উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/ডাকাত ব্রাহ্মণ ও ধার্মিক বক

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ডাকাত ব্রাহ্মণ ও ধার্মিক বক

 প্রাচীনকালে গৌতম নামে এক অতি মুর্খ ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ ছিল। সে দেশে দেশে ভিক্ষা করিয়া বেড়াইত। ভিক্ষা করিতে করিতে, সে উত্তর দেশে এক ডাকাতের বাড়িতে উপস্থিত হইয়া দেখিল যে, সেই ডাকাত তাহার লোক জনকে বড়ই সুখে রাখিয়াছে। খাওয়ায় পরায়, আমোদ আহ্লাদে তাহাদের সৌভাগ্যের আর সীমা নাই।

 ব্রাহ্মণ সেই ডাকাতের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, “আমাকে বাড়িঘর দাও, আর এক বৎসরের খোরাক দাও; আমি তোমার গ্রামে বাস করিব।”

 ডাকাত বলিল, “ঠাকুর, আপনার বড়ই দয়া!” সে তখনই বাড়ি, ঘর, খোরাক, পোশাক দিয়া ব্রাহ্মণকে পরম আদরে তাহার গ্রামে রাখিয়া দিল।

 তারপর দিন যায়, মাস যায়, গৌতম ঠাকুরের আর ডাকাতের বাড়ি ছড়িতে ইচ্ছা হয় না। তাহার মনে হইল যে, সন্ধ্যা তর্পণে বড়ই কষ্ট, ভিক্ষা করাও নিতান্ত নির্বোধের কাজ। সুতরাং ভিক্ষা করিয়া কেন মরিব? তাহা হইতে হয়ত ডাকাত হওয়াই ভাল!

 অল্পদিনের ভিতরেই সেই ব্রাহ্মণ ডাকাতের মেয়ে বিবাহ করিয়া, তীর ধনুক শিখিয়া, বিকট চেহারা করিয়া, মস্ত ডাকাত হইয়া গেল, তাহার মত শিকার করিতে কেহই পারিত না। যখন ডাকাতি করিতে না যাইত, তখন কেবল পাখি মারিয়াই সময় কাটাইত।

 গৌতমের এক পরম ধার্মিক এবং পণ্ডিত ব্রহ্মচারী বন্ধু ছিলেন। সেই বন্ধু অনেকদিন গৌতমের কোন সংবাদ না পাইয়া, দেশে দেশে তাহার সন্ধান করিতে করিতে, দস্যুদিগের গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 সেখানে আসিয়া সেই ধার্মিক তপস্বী দেখিলেন যে, তাহার ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধু মরা  হাঁসের ভার কাঁধে করিয়া, ডাকাতের বেশে পথ দিয়া চলিয়াছে। তাহাতে তিনি নিতান্ত আশ্চর্য এবং দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “ভাই, তুমি ব্রাহ্মণ ছিলে, আর তোমার এই দুর্দশা। তুমি কোন কুলে জন্মিয়াছ তাহা কি তোমার মনে নাই। শীঘ্র এ স্থান পরিত্যাগ কর।”

 এ কথায় গৌতমের যার পর নাই অনুতাপ হওয়াতে, সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “ভাই, আমি অতিশয় মুখ আর দরিদ্র ছিলাম, তাই লোভে পড়িয়া আমার এমন দশা হইয়াছে। আমার ভাগ্যের জোরে যদি তুমি আসিয়াছ তবে দয়া করিয়া একটি রাত আমার বাড়িতে থাক। কাল সকালে আমরা দুজনেই এখান হইতে চলিয়া যাইব।”

 গৌতমের কথায় তপস্বী, সেই রাত্রির জন্য তাহার বাড়িতে থাকিতে সম্মত হইলেন। কিন্তু তিনি ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হইয়াও সেই অপবিত্র স্থানে এক বিন্দু জল পর্যন্ত খাইলেন না। রাত্রি প্রভাত হইবামাত্র তিনি সে স্থান ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

