উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের কথা
বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের কথা
মহামুনি বশিষ্ট ব্রহ্মার পুত্র। ধর্ম আর ক্ষমাগুণে তাঁহার সমান কেহই ছিল না। তাঁহার ক্ষমার কথা শুনিলে পুণ্যলাভ হয়। কান্যকুব্জ দেশে কুশিক নামে এক রাজা ছিলেন। কুশিকের পুত্র গাধি; গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র।
একদিন বিশ্বামিত্র পাত্রমিত্র সঙ্গে লইয়া মৃগয়া করিবার নিমিত্ত এক গভীর বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অনেক শূকর আর হরিণ বধ হইলে, তাহাতে রাজারও নিতান্ত পরিশ্রম আর পিপাসা হইল। নিকটে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রম ছিল; জল খাইবার জন্য রাজা সেই আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
রাজাকে পরম সমাদরপূর্বক বসিতে আসন দিয়া, মহামুনি মিষ্ট বাক্যে তাঁহার কুশল জিজ্ঞাসা করতঃ কহিলেন, “মহারাজ, কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া আমাকে তুষ্ট করুন।”
জলযোগের আয়োজন ভালো করিয়াই হইল। বশিষ্ঠের ধন জন ছিল না; তাঁহার ছিল কেবল নন্দিনী নামে একটি আশ্চর্য গরু। গাইটি অতি সুন্দরী। পাঁচ হাত চওড়া; ছয় হাত উঁচু; চক্ষু দুটি ব্যাঙের ন্যায়;শরীরটি নধর;পা চারিখানি অতি নিটোল;লেজটি আর শিং দুটি বড়ই চমৎকার; আর বাঁটগুলি যেন অমৃতের ভাণ্ড। মুনি যাহা চাহিতেন, নন্দিনীর নিকট তাহাই পাইতেন।
রাজার জলযোগের কথা শুনিয়া নন্দিনী দধি, দুগ্ধ, ক্ষীর, সর, মিঠাই, মণ্ডায় হাজার হাজার হাঁড়ি পরিপূর্ণ করিয়া দিলেন;মহামুল্য বস্ত্র আর অলঙ্কার সিন্দুকে আনিয়া উপস্থিত করিলেন। রাজা পাত্রমিত্র সহিত পরিতোপূর্বক ভোজন করিয়া, মনে ভাবিলেন, ‘একি আশ্চর্য ব্যাপার।
গরুটিকে বারবার দেখিয়াও রাজার সাধ মিটিল না;তিনি মুনিকে বলিলেন, “ঠাকুর, আমি দশকোটি গরু, আর আমার সমুদয় রাজ্য দিতেছি আপনার গাইটি আমাকে দিন্।”
বশিষ্ঠ বলিলেন, “মহারাজ, নন্দিনী আমার সকল ধর্মকর্মের একমাত্র উপায়;আমি নন্দিনীকে দিতে পারিব না।”
বিশ্বামিত্র বলিলেন, “আপনি সহজে না দিলে, আমি জোর করিয়া গাই লইয়া যাইব।”
বশিষ্ঠ বলিলেন, “আপনার বল বিক্রম অনেক আছে; আপনি যাহা ইচ্ছা করেন, তাহাই করিতে পারেন।”
রাজার লোকজন অনেক ছিল;তাহারা আজ্ঞামাত্র নন্দিনীকে বাঁধিয়া লইয়া চলিল। নন্দিনী মুহূর্তের মধ্যে সেই বাঁধন ছিঁড়িয়া, তাহাদের শত প্রহার সত্ত্বেও হাম্বা হাম্বা শব্দে বশিষ্ঠের নিকট আসিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। রাজার লোকেরা তাড়া খাইয়াও তিনি আশ্রম ছাড়িলেন না। তাহা দেখিয়া বশিষ্ঠ নিতান্ত দুঃখের সহিত বলিলেন, “মা, তোমার কাতর হাম্বারব শুনিয়া আমার বড়ই দুঃখ হইতেছে। কিন্তু বিশ্বামিত্র তোমাকে জোর করিয়া লইয়া যাইতেছে আমি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ, কি করিব?”
নন্দিনী বলিলেন, “ভগবন্, রাজার লোকেদের নিষ্ঠুর প্রহারে অনাথার ন্যায় কাতর ভাবে কাঁদিতেছি। এমন সময় কেন আপনি আমার দিকে চাহিতেছেন না?”
