উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/সোমক ও তাঁহার ঋত্বিক
সোমক ও তাঁহার ঋত্বিক
বহুকাল পর্বে সোমক নামে এক রাজা ছিলেন।
সোমকের একশত রানী ছিলেন, কিন্তু তাঁহার একটিও পুত্র ছিল না। এজন্য তিনি সর্বদাই অতিশয় দুঃখিত থাকিতেন। এইরূপে অনেক বৎসর গত হইলে, ভগবানের কৃপায় বৃদ্ধ বয়সে রাজার জন্তু নামে একটি পুত্র হইল। এত কষ্টের পরে পুত্রটিকে পাইয়া রাজা এবং রানীগণেব কিরূপ আনন্দ হইল, আব তাহারা কিরূপ স্নেহের সহিত তাহার লালন পালন করিতে লাগিলেন, তাহা লিখিয়া কত জানাইব? ছেলেটিকে বারবার অনিমেষ চক্ষে দেখিয়াও রানীদিগের তৃপ্তি হয় না, তাঁহার আহার নিদ্রা ভুলিয়া দিন রাত কেবল তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া ধকিতেন।
এমন করিয়া দিন যায়, ইহার মধ্যে কি হইল শুন। হীরা-মতির ঝালর দেওয়া সোনার খাটে মাখনের মত কোমল শয্যায়, জন্তু সুখে নিদ্রা যাইতেছিল, এমন সময় কোথা হইতে এক পাপিষ্ঠ পিপীলিকা আসিয়া তাহার কোমরে কামড়াইয়া দিল। খোকা তখনই পিঠ বাঁকাইয়া, মুখ সিটকাইয়া, বিষম ভূকুটি পূর্বক চিৎকার করিয়া উঠিল। তাহাতে খোকার সেই একশত মাতা সকলে মিলিয়া বুক চাপড়াইয়া, হাত পা ছুড়িয়া, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন।
সেকালের মেয়েরা কিরকম সুরে বিলাপ করিত জানি না। কিন্তু সেই একশত রানীর চিৎকার মিলিয়া যে খুবই ভয়ানক একটা গোলমাল হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। মহারাজ সোমক তখন ঋত্বিক (যজ্ঞের পুরোহিত) ও পাত্রমিত্র লইয়া সভায় বসিয়াছিলেন, রানীদের কান্নার শব্দ প্রলয়ের ঝড়ের ভয়ঙ্কর গর্জনের ন্যায়, সেই সভায় আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজা তাহাতে নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া দবোয়ানকে বলিলেন, “শীঘ্র দেখ, কি হইয়াছে।” দরোয়ান উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া অন্তঃপুর হইতে সংবাদ আনিল, “খোকা মহারাজের না জানি কি ভয়ানক কি হইয়াছে।”
তখন রাজা ছুটলেন, মন্ত্রী ছুটিলেন, ঋত্বিক ছুটিলেন, পাত্রমিত্র সকলেই পাগড়ি ফেলিয়া শিখা এলাইয়া, অন্তঃপুরের দিকে ছুটিয়া চলিলেন। ততক্ষণে পিঁপড়েও চলিয়া গিয়াছে, খোকাও চুষি মুখে দিয়া যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়াছে। রাজা আসিয়া সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “তাই বল, আমি ভাবিয়াছিলাম, না জানি কি।”
খোকাকে খানিক আদর করিয়া আবার সভায় আসিয়া রাজা বলিলেন, “হায়! একপুত্র হওয়ার কি কষ্ট! ইহার চেয়ে পুত্র না থাকাও বরং ভাল। বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্টে একটি মাত্র পুত্র পাইয়া এখন তাহার চিন্তা আমার রোগের চিন্তার চেয়েও যেন বেশি হইয়াছে। ঋত্বিক মহাশয়, এমন কি কোন কর্ম নাই, যাহা করিলে আমার একশতটি পুত্র হইতে পারে? যদি থাকে, বলুন সে কার্য নিতান্ত কঠিন হইলেও আমি তাহা করিব।”
ঋত্বিক বলিলেন, “মহারাজ, এমন কার্য আছে আপনি যদি তাহা করিতে পারেন, তবে বলি!”
রাজা বলিলেন, “শীঘ্র বলুন! সে কাজ ভালই হউক আর মন্দই হউক, আমি অবশ্যই তাহ করিব!”
