উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/মুদ্গল ও দুর্বাসা
মুদগল ও দুর্বাসা
মহর্ষি মুদগলের বৃত্তান্ত অতি চমৎকার।
মহর্ষি মুদগল কুরুক্ষেত্রে বাস করিতেন। তাঁহার মত দরিদ্র এবং ধার্মিক লোক সংসারে আতি অল্পই ছিল। চাষিরা ক্ষেত্রের ধান কাটিয়া নিলে যে দু-একটি ধান ক্ষেত্রে পাড়িয়া থাকিত, মহর্ষি মুদগল পনের দিন ধরিয়া তাহাই খুঁটিয়া খুঁটিয়া কুড়াইতেন। এমনি করিয়া পনের দিনে তাঁহার এক দ্রোণ (প্রায় বত্রিশ সের) ধান হইত। পনের দিন পরে সেই ধান দেবতা আর অতিথিগণের পূজা হইয়া যাহা অবশিষ্ট থাকিত, মুদগল এবং তাহার পরিবার তাহাই আহার করিয়া আনন্দে দিন কাটাইতেন, পনের দিন অন্তর এইরূপে মুগলের আশ্রমে পূজা হইত! আর সেই পুজা তিনি এমন ভক্তিভরে এবং পবিত্রভাবে করিতেন যে, ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাগণ তাহাতে না আসিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাহাদের কৃপায় মহর্ষির এক দ্রোণ ধানেই সমুদয় দেবতাগণ এবং শত শত ব্রাহ্মণের পবিতোষ পূর্বক ভোজন হইত।
মুদগলের আশ্চর্য পূজার কথা শুনিতে পাইয়া, একদিন দুর্বাসা মুনি তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দুর্বাসার স্বভাব যেমন কর্কশ, চেহারা তেমনি কদাকার, তাহার উপর আবার মাথার চুল নাই, পরনে কাপড় নাই, মুখে গালি ভিন্ন আর কোন কথা নাই। চাহনি আর চাল-চলন দেখিলে সাধ্য কি কেহ বলে যে এ ব্যাক্তি পাগল নহে, ভাল মানুষ। দুর্বাসা আসিয়াই বলিলেন, “বড ক্ষুধা হইয়াছে, শীঘ্র খাবার আন!”
মুদগল মধুর বাক্যে সেই পাগলের কুশল জিজ্ঞাসা পূর্বক পাদ্য অর্ঘ্য দ্বারা তাঁহার পুজা করিলেন, এবং সন্তোষের সহিত তাঁহার সকল গালি আর অত্যাচার সহ্য করিয়া, পরম যত্নে তাঁহাকে আহার করাইলেন।
না জানি সর্বনেশে মুনির কেমন সর্বনেশে ক্ষুধা হইয়াছিল! মুদগলের অতি কষ্টে কুড়ান সেই আধ মণ ধানের ভাত দেখিতে দেখিতে তিনি প্রায় শেষ করিয়া ফেলিলেন। তারপর সামান্য যাহা অবশিষ্ট ছিল তাহা গায়ে মাখিয়া, বিড় বিড় করিতে করিতে পাগলের মত চলিয়া গেলেন, মুদগল এবং তাঁহার পরিবারের খাইবার জন্য কিছুই রহিল না।
সেই পরম ধার্মিক তপস্বী ইহাতে কিছুমাত্র বিরক্ত বা দুঃখিত না হইয়া, অনাহারে থাকিয়াই পুনবায় ধান কুড়াইতে লাগিলেন। দুর্বাসাও পনের দিন পরে আবার আসিয়া, তাহার সমস্ত খাইয়া আর গায়ে মাখিয়া শেষ করিতে ভুলিলেন না।
