উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/একলব্যের গুরুদক্ষিণা
একলব্যের গুরুদক্ষিণা
মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র মহাবীর দ্রোণাচার্য কৌরব এবং পাণ্ডব রাজপুত্রদিগকে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা দিতেন। তাঁহার যশে ত্রিভুবন ছাইয়া গিয়াছিল। দেশ-বিদেশের সকল রাজপুত্রেরা আসিয়া তাঁহার শিষ্য হইয়াছিলেন। একদিন নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য আসিয়া, ভুমিতে লুটাইয়া অতি বিনীতভাবে তাঁহাকে প্রণাম পূর্বক করজোড়ে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল।
দ্রোণ সেই বালকের বলিষ্ঠ দেহ এবং সকল উজ্জ্বল মুখশ্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বিস্ময়ের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে বৎস? কাহার পুত্র?কি জন্য আসিয়াছ?”
একলব্য মাথা হেঁট করিয়া জোড়হাতে বলিল, “ভগবন! আমার নাম একলব্য, পিতার নাম হিরণ্যধনু, জাতিতে নিষাদ। দয়া করিয়া আমাকে শিষ্য করিলে, আপনার চরণ সেবা করিয়া কৃতার্থ হইব।”
একলব্যের মুখের দিকে চাহিয়া দ্রোণের মনে যে স্নেহের সঞ্চার হইয়াছিল, তাহার পরিচয় শুনিবামাত্র তাহা শুকাইয়া গেল, নিষাদের পুত্র ম্লেচ্ছ জাতি, তাহকে স্পর্শ করিলেও পাপ হয়। তাহাকে কি কখনো শিষ্য করা যাইতে পারে, না সকলের সঙ্গে সমানভাবে মিশিতে দেওয়া যাইতে পারে? দ্রোণ তাহাকে অবজ্ঞার সহিত বলিলেন, “তুমি ম্লেচ্ছের পুত্র, তুমি কি সাহসে আমার শিষ্য হইতে আসিয়াছ?”
একলব্য অনেক আশা করিয়া আসিয়াছিল, দ্রোণের এক কথায় তাহার সকল আশা চূর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু তথাপি তাঁহার প্রতি তাহার ভক্তি কিছুমাত্র হ্রাস হইল না। তাঁহার ঐ কথার পর সে আর তাঁহাকে কিছু বলিলও না। সে নীরবে তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া, ধীরে ধীরে সেখান হইতে চলিয়া আসিল।
একলব্য এখন কোথায় যাইবে? দেশে ফিরিবে? না, দেশে যাইবার যে পথ, সে পথে ত সে গেল না, সে যে অন্য পথে বনের দিকে চলিয়াছে। বাস্তবিক সে বনে যাওয়াই স্থির করিয়াছে। ম্লেচ্ছের পুত্র হইলেও সে সাধারণ লোক নহে, যাহা শিখিতে আসিয়াছিল, তাহা না শিখিয়া কখনই সে দেশে ফিরিবে না। দেশ হইতে যাত্রা করিবার সময়ই সে মনে মনে দ্রোণকে শুরু করিয়া আসিয়াছিল। তিনি তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছেন, তাহাতে কি? তথাপি তিনিই তাহার গুরু। যে বিদ্যা তিনি ইচ্ছা পূর্বক দান করিলেন না, ভগবানের কৃপা হইলে, তপস্যা করিয়া সে সেই বিদ্যা তাঁহার নিকট হইতে আদায় করিবে।
এই মনে করিয়া সে বনের ভিতরে আসিয়া মৃত্তিকা দ্বারা দ্রোণের এক মূর্তি প্রস্তুত করিল। তারপর, সম্মুখে সেই মূর্তি, হাতে ধনুর্বান, আর হৃদয়ে অটল প্রতিজ্ঞা, এইরূপে সে ভগবানকে স্মরণ পূর্বক আশ্চর্য অধ্যবসায়ের সহিত অস্ত্র অভ্যাস আরম্ভ করিল।
এইরূপে অনেকদিন চলিয়া গেল। ইহার মধ্যে একদিন পাণ্ডব এবং কৌরব মৃগয়া করিবার জন্য রথারোহণ পূর্বক সেই বনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের একজন সঙ্গে করিয়া একটি কুক্কুরও আনিয়াছিলেন। রাজপুত্রেরা মৃগের সন্ধানে বনে প্রবেশ করিলে, সেই কুক্কুর স্বভাব-দোষে চঞ্চলভাবে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল। সে স্থান হইতে একলব্যের আশ্রম বেশি দূরে ছিল না। কুকুরটি ঝোপে ঝোপে উঁকি মারিয়া আর গাছে গাছে শুঁকিয়া ক্রমে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হয়, আর একলব্যকে দেখিবামাত্র সে নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া ঘেউ ঘেউ করিতে থাকে। ইহাতে একলব্যের অতিশয় অসুবিধা বোধ হওয়াতে, সে একবারে সাতটি শর মারিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দিল।
