উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/ধূর্ত শিয়াল
ধূর্ত শিয়াল
এক যে ছিল শিয়াল, তার ছিল চারিজন বন্ধু। এক বন্ধু বাঘ, এক বন্ধু ইঁদুর, এক বন্ধু বৃক (হুড়ার), আর এক বন্ধু নেউল, পাঁচ বন্ধুতে খুব ভাব, তাহারা বনের ভিতরে থাকে আর শিকার ধরিয়া খায়।
সব দিন সমান শিকার মিলে না, কোনদিন ছোট, কোনদিন বড়। ইহার মধ্যে একদিন খুব বড় একটা হরিণ কোথা হইতে সেখানে আসিল। হরিণ দেখিয়া পাঁচ বন্ধুর বড়ই আনন্দ হইল, তাহারা বলিল, “আজ এই হরিণ মারিয়া পেট ভরিয়া খাইব!”
অমনি বাঘ ছুটিল, বৃক ছুটিল, শিয়াল ছুটিল, নেউল ছুটিল। হরিণও তাহাদিগকে দেখিয়া প্রাণের ভয়ে ছুটিতে লাগিল। সে হরিণ ছিল তাহার দলের সর্দার! তাহার গায় আর পায় ভয়ানক জোর। মাথায় তেমনি মস্ত শিং। তাহার সঙ্গে ছুটাছুটি করিয়া পাঁচ বন্ধুর এই লম্বা লম্বা জিব বাহির হইয়া পড়িল, তাহার শিং নাড়া দেখিয়া ভয়ে তাহাদের প্রাণ উড়িয়া গেল!
তখন শিয়াল বলিল, “বাঘ মামা, ওর গায়ে বড় জোর, ওকে অমনি কাবু করিতে পারিবে না। চল, আমরা চুপি চুপি ঝোপের ভিতরে লুকাইয়া থাকি। তারপর যখন হরিণটা ঘুমাইয়া পড়িবে, তখন ইঁদুর গিয়া খ্যাঁচ করিয়া তাহার পায়ের শির কাটিয়া দিবে। তখন আর সে ছুটিতেও পারিবে না, গুঁতাইতেও পারিবে না। তাহা হইলেই আমরা তাহাকে মারিয়া, মনের সুখে পেট ভরিয়া খাইব।”
বাঘ বলিল, “বেশ বলিয়াছ ভাগ্নে, তবে তাহাই হউক।”
বৃক, নেউল, আর ইদুরও একসঙ্গে বলিল, “হাঁ, হাঁ! তবে তাহাই হউক!”
তারপর ইঁদুর ঘুমের ভিতর যেই হরিণের পায়ের শির কাটিয়া দিল, অমনি বাঘ তাহার ঘাড় ভাঙিয়া ফেলিল।
তখন শিয়াল নাচিতে নাচিতে বলিল, “বাঃ! বাঃ! ইদুর বন্ধুর দাঁতে কেমন ধার, আর বাঘ মামার গায়ে কি জোর! এখন সকলে মিলিয়া হরিণটাকে খাইতে হইবে। তোমরা শীঘ্র শীঘ্র স্নান করিয়া আইস, ততক্ষণে আমি এটাকে পাহারা দিই!”
শিয়ালের কথায় আর সকলে স্নান করিতে গেল, আর সে ঘাড় উঁচু করিয়া, কান খাড়া করিয়া, খুব গম্ভীরভাবে বসিয়া যেন কতই পাহারা দিতে লাগিল। খানিক বাদে বাঘ স্নান করিয়া আসিয়া দেখিল, শিয়ালের মুখ বড়ই ভার, যেন সে যার পর নাই ভাবনায় পড়িয়াছে।
তাই সে ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি ভাগ্নে, এত গম্ভীর দেখিতেছি যে, কি ভাবিতেছ?”
