উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/কুশিকের সহিষ্ণুতা
কুশিকের সহিষ্ণুতা
কান্যকুব্জের রাজা গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র, ক্ষত্রিয় হইয়াও নিজের অসাধারণ তপস্যার বলে ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন। বিশ্বামিত্র যে ব্রাহ্মণ হইবেন, এ কথা তাঁহার জন্মের অনেক পুর্ব হইতেই জানা ছিল। ক্ষত্রিয়েরা এইরূপে ব্রাহ্মণ হয়, ব্রাহ্মণদিগের এরূপ ইচ্ছা হয়ত একেবারেই ছিল না। এমন কি, মহর্ষি চ্যবন প্রথমে একথা ব্রহ্মার নিকট শুনিতে পাইয়া, যে বংশে বিশ্বামিত্রের জন্মগ্রহণ করিবার কথা ছিল, সেই বংশটাকেই নাশ করিবার জন্য বিধি মতে চেষ্টা করেন।
তখন বিশ্বামিত্রের পিতামহ মহারাজ কুশিক কান্যকুজের রাজা ছিলেন। চ্যবন মনে করিলেন, এই কুশিককে কোন সুযোগে শাপ দিয়া বংশকে ভস্ম করিতে হইবে। আমি উহার সঙ্গে বাস করিয়া নানারূপে উহাকে কষ্ট দিব। তাহা হইলে অবশ্য উহার রাগ হইবে। তখন সে আমাকে কিছুমাত্র অসম্মান করিলেই, আমি উহাকে শাপ দিব। তাই তিনি একদিন কুশিকের নিকট গিয়া বলিলেন, “মহারাজ। আমি তোমার সহিত কিছুকাল বাস করিব।”
রাজা তাঁহার কথায় সম্মত হইয়া, নিজ হাতে তাঁহার পদ প্রক্ষালন পূর্বক অতিশয় বিনয় ও সমাদরের সহিত বলিলেন, “ভগবন, অনুমতি করুন, এখন কি করিতে হইবে।”
মুনি বলিলেন, “আর কিছুই করিতে হইবে না, আমি একটি ব্রত করিব, সেই ব্রত শেষ না হওয়া পর্যন্ত, তুমি এবং তোমার রানী সর্বদা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া আমার সেবা কর।”
রাজা ও রানী আহ্লাদের সহিত তখনই তাঁহার সেবায় নিযুক্ত হইলেন। সন্ধ্যা হইবামাত্র মুনিঠাকুর রাজার গৃহের সমস্ত অন্ন, ব্যঞ্জন, পায়স এবং মিষ্টান্ন নিঃশেষ পূর্বক, অতি পরিপাটি রূপে আহার করিয়া বলিলেন, “আমি নিদ্রা যাইব, যতক্ষণ আমি নিদ্রিত থাকি, ক্রমাগত আমার সেবা কর, দেখিও, আমার ঘুম ভাঙে না যেন।”
মহর্ষি নিদ্রা গেলেন, রাজা আর রানী তাঁহার পদসেবা করিতে লাগিলেন। একুশদিন এইভাবে চলিয়া গেল, একুশদিনের মধ্যে একবারও মহর্ষির নিদ্রাভঙ্গ হইল না। একুশদিনের ভিতরে, রাজা আর রানী একটিবারও মহর্ষির পদসেবা ছাড়িয়া উঠিবার অবসর পাইলেন না। অনাহারের অনিদ্রায় তাঁহাদের এই দীর্ঘকাল কাটিল।
একুশদিনের পর মহর্ষি শয্যা ত্যাগ পূর্বক, কোন কথা না বলিয়া, বেড়াইতে বাহির হইলেন। রাজা আর রানী ক্ষুধায় অতিশয় কাতর এবং অনিদ্রা আর পরিশ্রমে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়াও মুনির সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন, কিন্তু মুনি একটিবার তাঁহাদের পানে চাহিয়াও দেখিলেন না।
কিঞ্চিৎ পরেই রাজা দেখিলেন মুনি আর সেখানে নাই, তিনি আকাশে মিলাইয়া গিয়াছেন। রাজা আর রানী তখন যার পর নাই ভয় এবং দুঃখের সহিত সেই ক্লান্ত শরীরেই প্রাণপণে মুনিকে খুঁজিতে লাগিলেন, কিন্তু কোথাও তাঁহার দেখা পাইলেন না। শেষে নিতান্ত লজ্জিত ও কাতরভবে ঘরে ফিরিয়া আসিবামাত্র দেখিলেন, মহর্ষি পরম সুখে শয্যায় নিদ্রা যাইতেছেন! সুতরাং তখনই আবার তাঁহার পদসেবা আরম্ভ করিতে হইল।
এইরূপে গেল আর একুশদিন। আমরা হইলে এতদিন অনাহারে অনিদ্রায় বাঁচিয়াই থাকিতে পারিতাম না, পদসেবা করা ত দূরের কথা। কিন্তু রাজা আর রানী এত কষ্ট সহিয়াও কিছুমাত্র বিরক্ত হন নাই, বা সেবার ত্রুটি করেন নাই।
তারপর মহর্ষি হঠাৎ উঠিয়া বলিলেন, “তৈল আন! স্নান করিব।”
তখনই মহামূল্য তৈল আনিয়া মুনির গায়ে মাখান হইল। অনেকক্ষণ ধরিয়া মাখান হইলে, মুনি নিজেই উঠিয়া স্নানের ঘরে গেলেন। সেখানে স্নানের আয়োজন সকলই প্রস্তুত ছিল। রাজ মুনিকে স্নান করাইতে গিয়া দেখেন, মুনি নাই! আবার তখনই ঘরে আসিয়া দেখিলেন, মুনি সেখানে বসিয়া আছেন, তাঁহার স্নান হইয়া গিয়াছে! তখন রাজা ভক্তি পূর্বক জোড় হাতে বলিলেন, “ভগবন! অনুমতি করুন, অন্ন আনি।”
মুনি বলিলেন, “ঘরে যত খাবার আছে, সব লইয়া আইস!”
