উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/ইন্দ্র ও নহুষ

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ইন্দ্র ও নহুষ

 পূর্বকালে ত্বষ্টা নামক প্রজাপতির সহিত ইন্দ্রের শত্রুতা হইয়াছিল। সে সময়ে ত্বষ্টা তাহার ব্রিশিরা নামক পুত্রকে ইন্দ্রের অনিষ্ট করিবার জন্য নিযুক্ত করেন। ত্বষ্টার পুত্রটি নিতান্তই অত রকমের ছিলেন। ত্রিশিরা কি না যাঁহার তিনটা মাথা। তিন মুখের এক মুখ দিয়া তিনি বেদপাঠ করিতেন, আর-এক মুখে মদ্যপান করিতেন, আর-একখানি মুখ তাঁহার এমনি ভয়ানক ছিল যে, তাহা দেখিলেই মনে হইত, যেন তিনি ঐ মুখখানি দিয়া ত্রিভুবন গিলিয়া খাইবেন।  পিতার কথায় এই ত্রিশিরা, ইন্দ্রকে তাড়াইয়া নিজে ইন্দ্র হইবার জন্য, ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। যাহার চেহারা দেখিলেই আতঙ্ক উপস্থিত হয়, সে যদি আবার এমন বিষম তপস্যা করিতে থাকে, তবে তাহাতে ইন্দ্রেরও ভয় সহজেই হইতে পারে। সুতরাং ইন্দ্র ত্রিশিরার তপস্যা ভাঙ্গিবার জন্য বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই সেই উৎকট তপস্যার কোনরূপ হানি করিতে পারিলেন না।

 তখন ইন্দ্রের মনে হইল যে, ইহাকে বধ করা ভিন্ন আর ইহার তপস্যা নিবারণের অন্য উপায় নাই। এই মনে করিয়া তিনি ত্রিশিরার উপরে অতি ভয়ঙ্কর একটা অস্ত্র ছুঁড়িয়া মারিলেন। অস্ত্রের ঘায় ত্রিশিরা পড়িয়া গেলেন বটে, কিন্তু তাহাতে যে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, এমন বোধ হইল না। তাহা দেখিয়া ইন্দ্র নিতান্ত ভয় পাইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, এখন কি করি?

 এমন সময় একজন ছুতার কুড়াল কাঁধে সেইখান দিয়া যাইতেছিল। ইন্দ্র তাহাকে দেখিয়া বলিলেন, “বাপু, তুই এক কাজ করিতে পারিস? তোর ঐ কুড়ালখানি দিয়া এই লোকটার মাথা তিনটা কাটিয়া ফেলত দেখি।”

 ছুতার বলিল, “আমি তাহা পারি না, কর্তা! কাজটা আমার বড়ই অন্যায় মনে হইতেছে, আর তাহা না হইলেও ইহার ঘাড় যে মোটা, আমার কুড়ালে ধরিবে না।”

 ইন্দ্র বলি, “তোর কোন ভয় নাই। আমি তোর কুড়ালকে বজ্রের মত কঠিন করিয়া দিব।”

 ছুতার বলিল, “আপনি কে মহাশয়? আর এমন অন্যায় কাজ করিয়া আপনার কি লাভ হইবে?”

 ইন্দ্র বলিলেন, “আমি ইন্দ্র! তুই কোন চিন্তা করিস না, আমার কাজটা করিয়া দে।”

 ছুতার বলিল, “এমন নিষ্ঠুর কাজ করিতে কি আপনার লজ্জা হইতেছে না? ব্রহ্মহত্যার পাপের কথাও ত একবার ভাবিতে হয়!”

 ইন্দ্র বলিলেন, “তাহার জন্য কোন ভাবনা নাই, আমি অনেক ধর্ম কর্ম করিয়া ব্রহ্মহত্যার দোষ সারাইয়া লইব।”

 তখন ছুতার যেই তাহার কুড়াল দিয়া ত্রিশিরার মাথাগুলি কাটিল, অমনি তাঁহার তিনটি মুখ হইতে তিত্তির, চড়ই প্রভৃতি পক্ষী উড়িয়া বাহির হইতে লাগিল।