তখন ঋত্বিক বলিলেন, “মহারাজ! আমি আমার বাড়িতে এক যজ্ঞ করিব। সেই যজ্ঞে আপনাকে আপনার পুত্রের বসা (চবি) দ্বারা আহুতি দিতে হইবে। সেই সময় রানীগণ আহুতির ধোঁয়ার গন্ধ লইলে, তাঁহাদের সকলেরই এক-একটি পুত্র জন্মিবে। সেই সকল পুত্রের সহিত আপনার এই পুত্রটিও পুনরায় জন্মগ্রহণ করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। এ কথা যে সত্য, সেই খোকার বামপার্শ্বে একটি সোনালি চিহ্নই হইবে তাহার প্রমাণ।”
রাজা তাহাতেই সম্মত হইলেন, সুতরাং যথাসময়ে সেই নিষ্ঠুর যজ্ঞ আরম্ভ হইল, যখন আহুতি দিবার জন্য ঋত্বিক জন্তুকে লইতে আসিলেন, রানীরা তখন তাহাকে কিছুতেই ছাড়িয়া দিতে চাহিলেন না। তাঁহাদের করুন কান্নায় পাষাণ গলিয়া যাইতে লাগিল, কিন্তু সেই নিষ্ঠুর ঋত্বিকের হৃদয় গলিল না। রানীরা খোকার ডান হাতখানি ধরিয়া রাখিয়াছিলেন, ঋত্বিক তাহার বাম হাত ধরিয়া টানাটানি করিয়া তাহাকে ছিনাইয়া আনিলেন। সেই শিশুকে হত্যা করিয়া, তাহার রসা দ্বারা আহুতি আরম্ভ হইল। সে আহুতির গন্ধ পাইয়া আর মাতাগণ তাঁহাদের শোক কিছুতেই সহ্য করিতে পারিলেন না, তাঁহারা সকলেই অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন।
যাহা হউক, কিছুদিন পরে তাঁহাদের সকলেরই এক একটি পুত্র হইল আর তাহাদের সঙ্গে জন্তুও যে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহাতেও কোন সন্দেহ নাই। কেন না, ঋত্বিক যে সোনালি চিহ্নের কথা বলিয়াছিলেন, সেই চিহ্নটি তাহার বামপার্শে স্পষ্টই দেখা গিয়াছিল। একশত পুত্রের মধ্যে জন্তুই হইল সকলের বড়, আর সকলের চেয়ে মাতাগণের অধিক স্নেহের পাত্র।
ইহার কিছুদিন পরে ঋত্বিকের মৃত্যু হইল, এবং যথাসময়ে মহারাজ সোমকও দেহত্যাগ করিলেন। পরলোকে গিয়া সোমক দেখিলেন যে, তাঁহার ঋত্বিককে ঘোরতর নরকে ফেলা হইয়াছে। ইহাতে তিনি নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি, ঋত্বিক মহাশয়! আপনার এমন দশা কেন হল?”
ঋত্বিক বলিলেন, “মহারাজ। আপনার জন্য সেই যজ্ঞ করিয়াছিলাম, এখন তাহারই ফলভোগ করিতেছি।”
তখন সোমক যমকে বলিলেন, “হে ধর্মরাজ, ইনি আমার গুরু, আর আমারই নিমিত্ত এই নরকে পতিত হইয়াছে। সুতরাং আপনি দয়া করিয়া ইঁহাকে ছাড়িয়া দিন, ইঁহার পরিবর্তে আমি নিজে এই নরকে প্রবেশ করিতেছি।”
যম কহিলেন, “মহারাজ। একজনের কর্মের ফল অন্যে ভোগ করিতে পারে না। তুমি সৎকার্য করিয়াছ, তাহার ফল-স্বরূপ তুমি পবিত্র লোক স্থান সকল ভোগ করিবে।”
রাজা কহিলেন, “ইঁহাকে ছাড়িয়া আমি পবিত্র লোক ভোগ করিতে চাহিনা। স্বর্গেই হউক আর নরকেই হউক, আমি ইঁহার সঙ্গে থাকিব। আমাদের দুজনেরই সমান কাজ, তাহার ফলও সমান হউক।”
যম বলিলেন, “তথাস্তু! তবে তোমরা উভয়ে কিছুকাল নরক ভোগ কর, তারপর উভয়ে স্বর্গে গিয়া সুখে বাস করিবে।”
ইহাতে সোমক অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া সেই নরকে প্রবেশ পূর্বক তাঁহার প্রিয় পুরোহিতের সহিত বাস করিতে লাগিলেন। অল্পকালের মধ্যেই তাঁহাদের সকল পাপ ক্ষয় হইয়া গেল। তারপর উভয়ে স্বর্গে গিয়া সেখানকার সকল সুখের অধিকারী হইলেন।