উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/উপমন্যু
উপমন্যু
আয়োদধৌম্যের আর একটি শিষ্যের নাম ছিল উপমন্যু। একদিন মহর্ষি উপমন্যুকে বলিলেন, “বৎস, তোমার উপর আমার গরু চরাইবার ভার রহিল। যত্নের সহিত আমার গরুগুলিকে রাখিবে।”
উপমন্যু পরম যত্নে মহর্ষির গরু চরাইতে আরম্ভ করিলেন। সারাদিন গরু চরাইয়া সন্ধ্যাকালে আশ্রমে ফিরিয়া, তিনি গুরুকে প্রণামপূর্বক জোড়হাতে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইতেন। মহর্ষি দেখিলেন, উপমন্য দিন দিন মোটা হইতেছে। ইহাতে তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস, তোমাকে ত ক্রমেই বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট দেখিতেছি তুমি কি আহার কর?
উপমন্যু বলিললেন, “ভগবন, আমি ভিক্ষা করিয়া যাহা পাই, তাহাই আহার করি।”
মুনি বলিলেন, “সে কি? ভিক্ষা করিয়া তুমি যাহা পাও, আমাকে না জানাইয়া তুমি তাহা আহার কর? ইহাত’ ঠিক হইতেছে না!”
তখন হইতে উপমন্যু ভিক্ষার জিনিস আনিয়া গুরুর হাতে দেন। গুরু তাহা সমস্তই নিজে রাখেন, উপমন্যুকে কিছুই দেন না।
উপমন্যু তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিয়া সারাদিন গরু চরান, আর সন্ধ্যাকালে আসিয়া গুরুকে প্রণামপূর্বক জোড়হাতে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়ান। মুনি দেখিলেন, তথাপি উপমন্যু দিন দিন মোটাই হইতে চলিয়াছেন; তাহাতে তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস উপমন্যু তুমি ভিক্ষা করিয়া যাহা আন, তাহার সমস্তই ত আমি রাখিয়া দিই; তথাপি তোমাকে বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট দেখিতেছি। এখন তুমি কি আহার কর?”
উপমন্যু বলিলেন, “ভগবন্, আমি একবারের ভিক্ষার জিনিস আপনাকে দিয়া, তারপর আবার নিজের জন্য ভিক্ষা করি।” মহর্ষি বলিলেন, “ইহা ত অন্যায়! ইহাতে অন্যের ভিক্ষার ক্ষতি হইতেছে, আর তোমারও লোভ বাড়িয়া যাইতেছে। ভদ্রলোকের এমন কাজ করিতে নাই।”
উপমন্যু তাহাতেই রাজি হইয়া সারাদিন গরু চরান, আর সন্ধ্যা হইলে, গুরুর নিকট আসিয়া, তাঁহাকে প্রণামপূর্বক জোড়হাতে দাঁড়াইয়া থাকেন। মুনি দেখিলেন, তথাপি উপমন্যু মোটা হইতেছেন। তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস, তুমি একবার ভিক্ষা করিয়া আনিয়া সমস্তই আমাকে দাও, তারপর আর নিজের জন্য ভিক্ষা কর না;তবে তুমি কি করিয়া মোটা হইতেছ? এখন কি খাও?”
উপমন্যু বলিলেন, “ভগবন্, এখন আমি গরুর দুধ খাই।”
মহর্ষি বলিলেন, “আমি ত তোমাকে গরুর দুধ খাইতে অনুমতি দিই নাই, তবে তুমি তাহা কি করিয়া খাও? ইহা অত্যন্ত অন্যায়।”
উপমন্যু লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “যে আজ্ঞা।”
তারপর তিনি সারাদিন গরু চরান, সন্ধ্যাকালে মুনির নিকট আসিয়া দাঁড়ান। তাঁহার শরীর তখনো মোটাই হইতেছে। তাহা দেখিয়া মুনি বলিলেন, “বৎস, তুমি নিজের জন্য আর ভিক্ষা কর না, গরুর দুধ খাওয়াও ছাড়িয়া দিয়াছ। তথাপি তোমাকে হৃষ্ট-পুষ্টই দেখিতেছি। এখন তুমি কি খাও?”
উপমন্যু বলিলেন, “বাছুরেরা গরুর দুধ খাইবার সময় তাহাদের মুখ দিয়া যে ফেনা বাহির হয়। আমি এখন তাহাই খাই।”
মহর্ষি বলিলেন, “আহা ওরূপ করিতে নাই। বাছুরদের যে দয়া, তুমি ফেনা খাইতে গেলে, উহারা তোমার জন্য বেশি করিয়া ফেনা বাহির করিবে। কাজেই তাহাদের নিজেদের পেট ভরিবে না।”
উপমন্যু মাথা হেঁট করিয়া বলিলেন, “যে আজ্ঞা!"
