উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/গরুড়ের কথা
একবার মহামুনি কশ্যপ, পুত্র লাভের জন্য, খুব ঘটা করিয়া যজ্ঞ করিতেছিলেন। দেবতা এবং মুনিগণ সকলে মিলিয়া সেই যজ্ঞে কাজ করিতে আসেন।
যজ্ঞের সকল কাজ ইঁহাদিগের মধ্যে বাঁটিয়া দেওয়া হইল। যাঁহারা কাঠ আনিবার ভার লইলেন, ইন্দ্র তাঁহাদেব মধ্যে একজন। ইঁহাদেব মধ্যে বালখিল্য নামক একদল মুনিও ছিলেন।
এই বালখিল্যদিগের মতন আশ্চর্য মুনি আর কখনো হইয়াছে কিনা সন্দেহ। দেখিতে ইঁহারা নিতান্তই ছোট ছোট ছিলেন। কত ছোট, তাহা আমি ঠিক করিয়া বলিতে পারি না। কেহ বলিয়াছেন যে, তাঁহারা ‘অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ’ (অর্থাৎ বুডো আঙুলের মত ছোট) ছিলেন। কিন্তু এ কথা যে একেবারে ঠিক নয়, তাহার প্রমাণ এই একটা ঘটনাতেই পাওয়া যাইতেছে—
ইঁহাদের দলে কয়জন ছিলেন, জানি না। কিন্তু দেখা যায় যে কশ্যপ মুনির যজ্ঞের জন্য কাঠ কুড়াইতে গিয়া, তাহারা সকলে মিলিয়া অতি কষ্টে একটি পাতার বোঁটা মাত্র বহিয়া আনিতেছিলেন। তাহাও আবার, পথে এক দুর্ঘটনা হওয়াতে, তাহারা যজ্ঞ স্থানে পৌঁছাইয়া দিতে পারেন নাই।
দুর্ঘটনাটা একটু ভারিরকমের! গরুর পায়ের দাগ পড়িয়া, পথে ছোট ছোট গর্ত হইয়াছিল, সেই গর্তগুলিতে বৃষ্টির জল দাঁড়াইয়াছিল। পাতার বোঁটা লইয়া ঠেলাঠেলি করিতে করিতে, বালখিল্য ঠাকুরেরা সেই বোঁটা সুদ্ধ সকলে, সেই গর্তের একটার ভিতর গড়াইয়া পড়িয়াছেন, তারপর আর তাহার ভিতর হইতে উঠিতে পারেন না।
এই সময়ে ইন্দ্র পর্বত প্রমাণ কাঠের বোঝা লইয়া সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুনিদিগের দুর্দশা দেখিয়া তাঁহার বড়ই আশ্চর্য বোধ হইল, আর হাসি পাইল। পিপীলিকার মতন মুনিগণকে দেখিয়া তাঁহার একেবারেই গ্রাহ্য না হওয়াতে, সেই হাসি আর তিনি থামাইতে চেষ্টা করেন নাই। ইহার উপর আবার একটু আধটু ঠাট্টাও যে না করিয়াছিলেন, এমন নহে। শেষে আবার উঁহাদিগকে ডিঙাইয়া চলিয়া আসেন।
মুনির সম্মান ত আর শরীরের লম্বা চওড়া দিয়া হয় না তাঁহাদিগের সম্মান আর ক্ষমতা তাঁহাদের তপস্যার ভিতরে। বালখিল্যদিগের মতন তপস্বী খুব কমই ছিল। আর তাঁহাদের ক্ষমতা যে কিরূপ ছিল তাহার পরিচয়ও তাঁহারা তখনই দিলেন।