তখনই রাজবাটীর সকল ভাত, সকল ব্যঞ্জন, সমস্ত সন্দেশ আনিয়া মুনির সম্মুখ উপস্থিত করা হইল। মুনিবর তাহার উপরে সেই ঘরের সমস্ত মহামূল্য বস্তু, আসন, শয্যা প্রভৃতি স্থাপন করতঃ, তাহাতে অগ্নি প্রদান পূর্বক সেখান হইতে অন্তর্ধান হইলেন।
তাহাতেও রাজার কিছুমাত্র রাগ হইল না। এইরূপে উনপঞ্চাশ দিন গেল। এই দীর্ঘকালের মধ্যে একদিনও এমন দেখা গেল না যে, রাজার অতি সামান্য পরিমাণেও মুখ ভার হইয়াছে।
পঞ্চাশদিনের দিন মুনি বলিলেন, “আমাকে রথে বসাইয়া তুমি আর রানী তাহা টানিয়া লইয়া চল, আমি হাওয়া খাইব।”
তখনই রাজা আর রানীকে জুতিয়া রথ আনা হইল, মুনি অতিশয় তীক্ষ্ণ প্রতোদ (খোঁচা মারিবার জন্য লাঠি) হস্তে তাহাতে উঠিয়া বসিলেন।
রাজা বলিলেন, “ভগবান! কোন দিকে যাইব?”
মুনি বলিলেন, “বড় রাস্তার ভিতর দিয়া চল। আর ধনরত্ন যত পার সঙ্গে লও, আমি দান করিব।”
রাজা আর রানী রাজপথের জনতার ভিতর দিয়া রথ টানিতে লাগিলেন। ভৃত্যগণ দানের জন্য রাশি রাশি ধন, রত্ন, হাতি, ঘোড়া, ছাগ, মেষ, প্রভৃতি লইয়া সঙ্গে চলিল। তখন মুনি অতি নির্দয় ভাবে সেই তীক্ষ্ম প্রতোদ দিয়া, রাজা রানীর শরীরে খোঁচা মারিতে আরম্ভ করিলেন। নগরের লোক সে দৃশ্য সহ্য করিতে না পারিয়া হাহাকার করিতে লাগিল, কিন্তু রাজার তাহাতেও রাগ হইল না। তারপর মুনি তাঁহার ধনরত্ন সমুদায়ই দান করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু এত অত্যাচারেও যাঁহার রাগ হয় নাই সামান্য ধনের ক্ষতিতে তাঁহার কি হইবে মুনি পরাস্ত হইয়া গেলেন। ইহার পর রাজার অনিষ্টের চেষ্টা তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে হইল।
তখন তিনি নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া, রাজার নিকট সকল বৃত্তান্ত প্রকাশ পূর্বক বলিলেন, “মহারাজ! বর লও!”
রাজা বিনয়ের সহিত বলিলেন, “মুনি ঠাকুর! আমি যে সবংশে নষ্ট হই নাই, ইহাই আমার যথেষ্ট বর, আর বর লইয়া কি করিব? আপনি আমার ক্রটি পাইলেই আমাকে ভস্ম করিতেন। এত ঘটনার ভিতরেও যে আমার কোন ত্রুটি হয় নাই, ইহা আমার বিশেষ সৌভাগ্য।”