেখিবে। সাপটার হাঁ টা কতখানি বড় হইয়াছে। তুমি হাজার চেষ্টা করিলেও এত বড় হাঁ করিতে পরিবে না। আমাদের চোয়ালের হাড় কানের কাছে কব্জা আটকান। এ অবস্থায় যত বড় হাঁ করা সম্ভব, আমরা ততবড় হাই করিতে পারি। কিন্তু সাপের চোয়াল আলগা, তাহার কোনো জায়গা কিছুতেই আটকানো নাই, কাজেই দরকার হইলে সে আমাদের চেয়ে বড় অর্থাৎ তাহার গালের চামড়া যত লম্বা হয়, ততবড় হাঁ করিতে পারে।

 দুঃখের বিষয় এ ছবিগুলিতে এই ঘটনার শেষ দেখান হয় নাই। ব্যাঙটাকে গিলিয়া শেষ করিলে পর সাপের কেমন চেহারা হয়, সেটা দিখিবার জিনিস। সেরূপ চেহারার একটা ছবি দেওয়া গেল। এ ছবির কথা বোধ হয় আমার আর বুঝাইয়া বলিবার দরকার নাই। খুব খাইলে পেট ভারি হয়, এ কথা আমরা সকলেই মাঝে মাঝে বলি; কিন্তু যথার্থ পেট ভারি যে কাহাকে বলে এইরূপ একখানা ছবি দেখলে তবে তাহা বুঝিতে পারা যায়। এ উদরটি লইয়া যে ছুটাছুটি করিতে একটু অসুবিধা হইবে, তাহা কিছুমাত্র আশ্চর্য নহে। এমন অবস্থায় সাপকে পাইলে তাহাকে ঠেঙ্গাইয়া মারা খুবই সহজ।

 ছবির সাপটি একটি বোরা সাপ, তাহার পেটের ভিতরে একটি ছাব্বিশ সের ওজনের ছাগল। সাতদিন আগে এই সাপটি সাড়ে দশ সের ওজনের একটি ছাগল আর একুশ সের ওজনের একটি হরিণ ছানা দিয়া জলযোগ করিয়াছিলেন। ইহার চেয়েও বড় জন্তুকে গিলিতে পারে কিনা, তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য এই ছাব্বিশ সের ওজনের ছাগলটা তাহাকে দেওয়া হয়। কেহই মন করে নাই যে এটাকে সে গিলিতে পরিবে, কিন্তু সে ফটোওয়ালা আসিবার আগেই সেকাজ শেষ করিয়া ফেলিল। যাহা হউক ইহাতে তাহার খুব পরিশ্রম হইয়াছিল। আর সে অনেকবার গোঙাইয়াছিল।

 কোনো জন্তুকে গিলিবার আগে বোরা সাপ সেটাকে জড়াইয়া ধরে। সে জড়ানো এমনি ভীষণ জড়ানো যে তাহার চাপেই জন্তুটা থেঁৎলা হইয়া যায়। তারপর সাপটা সেটাকে গিলিতে থাকে। একটা বোরা সাপ এমনি করিয়া দেড় ঘণ্টার মধ্যে একমণ ছয় সের ওজনের একটা ছাগলকে গিলিয়া ফেলিয়াছিল।

 একবার একটা জন্তুকে গিলিতে আরম্ভ করিলে নাকি সাপের আর থামিবার শক্তি থাকে না। জন্তুটাকে গিলিয়া শেষ করিতে হয়।

 সাপের ছাগল গেলার সম্বন্ধে একটা মজার গল্প আছে। কাফ্রীরা একটা দেওয়ালে ছিদ্র করিয়া তাহার দুপাশে দুটা ছাগল বাঁধিয়া রাখিল। বোরা সাপ আসিয়া দেখিল ফলার প্রস্তুত এখন পাতে বসিলেই হয়!

 সে আগে একটি ছাগলকে গিলিল, তারপর দেওয়ালের ছিদ্র দিয়া গলা বাড়াইয়া আর একটিকেও খাইল, তাতে মজা হইল এই যে, দেওয়ালের দুপাশে দুই ছাগল সাপের গায়ে দুই প্রকাণ্ড পুঁটুলির মতো হইয়া আছে, সে পুঁটুলি আর দেওয়ালের ছিদ্র দিয়া গলিতে চাহে না, কাজেই সাপ মহাশয় ছাগুলে গেরোয় বাঁধা পড়িলেন! এমনটি যে হইবে, তাহা জানিয়াই কাফ্রীরা দুটা ছাগল খরচ করিয়াছিল, আর আগে থাকিতেই সাপ মহাশয়ের জন্য বড় বড় মুগুরের জোগাড় করিয়া রাখিয়াছিল। তারপরে যেই তাহারা দেখিল যে তাঁহার ভোজন শেষ হইয়াছে, এখন আঁচাইবার সময়, অমনি—বুঝিতেই পার।

 একটা খাঁচার ভিতরে একটা প্রকাণ্ড বাঘ ছিল, আর সেই খাঁচার পাশে একটা বোরা সাপ ছিল। ইহার মধ্যে কেমন করিয়া সাপটা আসিয়া বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়াছে। বাঘ বোধহয় ইহার পূর্বে আর এমন অদ্ভুত জন্তু দেখে নাই, তাই সে ভারি আশ্চর্য হইয়া তাহার তামাশা দেখিতে লাগিল; সে মনে করে নাই যে উহার পেটে কোনো দুরভিসন্ধি আছে। এমন সময় সাপটা হঠাৎ তাহাকে জড়াইয়া ফেলিল। বাঘের তখন বিপদের আর সীমা নাই। গলায় বুকে আর সামনের দুপায়ে বাঁধন পড়িয়াছে, দুখানি পাঁজর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে যুদ্ধ করিবার বড়-বড় হাতিয়ার গুলি সবই আটকা, বেচারা এখন কি দিয়া প্রাণ বাঁচায়? যাহা হউক, তাহার পিছনের পা দুখানি খোলা ছিল; তাই দিয়া সে প্রাণপণে সাপের গায়ে আঁচড়াইতে লাগিল। হাজার হোক বাঘের আঁচড়। সে আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হইয়া দেখিতে দেখিতে সাপ মরিয়া গেল।

 বোরা সাপ যেমন বাঘের হাতে জব্দ হইয়াছিল, ছোট-ছোট সাপ (বিশেষত ঢোড়া সাপ) অনেক সময়—তেমনি কই মাছের কাছে জব্দ হয়। কই মাছের কাঁটা বড়ই ভয়ংকর! তাহাকে গিলিতে গেলে সেই কাঁটা গলায় আটকাইয়া যায়। তখন আর সাপের বাছা গিলিতেও পারেন না, ফেলিতেও পারেন না। কেবল ওয়াক্‌ তোলাই সার হয়, আর সেই অবস্থায় তাঁর প্রাণটি বাহির হইয়া যায়।