ইন্দ্রের ব্যবহারে অত্যন্ত অপমান বোধ করিয়া, তাহারা, উহার চেয়ে অনেক বড় আর এক ইন্দ্র জন্মাইবার জন্য যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। এ কথা জানিবামাত্রই ইন্দ্রের ভয়ের আর সীমা নাই। তিনি তাড়াতাড়ি কশ্যপের নিকট আসিয়া বললেন, “বাবা, এখন আপনি না বাঁচাইলে, আর উপায় দেখিতেছি না।”
ইন্দ্র কশ্যপের পুত্র (বারজন আদিত্যের মধ্যে যাঁহার নাম শুক্র তিনিই ইন্দ্র) সুতরাং পুত্রের জন্য তাঁহার দয়া না হইবে কেন? কশ্যপ ইন্দ্রের সকল কথা শুনিয়া; বালখিল্যদিগের নিকট গিয়া বলিলেন—
“মুনিগণ, আপনাদের তপস্যা বৃদ্ধি হউক। আমি একটি কাজ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, আশীর্বাদ করুন, যেন অমার কাজটি হয়।”
সত্যবাদী বালখিল্যগণ তখনই বলিলেন, “আপনার কার্যসিদ্ধ হইবে।”
তাহা শুনিয়া কশ্যপ তাঁহাদিগকে মিষ্ট কথায় বুঝাইয়া বলিলেন যে, “দেখুন, ব্রহ্মা আমার এই পুত্রটিকে ইন্দ্র করিয়া দিয়াছেন। এখন, আপনারা যদি ইহাকে যজ্ঞ করিয়া তাড়াইয়া দেন, তাহা হইলে ত ব্রহ্মার কথা মিথ্যা হইয়া যায়। আপনাদের যজ্ঞ বৃথা হয়, ইহা কখনই আমার ইচ্ছা নহে। আপনারা যে একটি ইন্দ্র করিতে চাহিয়াছেন, তাহা হইবেই। তবে আমি এই চাহি যে সে ইন্দ্র আমাদিগের ইন্দ্র না হইয়া পাখির ইন্দ্র হউক। দেখুন, ইন্দ্র মিনতি করিতেছেন আপনারা তাহার উপর সন্তুষ্ট হউন।”
ধার্মিকের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। সুতরাং কশ্যপের কথায় বালখিল্যগণ তখনই আহ্লাদের সহিত ইন্দ্রকে ক্ষমা করিলেন। তারপর তাহারা কশ্যপকে বিনয় করিয়া বলিলেন যে, “আমরা দুইটি জিনিসের জন্য এই যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছিলাম, নতুন একটি ইন্দ্র, আর আপনার একটি পুত্র। এ অবস্থায আপনার যাহা ভাল বোধ হয়, তাহা করুন।”
সুতরাং স্থির হইল যে, এই নূতন ইন্দ্রটি যেমন পাখির ইন্দ্র হইবে, তেমনি কশ্যপের পুত্রও হইবে। সেই পুত্রই গরুড়, সে পক্ষিগণের ইন্দ্র।
গরুড়ের শরীর অতিশয় প্রকাণ্ড ছিল, আর তাহা সে ইচ্ছামত ছোট বড় করিতে পারিত। আগুনের মত লাল আর উজ্জ্বল তাহার গায়ের রঙ ছিল। সে বিদ্যুতের মতন বেগে ছুটিতে পারিত, আর যখন যেমন ইচ্ছা রূপ ধরিতে পারিত। জন্মমাত্রেই সে আকাশে উঠিয়া, আনন্দে চিৎকার করিতে লাগিল।
এদিকে দেবতারা গরুড়কে দেখিয়া মনে করিলেন যে, উহা বুঝি আগুন। তাই তাহারা ব্যস্ত ভাবে অগ্নির নিকট গিয়া বলিলেন, “আজ কেন তোমার এত তেজ দেখিতেছি? তুমি কি আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিবার ইচ্ছা করিয়াছ?”