 তাহার কিঞ্চিৎ পরে, গৌতমও বাড়ি হইতে বাহির হইয়া সমুদ্রের দিকে যাত্রা করিল, এবং সেই পথে একদল বণিককে যাইতে দেখিয়া, তাহাদের সঙ্গে জুটিয়া পড়িল।

 তারপর তাহারা খানিক দূর চলিয়া, যেই একটা পর্বতের গুহার নিকট উপস্থিত হইয়াছে, অমনি একটি প্রকাণ্ড হাতি ঘোরতর গর্জনে আসিয়া সেই বণিকদিগকে আক্রমণ করিল। গৌতম তখন প্রাণের ভয়ে, বনের ভিতর দিয়া উত্তর দিক পানে উর্ধশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। সে এইরূপে কতদুর পর্যন্ত যে ছুটিয়া গেল, তাহা তখন তাহার ভাবিয়া দেখিবার অবসর ছিল না। কিন্তু অনেকক্ষণ ছুটির পর তাহার মনে হইল যে, সে একটি সুন্দর স্থানে উপস্থিত হইয়াছে। এমন স্থান গৌতম তাহার জীবনে আর কখনো চক্ষে দেখে নাই। সেখানকার গাছপালা যেমন আশ্চর্য, পাখির গান তেমনি মিষ্ট। এ-সকল দেখিয়া শুনিয়া, গৌতমের বড়ই আশ্চর্য বোধ হইল, কিন্তু সে তথাপি দুটিতেই লাগিল। ডালে বসিয়া আশ্চর্য পাখিগণ গান করিতেছে, তাহাদের মানুষের মত মুখ; সেই অদ্ভুত পাখির দিকে চাহিয়া দেখিবার জন্যও গৌতম একটিবার দাঁড়াইল না। বন ছাড়িয়া শেষে সে মাঠে আসিয়া পড়িল। সে মাঠে বালি সোনার। সেই আশ্চর্য বালির দিকেও সে একবার চাহিয়া দেখিল না।

 এমনি করিয়া ঊর্ধশাসে ছুটিতে ছুটতে শেষে সে এক প্রকাণ্ড বটগাছের নীচে আসিবামাত্র, এমন সুন্দর একটি গন্ধ তাহার নাকে আসিয়া প্রবেশ করিল যে, সে আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না। সেই গায়ে গোড়ায় চন্দনের জল ছড়ান ছিল, আর অতি সুশীতল সুগন্ধি বায়ু সেই স্থান দিয়া ধীরে ধীরে বহিতেছিল। তখন গৌতমের মনে হইল যে, তাহার অতিশয় পরিশ্রম হইয়াছে। সুতরাং সে সেই পরিস্কার সুগন্ধি বটতলায় শুইয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল।

 গৌতম অনেকক্ষণ বিশ্রাম করিল। তখন বেলা অল্পই ছিল; ক্রমে সন্ধ্যা হইল। তখন গৌতম দেখিল যে, একটি অতি সুন্দর বক পক্ষী সেই গাছে আসিয়া বসিয়াছে। সেই বকের নাম নাড়ীজঙ্ঘ; সে কশ্যপের পুত্র, ব্রহ্মার বন্ধু। তাহার আর একটি নাম রাজধর্ম।

 গৌতম সেই পক্ষীর দেবতার ন্যায় অপরূপ উজল দেহ আর আশ্চর্য অলঙ্কারসকল দেখিয়া কিছুকাল অবাক হইয়া রহিল। কিন্তু সে সময়ে তাহার যার পর নাই ক্ষুধা হওয়াতে, সে তখনই আবার তাহাকে ধরিয়া খাইবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। এমন সময় পক্ষীটি তাহাকে বলিল “মহাশয়! আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, আপনি আমার বাড়িতে অতিথি হইয়াছেন। এখন সন্ধ্যা হইয়াছে সুতরাং আজ আমার এখানেই আহার এবং বিশ্রাম করুন।  কাল প্রাতে যেখানে ইচ্ছা হয়, যাইবেন।”

 এই বলিয়া, গৌতমের জন্য লাল ফুলের অতি সুন্দর শয্যা প্রস্তুত করিয়া দিয়া, সে গঙ্গায় মাছ ধরিতে গেল। এবং অল্প কালের ভিতরেই নানারূপ সুমিষ্ট মাছ আনিয়া তাহাকে পরিতোষ পূর্বক আহার করাইল। আহারের পর সে গৌতমকে, নিজের ডানার বাতাসে শীতল করিয়া, অতি মধুর স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে? আপনার কি নাম?”