 এইরূপে ত্রিশিরাকে বধ করিয়া ইন্দ্র নিশ্চিন্ত মনে ঘরে চলিয়া আসিলেন।

 ত্রিশিরার মৃত্যুব কথা শুনিয়া ত্বষ্টার যে খুব রাগ হইয়াছিল, এ কথা আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারি। তিনি রাগে অস্থির হইয়া আচমন পূর্বক অগ্নিতে আহুতি দিবামাত্র অতি ভীষণ এক দৈত্য উৎপন্ন হইল। দৈত্যকে দেখিয়া ত্বষ্টা বলিলেন, “বড় হও।” অমনি সে দেখিতে দেখিতে আকাশের মত উঁচু হইয়া গেল। তারপর সে আকাশকেও ছাড়াইয়া গেল তারপর আর কত বড় হইল তাহা আমি বলিতে পারি না।

 সেই দৈত্যের নাম বৃত্র। বৃত্র হাত জোড় করিয়া ত্বষ্টাকে বলিল, “মহাশয়! আজ্ঞা করুন, কি করিতে হইবে?”

 ত্বষ্টা বলিলেন, “তুমি স্বর্গে গিয়া ইন্দ্রকে সংহার কব!”

 এ কথায় বৃত্র তখনই স্বর্গে গিয়া কি কাণ্ড যে উপস্থিত করিলে, তাহা কি বলিব? দেবতারা কিছুকাল তাহার সহিত খুবই যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কিন্তু সে যুদ্ধে তাঁহার কি হইবে? সে তাঁহাদের অস্ত্রশস্ত্রকে মশার কামড়ের মত অগ্রাহ্য করিয়া, খালি দেখিতে লাগিল, কোনটা ইন্দ্র। তারপর তাঁহাকে চিনিবামাত্র, সে তাঁহাকে খপ করিয়া ধরিয়া, মুখের ভিতরে পুরিয়া, মুহুর্তের মধ্যে যুদ্ধের ঝঞ্জাট মিটাইয়া দিল।

 ভাগ্যিস দেবতাদিগের নিকট “জৃম্ভিকা”অর্থাৎ “হাইতোলানি” নামক অতি আশ্চর্য অস্ত্র ছিল, নহিলে সর্বনাশই হইয়াছিল আর কি! দেবতাগণ তাড়াতাড়ি সেই অস্ত্র আনিয়া প্রাণপণে তাহা ছুঁড়িয়া মারিবামাত্র, দুষ্ট দৈত্য বিশাল এক হাই তুলিল, আর সেই অবসরে ইন্দ্র যে কিরূপ উধর্বশ্বাসে ছুটিয়া তাহা মুখের ভিতর হইতে বাহিরে আসিলেন, তাহা বুঝিতেই পার।

তারপর আবার ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কিন্তু সেই দুষ্ট দৈত্যের মুখের ভিতর হইতে বাহির হইয়া অবধি, ইন্দ্রের কেমন যেন মন খারাপ হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং ইহার পর আরএকবার বৃত্র খুব রুখিয়া উঠিবামাত্র তিনি নিতান্ত ব্যক্তভাবে রণস্থল পরিত্যাগ করিয়া, মন্দর পর্বতের চূড়ায় গিয়া বসিয়া রহিলেন।

 সেইখানে গিয়া দেবতারা তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন, কিন্তু সে যাত্রা আর তাঁহাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনিতে পারিলেন না। এই যুদ্ধের শেষ কি করিয়া হইয়াছিল—কি করিয়া দধীচ মুনির হাড় দিয়া বজ্র প্রস্তুত হয়, আর সেই বজ্র দিয়া ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করেন, এ-সকল কথা আমরা কিছু কিছু জানি। তবে, ইন্দ্র যে বস্ত্র হাতে পাইয়াই অমনি তাহা লইয়া বৃত্রের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন, এ কথা বোধ হয় ঠিক নহে। বাস্তবিক ইন্দ্র সরল ভাবে যুদ্ধ করিয়া বৃত্রকে বধ করেন নাই।

 সম্মুখ যুদ্ধে বৃত্রকে আঁটিতে না পারিয়া, দেবতারা স্থির করিলেন যে, উহাকে কৌশল পূর্বক বধ করিতে হইবে, এই মনে করিয়া তাঁহার মুনিদিগকে সঙ্গে করিয়া বৃত্রের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে গিয়া মুনিরা তাহাকে বলিলেন, “হে বৃত্র! তোমার তেজে জীবগণের বড়ই ক্লেশ হইতেছে, সুতরাং তুমি যুদ্ধ পরিত্যাগ করিয়া ইন্দ্রের সহিত বন্ধুতা স্থাপন কর। “

