উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/কচের কথা

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

কচের কথা

 এই ভাবিয়া তাঁহারা বৃহস্পতির জ্যেষ্ঠ পুত্র কচের নিকটে গিয়া বলিলেন, “কচ, আমরা দুঃখে পড়িয়া তোমার নিকট আসিয়াছি, তোমাকে আমাদের একটু উপকার করিতে হইবে।”

 কচ দেবতাদিগকে নমস্কার পূর্বক, বিনয়ের সহিত বলিলেন, “আমার সাধ্য হইলে, আমি তাহা অবশ্য করিব। বলুন, আমাকে কি করিতে হইবে?”

 দেবতারা বলিলেন, “ভৃগুর পুত্র শুক্র সঞ্জীবনী বিদ্যা জানেন, তাঁহার নিকট হইতে সেই বিদ্যা তোমাকে শিখিয়া আসিতে হইবে।”

 কচ বলিলেন, “আমি এখনই তাঁহার নিকট যাইতেছি।”

 দানবদিগের রাজা বৃষপর্বার বাড়িতে শুক্রাচার্য বাস করিতেন, কচ দেবতাদিগের নিকট বিদায় হইয়া সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 শুক্র তখন বৃষপর্বার নিকটেই বসিয়াছিলেন, কচ তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আমি অঙ্গিরার পৌত্র, বৃহস্পতির পুত্র, আমার নাম কচ, আপনার শিষ্য হইতে আসিয়াছি। আপনি কৃপাপূর্বক অনুমতি করিলে, এক হাজার বৎসর আপনার সেবায় থাকিয়া, ব্রহ্মচর্য (অর্থাৎ ছাত্রাদিগের ধর্ম পালন) করিব।”

 অঙ্গিরাও ব্রহ্মার পুত্র, ভৃগুও ব্রহ্মার পুত্র কাজেই সম্পর্ক হিসাবে কচ শুক্রের ভাইপো। সুতরাং শুক্র তাঁহার কথায় সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “বৎস, তোমার পিতা আমার মান্য লোক। আমি আহ্লাদের সহিত তোমাকে শিষ্য করিলাম।”

 এইরূপে কচ শুক্রের শিষ্য হইয়া, পরম সুখে তাঁহার আশ্রয়ে বাস করিতে লাগিলেন। শুক্র তাঁহাকে যথেষ্ট স্নেহ করিতেন, আর তাঁহার কন্যা দেবযানীর ত কচ না হইলে কাজই চলিত না। দেবযানীকে ফুল আনিয়া দেওয়া, তাঁহার কাজের সাহায্য করা, তাঁহার সঙ্গে গান গাওয়া, নানারকম নৃত্য করিয়া তাঁহাকে সন্তুষ্ট করা—অবসর কালে, এই-সকলই কচের প্রধান কাজ ছিল। এইরূপে পাঁচশত বৎসর পরম সুখে কাটিয়া গেল।

 এদিকে কচ শুক্রের শিষ্য হওয়াতে অসুরদের আর অসন্তোষের সীমা রহিল না। তাহাদের মনে বড়ই সন্দেহ হইল যে, এই ছোকরা সঞ্জীবনী বিদ্যা চুরি করিয়া নিতে আসিয়াছে। সুতরাং তাহারা স্থির করিল যে, যেমন করিয়াই হউক, ইহাকে মারিয়া ফেলিতে হইবে।

 একদিন কচ শুক্রের গরু লইয়া বনে গিয়াছেন, এমন সময় অসুরেরা তাঁহাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া শিয়াল কুকুর দিয়া খাওয়াইয়া ফেলিল। সন্ধ্যার সময় গরুগুলি ঘরে ফিরিল, কিন্তু কচ তাহাদের সঙ্গে আসিলেন না। তাহা দেখিয়া দেবযানী তাঁহার পিতাকে বলিলেন, “বাবা, সন্ধ্যা হইল আপনার অগ্নিহোত্রে আহুতি দেওয়া হইল, গরুগুলি আপনা আপনি ঘরে ফিরিল, কিন্তু কচ ত আসিল না! সে বুঝি তবে আর বাঁচিয়া নাই! আমি সত্য বলিতেছি, কচ বিনা আমিও বাঁচিয়া থাকিতে পারিব না।”

 দেবযানীর দুঃখ দেখিয়া শুক্র বলিলেন, “ভয় কি মা! কচ এখনই আসিবে, আমি তাহাকে বাঁচাইয়া দিতেছি।”

 এই বলিয়া তিনি সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়িতে পড়িতে কচকে ডাকিতে লাগিলেন আর অমনি কচ শিয়াল কুকুরের পেট ছিঁড়িয়া, তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া দেবযানী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কচ, তোমার আসিতে বিলম্ব হইল কেন?”

