উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/নৃগের পাপ

নৃগের পাপ

 দ্বারকা নগরের নিকটে যদুকুলের বালকগণ খেলা করিতেছিল। অনেকক্ষণ খেলা করিয়া তাহাদের অত্যন্ত পিপাসা হওয়ায়, তাহারা জল খুঁজিতে খুঁজিতে একটা প্রকাণ্ড পুরাতন কূয়ার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। সে যে কত কালের পুরানো কূয়া, তাহা কেহই ঠিক করিয়া বলিতে পারে না। তাহার মুখ লতা-পাতায় আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে, দেখিলে হঠাৎ তাহাকে কূয়ার মুখ বলিয়া চিনিতেই পারা যায় না। যাহা হউক, বালকেরা সেই কূয়া দেখিতে পাইয়া বড়ই আহ্লাদিত হইল, এবং উৎসারে সহিত তাহা হইতে জল তুলিতে গেল। কিন্তু তাহারা অনেকে চেষ্টা করিয়াও জল তুলিতে পারিল না। তাহাদের মনে হইল, যেন কোন একটা প্রকাণ্ড জিনিস সেই কূয়ার মুখ আটকাইয়া রহিয়াছে। তখন তাহারা বলিল যে, জল খাইতে পাই আর না পাই, কুয়ার মুখ কিসে বন্ধ হইল, তাহা দেখিতে হইব।

 এই বলিয়া তাহারা অনেক কষ্টে গাছপালা কাটিয়া কূয়ার মুখ পরিষ্কার করিবামাত্র দেখিতে পাইল যে, এক পর্বত প্রমাণ কৃকলাশ (গিরগিটি) কুয়ার ভিতর হইতে তাহাদের পানে মিট্‌মিট্ করিয়া তাকাইতেছে। যদুকুলের বালকেরা বিলক্ষণ সাহসী ছিল বলিতে হইবে। সেই বিশাল এবং ভীষণ গিরগিটিকে দিখিয়া চিৎকার বা উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন, ইহার কিছুই তাহারা করিল না বরং তখনই তাহারা ‘আন্‌ দড়ি!’ ‘আন্ আঁকষি!’ ‘আন্ দোয়ালি!’ বলিয়া মহা উৎসাহের সহিত তাহাকে কূয়া হইতে উঠাইবার আয়োজন করিল।

 কিন্তু সে কি সহজ গিরগিটি? বালকদের টানাটানিই সার হইল, গিরগিটি কিছুতেই সেখান হইতে নড়িল না।

 ইহাতে বালকগণ অতিশয় অপ্রস্তুত হইয়া কৃষ্ণের নিকট গিয়া বলিল, “মহারাজ। একটা ভয়ঙ্কর কৃকলাশ এক বিশাল কূপের মুখ জুড়িয়া বসিয়া আছে। আমরা প্রাণপণে টানাটানি করিয়াও তাহাকে উঠাইতে পারিলাম না!”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “বটে। তোমরা সকলে মিলিয়া একটা কৃকলাশকে টানিয়া তুলিতে পারিলে না! চল ত দেখি, সে কেমন ভয়ানক কৃকলাশ!”

 কৃষ্ণ সেই কূপের নিকট গিয়া গিরগিটিটাকে টানিয়া তুলিয়া দেখিলেন, বাস্তবিকই সেটা এক অতি বিশাল পর্বত প্রমাণ জন্তু, সে আবার মানুষের মত কথা কহে!

 কৃষ্ণ বলিলেন, “তুমি কে হে?” গিরগিটি বলিল, “আমি রাজা নৃগ!”

 ইহাতে কৃষ্ণ যার পর নাই আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “সে কি অদ্ভুত কথা। মহারাজ নৃগ পরম ধার্মিক ছিলেন। যাগ, যজ্ঞ, দান, ধর্ম এই পৃথিবীতে তাঁহার মতন আর কেহই করে নাই। সেই মহারাজ নৃগের এমন দুরবস্থা কি করিয়া হইল?”