বশিষ্ট অনেক কষ্টে স্থির থাকিয়া বলিলেন, “মা ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, আর ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। সুতরাং আমি কি করিতে পারি? তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে তুমি যাও।”
নন্দিনী বলিলেন, “হে ভগবন্, আপনি যদি আমাকে পরিত্যাগ না করেন, তবে কেহই জোর করিয়া আমাকে নিতে পারিবে না।”
বশিষ্ঠ বলিলেন, “মা, আমি কি ইচ্ছা করিয়া তোমাকে পরিত্যাগ করিতে পারি? তোমার যদি ক্ষমতা থাকে, তবে আমার কাছেই থাক। ঐ দেখ, তোমার বাছুরটিকে বাঁধিয়া নিতেছে!”
তখন রাগে নন্দিনীর দুই চোখ লাল হইয়া উঠিল; আর তিনি অতি ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ পূর্বক, ঘাড় উঁচু করিয়া শিং নাড়িতে নাড়িতে, ঘোরতর হাম্বা হাম্বা শব্দে রাজার সৈন্যদিগকে তাড়া করিলেন। তাহারা তাঁহাকে আটকাইবার জন্য কত চেষ্টা করিল, লাঠি দিয়া তাঁহাকে কতই মারিল; কিন্তু তাহাতে কাতর হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাঁহার রাগ শতগুণে বাড়িয়া গেল। সে সময়ে তাঁহার শরীর সুর্যের ন্যায় জ্বলিতেছিল। আর তাহার ভিতর হইতে পহ্নব, দ্রাবিড়, শক, যবন, কিরাত, কাঞ্চী, শরভ, পৌণ্ড্র, সিংহল, বর্বর, বশ, চিবুক, পুলিন্দ, চীন, কেরল প্রভৃতি অসংখ্য জাতীয় বিকটাকার সৈন্য কত যে বাহির হইতেছিল, তাহার সীমা সংখ্যা নাই। তাহাদের কাহারো ঝাঁটার মতন গোঁফ দাড়ি;কাহারো নেড়া মাথায় লম্বা টিকি; কাহারো গায়ে মুখে বিচিত্র উল্কি; কাহারো ঝাঁকড়া চুলে পালক গোঁজা; কেহ ঝোল্লা পরা পাগড়ি আঁটা।
এই-সকল সৈন্য বিশ্বমিত্রের লোকদের কোন অনিষ্ট করিল না। কিন্তু ইহাদের তীক্ষ্ণ অস্ত্র, ভয়ঙ্কর ভূকুটি, বিষম দাঁতখিঁচুনি আর উৎকট গর্জনের ভয়েই সে বেচারারা প্রাণভয়ে পিতামাতার নাম লইয়া পলায়ন করিল। নন্দিনীর সৈন্যেরা তাহাদিগকে অনেক দূর অবধি তাড়া করিয়াছিল, কিন্তু দয়া করিয়া তাহাদের একটিরও প্রাণ বধ করে নাই।
এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখিয়া বিশ্বামিত্রের মন বড়ই খারাপ হইয়া গেল।
তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন যে, ক্ষত্রিয়ের বল কিছুই নহে, ব্রাহ্মণের বলই যথার্থ বল; তপস্বীরা তপস্যা দ্বারা যাহা করিতে পারেন, রাজা তাঁহার রাজ্য, সম্মান, ধন জন লইয়া তাহার কিছুই করিতে পারেন না।
এইরূপ চিন্তায় রাজ্য আর ধনের উপরে বিশ্বামিত্রের এতই ঘৃণা জন্মিয়া গেল যে, তিনি চিরদিনের মত তাহা পরিত্যাগপূর্বক বনে গিয়া ঘোরর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সে যে কি কঠোর তপস্যা, তাহা আমি কি বলিব? তেমন তপস্যা আর কেহ করিয়াছে কি না সন্দেহ। এই তপস্যার জোরে শেষে তিনি ব্রাহ্মণ হইয়া ইন্দ্রের সহিত সোমরস পান করিয়াছিলেন।
ইহার পর হইতে বিশ্বামিত্র খুব বড় একজন মুনি হইলেন, আর তখন হইতেই নানা উপায়ে বশিষ্ঠকে ক্লেশ দিতে লাগিলেন। বিশ্বামিত্রের তপস্যার বল অসাধারণ ছিল, আর বশিষ্ঠকে তিনি যে দুঃখ দিয়াছিলেন, তাহাও অসাধারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।