এ কথা শুনিয়া অগ্নি বলিলেন, “আপনারা ব্যস্ত হইবেন না উহা আগুন নহে কশ্যপের পুত্র গরুড়। ইনি দেবতাদিগের উপকারী বন্ধু, সুতরাং আপনাদের কোন ভয় নাই।”
তখন তাহারা সকলে গরুড়ের নিকট গিয়া তাহার নানারূপ প্রশংসা করিতে করিতে বলিলেন, “বাপু তোমাকে দেখিয়া আমরা বড়ই ভয় পাইয়াছি, আর তোমার তেজে অস্থির হইয়াছি। সুতরাং তুমি দয়া করিয়া তোমার শরীরটাকে একটু ছোট কর, আর তেজ একটু কমাও।”
তাহাতে গরুড় বলিল, “এই যে, মহাশয়, আমি এখন ছোট হইয়া গিয়াছি। আপনাদের আর ভয় পাইতে হইবে না।” এই বলিয়া সে তাহার মাতা বিনতার নিকট চলিয়া গেল।
বিনতার দিন যে তখন কি দুঃখে যাইতেছিল, তাহা না বলিলে কেহ বুঝিতে পারিবে না। বাসন মাজা, জল টানা প্রভৃতি দাসীর যে কাজ, তাহা ত তাঁহাকে করিতেই হইত। ইহার উপর আবার কদ্রু যখন তখন বলিয়া বসিতেন, “আমি অমুক জায়গায় যাইব, আমাকে পিঠে করিয়া লইয়া চল।”
একদিন বিনতা গরুড়ের নিকট বসিয়া আছেন এমন সময় কদ্রু তাঁহাকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ বিনতা, সমুদ্রের মধ্যে একটা অতি সুন্দর দ্বীপ আছে, সেখানে অনেক নাগ বাস করে। আমাকে সেইখানে লইয়া যাইতে হইবে।”
তখনই কদ্রু, বিনতার পিঠে উঠিয়া বসিলেন, আর কতকগুলি সাপ (কদ্রুর পুত্র) গরুড়ের পিঠে গিয়া চড়িল। তাহাদিগকে লইয়া দুইজনকে সেই দ্বীপে যাইতে হইল।
দ্বীপে গিয়া সাপেরা কিছুকাল আমোদ আহ্লাদ করিয়া গরুড়কে বলিল, “তুমি আকাশে উড়িতে পার, তোমার ত না জানি ইহার চেয়ে কতই ভাল ভাল জায়গার কথা জানা আছে। সেই-সকল জায়গায় আমাদিগকে লইয়া চল।”
ইহাতে গরুড় নিতান্ত দুঃখিত হইয়া তাহার মাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মা, সাপেরা কেন এমন করিয়া আমাকে আজ্ঞা দিবে, আর আমাকেই বা কেন তাহা মানিতে হইবে, তাহা বল?”
বিনতা বলিলেন, “বাছা, পণে হারিয়া আমি উহাদের দাসী হইয়াছি তাই উহারা আমাদিগকে এমন করিয়া খাটাইয়া লয়।”
ইহাতে যে গরুড়ের মনে খুব কষ্ট হইল, তাহা বুঝিতেই পার। সে তখনই সাপদের নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হে সর্পগণ, কি হইলে তোমরা আমাদিগকে ছাড়িয়া দিতে পার?”
সর্পেরা বলিল, “যদি তুমি অমৃত আনিয়া দিতে পার, তাহা হইলে তোমাদিগকে ছাড়িয়া দিব।”
এ কথায় গরুড় তাঁহার মাকে বলিল, “মা আমি অমৃত আনিতে চলিলাম, পথে কি খাইব, বলিয়া দাও।”
বিনতা বলিলেন, “বাছা, সমুদ্রের মধ্যে হাজার হাজার নিষাদ (শিকারী ব্যাধ) বাস করে, তুমি তাহাদিগকে খাইও। কিন্তু সাবধান। কখনো যেন ব্রাহ্মণকে খাইও না।”
গরুড় বলিল, “মা ব্রাহ্মণ কিরকম থাকে? আর সে কি করে? সে কি বড় ভয়ানক?”
