উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/যবক্রীতের তপস্যা

যবক্রীতের তপস্যা

 মহর্ষি ভরদ্বাজ এবং রৈভ্য দুই বন্ধু ছিলেন, ভরদ্বাজের একটি পুত্র ছিলেন, তাঁহার নাম যবক্রীত, রৈভ্যের দুই পুত্র ছিলেন, তাঁহাদের নাম অর্ববসু ও পরাবসু।

 রৈভ্য এবং তাঁহার পুত্রগণ অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন, এজন্য মুনিরা সকলেই তাঁহাদিগকে যার পর নাই সম্মান করিতেন। ভরদ্বাজ এবং যবক্রীত তপস্বী ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের বিদ্যা অধিক না থাকায় তাঁহারা তেমন সম্মান পাইতেন না। ইহাতে যবক্রীতের মনে বড়ই ক্লেশ হইত।

 যবক্রীত যখন দেখিলেন যে, পণ্ডিত হইতে না পারিলে সমাজে মান লাভ করা যায় না, তখন তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, ‘আমি তপস্যা দ্বারা অতি অল্পকালের ভিতরেই অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইব।’

 এই মনে করিয়া যবক্রীত গঙ্গাতীরে গমন পূর্বক, চারিদিকে আগুন জ্বালিয়া, আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করতঃ ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সেই উৎকট তপস্যার তেজ ইন্দ্রের এতই অসহ্য হইয়া উঠিল যে, তিনি আর যবক্রীতের নিকট না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না।

 ইন্দ্র যবক্রীতের নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে মুনিপুত্র, তুমি কিজন্য এরূপ কঠোর তপস্যা করিতেছ?”

 যবক্রীত বলিলেন, “ভগবন, আমি বিদ্যালাভের জন্য তপস্যা করিতেছি। গুরুর নিকট শিক্ষা করিয়া বিদ্বান হইতে অনেক সময় লাগে, আমি তপস্যা করিয়া অল্প কালের মধ্যে এরূপ জ্ঞান লাভ করিতে চাহি যে, অন্য কোন ব্রাহ্মণের তাহা নাই!”

 ইন্দ্র বলিলেন, “ব্রাহ্মণ কুমার, বিদ্যালাভের উপায় ত এরূপ নহে, গুরুর নিকট গিয়া যত্ন পূর্বক বিদ্যা লাভ কর। তপস্যায় দেহ ক্ষয় করিলে তোমার বিদ্যালাভ হইবে না।

 এই বলিয়া ইন্দ্র চলিয়া গেলেন, আর যবক্রীত আরো অধিক আগুন জ্বালিয়া, পূর্বাপেক্ষাও ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন।

 ইন্দ্র দেখিলেন, ঋষিকুমার সহজে ছাড়িবার পাত্র নহে। তখন তিনি অতিশয় জীর্ণ শীর্ণ যক্ষায় কাতর এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরিয়া কাশিতে কাশিতে পুনরায় যবক্রীতের তপস্যার স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 যবক্রীত দেখিলেন যে, কোথা হইতে এক ব্রাহ্মণ আসিয়া, ক্রমাগত কেবল মুষ্টি মুষ্টি বালি আনিয়া গঙ্গায় ফেলিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহাতে তিনি আশ্চর্য হইয়া ভবিলেন, ‘বুড়া করে কি!’ তারপর হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, ও কি করিতেছেন?”

 বুড়া বামুন বলিলেন, “গঙ্গা পার হইতে লোকের ভারি কষ্ট হয়, তাই আমি সেতু বাঁধিতেছি। এই সুন্দর সেতুর উপর দিয়া সকলে অনায়াসে গঙ্গা পার হইবে!”

 যবক্রীত হাসিয়া বলিলেন, “হঃ! হাঃ! হাঃ! তাহাও নাকি কখনো হয়! মুঠো মুঠো বালি ফেলিয়া আপনি ভবিতেছেন, গঙ্গায় সেতু বাঁধিবেন! এ বিড়ম্বনা কেন? তাহার চেয়ে, যাহা হইতে পারে, এমন কোন একটা কাজ করুন।”

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, “কেন বাপু! তুমি যদি তপস্যা করিয়া মস্ত পণ্ডিত হইতে পার, তবে আমিই বা কেন বালি দিয়া গঙ্গায় সেতু বাঁধিতে না পারিব?”

