উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/গৌতমীর ক্ষমা
গৌতমীর ক্ষমা
পূর্বকালে গৌতমী নামে এক অতি দয়াশীলা ধর্মপরায়ণা এবং বুদ্ধিমতী ব্রাহ্মণী ছিলেন। অন্ধের যষ্টির ন্যায় একটিমাত্র অতি গুণবান পুত্র ভিন্ন এ সংসারে তাঁহার আর কেহই ছিল না। দুঃখিনী মাতার সেই পুত্রটিকে একদিন এক দুষ্ট সর্প দংশন পূর্বক সংহার করিল।
দৈবাৎ সেই সময়ে সেইখান দিয়া এক ব্যাধ যাইতেছিল, তাহার নাম অর্জুন, অর্জুন সেই দুষ্ট সর্পকে তাহার নিষ্ঠুর কার্য শেষ করিয়া আর পলায়ন করিবার অবসর দিল না। সে ক্রোধে অস্থির হইয়া তখনই তাহাকে বন্ধন করতঃ গৌতমীর নিকটে উপস্থিত করিল।
গৌতমীর নিকটে আসিয়া ব্যাধ বলিল, “মা! এই দুষ্ট সাপ আপনার পুত্রকে বধ করিয়াছে। এখন বলুন, ইহাকে কেমন করিয়া মারিব, পোড়াইয়া ফেলিব, না কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিব?”
ব্যাধের কথায় গৌতমী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “বাছা! ইহাকে মারিয়া এখন আমার কি লাভ হইবে? আমার পুত্রের আয়ু শেষ হওয়াতেই তাহার মৃত্যু হইয়াছে, সর্প কেবল উপলক্ষ মাত্র। সুতরাং তুমি ইহাকে ছাড়িয়া দাও।”
ব্যাধ বলিল, “মা! এই দুষ্টকে ছাড়িলে সে হয়ত আরো কত লোককে কামড়াইবে। সুতরাং ইহাকে বধ করাই উচিত হইতেছে।”
গৌতমী বলিলেন, “বাছা! ইহাকে মারিলে ত আমার পুত্র ফিরিয়া পাইব না। আর এ কাজে আমার কোন পুণ্যও হইবে না। সুতরাং আমি ইহাকে ক্ষমা করিতেছি।”
এই সকল শুনিয়া সেই সর্প ব্যাধকে কহিল, “ভাই, মৃত্যু আমাকে পাঠাইয়াছে, তাই আমি এই বালককে কামড়াইয়াছি। ইহাতে আমার কি দোষ? দোষ যদি থাকে তবে সেই মৃত্যুর।”
ব্যাধ বলিল, “হইতে পারে, মৃত্যুই তোমাকে পাঠাইয়াছে, কিন্তু মারিয়াছ ত তুমি। মৃত্যুর যদি দোষ থাকে তাহ পাঠাইবার দোষ মাত্র, মারিবার দোষ তাহার নহে, সে দোষ তোমারই।”
সর্প কহিল, “আমি ত কেবল আজ্ঞা পালন করিয়াছি মাত্র, দোষ কেন আমার হইবে? মৃত্যু আমাকে না পাঠাইলে কখনই আমি এই বালককে বধ করিতাম না। তোমরা যে পুরোহিতকে দিয়া পূজা করাও, তাহার ফল ত তোমরাই পাও। পুরোহিত ত পান না। তেমনি মৃত্যু যদি আমাকে দিয়া কোন কাজ করান, তাহার ফল তাঁহারই পাইতে হয়, আমার তাহাতে কোন ভাগ নাই।”
এইরূপ তর্ক হইতেছে, এমন সময় মৃত্যু সেখানে আসিয়া বলিলেন, “বালকের মৃত্যুর কাল হইয়াছিল, তাই আমি তাহাকে পাঠাইয়াছিলাম। আমরা সকলেই কালের অধীন, সুতরাং আমারই বা দোষ কি? দোষ ত কালের।”
তাহ শুনিয়া ব্যাধ বলিল, “বুঝিয়াছি। তোমরা দুজনেই যত অনিষ্টের মূল। তোমাদের মত এমন নিষ্ঠুর দুষ্ট লোক আর কোথাও নাই।”
এ সময়ে কাল যদি তথায় আসিয়া মীমাংসা করিয়া না দিতেন, তাহা হইলে এ তর্ক কোথায় গিয়া শেষ হইত, কে জানে? কাল আসিয়া বলিলেন, “তোমরা কেন এত বিবাদ করিতেছ? বালক পূর্বজন্মে যেমন কাজ করিয়াছে, এ জন্মে তেমন ফল পাইয়াছে, সুতরাং দোষ আর কাহারো নহে। দোষ সেই বালকের নিজেরই!”
তখন গৌতমী বলিলেন, “অর্জুন, আমার পুত্র তাহার কর্মদোষেই প্রাণত্যাগ করিয়াছে, আর আমিও আমার কর্ম দোষেই এই শোক পাইয়াছি। তাই বলি বাছা, এই সর্পকে ছাড়িয়া দিয়া নিজের ঘরে যাও।”
এ কথায় ব্যাধ সর্পকে ছাড়িয়া দিল। মৃত্যু এবং কাল নিজ নিজ স্থানে চলিয়া গেলেন। গৌতমীও ভগবানের চিন্তায় মন দিয়া পুত্রশোক নিবারণ করিলেন।