উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/সুন্দ ও উপসুন্দের কথা

সুন্দ ও উপসুন্দের কথা

 সুন্দ আর উপসুন্দ, দুই ভাই, হিরণ্যকশিপুর বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। দুই ভাই মিলিয়া যুক্তি করিল যে, ব্রহ্মার নিকট বর লইয়া, ত্রিভুবন জয় করিতে হইবে।

 এইরূপ পরামর্শ করিয়া, তাহারা বিন্ধ্য পর্বতে গিয়া এমনি ভয়ঙ্কর তপস্যা আরম্ভ করিল যে, তাহাতে দেবতারা পর্যন্ত ভয়ে অস্থির হইয়া উঠিলেন। ইহাদের তপস্যা ভাঙ্গিবার জন্য তাঁহারা অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। তাহারা খালি বাতাস খাইয়া, কেবল পায়ের বুড়ো আঙুলের ভরে খাড়া থাকিয়া, চোখের পলক না ফেলিয়া, একমনে তপস্যাই করিতে লাগিল। তপস্যার তেজে বিন্ধ্য পর্বতে আগুন ধরিয়া গেল।

 কাজেই তখন ব্রহ্মা আর তাহাদের নিকট না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না। ব্রহ্মা জিজ্ঞাসা করিলেন—

 “তোমরা কি বর চাহ?”

 সুন্দ ও উপসুন্দ বলিল, “আমরা এই বর চাহি যে, আমরা সকলরকম মায়া জানিব, যেমন ইচ্ছা তেমনি চেহারা করিতে পারিব, যুদ্ধে সকলকেই হারাইয়া দিব, আর অমর হইব।”

 ব্রহ্ম বলিলেন, “আমি তোমাদিগকে আর সব কয়টি বর দিতেছি, কিন্তু অমর করিতে পারিব না। তোমরা যখন ত্রিভুবন জয়ের জন্য তপস্যা করিতেছ, তখন তোমাদিগকে অমর করিলে চলিবে কেন? অমর হইলে ত তোমরা দেবতাদিগের সমানই হইয়া যাইবে!”

 এ কথা শুনিয়া সুন্দ উপসুন্দ বলিল, “যদি অমর না করেন, তবে এই বর দিন যে, ত্রিভুবনের ভিতরে কেহই আমাদিগকে বধ করিতে পারিবে না। আমাদিগকে মারিবার ক্ষমতা কেবল আমাদের নিজেরই থাকিবে।”

 ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হউক। তোমাদের নিজেদের হাতেই তোমাদের মৃত্যু হইবে, অপর কেহ তোমাদিগকে মারিতে পারিবে না।”

 এই বলিয়া ব্রহ্মা চলিয়া গেলে, সুন্দ উপসুন্দ ঘরে ফিরিয়া দিনকতক খুবই ধুমধাম করিল। তারপর তাহারা লাখে লাখে বিকটাকার অসুর সঙ্গে লইযা ত্রিভুবন জয় কবিতে বাহির হইল।

 ব্রহ্মা যে সুন্দ উপসুন্দকে বর দিয়াছেন, এ কথা দেবতাবা বেশ জানিতেন। সুতরাং তাঁহাবা তাহাদিগকে দেখিবামাত্রই যার পর নাই ব্যস্ত হইযা, তৎক্ষণাৎ স্বর্গ পরিত্যাগ পূর্বক একেবারে ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হইলেন। এদিকে অসুরেরা স্বর্গ খালি পাইযা তাহা অধিকার করিতে এবং সেখানে যাহাদিগকে পাইল তাহাদিগকে বধ করিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না।

 তারপর সুন্দ উপসুন্দ তাহাদের সৈন্যদিগকে ডাকিয়া বলিল, “রাজারা আর মুনিরা যাগ যজ্ঞ করিয়া দেবতাদিগের তেজ বাড়াইয়া দেন। সুতরাং আইস, আমরা তাহাদিগকে গিয়া বধ করি।”

 সমুদ্রের ধারে মুনিরা যজ্ঞ করিতেছিলেন। সুন্দ উপসুন্দর কথায় অসুরের দল ক্ষেপিয়া আসিয়া তাঁহাদিগকে বধ করিতে লাগিল। যজ্ঞের আযোজন সকল জলে ফেলিয়া দিল। মুনিরা শাপ দিতে লাগিলেন কিন্তু ব্রহ্মাব বরের গুণে সে শাপে কোন ফল হইল না। তাহাতে নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া, এবং ভয় পাইয়া, তাঁহারা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিলেন।

 তারপর সুদ উপসুন্দ, নানারূপ উপায়ে মুনি এবং রাজাদিগকে বধ করিতে লাগিল। সংসারময় হাহাকাব পড়িয়া গেল। ধর্মকর্ম ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি কোন কার্যই করিবার লোক রহিল না। দখিতে দেখিতে এই সুন্দর সৃষ্টির এমন অবস্থা হইল যে, তাহা শ্মশানের চেয়েও ভয়ানক! এইরূপে সুন্দ উপসুন্দ এিভুবন ছারখার করিয়া, নিশ্চিন্ত মনে, কুরুক্ষেত্রে আসিয়া বাস করিতে লাগিল।

 তখন দেবর্ষি এবং সিদ্ধগণ ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হইয়া জোড় হাতে, অতি কাতরভাবে বলিলেন “হে পিতামহ! সুন্দ উপসুন্দেব দৌরাত্ম্যে সৃষ্টি নষ্ট হইল। দয়া করিয়া ইহার উপায় করুন।”

 এ কথায় ব্রহ্মা একটু চিন্তা করিয়া বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি একটি এমন সুন্দর কন্যা প্রস্তুত কর যে, তেমন সুন্দর আর কেহ কখনো দেখে নাই।”

 তাহা শুনিয়া বিশ্বকর্মা বলিলেন, “যে আজ্ঞ।”