 কচ বলিলেন, “কাঠ কুড়াইতে কুড়াইতে বড় পরিশ্রম হইয়াছিল, তাই আমি গরুগুলি লইয়া একটা বটগাছের তলায় বিশ্রাম করিতেছিলাম। এমন সময় অসুরেরা আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুই কে?’ আমি বলিলাম, ‘আমি বৃহস্পতির পুত্র কচ।’ এ কথায় তাহারা আমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া, শিয়াল কুকুরকে খাইতে দিয়া, হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। তারপর তোমার পিতার মন্ত্রের গুণে বাঁচিয়া উঠিয়া, এই আসিতেছি।”

 আর-একদিন কচ দেবযানীর জন্য ফুল আনিতে বনে গিয়াছেন, এমন সময় অসুরেরা আবার আসিয়া, তাঁহাকে মারিয়া ফেলিল। তারপর, আর যাহাতে শুক্র তাঁহাকে না বাঁচাইতে পারেন, সেজন্য ভারি আশ্চর্যরকমের এক কৌশল করিল।

 শুক্র মদ্য পান করিতেন। যে মদ খায়, তাহার সকল সময় কাণ্ড জ্ঞান থাকে না। এই মনে করিয়া তাহারা কচের দেহটাকে পোড়াইয়া, সেই দেহের ছাইগুলি শুক্রাচার্যের সুরার সহিত মিশাইয়া দিল। শুক্রাচার্যও নেশার ঝোঁকে তাহা খাইয়া ফেলিলেন, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না!

 সেদিনও দেবযানী কচের জন্য কাঁদিতে লাগিলেন। কিন্তু অসুরেরা ক্রমাগতই কচকে মারিয়া ফেলিতেছে দেখিয়া, শুক্রের মনে উৎসাহ ছিল না। তাই তিনি দেবযানীকে বলিলেন—

 “উহাকে আর বাঁচাইয়া কি হইবে? অসুরেরা তাহাকে কিছুতেই ছড়িবে না। তুমি কাঁদিও না, মা! একটা সামান্য লোকের জন্য কেন এত দুঃখ করিতেছ?

 দেবযানী বলিলেন, “মহামুনি অঙ্গিরা যাঁহার পিতামহ, বৃহস্পতি যাঁহার পিতা, আর নিজেও যিনি এমন ধার্মিক আর বুদ্ধিমান, তিনি ত সামান্য লোক নহেন, বাবা! তাঁহার জন্য দুঃখ না করিয়া যে পারিতেছি না। কচকে আমি বড়ই ভালবাসি; তিনি মরিলে আমিও প্রাণত্যাগ করিব।”

 ইহাতে দানবদিগের উপরে শুক্রের বড়ই রাগ হইল। তখন তিনি, “অসুরেরা বারবার আমার শিষ্যকে বধ করিতেছে, আমি ইহার উচিত সাজা দিব।” এই বলিয়া ক্রোধভরে সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়িতে পড়িতে কচকে ডাকিতে লাগিলেন।

 কচকে ডাকিতে ডাকিতে শুক্রাচার্যের মনে হইল, যেন, সেই ডাকের উত্তর তাঁহার নিজের পেটের ভিতর হইতেই আসিতেছে! তখন তিনি নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি, কচ, আমার পেটের ভিতরে কি করিয়া ঢুকিলে!”

 কচ বলিলেন, “অসুরেরা আমাকে আপনার সুরার সঙ্গে মিশাইয়া দিয়াছিল, আপনি আমাকে খাইয়া ফেলিয়াছেন।”

 তাহা শুনিয়া শুক্র বলিলেন, “কি সর্বনাশ! ও মা দেবযানি, এখন তোমার কচকে আমি কি করিয়া বাঁচাইব? তাহা করিতে গেলে যে আমাকেই প্রাণত্যাগ করিতে হয়! আমার পেট ছিঁড়িয়া ত তাহার বাহির হইবার উপায় নাই!”