 গিরগিটি বলিল, “হে বাসুদেব, আমি পূর্বজন্মে অনেক দান, অনেক যজ্ঞ করিয়াছিলাম বটে, কিন্তু একটি পাপ কার্যও না জানিয়া করিয়াছিলাম।”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “কিরূপ পাপ?”

 গিরগিটি বলিল, “এক ব্রাহ্মণের একটি গরু আমার গরুর পালের ভিতরে ঢুকিয়া যায়। আমার রাখালেরা তাহাকে না চিনিতে পারিয়া আমারই গরুর সামিল করিয়া লয়। তারপর আমি এই ঘটনার কথা কিছুই না জানিয়া, সেইগরু অপর এক ব্রাহ্মাকে দান করি। কিছুদিন পরে গরু লইয়া দুই ব্রাহ্মণে বিবাদ হইল। একজন বলেন, আমার গরু! আর একজন বলেন, তাহা কখনই হইতে পারেনা, স্বয়ং রাজা আমাকে এই গরু দান করিয়াছেন।” এইরূপে বিবাদ করিতে করিতে দুই ব্রাহ্মণ আমার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমি দ্বিতীয় ব্রাহ্মণকে বলিলাম, ‘ঠাকুর আমি আপনাকে এক অযুত গরু দিতেছি, আপনি এই ব্রাহ্মণের ঐ গরুটি তাঁহাকে দিন।’ ইহাতে সেই ব্রাহ্মণ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘এই গরুর মিষ্ট দুধটুকু খাইয়া আমার মা-হারা রোগা ছেলেটি বাঁচিয়া রহিয়াছে। এমন গরুটিকে আমি কিছুতেই ছাড়িব না।’ এই বলিয়া তিনি তখনই তাড়াতাড়ি ঘরে চলিয়া গেলেন। তখন আমি প্রথম ব্রাহ্মণকে বলিলাম, ‘ভগবন! আমি আপনার সেই গরুর বদলে একলক্ষ গরু আপনাকে দিতেছি, দয়া করিয়া তাহা গ্রহণ করুন।’ ব্রাহ্মণ ইহাতে বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আমার ঘরে খাবার আছে, রাজাদের দান লওয়ার আমার কোন প্রয়োজন নাই! আপনি আমার গরুটি আমাকে ফিরাইয়া দিন। তখন আমি তাঁহাকে ধন, রত্ন, গাড়ি,ঘোড়া,কতই দিতে চাহিলাম, তিনি কিছুতেই রাজি না হইয়া দুঃখের সহিত গৃহে চলিয়া গেলেন। তারপর যথা সময়ে আমার আয়ু শেষ হইলে, আমি দেহত্যাগ করিয়া যমের নিকট উপস্থিত হইলাম, যম আমাকে দেখিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ! তোমার পুণ্যের শেষ নাই। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণের গরুটির দরুণ একটি পাপও তোমার হইয়াছে। এখন বল, তুমি পাপের ফল আগে চাহ না পুণ্যের ফল আগে চাহ?’ আমি জোড়হাতে বলিলাম, ‘ধর্মরাজ আমার পাপের সাজাই আমাকে আগে দিন।’ এই কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইবামাত্র, আমি কৃকলাশ হইয়া হেঁট মুখে এই কুয়ার ভিতরে পড়িয়া গেলাম। পড়িবার সময় শুনিতে পাইলাম, যম বলিতেছেন, ‘মহারাজ! একহাজার বৎসর পরে ভগবান বাসুদেব তোমাকে উদ্ধার করিবেন। তারপর তুমি স্বর্গে যাইবে!’”

 এই কথা শেষ হইতে না হইতেই স্বর্গ হইতে সুন্দর রথ নামিয়া আসিল এবং মহারাজ নৃগ কৃকলাশ রূপ পরিত্যাগ পূর্বক উজ্জ্বল দেহ ধারণ করতঃ, সেই রথে চড়িয়া স্বর্গে চলিয়া গেলেন। তারপর দ্বারকার বালকগণও, সেই অদ্ভুত কৃকলাশের বৃত্তান্ত উৎসাহের সহিত সকলকে বলিতে বলিতে, মনের সুখে কৃষ্ণের সঙ্গে ঘরে ফিরিল।