 গৌতম বলিল, “আমি ব্রাহ্মণ, আমার নাম গৌতম।”

 বক বলিল, “আপনি কিজন্য এখানে আসিয়াছেন?”

 গৌতম বলিল, “পাখি, আমি নিতান্ত দীনহীন, ধন পাইবার আশায় সমুদ্রে চলিয়াছি।”

 বক বলিল, “সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই, এখন আমার সহিত আপনার বন্ধুত্ব হইল; আপনি যাহাতে অনেক ধন পান, আমি তাহাব উপায় করিয়া দিব।”

 এ কথায় গৌতম অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া সুখে নিদ্রা গেল। পরদিন প্রভাতে রাজধর্ম তাহাকে একটি পথ দেখাইয়া দিয়া বলিল, “এই পথে তিন যোজন গেলে আপনি আমার পরম বন্ধু রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষের দেখা পাইবেন। তাহার নিকট গেলে আর আপনার ধনের ভাবনা থাকিবে না।

 গৌতম সেই পথে চলিতে চলিতে, মেরুব্রজ নামক নগরে উপস্থিত হইল, উহাই রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষের রাজধানী। গৌতম সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র, দরোয়ান বিরূপাক্ষের নিকট সংবাদ দিতে গেল, এবং খানিক পরেই ছুটিয়া আসিয়া বলিল, “আপনি শীঘ্র চলুন, রাজা আপনাকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন।”

 গৌতম মেকব্রজ নগরে পৌছিবার পূর্বেই রাজধর্ম বিরূপাক্ষকে তাহার সংবাদ দিয়াছিল। সুবাং সেখানে গিয়া তাহার সমাদরের কোন ত্রুটি হইল না। বিরূপাক্ষ অতিশয় ধীর এবং বুদ্ধিমান্ লোক ছিলেন, ধার্মিক বিদ্বান ব্রাহ্মণকে যেমন কথা জিজ্ঞাসা করিতে হয়, গৌতমকেও তিনি সেইরূপে, তপস্যার কথা, বেদাধ্যায়নের কথা, ব্রহ্মচর্যের কথা, এই-সব জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। গৌতম মূর্খ মানুষ, সে তাহার কি উত্তর দিবে? সে নিতান্ত লজ্জিত হইয়া কেবল বলিল, “আমি ব্রাহ্মণ!”

 তাহা শুনিয়া বিরূপাক্ষ আবার বলিলেন, “আপনার কোন ভয় নাই। আপনি যথার্থ বলুন, আপনার বাড়ি কোথায়, কোন বংশে জন্মিয়াছে, আর কোথায় বিবাহ করিয়াছে,?”

 গৌতম বলিল, “মহারাজ, আমার জন্মস্থান মধ্যদেশে, এখন আমি কিরাতগণের দেশে বাস করি, আর শুদ্রের কন্যা বিবাহ করিয়াছি।”

 বিরূপাক্ষ দেখিলেন, এ ব্রাহ্মণ নিতান্ত অধম, দানের উপযুক্ত পাত্র নহে। তথাপি তিনি মনে করিলেন যে, যা হোক, এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণ ত বটে;আর আমার বন্ধু রাজধর্ম ইহাকে পাঠাইয়াছে। সুতরাং তিনি যাহাতে সন্তুষ্ট হন, তাহাই করিতে হইবে। আজ কার্তিকমাসের পূর্ণিমা, আজ আমি সহস্র ব্রাহ্মণকে সুবর্ণদান করিব। সেই উপলক্ষে ইহাকেও সন্তুষ্ট করিয়া দেওয়া যাইবে।