এখন বেচারার আহারের পথ একেবারেই বন্ধ হইল। নিজের জন্য ভিক্ষা করিবার জো নাই। দুধ খাইবার অনুমতি নাই। তথাপি তিনি ক্ষুধা তৃষ্ণায় ভুগিয়া যথাশক্তি যত্নের সহিত মহর্ষির গরু চরাইতে লাগিলেন। ক্ষুধা যখন অসহ্য হইল, তখন সামনের একটা আকন্দ গাছ দেখিতে পাইয়া, তাহারই কতকগুলি পাতা চিবাইয়া খাইলেন। সে সর্বনেশে গাছের যে কি সর্বনেশে পাতা, উহা খাইবামাত্র উপমন্যুর চোখ ভয়ঙ্কর টাটাইয়া, ক্রমে তাহা একেবারে অন্ধ হইয়া গেল। তথাপি তিনি যথাশক্তি মহর্ষির গরু চরাইতে ত্রুটি করিলেন না। এইরূপে গরু লইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন তিনি এক কুয়ার ভিতরে পড়িয়া গেলেন।
এদিকে আয়োদধৌম্য সন্ধ্যাকালে উপমন্যুকে ফিরিতে না দেখিয়া শিষ্যদিগকে বলিলেন, “দেখ, উপমন্যু আজ এখনো ঘরে ফিরিল না; বোধ হয় আমি তাহার আহাব বন্ধ করিয়া দেওয়াতে সে রাগ করিয়াছে। চল ত দেখি, সে কোথায় গেল।”
বনের ভিতরে আসিয়া মহর্ষি ব্যস্তভাবে উপমন্যুকে ডাকিতে লাগিলেন। গুরুর ডাক শুনিয়া উপমন্যু কুয়ার ভিতর হইতে চিৎকারপূর্বক বলিলেন,“ভগবন্, আমি কুয়ার ভিতরে পড়িয়া গিয়াছি।”
ইহাতে মহর্ষি আশ্চর্য হইয়া বলেন, “তুমি কেমন করিয়া কুয়ায় পড়িলে?
উপমন্যু বলিলেন, “আকন্দের পাতা খাইয়া অন্ধ হইয়া গিয়াছিলাম, তাহাতেই কুয়ায় পড়িয়াছি।”
মহর্ষি বলিলেন, “অশ্বিনীকুমারদিগের স্তব কর; তোমার চক্ষু ভালো হইবে।
এ কথায় উপমন্যু অশ্বিনীকুমারদিগের অনেক স্তব-স্তুতি করিলে, তাঁহারা তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “আমরা তোমার স্তবে অতিশয় তুষ্ট হইয়াছি। তাই তোমার জন্য একটি পিঠা আনিয়াছি, তুমি ইহা আহার কর।”
উপমন্যু দেবতাদিগকে প্রণামপূর্বক বিনয়ের সহিত বলিলেন, “আপাদের কথা ত অবহেলার যোগ্য নয়। কিন্তু আগে গুরুকে না দিয়া আমি কেমন করিয়া ইহা খাইব?”
অশ্বিনীকুমারের বালিলেন, “তোমার গুরুকেও একবার আমরা একটি পিষ্টক দিয়াছিলাম আর তাহা তিনি তাঁহার গুরুকে না বলিয়াই খাইয়াছিলেন, তিনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহা তোমার করিতে বাধা কি?”
উপমন্যু জোড়হাতে বলিলেন, “আপনাদের বিনয় করিয়া বলিতেছি, আমি গুরুকে না দিয়া পিষ্টক ভক্ষণ করিতে পারিব না।”
ইহাতে অশ্বিনীকুমারেরা আহ্লাদের সহিত বলিলেন, “আমরা তোমার গুরু ভক্তি দেখিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম। তোমার গুরুর দাঁত লোহার; তোমার দাঁত সোনার হইবে। আর, তোমার চক্ষু ত ভালো হইবেই; তাহা ছাড়াও তোমার অনেক মঙ্গল লাভ হইবে।”
এ কথা শেষ হইতে না হইতেই উপমন্যু সেই অন্ধকার কুয়ার ভিতরে সকল জিনিস অতি পরিষ্কার দেখিতে লাগিলেন। ইহাতে তাঁহার মনে কিরূপ আনন্দ হইল, আর তিনি দেবতাদিগকে ভক্তিভরে প্রণামপূর্বক কত ধন্যবাদ দিলেন, তাহা বুঝিতে পার। ইহার পর আর সেই কুয়ার ভিতর হইতে উঠিয়া আসিতে তাঁহার কোন কষ্ট হইল না। তারপর উপমন্যু গুরুর নিকট আসিয়া তাঁহাকে নমস্কারপূর্বক সকল কথা বলিলে, মহর্ষির আনন্দের সীমা রহিল না। তখন তিনি উপমন্যুকে অনেক আদর দেখাইয়া, এই বলিয়া তাঁহাকে আশীর্বাদ করিলেন, “অশ্বিনীকুমারেরা যেরূপ বলিয়াছে, তোমার সেইরূপ মঙ্গল লাভ হইবে। আর, এখন হইতে বেদ আর ধর্মশাস্ত্রের কোন কথাই তোমার জানিতে বাকি থাকিবে না।”
এমনি করিয়া আয়োদধৌম্য তাঁহার শিষ্যদিগকে পরীক্ষা করিতেন। সেকালের মুনিরা যাহাকে তাহাকে বিদা দান করিতে চাহিতেন না। তাঁহারা বেশ জানিতেন যে, যথার্থ ধার্মিক লোক হইলে, সে বিদ্যা আর ধর্মের জন্য অনেক ক্লেশ সহিতে পারে। তাই তাঁহারা অনেক সময় শিষ্যদিগকে কষ্টে ফেলিয়া দেখিতেন, সে কেমন লোক, আর তাহার বাস্তবিকই শিখিবার খুব ইচ্ছা আছে কি না। তাঁহারা যদি এত অধিক কষ্ট না দিয়া, শিষ্যদিগকে পরীক্ষা করিবার কোন উপায় বাহির করিতে পারিতেন, তবে বড়ই ভালো হইত। এত কষ্ট সহিয়া গুরুকে সন্তুষ্ট করা সাধারণ ভালো লোকের কর্ম নহে। এ কষ্ট যাঁহারা একবার পাইতেন, তাঁহারা জীবনে আর তাহা ভুলিতে পারিতেন না।