বিনতা বলিলেন, “যাহাকে খাইলে তোমার পেটের ভিতরে ছুঁচের মত ফুটিবে, গলায় আগুনের মত জ্বালা হইবে, তিনিই জানিবে বাহ্মণ। বাহ্মণের বড় অদ্ভুত ক্ষমতা, নিতান্ত বিপদে পড়িলেও তাহাকে মুখে দিও না। যাও বাছা, তোমার মঙ্গল হউক।”
এইরূপে মায়ের নিকট বিদায় লইয়া গরুড় অমৃত আনিতে যাত্রা করিল। খানিক দূরে গিয়াই সে দেখিল যে, তাহার ভারি ক্ষুধা হইয়াছে। কিছু আহার না করিলে আর চলে না। তখন সে চারিদিক চাহিয়া দেখিল নিকটেই একটা নিষাদের গ্রাম দেখা যাইতেছে। তাহা দেখিবা মাত্র, সে, সেই গ্রামের পথে তাহার বিশাল মুখখানি মেলিয়া রাখিয়া, দুই পাখায় বাতাস করিতে লাগিল। কি ভীষণ বাতাসই সে করিয়াছিল। সে বাতসে ঝড় বহিয়া ঘূর্ণী বায়ু ছুটিয়া, ধূলা উড়িয়া গ্রামখানি সুদ্ধ একেবারে তাহার মুখের ভিতরে আনিয়া উপস্থিত, এখন মুখ বন্ধ করিয়া তাহা গিলিলেই হয়।
নিষাদের গ্রাম খাইয়া গরুড়ের পেট একটুও ভরিল না, লাভের মধ্যে গলা জ্বলিয়া বেচারার কষ্টে এক শেষ হইল। সে এমনি ভয়ানক জ্বালা যে, আর একটু হইলেই হয়ত গলা পুড়িয়া যাইত। গরুড় ভাবিল, “কি আশ্চর্য! একগাল জল-খাবাব খাইলাম, তাহাতে কেন এত জ্বালা? তবে বা কোন খান দিয়া একটা ব্রাহ্মণ আমার পেটের ভিতর ঢুকিয়া গেল। মা ত ব্রাহ্মণ খাইলেই এমনি জ্বালা হওয়ার কথা বলিয়াছিলেন।” এই ভাবিযা সে বলিল, “ঠাকুব মহাশয়। আপনি শীঘ্র বাহিরে আসুন আমি হাঁ করিতেছি।”
ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আমার স্ত্রীও যে আছে। আমি একেলা কেমন করিয়া বাহির হইব?”
গরুড় বলিল, “শীঘ্র আপনার স্ত্রীকে লইয়া বাহিরে আসুন। বিলম্ব হইলে হজম হইয়া যাইবেন।”
ব্রাহ্মণকে তাড়া দিবার কোন প্রয়োজন ছিল না, খুবই শীঘ্র শীঘ্র তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া ছুটিয়া বাহির হইলেন। গরুড়ের গলাও তৎক্ষণাৎ ঠাণ্ডা হইল। তখন ঠিক একসঙ্গে ব্রাহ্মণও বলিলেন, “কি, বিপদ!” গরুড়ও বলিল, “কি, বিপদ!”
তারপর ব্রাহ্মণ গরুড়কে ধন্যবাদ দিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন, গরুড়ও আবার অমৃত আনিতে যাত্রা করিল। সে সময় তাহার পিতা কশ্যপ সেই পথে যাইতে ছিলেন, সুতরাং খানিক দূর গিয়াই দুইজনে দেখা হইল। কশ্যপ গরুড়কে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, “কেমন আছ বৎস? তোমার যথেষ্ট আহার জোটে ত?”
গরুড় তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, “ভগবন; আমি ভালই আছি, কিন্তু আহার ত আমার ভাল করিয়া জোটে না! মাকে সাপদিগের হাত হইতে ছাড়াইবার জন্য আমি অমৃত আনিতে চলিয়াছি। মা বলিয়াছিলেন, পথে নিষাদ খাইতে। নিষাদ অনেকগুলি খাইলাম, কিন্তু তাহাতে আমার কিছুই হইল না! ভগবন্, দয়া করিয়া আমাকে আর কিছু খাবার জিনিসের কথা বলিয়া দিন। ক্ষুধায় আমার পেট জ্বলিয়া যাইতেছে, পিপাসায় তালু শুকাইয়া গিয়াছে।”
এ কথা শুনিয়া কশ্যপ বলিলেন, “বৎস, ঐ যে একটি প্রকাণ্ড সরোবর দেখা যাইতেছে, ওখানে গেলে পর্বত-প্রমাণ একটি কচ্ছপ আর তাহার চেয়েও বড় একটি হস্তি দেখিতে পাইবে। পূর্বজন্মে ইহারা বিভাবসু আর সুপ্রতীক নামে দুই ভাই ছিল। ইহাদেব পিতা কিছু টাকাকড়ি রাখিয়া যান, ছোটভাই সুপ্রতীক সেই টাকা তাহাকে ভাগ করিয়া দিবার জন্য, বড় ভাই বিভাবসুকে বড়ই পীড়াপীড়ি করিত। বিভাবসু রাগী লোক ছিল, তাই সে সুপ্রতীকের পীড়াপীড়িতে অত্যন্ত চড়িয়া গিয়া, তাহাকে শাপ দিল যে, তুই মরিয়া হাতি হইবি!” ইহাতে সুপ্রতীক বলিল, “তুমি মরিয়া কচ্ছপ হইবে!”