 বৃত্র প্রথমে এ কথায় সম্মত হয় নাই। কিন্তু তপস্বীগণ সহজে ছাড়িবার পাত্র ছিলেন না। তাঁহারা তাহাকে মিষ্ট কথায় ভুলাইয়া, বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন যে, সে ইন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুতা করিলে বড়ই চমৎকার ব্যাপার হইবে। তখন বৃত্র তাঁহাদিগকে বলিল, “ঠাকুর মহাশয়েরা আপনারা আমার মান্যলোক, তাহাতে সন্দেহ নাই। তবে ইহার মধ্যে একটা কথা আছে। আমি আপনাদের আজ্ঞা পালন করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু তাহার আগে দেবতাগণকে একটি প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে। উহারা শুকনো জিনিস দিয়া বা ভিজা জিনিস দিয়া, পাথর দিয়া বা কাঠ দিয়া, অস্ত্র দিয়া বা শস্ত্র দিয়া, দিনের বেলায় বা রাত্রিতে, আমাকে বধ করিতে পারিবেন। এ কথায় যদি দেবতারা রাজি হন তবে আমি তাঁহাদের সহিত বন্ধুতা করিতে প্রস্তুত আছি।”

 মুনিরা বলিলেন, “তথাস্তু”। সুতরাং তখন বৃত্র ভারি খুশি হইয়া ইন্দ্রের সহিত বন্ধু তা করিল। তাহতে ইন্দ্র মনে মনে বলিলেন, “বেশ হইয়াছে, এখন ইহাকে একবার বাগে পাইলেই বধ করিব।”

 ইহার পর একদিন সন্ধ্যাকালে ইন্দ্র সমুদ্রের ফেনা দেখিয়া চিন্তা করিলেন যে, এই সন্ধ্যাকাল দিবাও নহে রাত্রিও নহে, আর এই ফেনা শুকনোও নহে ভিজাও নহে, পাথরও নহে কাঠও নহে, অস্ত্রও নহে শস্ত্রও নহে। সুতরাং এই সন্ধ্যাকালে এই ফেনা দিয়া বৃত্রকে বধ করিতে হইবে।

 তারপর ইন্দ্র সন্ধ্যাকালে ফেনার আঘাতে বৃত্রকে বধ করিলেন। এতবড় অসুরটা ফেনার আঘাতে মরিয়া গেল, এ কথা নিতান্তই আশ্চর্য বোধ হইতে পারে, কিন্তু সেই ফেনার ভিতরে যে ইন্দ্রের বস্ত্রখানি লুকান ছিল, এ সংবাদটি শুনিলে আর কাহারো আশ্চর্য হইবার কারণ থকিবে না।

 বৃত্র মরিয়া গেল, দেবতাগণের আপদ দুর হইল। কিন্তু ইন্দ্রের মন ইহাতেও নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না। ইহার কারণ এই যে, পাপ করিলে ইন্দ্রকেও ত তাহার ফলভোগ করিতে হয়। পূর্বে ত্রিশিরাকে মারিয়া এক মহাপাপ করিয়াছিলেন, এখন বৃত্রের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করাতে আব এক মহাপাপ হইল। না জানি এ-সকল পাপের কি ভয়ঙ্কর শাস্তি হইবে! এই চিন্তায় অস্থির হইয়া ইন্দ্র স্বর্গের রাজত্ব পরিত্যাগপূর্বক জগতের শেষে যে জল আছে, সেই জলের ভিতরে গিয়া লুকাইয়া রহিলেন।

 এদিকে ইন্দ্র চলিয়া যাওয়াতে সংসারময় হাহাকার উপস্থিত হইল। বৃষ্টি নাই, পৃথিবীতে জল নাই, গাছপালা মরিয়া গিয়াছে, জীব-জন্তুর আহার মিলে না। দেবতারা দেখিলেন, সৃষ্টি আর থাকে না, অবিলম্বে একজন ইন্দ্র ঠিক না করিলে সকলই মাটি হয়। অনেক চিন্তা করিয়া তাঁহারা সংসারে মধ্যে একটিমাত্র লোককে ইন্দ্র হইবার উপযুক্ত বলিয়া স্থির করিলেন। সেই লোকটি রাজা নহুষ। যশে, মানে তেজে, ধর্মে নিতান্তই সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্র হইবার উপযুক্ত লোক।

