উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/তিলোত্তমা
তিলোত্তমা
তারপর, এই জগতে যেখানে যাহা কিছু সুন্দর আছে, তিল তিল করিয়া তাহাদের সকলের সারটুকু বিশ্বকর্মা কুড়াইয়া আনিলেন। চাঁদের আলোব সার, রামধনুকের রঙের সার, ফুলের শোভার সার, মণিমুক্তার জ্যোতির সার, গানের সার, নৃত্যের সার, হাসির সার, সকল মিলাইয়া তিনি তিলোত্তমা (অর্থাৎ তিল তিল করিয়া যাহার রূপের আযোজন হইয়াছে) নামে এমনই এক অপরূপ রূপবতী কন্যার সৃষ্টি করিলেন যে, তাহাকে যে দেখে সেই আর চক্ষু ফিরাইতে পারে না। ইন্দ্র তাহাকে দুই চোখে দেখিয়া তৃপ্তি পাইলেন না। দেখিতে দেখিতে তাঁহার শরীরে এক হাজার চোখ হইল; সেই এক হাজার চোখ দিয়া তিনি ইহাকে আশ্চর্য হইয়া দেখিতে লাগিলেন!
তিলোত্তমা ভক্তিভরে ব্রহ্মাকে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভগবন্, আমাকে কি করিতে হইবে, অনুমতি করুন।”
ব্রহ্মা কহিলেন, “বাছা, তুমি একটিবার সুন্দ উপসন্দের নিকট গিয়া দেখা দেও।”
এ কথায় তিলোত্তমা দেবতাগণকে প্রণাম করিয়া, ও তাঁহাদের সকলের আশীর্বাদ লইয়া সুন্দ উপসুন্দর নিকট যাত্রা করিল। সে সময়ে সুন্দ উপসুন্দ বিন্ধ্য পর্বতের নিকটে বেড়াইতে গিয়াছিল। তিলোত্তমা সুন্দর লাল কাপড় পরিয়া, সেইখানে গিয়া ফুল তুলিতে লাগিল।
তিলোত্তমাকে দেখিবামাত্র, সুন্দ আর উপসুন্দ দুইজনেই একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, আমি ইহাকে বিবাহ করিব!”
সুন্দ বলিল, “তাহা হইবে না! আমি ইহাকে বিবাহ করিব।”
উপসুন্দ বলিল, “তুমি বলিলে কি হইবে? আমিই ইহাকে বিবাহ করিব।”
সুন্দ বলিল, “চুপ! বেয়াদব”
উপসুন্দ বলিল, “খবরদার। মুখ সামলাইয়া কথা কও!”
তখন সুন্দ গদা লইয়া উপসুন্দকে মারিতে গেল। উপসুন্দও গদা লইয়া সুন্দকে মারিতে গেল।
তারপর সেই গদা দিয়া দুইজনেই দুইজনের মাথা ফাটাইয়া দিল। সুতরাং ব্রহ্মার বরে দুইজনেই প্রাণ বাহির হইয়া গেল। তাহা দেখিয়া অন্যান্য দানবেরা ভয়ে কাঁপিতে কাপিতে পাতালে পলায়ন করিল।
ইহাতে দেবতারা অবশ্য অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তিলোত্তমার অনেক প্রশংসা করিলেন। তারপর, সূর্য যে পথে চলেন, সেই ঝক্ঝকে সুন্দর পথে দেবতারা তিলোত্তমাকে রাখিয়া দিলেন। সেই পথে সে মনের আনন্দে খেলা করিয়া বেড়ায়, সূর্যের তেজে আমরা তাহাকে দেখিতে পাই না।
ব্রহ্মা সুন্দ উপসুন্দকে অমর হইতে না দিয়া ভালই করিয়াছিলেন, নহিলে এত সহজে তাহাদের দৌরাত্ম্যের শেষ হইত না। দেবতারা যে অমর ছিলেন, আর অসুরেরা অমর ছিল না, ইহাও সৌভাগের বিষয় বলিতে হইবে; নহিলে দুর্দান্ত অসুরের দল কবে দেবতাদিগকে মারিয়া শেষ করিত।
এমন এক সময় ছিল, যখন দেবতারা অমর ছিলেন না। তখন অসুরদিগের ভয়ে, তাঁহাদের বড়ই দুঃখে দিন যাইত। সকলের চেয়ে বেশি দুঃখের কথা এই ছিল, যুদ্ধে সাংঘাতিক আঘাত পাইলে, দেবতারা মরিয়া যাইতেন, কিন্তু অসুরদিগের গুরু শুক্র তাহাদিগকে মরিতে দিতেন না। শুক্র ‘সঞ্জীবনী’, অর্থাৎ মরাকে বাঁচাইবার মন্ত্র জানিতেন, দেবতাদিগের গুরু বৃহস্পতি তাহা জানিতেন না। কাজেই, অসুর মরিলেই শুক্র তাহাকে বাঁচাইয়া দিতেন; কিন্তু দেবতা মরিলে বৃহস্পতি আর তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিতেন না।
একে ত অসুরদের বল বেশি, তাহাতে যদি আবার এমন হয়, তবে কি দুঃখের কথাই হয়! কাজেই দেবতারা দেখিলেন যে, সেই সঞ্জীবনী মন্ত্র তাঁহাদের না শিখিলে আর চলিতেছেনা।