“এখন সেই দুইভাই বিশাল হাতি আর প্রকাণ্ড কচ্ছপ হইয়াছে। ঐ শুন, হাতিটা সরোবরের কাছে আসিয়া কি ভয়ঙ্কর গর্জন আরম্ভ করিয়াছে, আর তাহা শুনিয়া কচ্ছপটা সরোবরের জল তোলপাড় করিয়া, কেমন রাগের সহিত উঠিয়া আসিতেছে, দেখ। ঐ দেখ, উহাদের কি বিষম যুদ্ধ বাধিয়া গেল! হাতিটা ছয় যোজন উঁচু আর বার যোজন লম্বা; কচ্ছপটা তিন যোজন উঁচু, আর তাহার বেড় দশ যোজন; এ দুটাকে খাইতে পারিলে তোমার পেটও ভরিবে, গায়ও খুব জোর হইবে।”
এই বলিয়া গরুড়কে আশীর্বাদ পূর্বক কশ্যপ চলিয়া গেলেন। তারপর গরুড়ও এক নখে হাতি, আর এক নখে কচ্ছপটাকে লইয়া, আবার আকাশে উড়িল। তখন তাহার চিন্তা হইল যে, ‘কোথায় বসিয়া এদুটাকে ভক্ষণ করা যায়।’ গাছের নিকটে গেলে, তাহা তাহার পাখার বাতাসেই ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমন একটা গাছ খুঁজিয়া পাওয়া গেল না, যাহার উপর গিয়া বসিতে ভরসা হয়। তারপর অনেক দূরে অতিশয় প্রকাণ্ড কতগুলি গাছ দেখা গেল। তাহাদের মধ্যে একটা বড় গাছ ছিল, তাহা এতই প্রকাণ্ড যে তাহার একটা ডাল এক শত যোজন লম্বা! গাছটি যেমন বড়, তেমনই ভদ্র। সে গরুড়কে ডাকিয়া বলিল, “গরুড়, আমার এই ডালে বসিয়া, তুমি গজ-কচ্ছপ আহার কর।”
গাছের কথায় গরুড় তাহার ডালে বসিবামাত্র, ঘোরতর মটমট্ শব্দে ডাল ভাঙিয়া পড়িল।
যাহা হউক, গরুড় ডালটিকে মাটিতে পড়িতে দিল না। সে দেখিল যে, পিঁপড়ার ন্যায় ছোট ছোট অনেকগুলি মুনি মাথা নিচু করিয়া, বাদুড়ের মত সেই ডালে ঝুলিতেছেন। ইঁহারা বালখিল্য মুনি; ইঁহারা ঐ ভাবে তপস্যা করিতেন। ইঁহাদিগকে দেখিয়া গরুড়ের বড়ই ভয় আর চিন্তা হইল, কেননা ডাল মাটিতে পড়িলে আর ইহাদের কেহই বঁচিয়া থাকিতেন না। সুতরাং সে দুইপায়ে হাতি আর কচ্ছপ, আর ডালটিকে ঠোঁটে লইয়া আবার আকাশে উড়িল। এইরূপে বিশাল তিনটি বোঝা লইয়া বেচারা ক্রমাগত উড়িতেছে, কোথাও বসিবার জায়গা পায় না। এমন সময় সে দেখিল যে, গন্ধমাদন পর্বতে বসিয়া কশ্যপ তপস্যা করিতেছেন। কশ্যপ তাহার অবস্থা দেখিয়া বলিলেন, “বৎস, করিয়াছ কি? ঐ ডালে বালখিল্যগণ রহিয়াছেন, উঁহারা যে তোমাকে এখনি শাপ দিয়া ভস্ম করিবেন!”
তারপর তিনি বালখিল্যদিগকে বলিলেন, “আপনারা অনুগ্রহ করিয়া গরুড়কে অনুমতি দিন, সে এই হাতিটাকে আর কচ্ছপটাকে খাইলে লোকের উপকার হইবে!”