 যবক্রীত বুঝিলেন, এই কেশো বামুন আর কেহই নহে, স্বয়ং ইন্দ্র। সুতরাং, তিনি বলিলেন, “দেবরাজ, আমার এই তপস্যা আপনার ঐ বালির বাঁধের মত, ইহাই যদি আপনার অভিপ্রায়, তবে আপনার যাহা সাধ্য হয় করুন। আমি ইহার পর আমার হাত পা গুলির এক-একখানি আগুনে ফেলিয়া আর-একটি ভাল মতে তপস্যা করিব।”

 ইন্দ্র ভবিলেন, ‘কি বিপদ। এত দেখিতেছি বড়ই ভয়ানক লোক, নিজের মতলব আদায় না করিয়া কিছুতেই ছড়িবে না।’ তখন তিনি আর উপায় না দেখিয়া বলিলেন, “ব্রাহ্মণ কুমার, ক্ষান্ত হও! আমি তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করিতেছি। তুমি আর তোমার পিতা আমার বরে অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইলে, এখন ঘরে চলিয়া যাও।”

 তখন আর যবক্রীতের আনন্দ দেখে কে! তিনি হাসিতে হাসিতে পিতার নিকট আসিয়া সকল কথা জানাইলেন। কিন্তু ভরদ্বাজ এ সংবাদে বিশেষ সন্তুষ্ট না হইয়া বলিলেন, “বৎস! আমার বড়ই ভয় হইতেছে, পাছে এই ঘটনায় তোমার অহংকার হয়, আর তুমি কষ্ট পাও! দেখ, বালধি মুনির পুত্র মেধাবীও বর পাইয়া বড়ই অহঙ্কারী হইয়াছিল। তাই সে ধনুষাক্ষ মুনির কোপে মারা যায়। পূর্বে বালধির এক পুত্রের মৃত্যু হওয়াতে তিনি অমর পুত্র লাভের জন্য তপস্যা করেন। দেবতা বর দিলেন, ‘তোমার পুত্র ঐ পর্বতের ন্যায় অমর হইবে। যতদিন পর্বত আছে, ততদিন তাহার মৃত্যু নাই, পর্বত নষ্ট হইলে তোমার পুত্রও মরিবে।’ সেই অমর পুত্র হইল মেধাবী। সে নিজেকে অমর ভাবিয়া অহঙ্কার পূর্বক ঋষিদিগের অপমান করিত, একদিন সে ধনুষাক্ষের আশ্রমে গিয়া তাহার অনিষ্ট করিল। ধনুক্ষ তাহাকে ‘ভস্ম হও!’ বলিয়া শাপ দিলেন, কিন্তু সে শাপে পর্বত নষ্ট হইল না, কাজেই মেধাবীরও মৃত্যু হইল না। তাহাতে মুনি ক্রোধভরে এমন ভয়ঙ্কর বিশাল মহিষ সকলের সৃষ্টি করিলেন যে, তাহারা দেখিতে দেখিতে শিং দিয়া পর্বত চূর্ণ করিয়া ফেলিল, আর সেই পর্বত নষ্ট হইবামাত্র মেধাবীও মরিয়া গেল। তাই বলি বৎস, তুমি যেন বরলাভে অহঙ্কারী হইয়া বিপদে পড়িও না।”

 যবক্রীত বলিলেন, “বাবা আপনি কিছুমাত্র চিন্তিত হইবেন না, আমি বিশেষ সাবধান হইয়া চলিব।”

 কিন্তু হায়! মুখে বলিলেই যদি কাজে তাহা হইত, তবে আর দুঃখ কি ছিল! অল্পদিনের ভিতরেই যবক্রীতের অহংকারে মুনিগণ অস্থির হইয়া উঠিলেন। শেষে একদিন যবক্রীত রৈভ্যের আশ্রমের গিয়া পশুর ন্যায় এমন জঘন্য অত্যাচার করিলেন যে, তেমন অত্যাচার কেহই সহিয়া থাকিতে পারে না।

 তখন মহর্ষি রৈভ্য ক্রোধে অস্থিব হইয়া নিজের মাথার একটি জটা অগ্নিতে আহুতি দিবামাত্র, তাহা হইতে অতি ভীষণ এক রাক্ষস জন্মিয়া, শূল হাতে যবক্রীতকে বধ করিতে চলিল।

 যবক্রীত প্রাণের ভয়ে ব্যাকুল হইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে এক সরোবরের দিকে ছুটিয়া চলিলেন, কিন্তু তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তাহাতে জল নাই। সেখান হইতে নদীতে গেলেন, দেখিলেন, তাহাও শুকাইয়া গিয়াছে। সেখান হইতে তিনি তাঁহার পিতার অগ্নিশালার দিকে ছুটিয়া আসিলেন, কিন্তু তাহাতে প্রবেশ করিতে পারিলেন না। সেই অবসরে রাক্ষস আসিয়া শূল দ্বারা তাঁহাকে হত্যা করিল।

 ভরদ্বাজ সে সময়ে গৃহে ছিলেন না। তিনি তথায় ফিরিয়া এই দারুণ সংবাদ শ্রবণমাত্র করুণ বিলাপ করিতে করিতে রৈভ্যকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “আমি যেমন পুত্র শোকে কাতর হইয়া প্রাণ ত্যাগ করিতেছি সেই রূপ রৈভ্যও কিনা অপরাধে তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাতে প্রাণ ত্যাগ করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

 আবার তখনই নিতান্ত দুঃখের সহিত তিনি এ কথাও বলিলেন, “হায়! পুত্র শোকে ব্যাকুল হইয়া আমি প্রিয় বন্ধুকে এমন শাপ দিলাম, আমার মত দুঃখী এবং পাপী আর কে আছে?”

