উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/কদ্রু ও বিনতার কথা

কদ্রু ও বিনতার কথা

 কদ্রু আর বিনতা দক্ষের কন্যা। মরীচির পুত্র কশ্যপের সহিত ইঁহাদিগের বিবাহ হইয়াছিল। একদিন কশ্যপ ইঁহাদের উপর সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন—

 “আমি তোমাদিগকে বর দিব, তোমরা কি বর চাহ?”  এ কথায় কদ্রু বলিলেন, “আমার যেন এক হাজারটি পুত্র হয়।”

 বিনতা বলিলেন, “আমি দুটির বেশি পুত্র চাহি না। কিন্তু সেই দুটি পুত্র যেন কদ্রুর একহাজার পুত্রের চেয়ে বীর হয়।”

 কদ্রু আর বিনতার কথা শুনিয়া কশ্যপ বলিলেন, “আচ্ছা। তোমরা যেমন চাহিতেছ তেমনি হইবে।”

 অনেক দিন পরে, কদ্রুর এক হাজারটি, আর বিনতার দুটি ডিম হইল। তারপর আর পাঁচশত বৎসর চলিয়া গেল, কদ্রুর ডিমগুলি ফুটিয়া এক হাজারটি পুত্র বাহির হইল। কিন্তু বিনতার ডিম দুটি হইতে তখনো কিছু বাহির হইল না।

 কদ্রুর ডিমগুলি সবই ফুটিল আর বিনতার একটি ডিমও ফুটিল না, ইহাতে বিনতার বড়ই দুঃখ আর লজ্জা হইল। তখন তিনি আর বিলম্ব সহিতে না পারিয়া নিজহাতেই তাঁহার দুটি ডিমের একটি ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। সেই ডিমের ভিতরে তাঁহার যে পুত্রটি ছিল, তাঁহার শরীরের সকল স্থান তখনো মজবুত হয় নাই। তাহার উপরকার অর্ধেক বেশ মজবুত হইয়াছিল, কিন্তু নীচের অর্ধেক তখনো নিতান্তই কাঁচা ছিল। ছেলেটি বাহির হইয়া যার পর নাই দুঃখ ও রাগের সহিত তাহার মাতাকে বলিল—

 “মা তুমি আমাকে কাঁচা থাকিতে বাহির করিয়া কেন আমার সর্বনাশ করিলে? যাহা হউক, তুমি যখন কদ্রুকে হিংসা করিতে গিয়া আমার এমন ক্ষতি করিয়াছ, তখন আমিও তোমাকে শাপ দিতেছি যে, তোমাকে পাঁচ শত বৎসর এই কদ্রুর দাসী হইয়া থাকিতে হইবে।”

 তারপর সেই ছেলেটি আবার বলিল, “আর একটি ডিম যে আছে, তাহাকে যেন এমন করিয়া অকালে ভাঙ্গিও না। উহার ভিতর তোমার যে পুত্র আছে, তাহার দ্বারাই তোমার দাসী হওয়ার দুঃখ ঘুচিবে। সত্যই তাহাকে যদি খুব শক্ত করিতে চাহ, তবে, ডিমটি আপনা আপনিই ফুটিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া থাক। উহা ফুটিতে আরো পাঁচশত বৎসর আছে।”

 এই বলিয়া সেই ছেলেটি আকাশপথে সূর্যের নিকট চলিয়া গেল। ছেলেটির নাম অরুণ, সূর্যের নিকট গিয়া সে তাঁহার সারথি হইল। সেই কাজ সে এখনো করিতেছে। সূর্যদেব যেমন সমান ওজনে চলা ফেরা করেন, তাহাতে নিশ্চয় বুঝা যায় যে, অরুণ তাহার কাজ বেশ ভাল করিয়াই করিতেছে।

 অরুণ যে আকাশে উড়িয়া গল ইহার মধে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। অরুণ মানুষ ছিল না, সে পাখি ছিল। আর কদ্রুর সেই এক হাজার ছেলেও যে মানুষ ছিল, তাহা নহে, তাহারা ছিল সাপ।

 অরুণ বিনতাকে শাপ দিয়া চলিয়া গল। তারপর কি হইল শুন।

 ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবাঃ নামক একটা সাদা ঘোড়া ছিল। একদিন কথায় কথায় কদ্রু বিনতাকে বলিলেন, “বল দেখি, উচ্চৈঃশ্রবাঃর কিরূপ বর্ণ।”