এ কথায় বালখিল্যগণ, গরুড়ের উপর সন্তুষ্ট হইয়া, সেই ডাল ছাড়িয়া হিমালয়ে চলিয়া গেলেন।
তারপর গরুড় কশ্যপকে বলিল, “ভগবন্, এখন এই ডাল কোথায় ফেলি?”
ইহাতে কশ্যপ একটা পর্বতেব কথা বলিয়া দিলেন। সে পর্বতে ডাল ফেলিয়া, গরুড় গজ-কচ্ছপ ভক্ষণ করিল।
তারপর যখন গরুড় আবার নূতন বলের সহিত অমৃত আনিতে যাত্রা করিল তখন তাহাকে দেখিয়া দেবতাগণ বড়ই চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। ইন্দ্র বৃহস্পতিকে বলিলেন, “ওটা কি আসিতেছে?”
বৃহস্পতি বলিলেন, “কশ্যপের পুত্র গরুড় অমৃত লইতে আসিতেছে, আর তাহা লইয়াও যাইবে।”
বৃহস্পতির কথায় তখনই এই বলিয়া অমৃতের প্রহরীদিগের উপর তাড়া পড়িল যে, “ভয়ঙ্কর একটা পক্ষী অমৃত লইতে আসিতেছে। সাবধান! সে যেন তাহা চুরি করিতে না পারে।”
কেবল প্রহরীদিগকে সতর্ক করিয়াই দেবতাগণ সন্তুষ্ট রহিলেন না, তাঁহারা নিজেরাও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া অমৃত রক্ষার জন্য প্রস্তুত হইলেন। ইন্দ্র বজ্র হাতে এবং অন্যান্য দেবতারা অসি, চক্র, ত্রিশূল শক্তি, পবিঘ প্রভৃতি ভয়ঙ্কর অস্ত্র লইয়া, অমৃতের চারিদিকে দাঁড়াইলে, বাস্তবিকই তাঁহাদিগকে অতি ঘোরতর দেখা যাইতে লাগিল।
কিন্তু গরুড় যে কতখানি ভয়ানক, দূর হইতে দেবতারা তাহা ভাল করিয়া বুঝিতে পারেন নাই। সুতরাং সে কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলে তাঁহারা মাথা ঠিক রাখিতে না পারিয়া নিজেরাই কাটাকাটি করিতে লাগিলেন। এদিকে গরুড় বিশ্বকর্মা বেচারাকে সামনে পাইয়া, চক্ষের পলকে তাঁহার দুর্দশার একশেষ করিয়া দিল! বেচারা কারিকর লোক যুদ্ধ করার অভ্যাস নাই, তথাপি তিনি কিছুকাল ভযানক যুদ্ধ করিয়াছিলেন; কিন্তু শেষে অজ্ঞান হইয়া গেলেন।
অপরদিকে গরুড়ের পাখার বাতাসে ধূলা উড়িয়া, অন্যানা দেবতাদিগেরও অজ্ঞান হইতে আর বেশি বাকি নাই। অমৃতের প্রহরীদিগের চক্ষুও ধূলায় অন্ধ হইয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে।
এমন সময় পবন আসিয়া ধূলা উড়াইয়া দিলে, দেবতারা সাহস পাইয়া, গরুড়কে আক্রমণ করিলেন। কিন্তু তাঁহাদের অস্ত্রের ঘায় গরুড় কিছুমাত্র কাতর না হইয়া, পাখার ঝাপটে তাঁহাদিগকে উড়াইয়া ফেলিতে লাগিল। ইহাতে তাঁহাদের নানারকম দুর্গতি হওয়ায় তাঁহারা অমৃতের মায়া ছাড়িয়া দিয়া, উৎসাহের সহিত পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। গন্ধর্ব ও সাধাগণ পলাইলেন পূর্বদিকে, রুদ্র ও বসুগণ দক্ষিণদিকে, আদিত্যগণ পশ্চিমদিকে, আর অশ্বিনীকুমার দুইভাই উত্তরদিকে।