সরস্বতী নদীর তীরে স্থানু নামক তীর্থ। সেই তীর্থের নিকটে সরস্বতীর পূর্বাধারে বশিষ্ঠের ও পশ্চিম কূলে বিশ্বামিত্রের আশ্রম। বশিষ্ঠ সরস্বতীর তীরে বসিয়া তপস্যা করেন, সেই আশ্চর্য তপস্যা দেখিয়া বিশ্বামিত্রের বড়ই হিংসা হয়। একদিন বিশ্বামিত্র মনে ভাবিলেন, “বশিষ্ঠ যখন নদীর ধারে বসিয়া জপ করে, তখন এই নদীকে দিয়া উহাকে আমার নিকট আনাইয়া, উহার প্রাণ বধ করিব।”
এই মনে করিয়া তিনি অতিশয় ক্রোধ ভরে নদীকে স্মরণ করিবামাত্র, নদী ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া করজোড়ে বলিলেন, “ভগবন্, আমাকে কি করিতে হইবে, অনুমতি করুন।”
বিশ্বামিত্র ভ্রূকুটি করিয়া রাগের সহিত বলিলেন, “শীঘ্র বশিষ্ঠকে এইখানে লইয়া আইস; আমি তাহাকে বধ করিব।”
এ কথা শুনিয়া সরস্বতী ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া বিশ্বামিত্র বলিলেন, “তোমার কোন ভয় নাই;শীঘ্র বশিষ্ঠকে এখানে লইয়া আইস।” সরস্বতী তখন কাঁপিতে কাঁপিতে বশিষ্ঠের নিকট গিয়া নিতান্ত দুঃখের সহিত বলিলেন, “ভগবন্, বিশ্বামিত্র অতিশয় ক্রোধভরে আমাকে আদেশ করিয়াছেন যে, আপনাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাইতে হইবে। এখন উপায় কি হয়?
সরস্বতীর মুখ মলিন দেখিয়া বশিষ্টের বড়ই দয়া হইল; তিনি বলিলেন, “মা তুমি কোন চিন্তা করিও না;এখনই আমাকে বিশ্বামিত্রের নিকট লইয়া যাও। নহিলে তিনি তোমাকে শাপ দিবেন।”
সরস্বতী ভাবিলেন, “এমনি লোকের অনিষ্ট আমি করিতে পারিব না আমি বিশ্বামিত্রের কথাও রাখিব, বশিষ্টকেও বাঁচাইব।”
তারপর বশিষ্ঠ নদীর কুলে বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন। সরস্বতী মনে করিলেন, এই আমার সুযোগ; এই বেলা কুল ভাঙ্গিয়া দেই।”
নদীর বেগে বশিষ্ঠকে সুদ্ধ কুল ভাঙ্গিয়া পড়িল; নদীর খরতর স্রোত তাহাকে বহিয়া, দেখিতে দেখিতে বিশ্বামিত্রের ঘাটে উপস্থিত করিল। তাহা দেখিয়া বিশ্বামিত্র ভাবিলেন, ‘এখন ইহাকে বধ করি।’
এই মনে করিয়া বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠকে মারিবার জন্য অস্ত্র খুঁজিতে গেলেন। এদিকে সরস্বতী দেখিলেন যে, বিশ্বামিত্রের কথা রাখা হইয়াছে;এখন বশিষ্ঠকে রক্ষা করিবার সময় উপস্থিত। সুতরাং তিনি বিশ্বামিত্র ফিরিয়া আসিবার পূর্বেই, তাড়াতাড়ি বশিষ্ঠকে অপর পারে দিয়া আসিলেন।
বিশ্বামিত্র অস্ত্র হাতে আসিয়া যখন দেখিলেন, বশিষ্ঠ নাই, তখন তিনি রাগে চোখ লাল করিয়া সরস্বতীকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তোর জল রক্ত হইয়া যাউক!”
অমনি সরস্বতীর জল রক্ত হইয়া গেল, আর রাক্ষসেরা আসিয়া আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে তাহা পান করিতে লাগিল।
এইরূপে দিন যায়। এক বৎসর পরে কয়েকজন তপস্বী সেই তীর্থে স্নান করিতে আসিয়া দেখিলেন, নদীতে রক্তধারা বহিতেছে। ইহাতে তাঁহারা নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে সরস্বতি! তোমার এমন দশা কি করিয়া হইল?”
