উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/ঔর্ব

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ঔর্ব

 এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল কৃতবীর্য, আর এক মুনি ছিলেন, তাঁরা নাম ভৃগু। ভৃগুর বংশের লোকেরা কৃতবীর্যের বংশের রাজাদিগের পুরোহিতের কার্য করিতেন।

 সে কালের রাজারা তাঁহাদের পুরোহিতদিগকে অনেক ধন দান করিতেন। ভৃগু বংশের লোকেরা পুরোহিতের কাজ করিয়া এমনই ধনী হইয়াছিলেন যে, তাঁহাদের ঘরে যে কত কোটি টাকা ছিল, তাহা কেহই ঠিক করিয়া বলিতে পারিত না।

 একবার রাজাদিগের একটা কাজের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন হইল। এত টাকা তাঁহাদের ঘরে না থাকায়, তাঁহারা ভার্গব (ভৃগু বংশের লোক) দিগের নিকট টাকা চাহিতে গেলেন। রাজাদিগকে টাকা দিতে ভার্গবদের ইচ্ছা ছিল না। নিতান্ত রাজাদের খাতিরে কেহ কেহ টাকা দিলেন বটে, কিন্তু অনেকেই তাঁহাদের টাকা পুঁতিয়া ফেলিলেন।

 ইহার মধ্যে একজন ক্ষত্রিয় গিয়া কেমন করিয়া সেই টাকা খুঁজিয়া বাহির করিয়াছে। সে টাকা তুলিতে তুলিতে প্রকাণ্ড পাহাড় হইয়া গেল, আর ক্ষত্রিয়েরা আশ্চর্য হইয়া তাহা দেখিতে আসিল।

 এ-সকল ঘটনায় ভার্গবেরা যে নিতান্ত বিরক্ত হইলেন, ইহাতে আশ্চর্য হইবার কোন কারণ নাই। এজন্য তাঁহারা ক্ষত্রিয়দিকের বিস্তর কটু কথা কহিলেন, আর তাহাদের অনেককে বিধিমতে অপমান করিতেও ছাড়িলেন না।

 ইহাতে ক্ষত্রিয়েরা সকলে রাগে অস্থির হইয়া, ধনুর্বাণ হাতে ভার্গবদিগকে আক্রমণ করিল। দেখিতে দেখিতে তাহাদের হাতে ভার্গবদিকের সকলেই প্রাণত্যাগ করিলেন, মার কোলের শিশুরা পর্যন্ত রক্ষা পাইল না। ইহাতেও কি নিষ্ঠুর ক্ষত্রিয়গণের রাগ থামিল? ইহার পর তাহারা দেশ বিদেশে খুঁজিয়া দেখিতে লাগিল, ভার্গবদিগের কে কোথায় পলায়ন করিয়াছে।

 ভার্গবদিগের মৃত্যুর পর, তাঁহাদের স্ত্রীসকল ক্ষত্রিয়ের ভয়ে হিমালয়ে গিয়া লুকাইয়া রহিলেন। ইহাদের একজন নিজের নিতান্ত শিশু পুত্রটিকে, অতি আশ্চর্য উপায়ে গোপন করিয়া সঙ্গে আনিয়াছিলেন। ক্ষত্রিয়েরা তাহা জানিতে পারিয়া, সেই শিশুর প্রাণবধ করিবার জন্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। শিশুটি অসাধারণ মহাপুরুষ ছিলেন। ক্ষত্রিয়দিগের আস্পর্দ্ধা দেখিয়া তিনি ক্রোধভরে মায়ের নিকট হইতে বাহিরে আসিবামাত্র, দুরাচারগণ অন্ধ হইয়া গেল! তখন আর তাহাদের দুর্গতির অবধি রহিল না। বিশাল পর্বতের ভয়ঙ্কর খানা-খন্দের ভিতরে তাহারা না পাইল পথ, না করিতে পারিল আহারের আয়োজন। এইরূপে তাহারা নাকালের একশেষ হইয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে জোড়হাতে সেই স্ত্রীলোকটিকে বলিল, ‘মা! আমরা যেমন দুরাচার, তেমনি আমাদের উচিত সাজা হইয়াছে। আর কখনো আমরা এমন কর্ম করিব না। এখন দয়া করিয়া আমাদের চক্ষু দিয়া দিন, আমরা দেশে ফিরিয়া যাই।’

