উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/ব্যাধ ও কপোতের কথা
ব্যাধ ও কপোতের কথা
পূর্বকালে এক পাপিষ্ঠ ব্যাধ যমদূতের ন্যায় বনে বনে পাখি ধরিয়া বেড়াইত। তাহার চেহারা যেমন কদাকার এবং ভয়ঙ্কর ছিল, মনও তেমনি নিষ্ঠুর ছিল। নিরপরাধ পাখিগুলিকে বধ করিয়া বাজারে বিক্রয় করা ভিন্ন, তাহার আর কোন কাজ ছিল না।
একদিন সেই ব্যাধ, জাল এবং তীর ধনুক হাতে বনে বনে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, এমন সময় আকাশ অন্ধকার করিয়া ঘোরতর শব্দে ঝড় বৃষ্টি আরম্ভ হইল। তারপর দেখিতে দেখিতে চারিদিক জলে ভাসিয়া গেল। আর বড় বড় গাছ ক্রমাগত ভাঙিয়া পড়াতে, বনের বড়ই ভয়ানক অবস্থা হইল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রি আসিয়া উপস্থিত হওয়ায়, ব্যাধের কষ্ট আর দুর্দশার অবধি রহিল না। সে জলে ভিজিয়া, শীতে কাঁপিয়া, ঝড়ে নাকাল হইয়া ভাবিতে লাগিল, “হায়! হায়! কোথায় পথ, কোথায় ঘাট? এখন কি করিয়া প্রাণ বাঁচাই, কি করিয়াই ঘরে ফিরি?”
কিন্তু এই দুঃখের সময়েও তাহার দুষ্ট বুদ্ধি তাহাকে ছাড়ে নাই। সেই অন্ধকারের ভিতরে হাতড়াইয়া বেড়াইতে বেড়াইতে সে দেখিল, একটি পায়রা জলে ভিজিয়া আর শীতে আড়ষ্ট হইয়া মাটিতে পড়িয়া আছে। অমনি সেই দুষ্ট তাহার নিজের দুর্গতি ভুলিয়া গিয়া, পায়রাটিকে ধরিয়া খাঁচায় পুরিল।
ক্রমে ঝড় বৃষ্টি থামিয়া আকাশ পরিষ্কার হইল, কিন্তু সেই ঘোর রাত্রিতে ব্যাধের আর ফিরিবার শক্তি রহিল না। তখন সে নিকটে একটা প্রকাণ্ড গাছ দেখিতে পাইয়া, তাহার তলাতেই রাত কাটাইবার আয়োজন করিল।
সেই গাছে একটি পায়রা আর একটি পায়রী তাহাদের সুহৃদ স্বজন লইয়া সুখে বাস করিত, সেদিন সকালে পায়রীটি খাবার খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল, তাহার পর আর ঘরে ফিরে নাই। তাই পায়রাটি তাহার জন্য কাঁদিতে কাঁদিতে, এই বলিয়া দুঃখ করিতেছিল যে, হয়। আমার প্রিয় পায়রী ত এখনো ঘরে ফিরিল না। না জানি এই ভয়ঙ্কর ঝড়ে তাহার কি বিপদ হইয়াছে! আহা! তাহার কি সুন্দর রাঙা চোখ, আর খুরখুরে পা দুখানি ছিল। আর তাহার কথা আমার কি মিষ্ট লাগিত। আমি রাগ করিলে সে কি স্নেহের সহিত আমাকে শান্ত করিত! তাহাকে হারাইয়া আমি কেমন করিয়া বাঁচিব? সে জানিত না যে, তাহার পায়রী সেই গাছের তলাতেই, ব্যাধের হাতে পড়িয়া ঠিক এমনি করিয়া তাহার কথা ভাবিতেছে।
পায়রার কথা শুনিয়া পায়রী এই বিপদের ভিতরেও একটু আনন্দিত হইল, এবং সে সেই পিঞ্জরের ভিতর ইতেই তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “ওগো! তুমি আমার জন্য দুঃখ করিও না। এই লোকটি শীতে আর ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়াছে, ইহার দুঃখ দূর করাই হইতেছে এখন আমাদের প্রধান কাজ।
তখন পায়রা ভাবিল, তাইত! এই ব্যাধ এখন আমার অতিথি। ইহার সেবা করা আমার কর্তব্য! এই মনে করিয়া সে ব্যাধকে বলিল, ‘মহাশয়। আপনি যাহাই করিয়া থাকুন, আপনি আমাদের অতিথি—আপনার সেবা করাই আমাদের ধর্ম। এখন বলুন, আপনার জন্য আমি কি করিতে পারি।
এ কথায় ব্যাধ নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া বলিল, “বাপু! আমি শীতে বড়ই কষ্ট পাইতেছি। আমার এই কষ্ট যদি দূর করিতে পার, তবে আমার বড় উপকার হয়।”
পায়রা তখনই শুকনো পাতা কুড়াইতে গেল, এবং দেখিতে দেখিতে অনেকগুলি পাতা আনিয়া উপস্থিত করিল।
তারপর দেখা গেল যে, কোথা হইতে এক টুকরা জ্বলন্ত কয়লা ঠোটে করিয়া লইয়া আসিয়াছে। কয়ালাখানি পাতার ভিতরে খুঁজিয়া পায়রা তাহার পাখা দিয়া একটু বাতাস করিতেই, দপ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সেই আগুনের তাপে যর পর নাই আরাম পাইয়া, ব্যাধ বলিল, “আঃ বাঁচিলাম। কিন্তু আমার বড় ক্ষুধা হইয়াছে।”
এ কথায় পায়রা অতিশয় চিন্তিত হইল।
পায়রা যেদিন যাহা দরকার, সেইটুকু মাত্র খাবার খুঁজিয়া আনে;তাহাদের সঞ্চয় করিবার রীতি নাই। কাজেই তখন পায়রার ঘরে কণামাত্রও খাবার জিনিস ছিল না। এখন অতিথিকে সে কি খাইতে দিবে?
