উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/পরাশর
বশিষ্ঠদেব তাঁহার পৌত্রটির নাম পরাশর রাখিলেন। পরাশর পিতাকে চক্ষে দেখেন নাই, তিনি মনে করিতেন, বুঝি বশিষ্ঠই তাঁহার পিতা। জন্মাবধি তিনি বশিষ্ঠের সঙ্গে সঙ্গেই থাকিতেন, আর তাঁহাকেই পিতা বলিয়া ডাকিতেন।
পরাশর যখনই বশিষ্ঠকে পিতা বলিয়া ডাকিতেন, তখনই শক্তির কথা মনে হইয়া অদৃশ্যন্তীর চক্ষে জল পড়িত। একদিন তিনি পরাশরকে কোলে লইয়া, তাঁহার মুখে চুমো খাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘বাছা, আমার শ্বশুর ত তোমার পিতা নহে, তিনি তোমার পিতামহ।’
পরাশর তাঁহার উজ্জ্বল চোখ দুটি বড় করিয়া মার মুখের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘তবে আমার পিতা কোথায় গিয়াছেন?’
অদৃশ্যন্তী অনেক কষ্টে স্থির থাকিয়া বলিলেন, ‘তিনি স্বর্গে চলিয়া গিয়াছেন’ এ কথায় পরাশর বলিলেন, ‘মানুষ ত মরিয়া গেলেই স্বর্গে যায়, আমার পিতা কি করিয়া মরিয়া গেলেন?’
অদৃশ্যন্তী বলিলেন, ‘এক রাক্ষস তাঁহাকে মারিয়া ফেলিয়াছিল।’
পিতার এমনভাবে মৃত্যু হইয়াছিল, এ কথা শুনিয়া পরাশর রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘আমি সৃষ্টি নষ্ট করিব।’ পরাশর বালক হইলেও, তিনি সাধারণ বালক ছিলেন না। জন্মিবার পূর্বেই তিনি সকল শাস্ত্র মুখস্থ করিয়া ফেলেন, আর জন্মিবামাত্রই অদ্বিতীয় তপস্বী হইয়া উঠেন। সুতরাং তাঁহার মুখে এ কথা শুনিয়া বশিষ্ঠদেবের বড়ই চিন্তা হইল। তাই তিনি পরাশরকে অনেক বুঝাইয়া বলিলেন, ‘বৎস, তুমি এমন কাজ করিও না।’
বশিষ্ঠদেবের কথায় পরাশর সৃষ্টিনাশ করিবার প্রতিজ্ঞা ছাড়িয়া দিলেন বটে, কিন্তু রাক্ষসদিগের উপর তাঁহার বড়ই রাগ রহিয়া গেল। সেই রাগে তিনি রাক্ষস মারিবার জন্য এমন ভয়ঙ্কর একযজ্ঞ আরম্ভ করিলেন যে, তেমন যজ্ঞ আর কেহ কখনো দেখেন নাই। ইহাতে বশিষ্ঠদেব দুঃখিত হইলেন বটে, কিন্তু বারবার পরাশরের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা অনুচিত মনে করিয়া, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন।
এদিকে যজ্ঞ ভূমিতে প্রকাণ্ড তিন কুণ্ডে ঘোর শব্দে আগুন জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহার আলোকে স্বর্গ মর্ত উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। রাক্ষসেরা যে যেখানে আছে, সেই আগুনে আহুতি পড়িবামাত্র আর কোথাও তাহারা স্থির থাকিতে পারিতেছে না। পাহাড় পর্বত আঁকড়াইয়াও তাহাদের রক্ষা নাই, সে ভীষণ আগুন তাহা সুদ্ধই তাহাদিগকে টানিয়া আনিতেছে।
বনের ভিতর হইতে, পর্বতের গুহা হইতে, এমন-কি, পাতাল হইতেও দলে দলে বিকটাকার রাক্ষস, ঘন ঘন চিৎকার পূর্বক প্রাণপণে মাটি আঁকড়াইয়া থাকিবার চেষ্টা করিতে করিতে, পিছন বাগে আসিয়া আগুনে পুড়িতে লাগিল। এরূপভাবে অধিকক্ষণ চলিলে আর পৃথিবীতে একটি রাক্ষসও থাকিবে না, ইহা দেখিয়া রাক্ষসদিগের পূর্বপুরুষ মহর্ষি পুলস্ত্যর মনে বড়ই কষ্ট হইল। এজন্য তিনি পুলহ, ক্রতু আর মহাক্রতু এই তিনজন মুনিকে সঙ্গে করিয়া, পরাশরের নিকট আসিয়া বলিলেন, ‘বৎস, এ-সকল রাক্ষসের ত কোন দোষ নাই, ইহাদিগকে বধ করা তোমার উচিত হইতেছে না। তোমার পিতা তাঁর ভাইদিগের সহিত স্বর্গে গিয়া পরম সুখে আছে, সুতরাং তাঁহার মৃত্যুর জন্য তোমার ক্রোধ করারও কোন কারণ নাই। তাই বলিতেছি, বৎস, আর যজ্ঞ করিয়া কাজ কি? উহা শেষ করিয়া দাও।’
তখন বশিষ্ঠদেবও পুলস্ত্যের পক্ষ হইয়া পরাশরকে যজ্ঞ শেষ করিতে বলায়, পরাশর আর তাহাতে কোন আপত্তি করিলেন না। এইরূপে রাক্ষসদিগের বিপদ কাটিয়া গেল।
পরাশর তাহার শেষ করিয়া,তাহার আগুন হিমালয় পর্বতে গিয়া ফেলিয়াছিলেন। আজও সে আগুনকে মাঝে মাঝে পর্বতের গায় জ্বলিতে দেখা যায়।