 ইহার একটু পরেই নানাদিকে হইতে মহামান্য দেবতুল্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ রাজসভায় উপস্থিত হইতে লাগিলেন। তাঁহারা সভা বসিলে সে স্থানের অতি অপরূপ শোভা হইল। রাজার কথায় গৌতমও নিতান্ত জড়সড় হইয়া তাঁহাদের এক পাশে গিয়া বসিল! রাজা তাঁহাদের প্রত্যেককে রাশি রাশি ধনরত্ন দান করিয়া, বিনয়ের সহিত বলিলেন, “ঠাকুর

উপেন্দ্র—৮২ মহাশয়েরা কেবল আজিকার দিনটির জন্য আমার রাক্ষসেরা মানুষ খাওয়া বন্ধ করিয়াছে। সুতরাং আপনারা আপনাদের ধনরত্ন লইয়া যত শীঘ্র পারেন, প্রস্থান করুন; বিলম্ব হইলে বিপদ হইতে পারে!”

 এ কথা শুনিয়া ঠাকুর মহাশয়েরা আর তিলার্ধও তথায় অপেক্ষা করিলেন না। নিজ নিজ সম্পত্তি পুটুলি বাঁধিয়া, তাহারা সকলেই যার পর নাই ব্যস্তভাবে প্রস্থান করিলেন। গৌতম তাহার অতিশয় প্রকাণ্ড পুঁটুলিটি মাথায় করিয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে যখন সেই বটগাছের তলায় আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন প্রায় সন্ধ্যাকাল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর পরিশ্রমে, তখন আর তাহার এক পাও চলিবার শক্তি ছিল না।

 সেই গাছের তলায় পুটুলিটি রাখিয়া গৌতম বিশ্রাম করিতেছে, এমন সময় রাজধর্মও সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং তাকে ক্লান্ত দেখিয়া ব্যস্তভাবে নিজের ডানা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। তাহাতে সে একটু শান্ত হইলেই, রাজধর্ম তাড়াতাড়ি ভাল ভাল মাছ আনিয়া তাহাকে পেট ভরিয়া আহার করাইল।

 বকের সেবায় খুব আরাম পাইয়া দুষ্ট ব্রাহ্মণ ভাবিল যে, এরপর আমাকে অনেক দূর যাইতে হইবে, অর তত দূর এই প্রকাণ্ড পুঁটুলি বহিয়া নিতে খুব পরিশ্রম আর ক্ষুধাও হইবে। তখন কি খাইব?’ এই ভাবিয়া দুরাত্মা বারবার বকের দিকে তাকাইতে লাগিল, আর মনে করিল যে, এই পাখিটার গায় ঢের মাংস, আর, বোধহয় যেন তাহা খাইতে বড়ই ভাল লাগিবে। ইহাকে মারিয়া সঙ্গে লইলে আর আমার খাবারের ভাবনা থাকিবে না।

 রাজধর্ম তখন নিদ্রা যাইতেছিল। পাপিষ্ঠ ডাকাত সেই সুযোগে তাহাকে বধ করিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার পালক ছড়াইয়া আগুনে পোড়াইতে লাগিল। তারপর তাহাকে পুটুলিতে বাঁধিয়া, নিতান্ত আহ্লাদের সহিত সেখান হইতে প্রস্থান করিল।

 রাজধর্ম প্রতিদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া ব্রহ্মাকে প্রণাম করিতে যাইত্ত এবং প্রতিদিন ব্রহ্মার নিকট হইতে ফিরিবার সময় বিরূপাক্ষের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিত। ইহার পর আর সে বিরূপাক্ষের নিকট গেল না। বিরূপাক্ষ তাহাকে দেখিতে না পাইয়া, পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন, “আজ কেন বন্ধু রাজধর্ম আসিল না? তাহার জন্য আমার মন বড়ই ব্যাকুল হইয়াছে সেই অপদার্থ মূর্খ ব্রাহ্মণ তাহাকে বধ করে নাই ত? ঐ দুষ্টকে দেখিয়াই তাহাকে ডাকাত বলিয়া বোধ হইয়াছিল। তুমি শীঘ্র রাজধর্মের নিকট গিয়া তাহার সংবাদ জানিয়া আইস।”