খানিক চিন্তা করিয়া সে ব্যাধকে বলিল, “আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আপনার ক্ষুধা দূর করিতেছি।”
এই বলিয়া সে আরো অনেক পাতা আনিয়া খুব বেশি করিয়া আগুন জ্বালিল। তারপর ব্যাধকে বলিল, “মহাশয়, দয়া করিয়া আজ আমাকে আহার করিয়াই আপনার ক্ষুধা দূর করুন।
বলিতে বলিতে সে তিনবার সেই আগুন প্রদক্ষিণ করিয়া, তাহাতে ঝাঁপ দিয়া পড়িল! ব্যাধ এতক্ষণ হতবুদ্ধি হইয়া এই ব্যাপার দেখিতেছিল, পায়রা আগুনে ঝাঁপ দিবামাত্র, সে হায় হায় করিতে করিতে বলিল, “আমি কি করিলাম। আমার মতন মহাপাপী বোধহয় আর ইহ সংসারে নাই। আজ এই পুণ্যবান পক্ষীটি আমাকে বড়ই শিক্ষা দিল। আমি ইচ্ছা করিলে কত সৎকাজ করিতে পারিতাম, তাহার বদলে আমি পাখি মারিয়া বেড়াইতেছি। আমাকে ধিক্ আমার আর বাঁচিয়া কি ফল?”
এই বলিয়া সে সেই পাখিটিকে ছাড়িয়া দিয়া, নিতান্ত বিরক্তভাবে তীর, ধনুক, জাল প্রভৃতি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে প্রস্থান করিল।
এদিকে পায়রী পায়রার শোক সহ্য না করিতে পারিয়া, পিঞ্জর হইতে মুক্তি পাওয়া মাত্র সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াছে। তখন সে সেই আগুনের ভিতর যে আশ্চর্য ব্যাপার দেখিতে পাইল, তাহার কথা বলি, শুন। সে দেখিল, তাহার পায়রা পরম সুন্দর দেহ ধারণ পূর্বক, দিব্য অলঙ্কার, মালা, চন্দন, আর উক্ত বসনের শোভায় সোনার রথ আলো করিয়া বসিয়া আছে আর স্বর্গ হইতে পুণ্যবানেরা আসিয়া তাহার স্তব করিতেছেন। তারপর পায়রীও তাহার সঙ্গে সেই রথে চড়িয়া হাসিতে হাসিতে স্বর্গে চলিয়া গেল।
সেই সময়ে সেই ব্যাধ উপরের দিকে চাহিয়া পায়রা ও পায়রীর সেই সুন্দর রথ দেখিতে পাইয়াছিল। তখন তাহার মনে হইল যে, যে পুণ্য কাজ করিয়া এমন সুখ লাভ করা যায়, এরপর সেই পুণ্য কাজ ভিন্ন আর সে কিছুই করিবে না।
তখন হইতে সেই ব্যাধ পরম ধার্মিক তপস্বী হইল। সে এক মনে এক প্রাণে কেবলই ভগবানের চিন্তা করিয়া বনে বনে ফিরিত। সেই বনের ভিতরে একদিন ভীষণ দাবানল জ্বলিয়া উঠিল। তপস্বী তাহা দেখিয়া ভয়ও পাইল না। পলায়নও করিল না; সে ভগবানের নাম লইয়া হাসিতে হাসিতে সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। তাহার ভক্তিতে তুষ্ট হইয়া দেবতারা তাহাকে পরম আদরের সহিত স্বর্গে গেলেন; সে এককালে ব্যাধ ছিল বলিয়া তাহাকে ঘৃণা করিলেন না।