উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/চ্যবনের মূল্য

চ্যবনের মূল্য

 মহর্ষি চ্যবন প্রয়াগ তীর্থে দীর্ঘকাল তপস্যা করিয়াছিলেন। এই পবিত্র তীর্থে গঙ্গা এবং যমুনার মিলনের স্থান। সেই স্থানে, গঙ্গা এবং যমুনার জলের মধ্যে কাষ্ঠের ন্যায় স্থিরভাবে বসিয়া, মহর্ষি চ্যবন ক্রমাগত বার বৎসর একমনে একাসনে কেবল ভগবানের চিন্তা করেন। এতদিন জলের মধ্যে স্থির ভাবে থাকায়, তাঁহার দেহ শ্যাওলায় আর শামুকে ঢাকিয়া গিয়াছিল। মাছেরা আশ্চর্য হইয়া দলে দলে তাঁহাকে দেখিতে আর শুঁকিতে আসিত, এবং কিছুমাত্র ভয় না পাইয়া তাঁহার চারিদিকে খেলা করিত। মহর্ষি এসকল ব্যাপারের কোন সংবাদ না লইয়া মনের সুখে ঈশ্বর-চিন্তায় সময় কাটাইতেছেন।

 এমনি করিয়া বার বৎসর কাটিয়া গেল। তারপর একদিন কোথা হইতে অসুরের মত জেলেসকল আসিয়া, বিশাল জগৎ-বেড় জালে সে স্থান ঘিরিয়া ফেলিল।

 মাছ, কচ্ছপ, কুমির প্রভৃতি যত জন্তু নদীতে ছিল, সকলেই সেই জালে ধরা পড়িল, কেহই তাহা এড়াইতে পারিল না।

 তারপর সেই প্রকাণ্ড জালকে টানিয়া ডাঙ্গায় তুলিবামাত্র জেলেরা দেখিল যে সেইসকল মাছের সঙ্গে একটি অদ্ভুতরকমের মুনিও সেই জালে ধরা পড়িয়াছেন। তাঁহার সমস্ত শরীর, এমন-কি, দাড়ি আর জটা পর্যন্ত শ্যাওলায় সবুজ হইয়া গিয়াছে, অসংখ্য শামুক, ডুমুরের ফলের ন্যায় তাঁহার দেহে লাগিয়া রহিয়াছে।

 মুনিকে দেখিয়া জেলেরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে তাঁহাকে বারবার নমস্কার করিতে লাগিল। কিন্তু চ্যবন তাহাদিগকে কিছুই বলিলেন না। মাছ-গুলিকে জল হইতে তুলিয়া আনাতে তাহারা খাবি খাইতেছিল। তাহাদের কষ্ট দেখিয়া তিনি মনের দুঃখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া জেলেরা জোড়হাতে বিনয় করিয়া বলল, “ভগবান, আমরা না জানিয়া অপরাধ করিয়াছি আমাদিগকে ক্ষমা করুন, আর এখন আমরা আপনার কি প্রিয় কার্য করিতে পারি, তাহারও অনুমতি করুন।”

 চ্যবন বলিলেন, “বাপুসকল! আমি এই মৎস্যগণের সহিত বহুকাল বাস করিয়াছি, এখন কিছুতেই ইহাদিগকে ছাড়িতে পারিব না। আমি হয় ইহাদের সঙ্গে প্রাণত্যাগ করি, না হয় তোমরা আমাকে ইহাদের সহিত বিক্রয় কর।”

 মহর্ষির কথায় নিষাদগণ যার পর নাই ভয় পাইয়া, নিতান্ত দুঃখের সহিত মহারাজ নহুষের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। রাজা তাহাদের নিকট মুনির সংবাদ পাইবামাত্র, তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে প্রণাম এবং অশেষ রূপ সমাদর পূর্বক জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন্ কি অনুমতি হয়?”

 চ্যবন বলিলেন, “মহারাজ! এই জেলে বেচারারা বড়ই পরিশ্রম করিয়াছে। তুমি উহাদিগকে উহাদের মৎস্যের এবং আমার মূল্য প্রদান কর।”

 রাজা বলিলেন, “আপনার অনুমতি হইল আপনার মূল্যস্বরূপ সহস্র মুদ্রা ইহাদিগকে দেওয়া যাউক।”

 মুনি বলিলেন, “একহাজার টাকা আমার উপযুক্ত মূল্য নহে। তুমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া, আমার উচিত মূল্য ইহাদিগকে দাও।”

 রাজা বলিলেন, “তবে একলক্ষ টাকা দিই?”