 বিনতা বলিলেন, “কেন? সাদা।”

 কদ্রু বলিলেন, “হইল না। উহার শরীর সাদা কিন্তু লেজ কালো।”

 বিনতা বলিলেন, “বাজি রাখ।”

 কদ্রু বলিলেন, “আচ্ছা রাখ বাজি। যাহার কথা মিথ্যা হইবে, সে পাঁচ শত বৎসর অন্য জনের দাসী হইয়া থাকিবে।”

 এমনি করিয়া বাজি রাখা হইল, আর স্থির হইল যে, পরদিন দুইজনে মিলিয়া ঘোড়াটাকে দেখিতে যাইবেন। অবশ্য উচ্চৈঃশ্রবাঃ যে সাদা, এ কথা সকলেই জানে। কদ্রুও যে এ কথা না জানিতেন, এমন নহে। তাঁহার মনে দুষ্ট অভিসন্ধি ছিল, এজন্য তিনি জানিয়া শুনিয়াই বলিয়াছিলেন, “উচ্চৈঃশ্রবাঃর লেজ কালো।”

 বিনতার সঙ্গে বাজি বাখিয়া কদ্রু চুপি চুপি তাঁহার ছেলেদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাছাসকল, আমি ত বিনতার সঙ্গে এইরকম বাজি রাখিয়া আসিয়াছি। কাল গিয়া যদি উচ্চৈঃশ্রবাঃর লেজ কালো দেখিতে না পাই, তবেই কিন্তু আমাকে পাঁচ শত বৎসর দাসী হইয়া থাকিতে হইবে। তোমরা এই বেলা গিয়া, কালো কালো সূতার মতন হইয়া উহার লেজ ধরিয়া ঝুলিতে থাক। এমনি করিয়া তাহার লেজটাকে কালো করিয়া দেওয়া চাই, নইলে আমার বড়ই বিপদ।”

 কদ্রুর কথায় দলে দলে সরু সরু কলো সাপ গিয়া উচ্চৈঃশ্রবাঃব লেজ ধরিয়া ঝুলিয়া থাকিলে, সেই লেজের রং দূর হইতে কালোই দেখা যাইতে লাগিল। কতগুলি সাপ কদ্রুর কথা মত কাজ করিতে রাজি হয় নাই। তাহাদিগকে তিনি এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তোরা জন্মেজয় রাজার যজ্ঞের আগুনে পুড়িয়া মারা যাইবি।”

 পরদিন প্রাতঃকালে কদ্রু আর বিনতা দুজনে মিলিয়া উচ্চৈঃশ্রবাঃকে দেখিতে চলিলেন। বিনতা মনে কবিয়াছিলেন যে, তাঁহারা নিশ্চয়ই উচ্চৈঃশ্রবাঃকে সাদা রঙের দেখিতে পাইবেন। কিন্তু ঘোড়ার নিকটে গিয়া দেখিলেন যে, উহার লেজটি মিসমিসে কালো।

 তখন কদ্রু বলিলেন, “কেমন? বড় যে বলিয়াছিলে, ঘোড়াটি সাদা। দেখত উহার লেজটি কি রঙের। এখন আইস। আমার ঘর ঝাঁট দাও আসিয়া!”

 ইহাতে বিনতা নিতান্তই আশ্চর্য এবং দুঃখিত হইলেন বটে, কিন্তু বাজি যখন হারিয়াছেন, তখন ত আর কদ্রুর দাসী না হইয়া উপায় নাই! কাজেই তিনি কাঁদিতে কাঁদিতে দাসীর কাজই করিতে লাগিলেন।

 এই ঘটনার পাঁচশত বৎসর পরে বিনতার অপর ডিমটি ফুটিলে তাহার ভিতর হইতেও একটি পক্ষী বাহির হইল। এই পক্ষীটির নাম ছিল গরুড়।

 কশ্যপ হইতেই অধিকাংশ জীবের জন্ম হইয়াছিল। সুতরাং তাঁহার সন্তানেরা যে, কেহ দেবতা, কেহ অসুর, কেহ মানুষ, কেহ জানোয়ার, কেহ সাপ, আর কেহ পাখি হইবে, ইহা ত ধরা কথা! কিন্তু এই গরুড় যে পাখি হইয়াছিল, মহাভারতে তাহার একটা বিশেষ কারণের কথা আছে।