উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/জুতা আর ছাতার জন্ম

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

জুতা আর ছাতার জন্ম

 বহুকাল পূর্বে, একদিন জ্যৈষ্ঠ মাসের সকাল বেলায়, এই আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়াছিল।

 জমদগ্নি মুনি তীর ছুঁড়িতেছে, রেণুকা তাহা কুড়াইয়া আনিতেছেন, মুনি ভাবিতেছেন, এ খেলার বড়ই আমোদ;তাই আজ আর তাঁহার অন্য কাজের কথা মনে নাই, তিনি ক্রমাগত খালি তীরের উপর তীরই ছুঁড়িতেছেন। এদিকে বেলা যে ঢের হইযাছে, রোদে যে তালু ফাটিয়া গেল, মাটি যে তাতিয়া আগুন, সে কথা কে ভাবে? মুনির আজ তীর ছুঁড়িয়া বড়ই ভাল লাগিয়াছে।

 বেচারী রেণুকা একেবারে সারা হইয়া গেলেন, তাঁহাব মাথা ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে, পায় ফোস্কা হইয়াছে, প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু মুনির সেদিকে দৃষ্টি নাই। তাঁহার আজ বড়ই আমোদ হইয়াছে, তাই তিনি খালি তীরই ছুঁড়িতেছে, আর বলিতেছেন, “রেণুকা শীঘ্র আন! দেরি করিতেছ কেন?”

 কিন্তু রেণুকা আর পারেন না। একটু ছায়ায় দাঁড়াইয়া বিশ্রাম না করিলে এখনই হয়ত তাঁহার প্রাণ যাইবে। তাই তিনি মুহূর্ত কালের জন্য একটি গাছের তলায় দাঁড়াইলেন, তাহার পরের মুহূর্তেই ছুটিয়া মুনির কাছে উপস্থিত হইলেন।

 ইহাতেই মুনির রাগের সীমা নাই। তিনি ভূকুটি করিয়া বলিলেন, “এত বিলম্ব হইল কেন?

 রেণুকা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, নিতান্ত কষ্টের সহিত বলিলেন, “বড় রোদ। মাথা জ্বলিয়া গেল। একটু গাছতলায় দাঁড়াইযাছিলাম!”

 তখন মুনির চৈতন্য হইল। তিনি দেখিলেন, সত্য সত্যই রেণুকা রৌদ্রে নিতান্ত কাতর হইয়াছে। তাঁহার শরীর কাঁপিতেছে, তিনি আর দাঁড়াইতে পারেন না। মুনি একবার রেণুকার সেই অবস্থার দিকে, আর একবার সূর্যের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তারপর দুই চক্ষু লাল করিয়া বিষম ভ্রুকুটির সহিত তীর ধনুক উঠাইয়া সূর্যকে বলিলেন, “বটে, তোমার এতই আস্পর্ধা! তুমি রেণুকাকে কষ্ট দিয়াছ! দাঁড়াও! তোমাকে দেখাইতেছি!”

 সূর্য ত তখন, “বাপ রে! মারিল রে!” বলিয়া কাঁদিয়া অস্থির! তিনি তাড়াতাড়ি এক ব্রাহ্মণের বেশে জমদগ্নির নিকট আসিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন! সূর্য আপনার নিকট কি দোষ করিল? তাহার তেজ ভিন্ন ফল শস্য কিছুই থাকিতে পারে না, তাই এ সময়ে তাহার একটু গরম না হইলে চলিবে কেন?

 তাহার জন্য কি তাহাকে মারিতে হয়? আর তাহাকে মারিবেনই বা কিরূপে? সে যে আকাশে ছুটাছুটি করিয়া বেড়ায়!”

 জমদগ্নি ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “যাও বাপু! তোমার চালাকি করিতে হইবেনা। আমি টের পাইয়াছি, তুমি কে। আমি বেশ জানি, দুপুর বেলায় মাথার উপর আসিয়া তোমাকে দাঁড়াইতে হয়, সেই সময় আমি তীর মারিয়া তোমাকে কানা করিব।”

 তখন সূর্য অতিশয় ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “দোহাই মুনিঠাকুর! আমার ঘাট হইয়াছে, আমাকে ক্ষমা করুন।”

 সেকালের মুনিরা চট করিযাই ক্ষেপিয়া যাইতেন, আবার হাত জোড় করিলেই ঠাণ্ডা হইতেন! সূর্যের কথায় জন্মদগ্নি মুনি তুষ্ট হইয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আচ্ছা ঠাকুর, সে হইবে এখন। কিন্তু আমাব পত্নী যাহাতে তোমার তেজে কষ্ট না পায়, আগে তাহার একটা উপায় কর।”

 এ কথায় সূর্য তাঁহার চাদরের ভিতর হইতে একটি ছাতা আর এক জোড়া জুতা বাহির করিয়া জমদগ্নিকে দিলেন। ইহার পূর্বে আর এমন আশ্চর্য জিনিস কেহ কখনো দেখে নাই। মুনিঠাকুর তাহা হাতে লইয়া অপার বিস্ময় এবং কৌতূহলের সহিত, অনেকবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ-বল অস্ত্র দিয়া কি করিতে হয়?”

 সূর্য বলিলেন, “এই জিনিসটার নাম ছাতা,ইহাকে এমনি করিয়া মাথায় ধরিতে হইবে। আর, এই দুখানির নাম জুতা,ইহাকে এমনি করিয়া পায় পরিতে হইবে।” এই বলিয়া সূর্য চলিয়া গেলেন; রেণুকাও তখন হইতে রৌদ্রের কষ্ট হইতে রক্ষা পাইলেন। সেই অবধি লোকে জুতা পরিতে আর ছাতা মাথায় দিতে শিখিল।