 সুতরাং দেবতা, ঋষি, এবং পিতৃগণ সকলে মিলিয়া নহুষের নিকট গমন পূর্বক বলিলেন, “হে মহারাজ! আপনি দেবরাজ্যের ভাব গ্রহণ করুন।”

 নহুষ বলিলেন, “আমি নিতান্ত দুর্বল, আমি কি করিয়া স্বর্গে রাজত্ব করিব?”

 দেবতারা বলিলেন, “আপনার কোন চিন্তা নাই, আপনি যাহার পানে তাকাইবেন, তাহারই বল রূণ করিতে পারিবেন।”

 তখন নহুষ দেবতাদিগের কথায় সম্মত হইয়া স্বর্গে রাজত্ব করিতে লাগিলেন। কিছুকাল তিনি খুব ভালো করিয়াই রাজত্ব করিয়াছিলেন। কিন্তু হায়! মানুষ হইয়া হঠাৎ এমন উচ্চপদ লাভ করাতে, শেষে বেচারার মাথা ঘুরিয়া গেল।

 একদিন তিনি সভায় বসিয়া বলিলেন, “হে সভাসদগণ! আমি ত ইন্দ্র হইয়াছি তবে শচী কেন আসিয়া আমার পদসেবা করে না?”

 নহুষ আসিবার পূর্বে শচী ছিলেন স্বর্গের রাণী। নহুষের মুখে এই অপমানের কথা শুনিয়া তিনি ভয়ে এবং দুঃখে নিতান্তই কাতর হইলেন’ এসময়ে বৃহস্পতি তাঁহাকে সাহস দিয়া বলিলেন, “মা। তোমার কোন ভয় নাই, শীঘ্রই আমাদের ইন্দ্র স্বর্গে ফিরিয়া আসিবেন।”

 এদিকে নহুষ নিতান্তই প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়া আছে, শচীকে আসিয়া তাঁহার পদসেবা করিতেই হইবে। অনেক কষ্টে তাঁহাকে দুই-চারি দিনের জন্য থামাইয়া রাখিয়া সকলে ইন্দ্রকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য বিষ্ণুর নিকট পরামর্শ লইতে গেলেন। বিষ্ণু তাঁহাদের কথা শুনিয়া বলিলেন, “হে দেবতাগণ! তোমরা চিন্তিত হইও না। ইন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করিলেই তাঁহার পাপ দূর হইবে তোমাদেরও দুঃখ যাইবে। তোমরা কিছুকাল সাবধানে অপেক্ষা কর।”

 বিষ্ণুর উপদেশে অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়া ইন্দ্রের পাপ দূর হইল বটে, কিন্তু একবার স্বর্গে ফিরিয়া আসিয়াও নহুষের ভয়ে তাঁহাকে পুনরায় পলায়ন করিতে হইল। ইহাতে শচীদেবীর মনে যে কি দারুণ ক্লেশ হইল, তাহা কি বলিব? তিনি উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে করিতে বলিলেন, “হে ধর্ম! যদি আমি কখনো দান করিয়া থাকি, যদি কখনো অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিয়া থাকি, যদি কখনো গুরুজনকে তুষ্ট করিয়া থাকি, আর সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা রাখিয়া থাকি, তবে যেন আমি আমার স্বামীকে প্রাপ্ত হই।”

 ইন্দ্র যে কোথায় পলায়ন করিয়াছিলেন, উপশ্রুতি নাম্নী এক দেবী তার সন্ধান জানিতে। শচীর দুঃখে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া সেই উপতি দেবী তাঁহার নিকটে অসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার পরম সুন্দর স্নেহময় মূর্তি দেখিয়া শচী যার পর নাই সম্মান এবং আদরের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে মা?”