 ইহার কিছুদিন পরে, অর্বাবসু ও পরাবসু একটি যজ্ঞ উপলক্ষে কিছুদিনের জন্য বৃহদ্দ্যুম্ন রাজার বাড়িতে যান। সেই সময়ে একদিন রাত্রিকালে কোন কারণে, পরাবসুর আশ্রমে ফিরিয়া আসিবার প্রয়োজন হয়, রৈভ্য যে তখন কৃষ্ণাজিন (কাল হরিণের ছল) গায় দিয়া বাহিরে নিদ্রা যাইতেছিলেন, পরাবসু তাহা জানিতেন না। অন্ধকার রাত্রিতে সেই কৃষ্ণাজিন গায়ে রৈভ্যকে দেখিবামাত্র পরাবসু যার পর নাই চমকিয়া গেলেন এবং হিংস্র জন্তু মনে করিয়া, নিজের প্রাণের ভয়ে তাঁহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলেন।

 এই পিতৃ হত্যার পাপ হইতে পরাবসুকে মুক্ত করিবার জন্য, ব্রহ্মহিংসন নামক ব্রত করা আবশ্যক হইল। রাজার যজ্ঞ ছাড়িয়া পরাবসুর এই ব্রত করিতে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না, তাই অর্বাবসু তাঁহার হইয়া ব্রত করিতে গেলেন। ব্রত শেষ করিয়া তিনি যখন আবার রাজার যজ্ঞস্থানে ফিরিয়া আসিলেন, তখন সকলে বলিল, “এই ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যা করিয়াছে! ইহাকে প্রবেশ করিতে দিও না।” ইহাতে অর্বাবসু নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া বারবার উচ্চৈঃস্বরে সকলকে বলিলেন, “আমি ব্রহ্মহত্যা করি নাই। আমার ভ্রাতা এ কাজ করিয়াছেন, আমি কেবল তাহাকে সেই পাপ হইতে মুক্ত করিয়াছি।” কিন্তু তাঁহার কথা কে শুনে? রাজার হুকুমে বিকটাকার ভৃত্যগণ আসিয়া, তাঁহাকে সেখান হইতে বাহির করিয়া দিল।

 এই অপমান এবং অবিচারের পর অর্বাবসু আর গৃহে ফিরিলেন না। তিনি মনের দুঃখে বনে গিয়া ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সেই তপস্যায় তুষ্ট হইয়া দেবতাগণ তাঁহাকে বর দিতে আসিলেন, তিনি করজোড়ে, তাঁহাদিগকে বলিলেন, “হে দেবতাগণ, আপনাদের যদি দয়া হইয়া থাকে, তবে আমাকে এই বর দিন যে, আমার পিতা আবার জীবিত হউন, আমার ভ্রাতার পাপ দূর হউক, পিতৃদেব তাঁহার অকারণ হত্যার কথা ভুলিয়া যাউন, আর ভরদ্বাজ ও যবক্রীত দুজনেই আবার বাঁচিয়া উঠুন।”

 এ কথায় দেবগণ আনন্দের সহিত “তথাস্তু” বলিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। তারপর যে খুব আনন্দের ব্যাপার হইল, তাহা আর আমি পরিশ্রম করিয়া না বলিলেও হয়ত চলিবে।

 মরা মানুষ বাঁচিয়া উঠিলে খুব আনন্দ প্রকাশ করাই তাহার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু যবক্রীত তাহা করিবার পূর্বে দেবতাদিগকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে দেবতাগণ। আমি ত অনেক ব্রত করিয়াছিলাম, অনেক বিদ্যা শিখিয়াছিলাম তবে কেন রৈভ্যের হাতে আমার এমন দুর্দশা হইল?”

 দেবতারা বলিলেন, “বাপু! তুমি বিদ্যালাভ করিয়াছিলে ফাঁকি দিয়া, আর রৈভ্য তাহা পাইয়াছিলেন অনেক যত্নে, অনেক কষ্টে, কুরুকে সন্তুষ্ট করিয়া। এরূপ দুজনের মধ্যে যে প্রভেদ আছে তাই হয়ত তুমিও বুঝিতে পার। সুতরাং রৈভ্যের নিকট তোমার পরাভব হওয়া কিছুমাত্র আশ্চর্যের বিষয় নহে।”

 বোধহয়, এ কথায় যবক্রীতের বিলক্ষণ শিক্ষা হইয়াছিল। কেননা, তিনি যে শেষে একজন অতিশয় ধার্মিক ঋষি হইয়াছিলেন তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকে সকল পাপ হইতে মুক্ত হইবার জন্য যবক্রীতের আশ্রমে আসিয়া বাস করিত।