রাজপুত্রেরা শিকারে ব্যস্ত, এমন সময় কুকুরটি নিতান্ত জড়সড় ভাবে তাঁহাদের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। বেচারার লেজ প্রাণপণে গুটান, মুখে শরের ছিপি আঁটা, ঘেউ ঘেউ করিবার শক্তি নাই! অন্তরে আতঙ্কের অবধি নাই, তাহার সেই অবস্থা দেখিয়া রাজপুত্রগণের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। বিশেষত, এমন করিয়া তাহার মুখে সেই আশ্চর্য ছিপি কে আঁটিল, এই কথা ভাবিয়া তাঁহারা একেবারে অবাক হইয়া গেলেন। সে ব্যক্তি যে ধনুর্বিদ্যায় তাঁহাদের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাহা স্পষ্টই বুঝা গেল, কেননা, তাঁহাদের কাহারো এমন অদ্ভুত কাজ করিবার শক্তি ছিল না।
সুতরাং রাজপুত্রদের আর শিকার করা হইল না। তাহার পরিবর্তে, এখন সেই অসাধারণ বীরকে খুঁজিয়া বাহির করাই হইল তাঁহাদের প্রধান কাজ। অনেকক্ষণ বনে বনে অনুসন্ধান করিয়া, শেষে তাঁহারা দেখিলেন যে, এক বিশাল দেহ জটাধারী কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ এক মনে কেবলই শর নিক্ষেপ করিতেছে। তাহারা ইহাতে অতিশয় আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
সে বলিল, “আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র, এবং দ্রোণাচার্যের শিষ্য। আমার নাম একলব্য।”
ইহার পূর্বে রাজপুত্রদিগের যেমন আশ্চর্য বোধ হইয়াছিল, একলব্য দ্রোণাচার্যের শিষ্য এ কথা শুনিয়া তাঁহাদের তেমনই অভিমান হইল। সুতরাং তাঁহারা আর বিলম্ব না করিয়া সেখান হইতে একেবারে দ্রোণের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “গুরুদেব, আমাদের কি অপরাধ হইয়াছে, যে, আপনি আমাদিগকে ছড়িয়া, নিষাদ পুত্র একলব্যকে এমন চমৎকার শিক্ষা দান করিলেন?”
এ কথায় দ্রোণ ত নিতাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। তিনি অনেক ভাবিয়াও এই ব্যাপারের কোন অর্থ বুঝিতে পারিলেন না। সুতরাং তিনি বলিলেন, “বৎসগণ, আমি ত ইহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এই ব্যক্তি কেমন করিয়া আমার শিষ্য হইল, আমিই বা কখন ইহাকে শিক্ষা দিলাম, তাহা ভাবিয়া আমি অবাক হইতেছি, চল, ইহার বিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইবে।”
তখনই সকলে মিলিয়া পুনরায় একলব্যের নিকট আসিলেন। একলব্য দূর হইতে দ্রোণকে দেখিতে পাইয়াই “গুরুদেব” বলিয়া ছুটিয়া গিয়া তাঁহার পায়ে পড়িল। তাহার পর তাঁহাকে বসিবার জন্য আসন দিয়া, জোড়হাতে তাঁহার সম্মুখে দাড়াঁইয়া রহিল।
তখন দ্রোণ বলিলেন, “হে বীর, যদি তুমি সত্য-সত্যই আমার শিষ্য হও, তবে আমার দক্ষিণা দাও।”
এ কথায় একলব্য যার পর নাই আনন্দিত হইয়া বলিল, “গুরুদেব, কিরূপ দক্ষিণা দিতে হইবে, অনুমতি করুন, আমি তাহা আনিয়া দিতেছি।”
দ্রোণ বলিলেন, “তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কাটিয়া আমাকে দাও, উহাই আমার দক্ষিণা।”
একলব্য তখনই হাসিতে হাসিতে তাহার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কাটিয়া দ্রোণকে দিল। এমন নিষ্ঠুর ব্যবহারের পরও এমন বোধ হইল না যে, দ্রোণের প্রতি তাহার ভক্তি কিছুমাত্র কমিয়াছে।
অঙ্গুষ্ঠ গেল, সুতরাং একলব্যের আর তেমন আশ্চর্য রূপ তীর ছুঁড়িবার ক্ষমতা রহিল না, ইহাতে দ্রোণাচার্য এবং তাঁর শিষ্যগণ অতিশয় আনন্দিত হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। তখন একলব্যও এই সকল কথা ভাবিয়া একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন।