উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/উশীনরের পরীক্ষা

উশীনরের পরীক্ষা

 শিবিবংশীয় মহারাজ উশীনরের কথা অতি পবিত্র। যতদিন এই পৃথিবীতে পুণ্যবানের সম্মান থাকিবে, ততদিন লোকে মহারাজ উশীনরকে ভক্তি করিবে।

 মহারাজ উশীনর যেমন যজ্ঞ করিয়াছিলেন, দেবরাজ ইন্দ্রও তেমন করিতে পারেন নাই।

 একদিন ইন্দ্র অগ্নিকে বলিলেন, “উশীনর যে কেমন ধার্মিক, তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে।”

 এইরূপ পরামর্শ করিয়া ইন্দ্র শ্যেন (শাঁচান) আর অগ্নি কপোতের (পায়রার)বেশে উশীনরের যজ্ঞ ভূমিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 মহারাজ উশীনর যজ্ঞ করিতেছেন, এমন সময় শ্যেন পাখির তাড়ায় অত্যন্ত ভয় পাইয়া, কপোতটি তাঁহার কোলে আসিয়া আশ্রয় লইল।

 তখন শ্যেন রাজাকে বলিল, “মহারাজ, আমার অত্যন্ত ক্ষুধা হইয়াছে। আপনি কপোতটিকে ছাড়িয়া দিন, আমি ভক্ষণ করিব।”

 রাজা বলিলেন, “তাহা কি করিয়া হয়? এই কপোত প্রাণের ভয়ে পলায়ন করিয়া আমার নিকট আশ্রয় লইয়াছে, এখন ইহাকে পরিত্যাগ করা নিতান্ত অন্যায়! ব্রহ্মহত্যা আর গোহত্যার যেমন পাপ, আশ্রিতকে পরিত্যাগ করিতে তেমনি পাপ।”

 শ্যেন বলিলেন, “মহারাজ, আহার করিয়াই প্রাণিগণ জীবিত থাকে! না খাইতে পাইলে আমি মরিয়া যাইব, আমার মৃত্যু হইলে আমার স্ত্রী পুত্র পরিবার সকলেই বিনাশ পাইবে। আপনি একটি প্রাণীকে বাঁচাইতে গিয়া এতগুলি প্রাণীর মৃত্যু ঘটাইতেছেন, ইহা কি উচিত?”

 রাজা কহিলেন, “তোমার ত ভোজনই প্রয়োজন, এই কপোতকে বধ না করিয়াও তাহা তোমার স্বচ্ছন্দে জুটিতে পারে। গরু, মহিষ, শুয়োর, যাহা খাইতে তোমার ইচ্ছা হয়, এখনই তোমাকে আনিয়া দিতেছি।”

 শ্যেন বলিলেন, “মহারাজ, শ্যেন পক্ষী কপোত ভক্ষণ করে। ইহাই বিধাতার বিধি। অন্য কোন জন্তু আমরা খাই না, আমাকে ঐ কপোতটিই দিতে আজ্ঞা হয়।”

 রাজা বলিলেন, “তোমাকে শিবিদিগের বিশাল রাজ্য দিতেছি, অথবা আর যাহা চাহ তাহাই দিতেছি, কিন্তু এই শরাণাগত (আশ্রিত) কপোতটিকে কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারিব না। আমি যাহা করিলে তুমি এই কপোতটিকে ছাড়িতে সম্মত হও, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।”

 শ্যেন কহিল, “মহারাজ! যদি এই কপোতটির প্রতি আপনার এতই স্নেহ জন্মিয়া থাকে, তবে ইহার সমান ওজনে আপনার নিজের মাংস কাটিয়া আমাকে দিন। তাহা হইলে আমি আহ্লাদের সহিত কপোতকে ছাড়িয়া দিব।”

 এ কথায় রাজা অতিশয় আনন্দিত হইয়া, তখনই নিজের মাংস কাটিয়া কপোতের সহিত ওজন করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র কপোতের ভার কি অসম্ভব ছিল, রাজা নিজের দেহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া কতই মাংস কাটিলেন, তথাপি তাহা কপোতের সমান হইল না!

 রাজা পুনরায় তাঁহার শরীর হইতে অনেক মাংস কাটিয়া তুলায় দিলেন, তথাপি সেই ক্ষুদ্র কপোতের ভারই বেশি রহিয়া গেল, শেষে নিরূপায় ভাবিয়া তিনি নিজেই সেই তুলায় উঠিয়া বসিলেন।

 তখন শ্যেন পক্ষী বলিল, “মহারাজ, আমি ইন্দ্র, আর এই কপোত অগ্নি। আমরা তোমাকে পরীক্ষা করিতে আসিয়াছিলাম। আজ তুমি যে আশ্চর্য কাজ করিলে, তাহা চিরদিন ত্রিভুবনের লোকে স্মরণ করিবে।”

 এই বলিয়া ইন্দ্র আর অগ্নি চলিয়া গেলেন, মহারাজ উশীনরও তখন পরম সুন্দর মূর্তি ধারণ পূর্বক অতি আশ্চর্য মণিময় রথে আরোহণ করিয়া, স্বর্গে চলিয়া গেলেন।

 মহাভারতের অন্য স্থানে এই ঘটনার বর্ণনায় উশীনরের পরিবর্তে শিবির উল্লেখ আছে। কেহ কেহ উশীনরের তখনই স্বর্গে যাওয়ার কথা বলেন না। তাঁদের মতে, অগ্নি রাজার নিকট হইতে বিদায় হওয়ার সময়, তাঁহাকে এই বলিয়া বর দেন যে, মহারাজ, আমার জন্য তুমি নিজের মাংস কাটিয়া দিয়াছিলে, আমি তাহা সোনার করিয়া তোমাকে ফিরাইয়া দিতেছি। উহা তোমার শরীরে অতি সুন্দর এবং পবিত্র রাজ-চিহ্ন হইয়া থাকিবে আর তোমার দক্ষিণ পার্শ্ব হইতে কপোতরোমা নামক একটি ধার্মিক পুত্র জম্মিবে। উহার সমান বীর আর এই পৃথিবীতে কেহই থাকিবে না।