তারপর নয়জন যক্ষ আসিয়া গরুড়কে আক্রমণ করিয়াছিল। তাহারা মারা গেলে, আর কেহ যুদ্ধ করিতে আসিল না।
তখন গরুড় অমৃতের কাছে আসিয়া দেখিল যে, উহা ভয়ঙ্কর আগুন দিয়া ঘেরা; সেই আগুনের শিখায় আকাশ ছাইয়া গিয়াছে।
গরুড় যেমন ইচ্ছা তেমনই চেহারা করিতে পারিত। সুতরাং সেই আগুন নিভইবার জন্য সে, তাহার একটা মাথার জায়গায়, আট হাজার একশতটা মাথা করিয়া ফেলিল। সেই আট হাজার একশত মুখে জল আনিয়া আগুনেব উপরে ঢালিলে, আর তাহা নিভিতে অধিক বিলম্ব হইল না।
আগুন নিভিলে দেখা গেল যে, একখানি ক্ষুরের মত ধারালো লোহার চাকা বনবন করিয়া অমৃতের উপর ঘুরিতেছে। অমৃতের নিকট চোর আসিলেই সেই চাকায় তাহার গলা কাটিয়া যায়।
সৌভাগ্যের বিষয়, সেই চাকার মাঝখানে একটা ছিদ্র ছিল, গরুড় সেই ছিদ্র দেখিবামাত্র, মৌমাছির মত ছোট হইয়া, তাহার ভিতর দিয়া ঢুকিয়া পড়িল! ঢুকিয়া তাহার বিপদ বাড়িল কি কমিল, তাহা বলা ভারি শক্ত। সেই চাকার নীচেই এমন ভয়ঙ্কর দুইটা সাপ ছিল যে, তাহাদের মুখ দিয়া আগুন আর চোখ দিয়া ক্রমাগত বিষ বাহির হইতেছিল। তাহারা একটিবার কাহারও পানে তাকাইলেই সে ভস্ম হইয়া যাইত। কিন্তু গরুড় তাহাদিগকে তাকাইবার অবসর দিলে ত! সে তাহার পূর্বেই ধূলা দিয়া ও তাহাদিগকে অন্ধ করিয়া দিয়াছিল। ধূলার কাছে সাপেরা নাকি বড়ই জব্দ থাকেন! বাছাদের চক্ষে পলক পড়ে না, কাজেই চক্ষে ধূলা ছুঁড়িয়া মারিলেই তাঁহাদের সর্বনাশ উপস্থিত হয়।
গরুড় যেই দেখিল যে, সাপগুলি তাহাদের চোখ লইয়া বিপদে পড়িয়াছে, অমনি সে তাহাদিগকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল। তখন আর তাহার অমৃত লইয়া যাইতে কোন বাধা রহিল না।
গরুড় অমৃত লইয়া আকাশে ছুটিয়া চলিয়াছে, এমন সময়ে নারায়ণের সহিত তাহার দেখা হইল। নারায়ণ তাহার বীরত্ব দেখিয়া অতিশয় সস্তুষ্ট হইয়াছিলেন, সুতরাং তিনি তাহাকে বলিলেন, “তুমি আমার নিকট বর লও, আমি তোমাকে বর দিব।”
এ কথায় গরুড় বলিল, “আমি অমর হইতে, আর তোমার চেয়ে উঁচুতে থাকিতে চাহি; আমাকে সেই বর দাও।”
নারায়ণ বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে।”
তারপর গরুড় নারায়ণকে বলিল, “তোমাকেও আমার বড় ভাল লাগিয়াছে, তাই আমিও তোমাকে বর দিব। তুমি কি বর চাহ?”