শিয়াল বলিল, “আর মামা, সে কথা বলিয়া কাজ কি? আমার মন বড্ড খারাপ হইয়া গিয়াছে। তুমি ত গেলে স্নান করিতে। তখন ইঁদুর হতভাগা বলে কিনা যে, সে নিজেই হরিণ মারিয়াছে তুমি নাকি কিছুই করিতে পার নাই। আর মামা, তোমার নিন্দাটা যে সে করিল, সে আর কি বলিব? এরপর আমার আর এই হরিণ খাইতে ইচ্ছা হইতেছে না।”
এ কথায় বাঘ গর্জন করিয়া বলিল, “বটে? তবে কাজ নাই ভাগ্নে ও হরিণ খাইয়া। আমি এখনই আরো অনেক জন্তু মারিয়া আনিতেছি তাহাই আমরা খাইব।”
এই বলিয়া বাঘ সেখান হইতে চলিয়া গেল, তারপর আসিল ইঁদুর। ইঁদুরকে দেখিয়া শিয়াল খুব গম্ভীরভাবে বলিল, “তাই ত, ভাই একটা কথা যখন হইয়াছে, তখন তোমাকে তাহা না বলা কি ভাল হয়? এইমাত্র বৃক তোমাকে খুঁজিতে গেল। সে বলিয়াছে তাহার নাকি হরিণ খাইতে একটুও ভাল লাগে না, আজ সে ইদুর খাইবে!”
যেই এই কথা শুনা, অমনি, “মাগো! আমার কাজ নাই হরিণ খাইয়া! বলিয়া ইদুর দুই লাফে গর্তের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল!”
ইদুর গর্তে ঢুকিবার একটু পরেই শিয়াল দেখিল, ঐ বৃক আসিতেছে। অমনি সে যার পর নাই ব্যস্ত হইয়া তাহার নিকট গিয়া তাহার কানে কানে বলিল, “ভাই! বড়ই ত মুস্কিল দেখিতেছি। তুমি বাঘকে কি বলিয়াছ? সে দেখিতেছি তোমার উপর চটিয়া একেবারে আগুন। আমি কি তাহাকে থামাইয়া রাখিতে পারি? সে পারিলে যেন আমাকেই ধরিয়া খায়। সে এই মাত্র তোমার খুঁজিতে গেল। এখনই আবার আসিবে।”
তাহা শুনিয়া বৃক বলিল, “সর্বনাশ! তবে আমি এই বেলা পলাই! বাঁচিয়া থাকিলে অনেক হরিণ খাইতে পারিব।” তারপর আর সে সেখানে একটুও দেরি করিল না।
বৃক যাইবামাত্র, শিয়াল তাড়াতাড়ি উঠিয়া সেখানকার মাটিতে বড় বড় আঁচড় কাটিতে লাগিল। তারপর খানিক ধূলায় গড়াগড়ি দিয়া, আর মুখের দুই পাশে অনেক থুথু আর হরিণের রক্ত মাখাইয়া, বিকট ভেংচি মারিয়া বসিয়া রহিল।
নেউল স্নান করিয়া আইয়া দেখে, একি বিষম কাণ্ড! শিয়াল তাহার দিকে খালি আড় চোখে চায়, আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেই দাঁত খিচাইতে থাকে। শেষে সে অনেক মিনতি করিয়া বলিল, “কি হইয়াছে ভাই, বল না?”
এ কথায় শিয়াল দুই চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “বাঘ পলাইল, বৃক পলাইল, এখন নেউল বলে কিনা, কি হইয়াছে?’ হইবে আর কি? ওরা সকলেই আমার কাছে যুদ্ধে হারিয়া পলাইয়াছে। এখন খালি তুমিই বাকি, আইস একবার যুদ্ধ করি।”
এই বলিয়া শিয়াল আরো বেশি করিয়া দাঁত খিচাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া নেউল বলিল, “ভাই, তোমার অত পরিশ্রম করিতে হইবে না, আমি বিনা যুদ্ধেই হার মানিতেছি।”
তারপর তাড়াতাড়ি সেখান হইতে চলিয়া গেল। আর শিয়াল খানিক খুব হাসিয়া লইয়া হরিণ খাইতে বসিল।