 উপশ্রুতি বলিলেন, “দেবি আমি উপশ্রুতি, তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি। তুমি একান্ত পুণ্যবতী এবং পতিপরায়ণা, তোমার মঙ্গল হউক। তুমি আমার সহিত আইস, আমি তোমাকে ইন্দ্রের নিকটে লইয়া যাইব।”

 উপশ্রুতির কথায় শচী পরম আহ্লাদের সহিত তাঁহার সঙ্গে চলিলেন। তাহারা দেবতাদিগের বাসস্থান পার হইয়া, হিমালয় পার হইয়া উত্তরদিকে কতদূর যে গেলেন, তাহার অবধি নাই। যাইতে যাইতে শেষে তাহারা এক মহাসমুদ্রের ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সে সমুদ্রে নানারূপ বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপের মাঝখানে শতযোজন বিস্তৃত একটি সুন্দর সবোবর। সেই সরোবরে, নানাবর্ণের অসংখ্য পদ্মের মধ্যে একটি শ্বেতবর্ণের পদ্ম খুব উঁচু বোটায় ফুটিয়া বড়ই শোভা পাইতেছিল। উপশ্রুতি এবং শচী সেই পদ্মের বোঁটাব ভিতরে ইন্দ্রকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন।

 শচীকে দেখিয়া ইন্দ্র নিতান্ত আশ্চর্য এবং আহ্লাদিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এখানে কেমন করিয়া আসিলে? আর আমি যে এখানে আছি তাহাই বা কি করিয়া জানিলে?”

 এ কথায় শচী সকল সংবাদ ইন্দ্রকে শুনাইলে ইন্দ্র তাঁহাকে অনেক সাহস দিয়া নহুষকে জব্দ করিবার উপায় শিখাইয়া দিলেন। সেই উপায় শিখিয়া শচীর মনে বড়ই আনন্দ হইল, এবং সেইমত কাজ করিবার জন্য স্বর্গে ফিরিয়া আসিতে তিনি আর একমুহূর্তও বিলম্ব করিলেন না।

 শচীকে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়াই, নহুষ বলিলেন, “তুমি কবে আমার সেবা করিতে আসিবে?”

 শচী বলিলেন, “আপনি যখন আমাকে লইয়া যাইবার উপযুক্ত একখানি পাল্কিতে চড়িয়া আমাকে নিতে আসিবেন, তখনই আমি যাইব!”

 নহু ইহাতে একটু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে আবার কেমন পাঙ্কি?”

 শচী বলিলেন, “এমন পাল্কি হওয়া চাই যে, তেমন আর কাহারো নাই সকলের পাল্কি বেহারায় বয়, কিন্তু আপনি যে পাল্কিতে চড়িয়া আসিবেন, তাহা বড়বড় মুনিরা বহিবে।”

 নহুষ বলিলেন, “এ আর কত বড় একটা কথা?”

 তখনই মুনি-ঋষিদিগের বড় বড় কয়েকজনকে পাল্কি কাঁধে করিয়া আসিতে হইল, সেই পাল্কিতে উঠিয়া নহুষ ভাবিলেন যে, এমন আমোদ আর তিনি কখনো ভোগ করেন নাই। সেই সকল মুনির মধ্যে একজন ছিলেন অগস্ত্য। তিনি যে কিরূপ অদ্ভুত লোক, তাহা ত জানই। নহুষ আহ্লাদে অধীর হইয়া সেই অগস্ত্যর মাথায় পা তুলিয়া দিলেন! অমনি আর তিনি যাইবেন কোথায়? তখনই অগস্ত্যের শাপে তাঁহাকে অজগর হইয়া পৃথিবীতে পড়িতে হইল, দেবতাদিগেরও আপদ কাটিয়া গেল।

 তোমরা নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিয়াছ যে, এই অজগরের সঙ্গেই একবার পাণ্ডবদিগের দেখা হইয়াছিল। তখন সে ভীমকে ধরিয়া গিলিবার আয়োজন করে, আর যুধিষ্ঠির আসিয়া তাঁহাকে বাঁচাইয়া দেন। সে ঘটনা উপস্থিত ঘটনার দশ হাজার বৎসর পরে হইয়াছিল।

 এইরূপে নহুষের অত্যাচার দূর হইল। তারপর যে ইন্দ্র স্বর্গে ফিরিয়া আসিলেন, আর দেবতাগণের তাহাতে খুব আনন্দ হইল, এ কথা আর বিশেষ করিয়া বলার কোন প্রয়োজন দেখি না।