সরস্বতী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “বিশ্বামিত্রের শাপে আমার এই দশা হইয়াছে।”
এই বলিয়া তিনি তপস্বীদিগকে সকল কথা জানাইলে, তাঁহারা বলিলেন, “এমন কথা? আচ্ছা মা, আমরা তোমার দুঃখ দুর করিয়া দিব।”
তারপর সেই দয়ালু তপস্বীগণ সকলে মিলিয়া শিবের আরাধনা করিতে লাগিল এবং মহাদেব তুষ্ট হইয়া তথায় উপস্থিত হইলে, তাঁহারা বলিলেন, “ভগবন্, দয়া করিয়া এই নদীর দুঃখ দূর করুন।”
এ কথায় মহাদেব তথাস্তু বলিবামাত্র, সরস্বতীর আবার পূর্বের ন্যায় সুমিষ্ট নির্মল জল হইল।
বশিষ্ঠের একশত পুত্র ছিলেন, তাঁহাদের সকলের বড়টির নাম ছিল শক্তি। একবার কল্মাষপাদ নামক অযোধ্যার এক রাজার সহিত শক্তির বিবাদ হইল। রাজা রথে চড়িয়া যাইতেছিলেন, শক্তি পথের মাঝখানে ছিলেন। রাজা শক্তিকে বলিলেন, “এইয়ো! পথ ছাড়িয়া দাও!” শক্তি মিষ্টভাবে বলিলেন, “মহারাজ! এ ত আমারই পথ; কেন না, শাস্ত্রে আছে, রাজা সকলের আগে ব্রাহ্মণদিগকে পথ ছাড়িয়া দিবেন।”
এইরূপে দুজনে পথ লইয়া এমনি তর্ক আরম্ভ হইল যে, শেষে রাজা রাগে অস্থির হইয়া শক্তিকে চাবুক মারিতে লাগিলেন। ইহাতে শক্তিও ক্রোধভরে রাজাকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তুমি যেমন রাক্ষসের মত ব্যবহার করিতেছ, তেমনি তুমি রাক্ষসই হও।”
সেইখান দিয়া তখন বিশ্বামিত্রও যাইতেছিলেন, এবং আড়ালে থাকিয়া শক্তি আর কল্মাষপাদের কলহ দেখিতেছিলেন। শক্তি কম্মাষপাদকে ‘রাক্ষস হও’ বলিয়া শাপ দিবামাত্র বিশ্বামিত্র কিঙ্কর নামক একটি রাক্ষসকে সেখানে দেখিতে পাইয়া, তাহাকে কল্মাষপাদের শরীরে ঢুকাইয়া দিলেন।
কল্মাষপাদ শক্তির শাপে ভয় পাইয়া বিনীত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছেন, এমন সময় রাক্ষস তাহার ভিতরে প্রবেশ করাতে হঠাৎ তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গেল। তখন তিনি আর ক্ষমা প্রার্থনা না করিয়া, সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। পথে এক ব্রাহ্মণ তাঁহার নিকট মাংস চাহিলেন, রাজা তাঁহাকে বলিলেন, “একটু বসুন, মাংস আনিতেছি।”
বাড়ি আসিয়া রাজার সমস্ত দিনের ভিতরে এ কথা মনেই হইল না। দুই প্রহর রাত্রিতে হঠাৎ তাহার চৈতন্য হইলে, তিনি তাড়াতাড়ি পাচককে ডাকিয়া ব্রাহ্মণের নিকট মাংস ভাত পাঠাইতে বলিলেন। কিন্তু চাকর অনেক খুঁজিয়াও মাংস পাইল না। রাজার ভিতরে রাক্ষস; তাহার বুদ্ধিসুদ্ধিও এতক্ষণে রাক্ষসের মতই হইয়া গিয়াছে। তাই তিনি পাচককে ধমক দিয়া বলিলেন, “কেন? শ্মশানে কত মানুষ পড়িয়া আছে, তাহার মাংস আনিয়া রাঁধ না।” পাচক রাজার আজ্ঞায় তাহাই করিল; আর সেই মানুষের মাংসের ব্যঞ্জন আর ভাত ব্রাহ্মণের নিকট পাঠাইয়া দেওয়া হইল। ব্রাহ্মণ অতিশয় তেজীয়ান তপস্বী ছিলেন, তিনি সেই মাংস দেখিবামাত্র সকল কথা জানিতে পারিয়া “রাক্ষস হও” বলিয়া রাজাকে শাপ দিলেন।