 মুনি বলিলেন, “একলক্ষ টাকাও আমার উচিত মূল্য নহে। তুমি অমাত্যগণের সহিত পরামর্শ করিয়া, আমার উচিত মূল্য ইহাদিগকে দাও।”

 নহুষ বলিলেন, “তবে ইহাদিগকে এককোটি টাকা বা তাহার চেয়েও বেশি দেওয়া হউক।”

 মুনি বলিলেন, “তাহাতেও আমার উচিত মূল্য হইবে না। তুমি ব্রাহ্মণদিগকে ডাকিয়া এ বিষয়ে পরামর্শ কর।”

 রাজা বলিলেন,“তবে আমার অর্ধেক বা সমস্ত রাজ্য দিই। তাহা হইলে বোধহয় আপনার উপযুক্ত মূল্য হইতে পারে।”

 মুনি বলিলেন, “তাহাতেও আমার উপযুক্ত মূল্য হইবে না। তুমি ঋষিদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া, আমার উপযুক্ত মূল্য স্থির কর।”

 এ কথায় নহুষ বড়ই চিন্তায় পড়িলেন। রাজ্য দিলেও যদি মুনির উপযুক্ত মূল্য না হয়, তবে আর এমন কি দিবার আছে, যাতে তাহা হইতে পারে? রাজা কত ভাবিলেন, অমাত্যেরা সকলে মিলিয়া কত পরামর্শ করিলেন, কিন্তু এ কথার উত্তর কেহই দিতে পারিলেন না।

 এমন সময় অতিশয় জ্ঞানী একজন ফলমূলাহারী তপস্বী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তিনি রাজাকে চিন্তিত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! আপনাকে এত চিন্তিত দেখিতেছে কেন?”

 রাজা বলিলেন, “ভগবান, এই মহর্ষির উচিত মূল্য কি, তাহা ত আমি কিছুতেই স্থির করিতে পারিতেছে না। আমার সমস্ত রাজ্য দিতে চাহিলাম, তাহাও তিনি যথেষ্ট মনে করিলেন না। ইহার উপর আর কি দেওয়া যাইতে পারে, তাহা ভাবিয়া আমি একেবারে অস্থির হইয়াছি। শীঘ্র ইঁহার উচিত মূল্য স্থির করিতে না পারিলে হয়ত ইঁহার রাগ হইবে, আর আমাকে শাপ দিয়া ভস্ম করিবেন।”

 এ কথা শুনিয়া তপস্বী বলিলেন, “টাকা কড়ি অপেক্ষা গোধনই শ্রেষ্ঠ। গরুর তুল্য ধন নাই। আপনি গরু দিলে মহর্ষির উচিত মূল্য হইতে পারে।”

 তখন রাজা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া চ্যবনকে বলিলেন, “ভগবন্, আমি গরু দিয়া আপনাকে ক্রয় করিলাম। বোধহয়, এইবার আপনার উচিত মূল্য হইয়াছে।”

 চ্যবন তখনো সেই মাছের গাদায় পড়িয়াছিলেন, রাজার কথায় তিনি আহ্লাদের সহিত তথা হইতে উঠিয়া আসিয়া বলিলেন, “মহারাজ। এইবার যথার্থই আমার উচিত মূল্য হইয়াছে। এ সংসারে গরুর তুল্য আর ধন নাই।”

 তখনই একটি গাই আনিয়া জেলেদিগকে দেওয়া হইল। গাভীটি পাইয়া জেলেরা অতিশয় বিনীত ভাবে চ্যবনকে বলিল “মুনি-ঠাকুর! সাত পা চলিতে যে সময় লাগে, ততটুকু সময় সাধুদের সঙ্গে থাকিতে পারিলেই তাঁহাদের সহিত বন্ধুতা হয়। আপনার সহিত অনেক্ষণ যাবৎ আমাদের সাক্ষাৎ এবং আলাপ হইয়াছে, সুতরাং আপনি আমাদের উপরে তুষ্ট হউন। আপনি অতি মহাপুরুষ, আপনার পায়ে পড়িয়া বলিতেছি দয়া করিয়া এই গরুটি আপনি নিন।”

 চ্যবন বলিলেন, “বাছাসকল! দরিদ্রের মনে দুঃখ দেওয়া মহাপাপ, সুতরাং আমি কখনো তোমাদের কথা অমান্য করিব না। আমি তোমাদের গাভী গ্রহণ করিলাম। এখন তোমরা এই সকল মৎস্যের সহিত স্বর্গে চলিয়া যাও।”

 এই বলিয়া চ্যবন জেলেদের নিকট হইতে গাভীটি গ্রহণ পূর্বক রাজাকে আশীর্বাদ করিয়া, সেই তপস্বীর সঙ্গে তথা হইতে চলিয়া গেলেন।