 তাহাতে দেবযানী বলিলেন, “আপনি মরিলেও আমি বাঁচিব না, কচ মরিলেও আমি বাঁচিব না। কাজেই আপনি যাহা ভাল বুঝেন, তাহাই করুন।”

 তখন শুক্র খানিক চিন্তা করিয়া কচকে বলিলেন, “বাবা, কচ, আমি তোমাকে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখাইয়া দিতেছি। তুমি বাহিরে আসিবার সময় আমি মরিয়া যাইব, তখন এই বিদ্যার দ্বারা তুমি আমাকে বাঁচাইয়া দিবে।”

 এই বলিয়া শুক্র কচকে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখাইয়া দিলেন। তারপর কচ বাহিরে আসিয়া, সেই বিদ্যার দ্বারা শুক্রকে বাঁচাইলেন। বাঁচিয়া উঠিয়া শুক্রের এইরূপ চিন্তা হইল—

 “তাই ত। আমি মদ খাই বলিয়াই ও আজ এমন কুকর্ম করিয়া বসিলাম। এখন হইতে এমন জঘন্য জিনিস যে ব্রাহ্মণে খাইবে, তাহার ইহকাল পরকাল দুইই নষ্ট হইবে।”

 তারপর তিনি দানবদিগকে, ডাকিয়া এমনই তিরস্কার করিলেন যে, আর তাহারা কচের কোন অনিষ্ট করিতে সাহস পাইল না। দেখিতে দেখিতে এক হাজার বৎসর নির্বিঘ্নে কাটিয়া গেল।

 এক হাজার বৎসরের পর কচ শুক্রের নিকটে বিদায় লইয়া ঘরে ফিরিবার সময়, দেবযানী তাঁহাকে বলিলেন—

 “কচ, আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি আমাকে বিবাহ করিয়া তোমার সঙ্গে লইয়া যাও।”

 দেবযানীর কথা শুনিয়া কচ বলিলেন, “দিদি তোমার পিতাকে আমি যেমন মান্য ও ভক্তি করি, তোমাকেও তেমনি মান্য ও ভক্তি করি। তোমার পিতা আমার গুরু, সুতরাং তিনিও আমার পিতা, আর তুমি আমার দিদি। আমাকে এমন কথা বলা তোমার উচিত হয় না।”

 ইহাতে দেবযানী নিতান্তই দুঃখিত হইতেছেন দেখিয়া কচ তাঁহাকে অনেক বুঝাইলেন। শেষে তিনি বলিলেন—

 “দিদি, তোমাদের এখানে এতদিন বড়ই সুখে ছিলাম। এখন অনুমতি কর গৃহে যাই, আর আশীর্বাদ কর, যেন পথে আমার কোন বিপদ না হয়, মাঝে মাঝে আমাকে স্মরণ করিও, আর সাবধানে গুরুদেবের সে করিও।”

 কিন্তু কচের কোন কথাতেই দেবযানী শান্ত হইলেন না। শেষে মনের দুঃখে তিনি কচকে এই বলিয়া শাপ দিলেন যে—

 “কচ, তুমি যখন আমাকে পরিত্যাগ করিয়া গেলে, তখন তোমার সঞ্জীবনী বিদ্যায় কোন ফল হইবে না।”

 এ কথায় কচ বলিলেন, “আমার বিদ্যায় কান ফল না হউক, তাহাতে দুঃখ নাই। আমি অন্যকে এই বিদ্যা শিখাইলে, তাহার বিদ্যার ফল হইবে। আর তুমি যেমন আমাকে শাপ দিলে, তেমনি আমিও বলিতেছি যে, কোন ঋষিপুত্র তোমাকে বিবাহ করিতে আসিবে না।”

 এই বলিয়া কচ সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। তাঁহাকে পাইয়া দেবতারা যে খুব আনন্দিত হইলেন, এ কথা বলাই বাহুল্য।