 ব্রাহ্মণী বলিলেন, ‘বাছাসকল, আমি ত জানিয়া শুনিয়া তোমাদের কিছু করি নাই। বোধহয় আমার এই ছেলেটির ক্রোধেই তোমাদের ওরূপ দশা হইয়া থাকিবে। এই শিশু অতি মহাপুরুষ, জন্মিবার পূর্বেই সকল বেদ শিক্ষা করিয়াছে। তোমরা ইহাকেই তুষ্ট কর, তোমাদের চক্ষু ভাল হইবে।’

 এ কথায় তাহারা সে ছেলেটির নিকট হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘ভগবন্‌, আমাদিগকে দয়া করুন, আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি।’

 তখন সেই শিশু ক্ষত্রিয়গণের চক্ষু ভাল করিয়া দিলে, তাহারা লজ্জিতভাবে সেখান হইতে প্রস্থান করিল।

 সেই ছেলেটির নাম ছিল ঔর্ব। সে যাত্রা ক্ষত্রিয়দিগকে তিনি ছাড়িয়া দিলেন বটে, কিন্তু উহারা যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরভাবে তাঁহার আত্মীয়দিগকে বধ করিয়াছিল, সে কষ্ট তিনি কিছুতেই ভুলিতে পারিলেন না। মনের দুঃখ কোনরূপে দূর করিতে না পারিয়া, তিনি সৃষ্টি বিনাশ করিবার জন্য ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সেই আশ্চর্য তপস্যার তেজ দেবতাদিগের সহ্য করা কঠিন হইল।

 এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া ঔর্বের পূর্বপুরুষগণ তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন, ‘বৎস, আমরা তোমার তপস্যার বল দেখিয়া আশ্চর্য এবং আনন্দিত হইয়াছি। এখন তুমি ক্রোধ পরিত্যাগ কর। আমরা ক্রোধের বশ নহি, সুতরাং তুমি যাহা করিতে যাইতেছ, তাহাতে আমরা সন্তুষ্ট হইতে পারিতেছি না। ইহাতে তোমার তপস্যার হানি হইবে, তুমি শীঘ্র এ কাজ ছাড়িয়া দাও।’

 ঔর্ব কহিলেন, ‘হে পিতৃগণ! আপনাদের আজ্ঞা পাইয়াও ত আমি রাগ দূর করিতে পারিতেছি না। ক্ষত্রিয়েরা যখন আপনাদিগকে বধ করে, তখন আমি মাতৃগণের ক্রন্দন শুনিয়াছিলাম। সে সময়ে আপনারা প্রাণ রক্ষার জন্য ব্যাকুল হইয়া, এই পৃথিবীতে কোথাও আশ্রয় পান নাই। এখন সেই-সকল কথা স্মরণ করিয়া, রাগে আমার প্রাণ জুলিয়া যাইতেছে। আপনারা নিশ্চয় জানিবেন, আমার সে রাগ এখন যথার্থই আগুন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এ আগুন আমি কোথায় ফেলি, আপনারা তাহা বলিয়া দিন।’

 পিতৃগণ বলিলেন, ‘বৎস, তোমার এই ভীষণ রাগের আগুন তুমি সমুদ্রের জলে ফেলিয়া দাও।’

 এ কথায় ঔর্ব সেই অদ্ভুত আগুন সমুদ্রের জলে ফেলিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন। জলে পড়িয়া তাহা অতি বিশাল এবং ভীষণ ঘোড়ার মুখের আকার ধারণ করিল। সেই ঘোড়ার মুখ দিয়া না কি এখনো আগুন বাহির হয়। যাহাকে বাড়বানল বলে, তাহা ঔর্বের সেই রাগের আগুন ভিন্ন আর কিছুই নহে।