শক্তির শাপেই রাজার স্বভাব ক্রমে রাক্ষসের মত হইয়া আসিতেছিল। তাহার উপর ব্রাহ্মণ এইরূপ শাপ দেওয়াতে রাজা একেবারেই ক্ষেপিয়া গিয়া দাঁত কড়মড় করিতে করিতে ছুটিয়া বাহির হইলেন। খানিক দূরে গিয়াই তিনি দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে, শক্তি! অমনি আর কথাবার্তা নাই—“তবে রে বামুন, তুই-ই না আমাকে রাক্ষস হইতে বলিয়াছিলি? আয় তোকেই আগে খাই!” এই বলিয়া তিনি মুহূর্তের মধ্যে শক্তির ঘাড় ভাঙ্গিয়া তাঁহাকে খাইয়া ফেলিলেন।
বিশ্বামিত্র যে রাজার দেহে রাক্ষস প্রবেশ করাইয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন এমন নহে। তিনি ক্রমাগতই সংবাদ লইতে ছিলেন, ইহার পর কি হয়। যেই তিনি দেখিলেন, রাজা শক্তিকে খাইয়াছে, অমনি তিনি বশিষ্ঠের আর নিরানব্বইটি পুত্রকেও খাইবার জন্য সেই রাক্ষসকে লেলাইয়া দিলেন। সিংহ যেমন শিকার ধরিয়া খায়, মুনির ইঙ্গিত পাইবামাত্র রাক্ষস সেইরূপ করিয়া শক্তির নিরপরাধ ভাই গুলিকে একে একে চিবাইয়া খাইল।
এই দারুণ সংবাদ যখন বশিষ্ঠদেব শুনিতে পাইলেন, তখন তিনি সামান্য মানুষের ন্যায় ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন না। শোক ত তাঁহার হইয়াছিলই, সে শোকের আমরা কি বুঝিব? কিন্তু এমন শোক পাইয়াও তিনি এমন কথা বলিলেন না, ‘আমার শত্রুর কোনরূপ অনিষ্ট হউক।’ অথচ তিনি ইচ্ছা করিলেই বিশ্বামিত্রকে সবংশে সংহার করিতে পারিতেন। এমন ক্ষমতা তাঁহার ছিল।
সেই ভীষণ শোকের আগুনে পুড়িয়া বশিষ্ঠদেবের হৃদয় যেন একেবারে ছাই হইয়া গেল, ইহার পর আর এই অন্ধকার, শূন্য সংসারে একদিনও বাঁচিয়া থাকিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল না। দেহ ত্যাগ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া তিনি মেরু পর্বতের চূড়া হইতে লাফাইয়া পড়িলেন। কিন্তু এমন মহাপুরুষের এভাবে মৃত্যু হয়, ইহা ভগবানের ইচ্ছা ছিল না। তিনি বশিষ্ঠের দেহ তুলার মত হাল্কা করিয়া দিলেন, আর বশিষ্ঠ তুলার মত হাওয়ায় ভাসিতে ভাসিতে অতিশয় আরামের সহিত আস্তে আস্তে নামিয়া আসিলেন।
দেহে একটি আঘাত বা আঁচড় পর্যন্ত লাগিল না। মৃত্যু কেমন করিয়া হইবে? তখন বশিষ্ঠদেব ভাবিলেন, ‘ঐ বনের ভিতরে প্রচণ্ড দাবানল জ্বলিতেছে, উহাতে প্রবেশ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব!’