 সেই সঞ্জীবনী বিদ্যার জোরে কতজন মরা দেবতা বাঁচিয়াছিলেন, আমি তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু দেখা যায় যে এই ব্যবস্থায় তাঁহারা সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই। একজন মরিয়া গেলে পরে, আর একজন আসিয়া তাঁহাকে বাঁচাইয়া দিবে, ইহা খুবই ভাল কথা, তাহাতে সন্দেহ কি? কিন্তু একেবারেই যদি না মরিতে হয়, তবে যে ইহার চেয়ে অনেক সুবিধা হয়, এ কথা সকলেই বুঝিতে পারে।

 সুতরাং দেবতারা যে সঞ্জীবনী বিদ্যায় সস্তুষ্ট না থাকিয়া অমর হইবার উপায় খুঁজিবেন, ইহা কিছুমাত্র আশ্চর্য নহে। অমর হইবার ঔষধ অমৃত। এই অমৃত খাইয়া অমর হইবার জন্য, দেবতাদিগের মনে বড়ই ইচ্ছা হইল।

 তাই তাঁহারা, সুমেরু পর্বতের উপর বসিয়া, পরামর্শ করিতে লাগিলেন যে, কি উপায়ে এই অমৃত পাওয়া যাইতে পারে। তাঁহাদিগকে এইরূপ পরামর্শ করিতে দেখিয়া নারায়ণ ব্রহ্মাকে বলিলেন, “দেবতা আর অসুরগণ একত্র হইয়া যদি সমুদ্র মন্থন করেন, তবে তাহা হইতে অমৃত উঠিবে।”

 এ কথায় ব্রহ্মা দেবগণকে ডাকিয়া বলিলেন, “হে দেবতাগণ। তোমরা সমুদ্র মন্থন কর, অমৃত পাইবে। অল্প মন্থন করিয়াই ক্ষান্ত হইও না; অতিশয় পরিশ্রম হইলেও ছাড়িয়া দিও না, ধনরত্ন বিস্তর পাইলেও মন্থন বন্ধ করিও না। ক্রমাগত কেবলই মন্থন করিতে থাক, নিশ্চয় অমৃত পাইবে!”

 ব্রহ্মার কথা শুনিয়া সকলেই আনন্দিত হইলেন। তখনই সকলে ‘আইস!’ ‘কোম বাঁধ!’ ‘মন্থন বাড়ি আন!’ ‘মন্থন দড়ি খুঁজিয়া বাহির কর।’ এই বলিয়া সমুদ্র মন্থনের আয়োজনের তাড়া পড়িল।

 সমুদ্র মন্থন হইবে, তাহার মতন মন্থন বাড়ি চাহি! যে সে মন্থন-বাড়িতে একাজ চলিবে না। বাঁশে হইবে না, তালগাছে কুলাইবে না। আরো অনেক লম্বা, অনেক হাজার যোজন লম্বা মন্থন-বাড়ি চাহি।

 এত বড় মন্থন-বাড়ি আর কিসে হইতে পারে? এক মন্দর পর্বতখানি আছে, তাহা বাইশ হাজার যোজন লম্বা। সেই মন্দর পর্বতকে দিয়াই মন্থনবাড়ি করিতে হইবে।

 সে পর্বত বাইশ হাজার যোজন লম্বা। এগার হাজার যোজন মাটির নীচে, এগার হাজার যোজন উপরে। বন জঙ্গল, বাঘ ভাল্লুক, গন্ধর্ব কিন্নর সুদ্ধ, সেই বিশাল পুরানো পর্বত তুলিতে দেবতাদিগের কিছুতেই শক্তি হইল না। অনেক পরিশ্রম, অনেক টানাটানি করিয়া, শেষে তাঁহারা হেঁট মুখে ব্রহ্মা ও নারায়ণের নিকট গিয়া, জোড়হাতে বলিলেন, “প্রভো, আমরা ত পর্বত উঠাইতে পারিলাম না। দয়া করিয়া ইহার উপায় করুন!”