নারায়ণ বলিলেন, “তুমি আমার বাহন (যে জন্তুর উপরে চড়িয়া চলাফেরা করা যায়) হইলে বেশ সুবিধা হইত। কিন্তু তোমাকে যে বর দিয়াছি, তাহাতে আর তোমার উপরে চড়িবার উপায় থাকে না; কাজেই তুমি আমার রথের চূড়ায় বসিয়া থাকিবে, আর জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে যে, তুমি আমার বাহন।”
গরুড় বলিল, “তথাস্তু। (তাই হোক)”
এই বলিয়া সে সবেমাত্র অমৃত লইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, এমন সময় ইন্দ্র তাহাকে বধ করিবার জন্য বজ্র ছুঁড়িয়া মারিলেন। কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুই হইল না। তখন সে মনে ভাবিল যে “এত বড় একটা অস্ত্র, এতবড় মুনির হাড় দিয়া তাহা প্রস্তুত হইয়াছে, আর জগতে তাহার এত বড় নাম। এমন একটা অস্ত্র বৃথা হইলে ত বড় লজ্জার কথা হয়। সুতরাং ইহার জন্য আমার কিছু ক্ষতি হওয়া উচিত হইতেছে।”
এই ভাবিয়া সে তাহার শরীর হইতে একখানি পালক ফেলিয়া দিয়া, ইন্দ্রকে বলিল, “এই নিন। আপনার অস্ত্রের মান রাখিয়া গেলাম।”
ইন্দ্র ত তাহা দেখিয়া একেবাবে অবাক। তিনি তখন গরুড়ের সহিত বন্ধুতা করিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। তাহা দেখিয়া গরুড়ও তাঁহার উপর খুব সস্তুষ্ট হইল।
তখন ইন্দ্র বলিলেন, “ভাই অমৃত যাহারা খাইবে তাহারাই অমর হইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করিবে। তোমার যদি উহাতে প্রয়োজন না থাকে তবে উহা আমাকে দিয়া যাও।”
গরুড় বলিল, “আমার বিশেষ প্রযোজন আছে, সুতরাং ইহা আমি কিছুতেই দিতে পারিতেছি না। কিন্তু আমি যেখানে ইহা রাখিব সেখান হইতে তখনই আপনি ইহা লইয়া আসিতে পারিবেন।”
ইহাতে ইন্দ্র যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়া গরুড়কে বর দিতে চাহিলে সে বলিল, “সর্পগণ আমার মাতকে বড়ই কষ্ট দিয়াছে, সুতরাং আমাকে এই বর দিন যে সাপেরা আমার খাদ্য হইবে, তাহাদের বিষে আমার কিছুই হইবে না।”
ইন্দ্র বললেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে। এখন তুমি অমৃত লইয়া যাও। তুমি উহা রাখিয়া দিবা মাত্র আমি তাহা লইয়া আসিব।”
এই বলিয়া ইন্দ্র গরুড়কে বিদায় দিলে সে অমৃতসহ তৎক্ষণাৎ সর্পগণের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল—
“এই দেখ আমি অমৃত আনিয়াছি আমি উহা কুশের (সেই যাহাতে কুশাসন হয়) উপর রাখিয়া দিলাম, তোমরা মনে করিয়া আহ্নিক সারিয়া আসিয়া উহা আহার কর।”
তারপর সে বলিল, “তোমরা যাহা বলিয়াছিলে, আমি তাহা করিয়াছি সুতরাং এখন হইতে আর আমার মা তোমাদের দাসী থাকিলেন না।”
নাগগণ ইহাতে সম্মত হইয়া স্নান করিতে গেল, আর সেই অবসরে ইন্দ্রও আসিয়া কুশের উপর হইতে অমৃত লইয়া পলায়ন করিলেন।
সর্পগণ সেদিন খুবই আনন্দের সহিত, আর হয়ত খুব তাড়াতাড়ি স্নান আর পূজা শেষ করিয়াছিল। কিন্তু হায়! ফিরিয়া আসিয়া তাহারা দেখিল অমৃত নাই, খালি কুশ পড়িয়া রহিয়াছে। তখন তাহারা ভাবিল, “আর দুঃখ করিয়া কি হইবে? আমরা যেমন ছল করিয়া বিনতাকে দাসী করিয়াছিলাম, তেমনি ছল করিয়া আমাদের নিকট হইতে অমৃত লইয়া গিয়াছে।”
তারপর, “আহা! এই কুশের উপর অমৃত রাখিয়াছিল গো” বলিয়া তাহারা সেই কুশ চাটিতে লাগিল। চাটিতে চাটিতে কুশের ধারে তাহাদের জিব চিরিয়া দুইভাগ হইয়া গেল। তাই আজও সাপের জিব চেরা দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপে মাতাকে সর্পগণের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া গরুড় মনের আনন্দে সাপ ধরিয়া খাইতে আরম্ভ করিল। তখন আর তাহার পেট ভরিবার জন্য কোন চিন্তা রহিল না, পৃথিবীর লোকেরও বোধহয় তাহাতে সাপের ভয় অনেকটা কমিয়া থাকিবে।