বশিষ্ঠদেব ছুটিয়া আগুনের ভিতরে গেলেন। কিন্তু ভগবানের কৃপায় তাহার পূর্বেই আগুন হিমের ন্যায় শীতল হইয়া গিয়াছিল, তাহাতে বশিষ্ঠের দেহ পুড়িল না। এইরূপে বশিষ্ঠদেব কোন মতেই মরিতে না পারিয়া আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু সেই শ্মশানের মত শূন্য আশ্রম দেখিবামাত্র, তাঁহার প্রাণত্যাগের ইচ্ছা দ্বিগুন বাড়িয়া উঠিল, তিনি আবার সেখান হইতে ছুটিয়া বাহির হইলেন।
বর্ষাকাল, নদীতে বান ডাকিয়াছে, জলের স্রোতে গাছ পাথর সকল ভাঙ্গিয়া কল কল শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে। বশিষ্ঠ ভাবিলেন, ‘এই নদীতে ঝাঁপ দিয়া মরিব।’ এই মনে করিয়া তিনি নিজের হাত পা বাঁধিয়া নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। কিন্তু নদী তাঁহাকে তল না করিয়া, পরম যত্নে তীরের দিকে লইয়া চলিল, খরতর স্রোত তাঁহার পাশ (অর্থাৎ বাঁধন) কাটিয়া দিল। তাই মহর্ষি তীরে উঠিয়া নদীর নাম রাখিলেন ‘বিপাশা’।
তারপর ‘হায়! আমার কি কিছুতেই মৃত্যু হইবে না?’ বলিয়া বশিষ্ঠদেব সংসারময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। শেষে তিনি অতি ভয়ঙ্কর কুম্ভীর পরিপূর্ণ হৈমবতী নদীর তীরে আসিয়া মনে করিলেন, ‘ইহার জলে নামিলে নিশ্চয়ই কুমিরেরা আমাকে সংহার করিবে।’
কিন্তু সেই মহাপুরুষ নিকটে আসিবামাত্রই নদী শতভাগ হইয়া পলায়ন করিল। তাঁহার প্রাণত্যাগ করা হইল না। এইজন্য এখনো লোকে সেই নদীকে ‘শতদ্রু’ বলিয়া থাকে।
তখন বশিষ্ঠ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার মৃত্যু হওয়া ভগবানের ইচ্ছা নহে, সুতরাং তিনি আশ্রমের দিকে ফিরিয়া চলিলেন। এমন সময় তাঁহার পুত্রবধূ (শক্তির স্ত্রী) অদৃশ্যন্তী দেবীও তাঁহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে আসিয়া পিছন হইতে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। বশিষ্ঠদেব সে কথা জানিতে পারেন নাই। তাহার মনে হইল যেন, কেহ তাঁহার পিছন হইতে অতি চমৎকারভাবে বেদ পাঠ করিতেছে। ইহাতে মহর্ষি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কে, আমার পশ্চাতে আসিতেছ?’
অদৃশ্যন্তী বলিলেন, ‘ভগবন্, আমি তপস্বিনী অদৃশ্যন্তী, আপনার পুত্রবধূ।’
মহর্ষি বলিলেন, ‘মা, এমন সুন্দর করিয়া কে বেদ পাঠ করিতেছে? আহা, আমার শক্তির মুখে যেমন শুনিতাম, মনে হইতেছে যেন ঠিক সেইরূপ।’
অদৃশ্যন্তী বলিলেন, ‘বাবা, এটি আপনার নাতি, জন্মিবার পূর্বেই সে বেদ পড়িতে শিখিয়াছে।’ এমন নাতির কথা শুনিয়া স্নেহে এবং আনন্দে বশিষ্ঠের হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, সংসারে এখনো তাঁহার অনেক কর্তব্য রহিয়াছে, তাহার জন্য তাঁহার বাঁচিয়া থাকা প্রয়োজন। সুতরাং তিনি পরম স্নেহে অদৃশ্যন্তীকে সঙ্গে লইয়া, তাড়াতাড়ি আশ্রমের দিকে চলিলেন।
পথে একটা গভীর বন। সেই বনের ভিতরে রাক্ষস রাজা কল্মাষপাদ শুইয়াছিলেন। বশিষ্ঠ আর অদৃশ্যন্তীকে দেখিয়াই রাক্ষস তাঁহাদিগকে খাইবার জন্য ছুটিয়া আসিতে লাগিল। ইহাতে অদৃশ্যন্তী বড়ই ভয় পাইতেছে দেখিয়া, বশিষ্ঠ তাঁহাকে বলিলেন, ‘মা, কোন ভয় নাই।’
এই বলিয়া তিনি রাক্ষসকে এক ধমক দিবামাত্র, সে থমকিয়া দাঁড়াইল। তারপর তিনি মন্ত্র পড়িতে পড়িতে তাহার গায় খানিকটা জল ছড়াইয়া দিতেই, তাহার শাপ দূর হইয়া গেল।
এইরূপে শাপ হইতে রক্ষা পাইয়া, কল্মাষপাদ যার পর নাই ভক্তি এবং বিনয়ের সহিত বশিষ্ঠকে প্রণাম করিলে, বশিষ্ঠ বলিলেন, ‘মহারাজ, এখন রাজধানীতে গিয়া রাজ্য শাসন কর, আর কখনো ব্রাহ্মণের অপমান করিও না।’
রাজা লজ্জিত হইয়া বলিলেন, ‘ভগবন্, আমি আর কখনো এমন কাজ করিব না।’
তারপর কল্মাষপাদ অনেক মিনতি করিয়া বশিষ্ঠকে অযোধ্যায় লইয়া গেলেন। সেখানকার লোকেরা মহর্ষির যে কত সম্মান, কত স্তব স্তুতি করিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।