 ইহা শুনিয়া নারায়ণ সর্পরাজ অনন্তকে বলিলেন, “অনন্ত, তুমি এই পর্বত উঠাইয়া দাও।”

 অনন্ত এই পৃথিবীটাকে মাথায় করিয়া রাখেন, তাঁহার পক্ষে একটা পর্বত উঠান কি কঠিন কাজ? নারায়ণের অনুমতি মাত্রই তিনি সেই বিশাল পর্বত তুলিয়া আনিলেন। তাঁহার কিছুমাত্র কষ্ট হইল না।

 তারপর সেই পর্বত লইয়া আর অনন্তকে সঙ্গে করিয়া দেবতা ও অসুরগণ সমুদ্রের তীরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। মন্থন-দড়ির জন্য কোন চিন্তা করিতে হইল না। অনন্ত সর্প অতিশয় লম্বা আর তাঁহার শরীর বড়ই মজবুত, তিনি বললেন, “আমিই দড়ি হইব!”

 কিন্তু সমুদ্রের তলায় কাদা, তাহাতে পর্বত বসাইয়া পাক দিলে তলায় ছিদ্র হইয়া যাইবে! হয়ত সেই ছিদ্রে পর্বত আঁটিয়া যাইবে—তারপর আর তাহাতে পাক দেওয়া যাইবে না! সুতরাং কিসের উপরে পর্বত রাখা যায়?

 অনন্ত পৃথিবীকে মাথায় রাখেন। সেই পৃথিবীসুদ্ধ সেই অনন্তকে কচ্ছপের রাজা পিঠে করিয়া রাখেন, তাঁহার পিঠের খোলা বড়ই কঠিন।

 তাই দেবতারা পবিলেন, “হে কুর্মরাজ (কচ্ছপের রাজা)! তোমার পিঠে পর্বত রাখিয়া দাও!”

 কুর্মরাজ বলিলেন, “এ আর কত বড় একটা কথা!”

 কচ্ছপের রাজা তখনই গিয়া সমুদ্রের তলায় বসিলেন। তাঁহার পিঠের উপরে মন্দর পর্বত রাখা হইল। সেই পর্বতের চারিদিকে অনন্তকে জড়াইয়া দেওয়া হইল। তারপর দেবতারা ধরিলেন সাপের লেজ, অসুরেরা ধরিল তাঁহার মাথা, এইরূপ করিয়া তাঁহারা সেই পর্বতে এমনি বিষম পাক দিতে লাগিলেন যে, পাক যাহাকে বলে!

 দেবতারা টানেন—হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্!!

 অসুরেরা টানে—ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-!!!

 তাহাতে ত্রিভুবন কাঁপাইয়া ঘোরতর শব্দ উঠিল। পৃথিবী টলমল করিতে লাগিল। জল ছুটিয়া আকাশে উঠিল! মাছ মরিয়া গেল, পর্বতে আগুন ধরিয়া গেল।

 তারপর, সেই পর্বতে যত ঔষধ, মণি, আর ধাতু ছিল; আগুনের তেজে তাহা গলিয়া সমুদ্রে পড়াতে, সমুদ্রের জল দুধ হইয়া গেল। সেই দুধ হইতে ঘি বাহির হইল।

 এইরূপ করিয়া অনেকদিন চলিয়া গেল। দেবতারা ক্রমাগত পর্বতে পাক দিয়া দিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন, তখন যদি নারায়ণ তাঁহাদিগকে উৎসাহ না দিতেন, তবে তাঁহারা কখনই এ কাজ শেষ করিয়া উঠিতে পারিতেন না। নারায়ণের উৎসাহে নূতন বল পাইয়া, তাঁহারা আরো বেশি করিয়া পর্বতে পাক দিতে লাগিলেন।

 এমন সময় হঠাৎ অতি কোমল এবং শীতল সাদা আলোতে চারিদিক উজ্জ্বল হইয়া গেল, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রদেব তাঁহার সুন্দর গোল মুখখানি লইয়া হাসিতে হাসিতে সমুদ্রের ভিতর হইতে উঠিয়া আসিলেন।

 তাঁহাকে দেখিয়া সকলে আশ্চর্য হইয়া গেলেন, কিন্তু তাঁহারা পাক দিতে ভুলিলেন না। চন্দ্র উঠিয়া সবে দেবতাদিগের নিকট গিয়া বসিয়াছেন, এমন সময় সেই ঘৃতের ভিতর হইতে একটি আশ্চর্য পদ্মফুল উঠিল। সেই পদ্মের ভিতরে লক্ষ্মীদেবী বসিয়াছিলেন, তাঁহার রূপের ছটায় ত্রিভূবন আলো হইয়া গেল!