 রাজপুত্র অনেক রাক্ষসের সহিত তখনই রাজধর্মের বাড়িতে গিয়া দেখিলেন যে, সে সেখানেই নাই, আর গায়ের তলায় তাহার পালকসকল পড়িয়া আছে। তাহা দেখিয়া রাক্ষসেরা চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে, তখনই ক্রোধ ভরে সেই দুষ্ট দস্যুকে ধরিবার জন্য ছুটিয়া চলিল। দুষ্ট ততক্ষণে অনেক দূর চলিয়া গিয়াছিল, কিন্তু তাই বলিয়া রাক্ষসেরা তাহাকে ধরিয়া, পুটুলি খুলিয়া যেই তাহার ভিতরে রাজধর্মের দেহ দেখিতে পাইল, অমনি চুলের মুঠি ধরিয়া, তাহাকে একেবারে বিরূপাক্ষের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল।

 বন্ধুর মৃতদেহ দেখিয়া বিরূপাক্ষের দুঃখের সীমা রহিল না। তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে মেরুব্রজ নগরের সকল লোক, সেই সরল হৃদয় সুন্দর পক্ষীটির জন্য কাঁদিয়া অস্থির হইল। তখন বিরূপাক্ষ অনেক কষ্টে চোখের জল মুছিয়া রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “এই দুরাত্মা ব্রাহ্মণকে এখনই বধ। রাক্ষসেরা ইহার মাংস ভক্ষণ করুক।”

 রাজ-আজ্ঞায় রাক্ষসগণ অতি ভীষণ পট্টিশের আঘাতে সেই দুরাত্মার দেহ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিল;কিন্তু এমন মহাপাপীর মাংস খাইতে তাহারা কিছুতেই সম্মত হইল না। রাজা তখন নিতান্ত নীচাশয় মানুষখেকো দস্যুদিগকে ডাকিয়া, সেই মাংস খাইতে বলিলেন। কিন্তু তাহারাও সেই দুরাচারের জঘন্য মাংস খাইতে মুখ সিটকাইয়া অস্বীকার করিল।

 তারপর সুগন্ধি কাঠের সুসজ্জিত চিতা প্রস্তুত করিয়া, সকলে অতিশয় যত্ন ও স্নেস্ত্রে সহিত রাজধর্মের দেহ দাহ করিতে আরম্ভ করিলে, সেই বকের মাতা সুরভি স্বর্গ হইতে ঠিক সেই চিতায় উপরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার মুখ হইতে ক্রমাগত অমৃত তুল্য দুগ্ধ এবং ফেনা বাহির হইতেছিল। সেই ফেনা বকের শরীরে পড়িবামাত্র, সে চিতা হইতে উঠিয়া বিরূপাক্ষের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল!

 তখন সকলের আর আনন্দের সীমা কি? দেবতারা পর্যন্ত আনন্দ করিতে আসিয়া বিরূপাক্ষকে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন। সেই সময়ে ইন্দ্র বলিলেন, “ব্রহ্মার সভায় যাইতে অবহেলা করায় তিনি রাজধর্মকে এই বলিয়া সাপ দেন যে, তুমি অতি দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকিবে। এইজন্য আর সুরভির দুগ্ধের ফেনের গুণে, আজ সে মরিয়াও রক্ষা পাইল।”

 রাজধর্ম তখন ইন্দ্রকে প্রণাম করিয়া বিনয়ের সহিত বলিল, “দেবরাজ, আমার প্রতি যদি আপনার দয়া হইয়া থাকে, তবে আমার বন্ধু গৌতমকে আবার বাঁচাইয়া দিন।”

 এ কথায় ইন্দ্র তখনই গৌতমকে বাঁচাইয়া দিলেন বটে, কিন্তু সেই মহাপাপীর আর কিছুতেই ধর্মে মতি হইল না, সুতরাং মৃত্যুর পরে সে নরকে গিয়া তাহার সকল পাপের উচিত পুরস্কার লাভ করিল।