এইরূপ ঘটনা ক্রমাগত ছয়বার হইল। পনের দিনের কঠিন পরিশ্রমে যাহা কিছু সঞ্চয় হয়, দুর্বাসা আসিয়া তাহা খাইয়া যান, যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহা গায়ে মাখেন। সুতরাং এই দীর্ঘকালের মধ্যে মুগল আর তাঁহার পরিবার এক গ্রাস অন্নও মুখে দিতে পারিলেন না। কিন্তু ইহাতেও এমন বোধ হইল না যে, তাঁহার মনে কিছুমাত্র ক্লেশ বা অসন্তোষ হইয়াছে। প্রথম দিনে তিনি যেমন হাসিমুখে এবং মিষ্টভাবে দুর্বাসার সেবা করিয়াছিলেন, শেষদিনে ঠিক সেইরূপই দেখা গেল। তখন দুর্বাসা আর চুপ করিয়া থাকিতে না পারিয়া, মুদগলকে বলিলেন, “মুদগল, তোমার মত মহাশয় লোক আমি আর কোথাও দেখি নাই। তোমার এমন ক্ষুধার সময়েও আমি বার বার আসিয়া তোমার অতি কষ্টে সঞ্চিত অন্ন খাইয়া যাইতেছি, তথাপি তোমার কিছুমাত্র রাগ হইতেছে না, কি আশ্চর্য! আমার পরম ভাগ্য যে এমন মহাপুরুষের সহিত আমার পরিচয় হইল। দেবতারাও তোমার সাধুতায় পরম সন্তুষ্ট হইয়াছে, তুমি শীঘ্রই সশরীরে স্বর্গে যাইবে।”
দুর্বাসার কথা শেষ হইতে না হইতেই দেবদূত হংস-সারসে টানা বিচিত্র রথ সমেত মুদগলের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, “মহর্ষি, আপনার সিদ্ধি লাভ হইয়াছে, এখন এই রথে চড়িয়া স্বর্গে চলুন।”
দেবদূতের কথা শুনিয়া মুদগল বলিলেন, “দেবদূত, স্বর্গবাসের কিরূপ গুণ এবং তাহার দোষই বা কিরূপ, তুমি তাহার বর্ণনা কর! তোমার কথা শুনিয়া আমি যা করিতে হয়। করিব।”
দেবদূত বলিলেন, “স্বর্গ এখান হইতে অনেক উচ্চ। দেবতাগণ নানারূপ রথে চড়িয়া সেখানে বিচরণ করেন। যাহারা তপস্যা করে না, যাহারা ধর্মকে অবহেলা করে, যাহারা মিথ্যা কথা কহে আর যাহার নাস্তিক, সে-সকল লোকক কখনো স্বর্গে যাইতে পাবে না। কেবল ধার্মিকেরাই স্বর্গে গিয়া থাকেন। মেরু নামক তেত্রিশ যোজন বিস্তৃত সোনার পর্বতের উপরে দেবতাদিগের অতি আশ্চর্য এবং সুন্দর উদ্যান সকল আছে, পুণ্যবাণ লোকেরা স্বর্গে গিয়া সেই সকল উদ্যানে বিহার করেন। তথায় ক্ষুধা পিপাসা, ক্লেশ, ভয়, শোক, তাপ, ক্লান্তি প্রভৃতি কোন অসুখই নাই। পরম পবিত্র নির্মল সুশীতল বায়ু সর্বদাই সেখানে ধীরে ধীরে প্রবাহিত থাকে, আর নানারূপ সুমধুর শব্দে প্রাণ মন মোহিত হয়। সেই ধূলা ও দুর্গন্ধ শূন্য পরম সুন্দর পবিত্র স্থানে পুণ্যবানেরা, উজ্জল মূর্তি ধারণ পূর্বক রথে চড়িয়া বিচরণ কবেন। তাঁহাদের মনে কদাচ হিংসা, মোহ প্রভৃতি নিকৃষ্ট ভাব আসে না। তাঁহাদের সুগন্ধি পুষ্পমাল্য কল কখনো মলিন হয় না।”
"স্বর্গ বাসের এইরূপ শুণ। উহার দোষ এই যে, সেখানে গিয়া কেবল সুখই ভোগ করিতে হয়, ধর্ম কর্মের দ্বারা অধিক পুণ্য সঞ্চয় করিবার অবসব থাকে না। সুতরাং পূর্বের পুণ্য শেষ হইলে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিতে হয়।”
মুদগল বলিলেন, “আমি কেবল ভগবানকেই চাহি, স্বগে বা সুখে আমার প্রয়োজন নাই। তোমার রথ লইয়া তুমি ফিরিয়া যাও।” এই বলিয়া দেবদূতকে বিদায় পূর্বক মহর্ষি মুদগল ভগবানের চিন্তায় মন দিলেন, এবং শেষে তাঁহাকে লাভ করিয়া কৃতার্থ হইলেন।