 লক্ষ্মীকে পাইয়া সকলে আনন্দের সহিত আরো বেশি করিয়া পাক দিতে লাগিলেন। তাহাতে সেই ঘৃতের ভিতর হইতে ক্রমে আরো তিনটি জিনিস বাহির হইল—একটি দেবতা, উচ্চৈঃশ্রবাঃ নামক একটি ঘোড়া, আর কৌস্তুভ নামক একটি মণি।

 কৌস্তুভ মণিটি উঠিয়াই নারায়ণের বুকে গিয়া ঝুলিতে লাগিল। অন্য জিনিসগুলিও দেবতারাই পাইলেন।

 এদিকে কিন্তু পাক থামে নাই। হড়্-হড়্-ঘড়্-ঘড়্ গভীর গর্জনে তাহা ক্রমাগতই চলিতেছিল। কিঞ্চিত পরে, শ্বেতবর্ণ কমণ্ডলু হাতে চিকিৎসার দেবতা ধন্বন্তরি সমুদ্রের ভিতর হইতে উঠিয়া আসিলেন। সেই কমণ্ডলুর ভিতরে অমৃত ছিল।

 অমৃত দেখিবামাত্রই দৈত্যগণ, “উহা আমাদের” “উহা আমাদের” বলিয়া ঘোরতর কোলাহল আরম্ভ করিল।

 মন্থন কিন্তু তখনো থামে নাই। তারপর ঐরাবত নামে একটা চার-দাঁতওয়ালা সাদা হাতি উঠিল। তাহাকে দেখিয়া ইন্দ্র বলিলেন, “ইহা আমার!” সুতরাং উহা তাঁহাকেই দেওয়া হইল।

 তথাপি মন্থন থামিল না। এত জিনিস পাইয়া, বোধহয় সকলে ভাবিয়াছিল যে, আরো পাক দিলে, আরো ভাল ভাল জিনিস উঠিবে। কিন্তু এত লোভের কি সাজা, এবারে আর ভাল জিনিস না উঠিয়া, উঠিল, কালকূট নামক বিষম বিষ! সেই সাংঘাতিক বিষের গন্ধ শুঁকিয়াই ত্রিভূবন অজ্ঞান হইয়া গেল!

 এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখিয়া ব্রহ্মা শিবকে বলিলেন, “এখন উপায় কি হইবে? সকল যে যায়!”

 ব্রহ্মার কথায় মহাদেব, সৃষ্টি রক্ষার জন্য সেই বিষ নিজের কণ্ঠের ভিতরে রাখিয়া দিলেন। ইহাতেই তাহার কণ্ঠ নীল হইয়া যায়। সেইজন্য মহাদেবের এক নাম ‘নীলকণ্ঠ'।

 এদিকে দৈত্যগণ অমৃতের জন্য ক্ষেপিয়া গিয়া দেবতাদিগের নিকট হইতে তাহা কাড়িয়া লইয়াছে! দেবতাদের এমন শক্তি নাই যে, যুদ্ধ করিয়া উহাদের হাত হইতে তাহা উদ্ধার করেন। হায় হায়! এত ক্লেশ, এত পরিশ্রমের ফল কি এই?

 এই বিপদের সময় নারায়ণ অসুরদের হাত হইতে অমৃত উদ্ধারের উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। তারপর তিনি একটি অপরূপ সুন্দরী কন্যার বেশে অসুরদিগের নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলেন। অসুরেরা যখন তাঁহার সেই সুন্দর মুখখানি দেখিতে পাইল, তখন আর তাহাদের মুখে কথা সরিল না, চোখে পলক পড়িল না। তাহারা হাঁ করিয়া, হতবুদ্ধির ন্যায়, গোল চোখে, জোড়হাতে তাঁহার সামনে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর যখন তিনি হাত মেলিয়া, হাসিতে হাসিতে, তাহাদের নিকট অমৃতের পাত্রটি চাহিলেন, তখন নিতান্ত ব্যস্তভাবে তাহা তাঁহার হাতে তুলিয়া দিয়া, যেন তাহারা কতই কৃতার্থ হইল!